সেই কোন ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। হাঁটছি তো হাঁটছিই। নিজের তালে হেঁটে যাচ্ছি। কখনো মনে হয়নি আমি হাঁটছি। মনে হচ্ছে সময় পেরিয়ে যাচ্ছি। সেই কবে কে যেন আমাকে পথের ওপর দাঁড় করিয়ে বলেছিল—যাও। আমি তো তার কথা মতোই এগিয়ে চলেছি। আমার মনকে কখনো আমায় বলতে হয়নি—কিছুতেই থেমে যাওয়া নয়। মন ভাবছে কত কিছুই। এগিয়েও চলেছে সমানতালে। আমি তো শুধু তার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছি। যে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়েছিল, সে তো আমাকে পেছন থেকে ঠেলে দিয়েছিল। সেই গতিই তো এখন আমার শরীরে। হাঁটতে হাঁটতে গতি তো বেড়েছেই। আবার পাহাড়ি পথে গতি কমেছে। আসলে গতি তো বাড়ে-কমেনি। ওটা আমাদের চোখের ভুল। আমি যতটুকু মনের থেকে হাঁটতে চেয়েছি, সেটাই আমার গতি।
হাঁটতে হাঁটতে কতবার মনে হয়েছে, আচ্ছা এই যে আমি হাঁটছি, এটা কি হাঁটা? আমি কি হাঁটতে ভালোবাসি বলে হাঁটছি? হাঁটা নিয়ে আমার কি কোনো গর্ব আছে? হাঁটতে হাঁটতে আমি কি চারপাশে তাকিয়েছি? আচ্ছা, চারপাশে তাকাতে তাকাতে ঠিক কতটা হাঁটার ভেতরে হাঁটা যায়? হাঁটতে গিয়ে পথের জিনিসে ডুব দিলে হাঁটার আমিতে কতটা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়?
হাঁটতে গিয়ে হাঁটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। হাঁটার সমর্থনে কত কথা যে বলেছি তার কোনো ঠিক নেই। হাঁটার মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে জীবন। পরে আবার মনে হয়েছে হাঁটাকে ভালোবাসবো কেন? কেনই বা হাঁটাকে বিশেষ সমর্থন? হাঁটবো বলে তো আমি জন্মগ্রহণ করিনি। আমাকে দৌড়াতেও হতে পারতো। আমাকে তো এগিয়ে যেতে হবে। আমার তো শুধু এগিয়ে চলা, সেটা যেভাবেই হোক। আমার লক্ষ্য থাকবে এগিয়ে যাওয়ায়। কিভাবে এগিয়ে গেলাম সেটা বিচার্য বিষয় নয়।
রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে নিজের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দেখা হওয়া মানে তো শুধু চোখের দেখা নয়। দেখা হওয়া মানে তার জল, হাওয়া, মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। হাঁটতে হাঁটতে যে রাস্তা আমাদের স্বপ্নে ঘুরেফিরে আসতো, তার হাওয়াকে আমি চিনতে পারি। হাওয়ার সঙ্গে দেখা হওয়াটাই যেন আমার কাছে অনেক বড় পুরস্কার। মাটিকে কত কাছের করে নিয়ে চিনতে চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। অথচ আজ যখন রাস্তায় হাঁটায় ডোবে, তখন মাটি কত সহজে না আমার কাছে ধরা দিচ্ছে। আসলে মাটিকে ধরার জন্য যে যোগ্যতা লাগে, তার অংশবিশেষও আমার মধ্যে ছিল না। রাস্তায় হাঁটার যোগ্যতাটাই যেন মাটির সঙ্গে মেশার ছাড়পত্র।
হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দেখি, রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। দুটোই তো আমার রাস্তা। দুটো রাস্তা ধরেই আমি একভাবে হেঁটে যেতে পারি। রাস্তা হাঁটতে গিয়ে এটা আমার প্রাপ্তি। আমি শাখায় শাখায় ভাগ হয়ে যাচ্ছি। আরও এগিয়ে আমি আরও অনেক শাখায় বিভক্ত হয়ে যাব। হয়তো একটা রাস্তায় আমার বর্ণনা সম্ভব নয়। এটা যেন আমার একটা প্রসারিত রূপ।
কখনো দাঁড়িয়েছি। আমার প্রাপ্তিকে আমি দেখেছি। দেখেছি আমার ভেঙে যাওয়া। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে একটা সাদা পাতা, যার পুরোটা জুড়ে শুধু আমি। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে আমার ছবি আঁকা। নদীর জলের মতো সেই সব শব্দেরা পার হয়ে গেছে একেকটি আলোক বিন্দু। কী প্রবল তাদের গতি! একটা ভীষণ টান যেন তাদের ছুটিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। রাশি রাশি শব্দবিন্দু গড়িয়ে গেছে পাতার শেষ সীমানায়। সেখানেও তাদের বেঁধে রাখা যায়নি। ছড়িয়ে গেছে আরও একটি সাদা পাতায়। সেখানে তাদের গতি যেন আরও তীব্র। মনে হয় এরা যেন আর থামবে না। আরও অনেক অনেক সাদা পাতায় ওরা লিখে যাবে জীবনের ইতিবৃত্ত।
পাতার শব্দেরা সব উড়ছে। বিভিন্ন রঙে রঙিন তাদের ডানা। ওড়ার ভঙ্গিমায় তারা তাদের স্বাতন্ত্র্য চিনিয়ে দিচ্ছে। তাদের সংখ্যা অগণন। অথচ কেউ কারও পথে বাধা হয়ে নেই। প্রত্যেকেই তার নিজের নিজের জগতে উড়ে বেড়াচ্ছে।
অথচ বাহ্যিকে আমার যা গতি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কখনো হাঁটছি, আবার কখনো হয়তো কোনো গাছের নিচে পড়ে নিচ্ছি আমার শব্দদের আগামী দিনে উড়ে বেড়ানোর যাবতীয় পরিকল্পনা। কখনো হয়তো রোদ্দুরের স্রোতে ভেসে গিয়ে গলা মেলাচ্ছি উজ্জীবনের গানে। অক্টাভিও পাজের একটি কবিতায় আমি তারই সাড়া পাই:
যেখানে রাস্তা দুটো
. আলাদা হয়ে গেছে
লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
. একমনে কী যেন ভাবত
আসলে
‘ ও দুটো রাস্তা ধরেই
. এগোচ্ছিল
আর আমরা ভাবছিলাম
. ও ঠায় দাঁড়িয়ে
কারণ
. দাঁড়িয়েছিলাম
. আমরাই।