বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন শাখা ছড়া। সমৃদ্ধও। প্রাচীন কালে ছড়া লোকসাহিত্যেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মাহবুবুল আলম ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ বইয়ে প্রাচীন ছড়া সম্পর্কে বলেছেন, ‘ছড়াগুলো বিশেষ কোনো ব্যক্তির সৃষ্টি বলে মনে করা যায় না। এর পেছনে সমষ্টি মনের প্রভাব কার্যকর। ভাবের দিক থেকে তেমন কোন পরিণতি ছড়ায় থাকে না, ভাবের অস্পষ্ট আভাস ও দুর্লক্ষ্য ইঙ্গিত তাতে বিদ্যমান। ছড়াগুলোতে রসের প্রাধান্য পায়, ছন্দঝঙ্কারে মন বিমুগ্ধ হয়; বুদ্ধি দিয়ে তাকে বিচার করার প্রয়োজন পড়ে না।’
কবিতার মতো ছড়াও হাজার বছরের সময়ের সাগরে সাঁতার কেটে বর্তমানে এসে পৌঁছেছে। একইসঙ্গে লোকসাহিত্যের ফ্রেমে এখন আর বন্দি নেই। ছড়া আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে, সংগ্রামের সঙ্গে, সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিশে আছে। মাহবুবুল আলম লোকছড়া সম্পর্কে যে কথাটি বলেছেন, ‘ভাবের দিক থেকে তেমন কোন পরিণতি ছড়ায় থাকে না’, তা আধুনিক ছড়া সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামে, ক্ষোভে, দ্রোহে ছড়ার বলিষ্ঠ ভূমিকা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
বর্তমানে ছড়া সাহিত্যের জয়জয়কার। দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক, মাসিক কাগজ, সংকলন, ফেসবুকে প্রচুর নতুন নতুন ছড়া আমরা পাচ্ছি। অনেক ভালো ভালো ছড়া এর মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি।
তবে যত ভালো ছড়া পাচ্ছি, তারচেয়ে দশগুণ ছড়ার নামে দুর্বল লেখা, শব্দের মিলের তালিকা পাচ্ছি। অবশ্যই তা-ই হওয়ার কথা। ভালো কম বলেই চিরকাল তার কদর। তবে শুধু ছড়া নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও একই অবস্থা-প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, উপন্যাসে সব খানেই দুর্গন্ধময় শব্দের ভিড়ে ভালো জিনিস হারিয়ে যেতে বসেছে।
প্রশ্ন হতে পারে, সাহিত্যের সব শাখাতেই যদি এই বেহাল অবস্থা হয়, তাহলে রদ্দি ছড়া নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন কী? উত্তরে বলা যায়, ছড়ার নামে রদ্দিছড়ার ছড়াছড়ির কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে হয়। প্রথম কারণ যেটি বলে মনে হয়, একটি ভালো ছড়া পড়লে মনে হয়, আরে এমন ছড়া তো আমিও লিখতে পারি। তখন নবীনেরা কলম হাতে তুলে নেয়। কিছু প্রচলিত, অপ্রচলিত শব্দের অন্ত্যমিল দিয়ে নিজেই নিজেকে বাহ্বা দিতে থাকে। ভাবে, অমর ছড়াটি তিনি প্রসব করেছেন। এই যে ভালো ছড়া পড়ার পর মনে হয়, এমন তো আমিও লিখতে পারি, এটাই সবচেয়ে ছড়ার জন্য আত্মঘাতী একটি ব্যাপার। অধিকাংশ ব্যক্তিই বুঝতে পারেন না, সহজ কথা সহজে বলা যায় না। ফলে তিনি একের পর এক ছড়ার নামে যা-তা লিখতে থাকেন, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কিছু লাইক কমেন্ট পেয়ে আকাশে ভাসতে থাকেন।
পড়লে মনে হয় সবাই মিলে একটি ছড়াই লিখে চলেছেন জীবন ভর।
দুই-একটি ছড়া দৈনিকে ছাপা হলে তো কথাই নেই। কিছু টাকা জোগাড় করে বইমেলায় বই প্রকাশ করেন। পাঠক যখন বই কেনেন না, তখন তিনি এক মনে বাংলা সাহিত্যে দৈন্যদশা নিয়ে হা-হুতাশ করেন, অন্য মনে নিজেকে ক্লাসিক লেখকদের সমতুল্য ভাবেন, ভাবেন, পৃথিবীর মহৎ সাহিত্যের মতো তার লেখাও সমকালে কদর পাচ্ছে না ঠিকই। তবে ভাবীকালে তার বিজয়মুকুট কেউ আটকে রাখতে পারবে না।
ছড়ার অতিরিক্ত প্রচারমাধ্যমও বাজে ছড়া বা ছড়াকার তৈরির জন্য দায়ী। কাগজ ভরানোর জন্যে সম্পাদকদের কখনো সখনো আপস করতে হয়। আর সেটাকেই ছড়াকারদের রেপ্লিকাদের কাছে ‘মুই কি হনুরে’ বার্তা পৌঁছে দেয়।
সংঘবদ্ধতাও ছড়ার জন্য অনেক সময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বর্তমানে বিভিন্ন ছড়ার অনুষ্ঠানে একটি হাইপোথিসিস শোনা যায়, ‘প্রত্যেক ছড়াকারই কবি কিন্তু সব কবিই ছড়াকার নন।’ এ কথা যখনই কেউ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইকের সামনে বলেন, তখন ছড়াকারদের রেপ্লিকারা উত্তেজনায় টগবগ করতে থাকেন। তারা ভুলেই যান, ছড়া সাহিত্যের স্বতন্ত্র মাধ্যম, কবিতাও স্বতন্ত্র মাধ্যম। ছন্দ থাকলেই যেমন কবিতা হয় না, তেমনি কোনো লেখায় সোজাসোজি একটি বক্তব্য তুলে ধরলেই তা ছড়া হয় না। বরং এ উক্তির মধ্যে তাদের হীনম্মন্যতাই প্রকাশ পায়।
বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে অধিকাংশ ছড়াকারই একই ফরম্যাটে, একই ছাঁচে ছড়া লিখে যাচ্ছেন। স্বরবৃত্ত বা লৌকিক ছন্দকে কচলাতে কচলাতে তেতো করে ফেলা হয়েছে। ছড়ায় এক্সপেরিমেন্ট নেই বললেই চলে। শব্দ কমন, মিল কমন। সবচেয়ে বড় কথা, একটি ছড়ার সঙ্গে অন্য ছড়ার পার্থক্য নেই। পড়লে মনে হয় সবাই মিলে একটি ছড়াই লিখে চলেছেন জীবন ভর। কোনো কোনো অগ্রজ ছড়াকারের ছড়া পড়লে মনে হয়, অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীও এর চেয়ে ভালো ছড়া লিখতে পারে। হয়তো তারা এক সময় ভালো লিখেছেন। কিন্তু এখন লেজেগোবরে অবস্থা!
এসব ছড়া পড়েও নতুন ছড়াকাররা আরও বিপথগামী হয়। ভাবে অমুক, তমুক ছড়াকার এই লিখেছে, আমি তো ঘুমিয়েও এরচেয়ে ভালো ছড়া লিখতে পারি। অতএব চলরে ছড়ার রেলগাড়ি!
ছড়াকে সত্যিকারের অর্থে জাগিয়ে রাখতে হলে তার মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। অবশ্য কিছু ছড়াকার এই কাজটি করে চলছেন। তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তরুণ ছড়াকাররাও সব অর্থেই নতুন ছড়া উপহার দিচ্ছেন আমাদের। আর, যাঁরা এক সময় ভালো লিখতেন কিন্তু এখন ফুরিয়ে গেছেন, তাদের নামের প্রতি সুবিচার করার জন্যেই ছড়া লেখা থেকে অবসর নেওয়া প্রয়োজন।