সাহিত্য সমালোচনা সম্পর্কে রোমান লেখক হোরেস (কুইন্টাস হোরেসিয়াস ফ্ল্যাককাস) বলেছেন, ‘‘তিনিই সৎ সমালোচক যিনি ‘সত্য’ ও ‘মিথ্যা’র প্রভেদ বুঝিয়ে দিতে পারেন লেখককে। অহেতুক নিন্দা বা অতিরিক্ত স্তুতি-স্তাবকতা সুষ্ঠু ও শিষ্ট সমালোচনার জন্য গ্রহণীয় নয়। আসলে লেখকের প্রকৃত বন্ধু হবেন তিনি, যিনি মিথ্যার ধূম্রজালে লেখককে আচ্ছন্ন করবেন না, বরং তাকে সত্য সন্ধানে সহায়তা করবেন।”
দুর্ভাগ্য আমাদের! আমরা হালে এমন সাহিত্য সমালোচক খুব একটা দেখছি না। এই সময়ের বেশিরভাগ সমালোচনাই তৈলাক্ত রচনা! এক্ষেত্রে লেখক ও সমালোচক দুদলেরই পথচ্যুতি ঘটেছে। কেমন হওয়া উচিত সাহিত্য সমালোচনা-আমার একটু ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
প্রথমত, সাহিত্যের ও লেখকের মানোন্নয়ন। সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে এটিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমি মনে করি, দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্যের কোনো সীমারেখা নেই। সারবিশ্বের রয়েছে সাহিত্যের পাঠক। চোখ রাখেন অনেকেই বিভিন্ন দেশের সাহিত্যের মান, ধরন ও যাত্রাপথ নিয়ে। কোনো লেখক যখন তার সৃষ্টিকর্ম প্রকাশ করেন সঙ্গত কারণে, তার সঙ্গে আমাদের পুরো সাহিত্যের বিষয়টি জড়িয়ে যায়। সেটি তখন আর লেখকের ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপার থাকে না। সমালোচকমহল সাহিত্যের মানই বিচার করবে, এটিই স্বাভাবিক ও উচিত।
সমালোচকরা বিবেচনায় রাখবেন অন্যান্য ভাষার তুলনায় স্বভাষার সাহিত্যের তুলনামূলক অগ্রগতি বা অধঃগতির দিকেও। সমালোচনা তাই খুবই কঠিন দায়িত্ববোধের ব্যাপার। এখানে সব লেখককে সমান দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং সাহিত্যমানের প্রশ্নে কোনো সমঝোতা ছাড়াই সমালোচনার কাজটি করতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি, আমাদের দেশের সাহিত্য সমালোচনা যারা করেন, তারা শুধু বই ও লেখককেন্দ্রিক আবদ্ধ থাকেন। এ ধরনের সমালোচনাকে ব্যক্তিগত পাঠ পর্যালোচনা বলা যেতে পারে। সাহিত্য সমালোচনায় শুধু প্রশংসা বা শুধু তীব্র নিন্দাপূর্ণ হবে এমন নয়। এখানে লেখকের সৃষ্টিকর্মের প্রশংসা, ত্রুটি, তুলনা এ তিনটি বিষয় অবশ্যই থাকা উচিত।
দ্বিতীয়ত, লেখক ও সমালোচকের সম্পর্ক হতে হবে নির্মোহ। সবার ওপরে লেখকের সাহিত্যকর্মকে বিবেচনায় নিতে হবে। লেখকের সৃষ্টির বিশ্লেষণ হবে, লেখকের নয়। সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই উভয়মহলকেই এটি মেনে নিতে হবে। লেখক ও সমালোচকের সম্পর্ক হবে অন্ধ ভক্তের মতো নয় বরং প্রকৃত বন্ধুর ন্যায়। অন্ধ ভক্ত কখনো প্রকৃত রূপ দেখে না! কিন্তু বন্ধুতার সম্পর্কে নিমজ্জিত হয়ে সমালোচনা করলে তিনি প্রকৃতরূপ তুলে ধরবেন, যদি তিন সত্যিকার বন্ধুই হন। হাতিকে হাতির মতো বর্নণা করবে, আংশিক নয়! একটি লেখা জনসমক্ষে প্রকাশ করার আগে-পরে সম্পাদক বা সমালোচকের শরণাপন্ন হওয়া লেখকদের মৌলিক কাজ। সুতরাং লেখালেখির সাধনার সঙ্গে প্রকৃত সমালোচক বন্ধুও খুঁজে নিতে হবে লেখকদের-নিজের লেখকসত্তার বিকাশ ও সাহিত্যের বিকাশের প্রয়োজনেই।
তৃতীয় বিষয় হলো, বর্তমানে যারা লেখালেখি করছেন, তারা অনেকটা অপ্রস্তুত থাকেন সমালোচনার ব্যাপারে। সমালোচনা যে শুধু প্রশংসা করা নয়, এটি মেনে নেওয়ার মানসিকতা তাদের মধ্যে খুব একটি তৈরি হয়নি। এর একটি কারণ হলো, এই যুগে যারা লেখালেখি করেন, তারা বেশিরভাগই পেশাদার লেখক নন। বিভিন্ন পেশার লোকজন সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করছেন যদিও এটি ভালো দিক। তবু এখানে এ সমস্যাটি থেকে যায়। যেহেতু তারা তাদের কর্মজীবনের পাশাপাশি লেখালেখি করছেন, তাই সঙ্গত কারণে তারা চান একটু প্রশংসা।
সমালোচকেরাও এমনটি ভেবে-সমালোচনার কাজটি পরিমার্জিত করেন এবং এই পরিমার্জন করতে গিয়ে অনেকসময় প্রকৃত সত্য লুকিয়ে ফেলেন। পরিণামে ক্ষতিটি হয়ে যায় সাহিত্যের ও লেখকেরও। এ বিষয়টি এড়াতে লেখককে অবশ্যই লেখকসত্তাকে তার ব্যক্তিগত কর্মজীবন বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। লেখককে শুধুই লেখক ভাবতে হবে সমালোচকের। তবেই সমালোচনার তৈলাক্ত উপকরণ কমে আসবে!
অনেকে মনে করেন নেতিবাচক সমালোচনা লেখকদের অনুৎসাহিত করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমালোচকের নেতিবাচক সমালোচনা প্রকৃত লেখকের বিকাশে বাধা নয়। বরং এটি তাকে সাহিত্য সাধনায় আরও বেশি নিমগ্ন করে। সুতরাং সমালোচনা ইতিবাচক হোক, নেতিবাচক হোক তা ব্যাপার নয়, ব্যাপার হলো সমালোচনাটিতে কতটুকু সত্য তুলে ধরা হয়েছে, কতটুকু নির্মোহভাবে করা হয়েছে এবং সাহিত্যের জয়যাত্রার পথে কতটুকু সঠিক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এসব যদি ঠিকঠাক না হয়, তবে তা সাহিত্য সমালোচনা হবে না। সাহিত্য সমালোচনা সঠিক না হলে, পথ হারায়, হোঁচট খায়-লেখক, সমালোচক ও সাহিত্যও।