খুব আগ বাড়িয়ে, ঢঙ করে কমবেশি অনেককেই বলতে শুনি, আমি তো মরিনি রে! এখনো বেঁচে আছি। স্বীকার করছি স্বীকৃত আর উচিত সত্য বটে কথাটি। টগবগে উল্লাসে কেশর হাঁকিয়ে জোরগলায় বলতে পারা আমি বেঁচে আছি। এই বাক্য নানান বিভঙ্গে যখন যেখনেই উচ্চারিত হতে চায়, অলিখিত ধাক্কার এক ধূলির ঢেউ এসে আমাকে সবার থেকে ছিন্ন করে—দৃশ্য থেকে অন্তত মুহূর্তের জন্য হলেও ফেডআউট করে দিয়ে যায়। মগজে আমার মাত্রারিক্ত অক্সিজেন কমে যায়। চারিদিকে কেমন ঝাপসা আর দুমদুমি শব্দের অস্পষ্ট কাঁপুনি শুনতে পাই।
সহজ আর সলতে পোড়ার মতো অলস কিছু বাক্য আছে আমাদের রীতিতে, প্রথাতে, ভাবনায়। তারমধ্যে অতি অন্যতম; জীবনকে আমি বড় ভালোবাসি। অথচ যে বলছি, যাকে শোনাচ্ছি একবারও ভাবি না কেউই জীবন আসলে কী?
কাজেই বিলাপ করার মতো ক্লান্তা করোটি দিয়ে এ সব শীতল, বোকচোদ ফ্রেজের সমন্বয়ে তৈরি অতি সহনীয় বাক্যই কেবল বলতে শিখেছি আমরা। স্রোতের সঙ্গে যেতে যেতে কাজেই বলতে হয় বেঁচে আছি। বেঁচে থাকি। ফলে, হে জীবন তোমাকে ভালোবাসা অতীব আনন্দের, সুখের, মধুর ঘটনাময়। ফের দিনান্তে স্রোত ঠেলে যখন উজানে উঠতে চাই—তথা কষ্টের কর্মে এসে দুঃখ তথা বেদনা, তথা জরা, তথা মৃত্যুর মলিন সংবাদ, তাকেও হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে হয়। এ এক জটিল সূত্র। আশ্চর্য করিৎকর্মাময়। অর্থাৎ তুমি যদি জন্ম নেবে আমরা হাসব, উল্লাসে চিৎকারে তোমার সমস্ত কল্যাণে কুশলেরে আহব্বানিবো। যা কিনা ভিন্নার্থে তোমার মৃত্যুকে সুস্বাগতমের দ্বারা বাধিত করে। সেই দিনক্ষণের অপেক্ষায়। হয়তো সেদিন কাঁদব, কল্পনায় কেঁপে কেঁপে অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাব।
মূলত জন্ম-মৃত্যু নিয়ে আমজনতার এ রকমই কল্পলতা চিরকাল দোলা দিয়ে যায়। জীবিতের কাছে কাজেই মৃত্যুর মুহূর্ত আগ পর্যন্তই জীবন। মৃত্যু অতি পরিচিত। চেনা আর চরিত্র বাহিত।
কিন্তু আত্মহত্যা! যতই রগচটা, কবি আর কবিত্ব ফলাও—এর সংবাদ, এর রূপ, গন্ধ, এর স্পর্শে জীবিত তোমার মুহূর্ত কেঁপে যায়। থমকে যায়। জগতের তাবৎ বিস্ময় আর প্রশ্নবোধকের দল হুটহাট ছুটে এসে তোমার পায়েতে লুটায়। তাদের হাজারও প্রশ্নে, কটাক্ষে ধাপ করে মানুষ হতে ফানুষে রূপান্তরিত করে দিয়ে যায়। এ এক দুরূহ জটিল প্রশ্ন। যা আজও উত্তরবিহীন। ব্যাখ্যার অপেক্ষাতে মূখর হয়ে আছে। সে উত্তর চায়। বিস্তারিত বর্ণনা চায়। প্রকৃত কারণ জানতে চায়।
কালে কালে, যুগে, শতাব্দীতে মানুষই—মন দিয়ে গড়া, মায়া দিয়ে মোড়া, সে কেন এমন কাণ্ডে নিজেকে জড়ায়। উত্তরে কেবলই অন্ধকার। কেবলই হাতড়ে হাতড়ে ফেরা। পরিচিত জীবন থেকে ছিটকে, প্রথার বাইরে, রীতিকে লঙ্ঘন করে, মন আর মানুষকে অস্বীকার করে অনেকের ন্যায় আমি নিজেও এমন দৃশ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি বলতে গেলে খুব কমই।
আমাদের বিচিত্র আড্ডাখানায় আজও আমি প্রাপ্য তোমার সন্দেশের একাংশ রেখে যাই। চায়ের অর্ডারে মাথার গুনতিতে হঠাৎ কাউকে শামীম বলে ভ্রম হয়। আমি জ্বালায় মরি। আমি চোখ বন্ধ করি। স্পষ্ট শুনতে পাই শিবলী ভাই, লাল চা খাবো না আজ, দুধ চা চাই।
সেদিন সোমবার। যথারীতি ১৯৯৫ সাল। হালকা শীতের ২ অক্টোবর। এমনই বাংলাদেশে। সহজ শর্তে সূর্য উঠলে দিন, চাঁদ ঢাললে রাত। সেদিনও দুপুর ছিল, গোধূলি ছিল। শহর ছিল—বগুড়া যার নাম। আলোতে আড্ডা ছিল। রাত্রিতে আসারও কথা ছিল। এতসব ছিল। সবই সঠিক আর সতত বলা যায়। অথচ কেমন একটি ঘটনাতে, একটি পতনে। ঘটনার বিপরীতার্থক যদি বলি দুর্ঘটনাতে বলতে গেলে সবকিছু থমকে গিয়েছিল।
আমার বন্ধু, আমার কবি, হৃদয়ে যার উভয়ের আনাগোনা। মন যার উভয়ের ভাড়ায় চালিত। সেই প্রিয় মানুষটিও বটে। আহা! আকার আর আয়তনে স্রেফ নাই হয়ে গিয়েছিল। যদিও এ-শব্দে ঘোরতর আপত্তি আমার। কেমন ইন্ডিকেট করার মতো। কেমন জেলভাঙা ঘুঘুর মতো। নিষ্কামী কামুকের মতো। আচমকা চোর বলে গালি দেওয়ার মতো। সেই গুপ্ত আর সন্দেহপ্রবণ শব্দরাশি আত্মহত্যায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল। স্যরি, বাংলাতে দুঃখিত আমি। প্রচল ভাঙতে পারিনি আজও। কাজেই সেই শব্দই—বিদঘুটে, বেঢপ আত্মহত্যা শব্দটি ঘুরেফিরেই লিখতে হচ্ছে আমাকে। আমারে ক্ষমা করো।
আমরা ভাঙতে চেয়েছিলাম। যতসব ট্র্যাস, বাতিল পেনিয়াম, জোড়াতালি দেওয়া টায়ারকে বদলে উন্নত, চকচকে শকটের গর্বিত মালিক হতে চেয়েছিলাম। অথচ মাঝপথে না বলে এমন প্রস্থান, হুট করে চলে যাওয়া। আমি আহত হয়েছিলাম। সেদিন প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল আমার। ফলে, এই বোকামির মানেটা কী? এমন বাক্য খুব মনে পড়ে, ঘটনাস্থলের অন্য বন্ধুর উদ্দেশে ব্যক্ত করেছিলাম আমি।
হলো তো বহুদিন। তুমি আছ সেই ২৪-এ আটকে। আমার তো বন্ধু ৪৭ গড়িয়েছে। বয়স হচ্ছে। সীমাবদ্ধ হচ্ছে মন। ফের আমি স্যরি।
বহু সময় গড়িয়েছে। তবু সমাজ বলছে অশুভ, অন্যায়। বলছে পাপ, ধর্ম দিচ্ছে বিচার। আইন দিচ্ছে বিদ্যুৎ ঝলকানি। আজও হায় রে পোড়াদেশ! কী করে বান্ধব জোটাব আমি। এত এত কুৎসিত কলহের ভিড়ে—কে চেনে আমারে, কে চেনে তোমারে? বন্ধু শামীম কবীর। শারীরিকভাবে তুমি নেই। আনেকগুলো দিন, সন্ধ্যা-মাস। বর্ষা-শীত, ভ্রমণে পাশে নেই। অথচ এই তো সেদিন সামান্য নামের বানান নিয়ে যে অন্যায় রচিত হচ্ছে, তারে আমি গলাটিপে ধরতে গেছি। এ কিসের কুমন্ত্রণায়, বলো তো শামীম!
শুনুন, শামীম ছিল সহচর। সহযোদ্ধা, সহকবিত্বের অংশীদার। আমরা আসলে ছিলাম আমরাই। হায় রে হায়! ছিল বলছি কোন দাবিতে? এখন কি নেই। তুমি কি আমার আজও ভালো বন্ধু নও? ভুল নয়, ভাঁওতা নয়। আজও আমি তোমার লাজুক চাহনির চরিত্রকে সর্বদাই ডানে কিংবা বামে বহন করে যাই। রহমান নগরের তোমার চিরচেনা উজান পথে। সেইপথ এঁকেবেঁকে মিলেছে সাতমাথাতে। আমাদের বিচিত্র আড্ডাখানায় আজও আমি প্রাপ্য তোমার সন্দেশের একাংশ রেখে যাই। চায়ের অর্ডারে মাথার গুনতিতে হঠাৎ কাউকে শামীম বলে ভ্রম হয়। আমি জ্বালায় মরি। আমি চোখ বন্ধ করি। স্পষ্ট শুনতে পাই শিবলী ভাই, লাল চা খাবো না আজ, দুধ চা চাই।
আহারে স্মৃতি! বেদনার ভুক্তভুগি। সেইসব দিনে অলিখিত অস্থানে কবিতার আড্ডাতে ঝড়ের পরে ঝড় বয়ে গেছে। দিন শেষে রাত্রি নেমেছে। শামীমসহ কতিপয় আমরা রয়েছি পথে, প্রান্তরে। মেঠোরাস্তার গ্রামে। শুধুই চাঁদ দেখবো বলে শীতের মধ্যগগনে হু হু হাড়কাঁপানো রাতে চলে গেছি অচেনা অজোগ্রাম্য লোকালয়ে। অথবা অন্ধকারে, জোনাকীর আস্ফালন প্রত্যক্ষ করার ছলে চলে গেছি অশুদ্ধ, অর্বাচিন কোন ক্ষেত মজুরের স্নিগ্ধ বাঁশঝাড়ে। হায় রে জোনাক পোকা! হায় রে চাঁদনী রাত। সব আছে, স্নেহের শামীমকে পাই না পাশে।
শুদ্ধ, অশুদ্ধ কী করিনি আমরা? অথচ আশ্চর্যের ও কি আপনে করে বলতো আমাকে! আজ খুব মনোযোগ দিয়ে ভাবছি। স্মৃতিতে জাগছে না ছাই। দূর ঘোড়া বাদ যাক। আপনি, তুমি ছাই।
আবারও শুনুন কবিতা লিখতো শামীম। লিখছে আজও শামীম। হয়তো আমারই মাথায় ভর করে। কেমন পদ্য, কেমন গদ্য? এর উত্তর আমি বলতে নারাজ। শামীমের কবিত্বকে ফেড়ে ফেড়ে ব্যাখ্যা করতে আমি নৈব নৈব চ। তাঁর মৃত্যুর পর, আমি মৃত্যুই বলবো। আমাদেরই আর এক অগ্রজ বন্ধু কামরুল হুদা পথিক সম্পাদনা করেছেন—শামীম কবীর সমগ্র। আর এরও বহুদিন পর ওর তথা—আমারও বন্ধুজন নভেরা হোসেন, [প্রীতি বশে আমি নভেরাই বলছি] ও পিয়াস মজিদ যৌথভাবে মারাত্মক এক কাজ করেছেন শামীম কবীরের নির্বাচিত কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। তাহলে ঘটনা দাঁড়াচ্ছে এ-দুটি গ্রন্থের সমন্বয়ে লেখক শামীম, কবি, শিল্পী শামীমকে প্রায় অর্থে পূর্ণাঙ্গই পেয়ে যাব আমরা। তাহলে সংগ্রহ করুন। পড়ুন আর কাব্য বিচারে মাঠে নেমে পড়ুন।
যেকোনো কবির কবিতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আজকাল জর্জরিত, মর্মাহত, লজ্জিত, অপরাধীর মতো মনে হয় নিজেকে। আরে আমি কী কাব্যবিশরদ, বিচারক নাকি। রাতবিরাতে দারোগার ন্যায় অন্যের চোরাকুঠুরিতে হানা দিতে যাব। যৌন-যাতনায় জ্বলতে থাকা কমদামি কনস্টবলের ন্যায় সারাঘর ওলোট-পালোট করে শেষ রাতে আজানের ওয়াক্তে টলতে টলতে কোন প্রমান না পাওয়া সত্তেও ভোতাচাকু আর মরচে পড়া হাতুরীকে অস্ত্রে আখ্যায়িত করে বলব—মারাত্মক গোলাবারুদ আর বিদেশি বিপদী অস্ত্রের আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ বিরাট দাগী। আসুন আমরা বছরব্যাপী রিমান্ডে নেই তাকে।
আসলে সহজাত, প্রাকৃতিক, হত্যা, আত্মহত্যা—মৃত্যুকে যে নামেই ডাকি না কেন, সকল মৃত্যুই শ্রদ্ধেয়। কিন্তু কিছু মৃত্যু মহান, যদি হয় বীরের মৃত্যু। বলি রাত বাড়ছে অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বেলে, আহ! একটু আস্তে চল না ধীর। এপারে সব চোরকাঁটাতে ভরা। আসছে শামীম, সবুজ শামীম, বন্ধু শামীম কবীর। দুলছে দূরে শিউলি শাখা, সঙ্গে নিয়ে ব্যূহ চক্র তীর!
আসলে ঘুরেফিরে কথা ওই একটাই। প্রকৃত শামীমকে জানলেই জানা হবে শামীমকে। তার অন্দর-বাহির। যদিও সবকিছু প্রকাশ্যে বলতেও আমার এ মন করে মানা। এমনও তো থাকতে পারে যা শুধু শামীম আর আমার। মধ্য আশি আর প্রথমী নব্বই এত দীর্ঘ পথ। শামীম কখনো ঢাকা কখনো বগুড়া করেছে। পড়েছে, ছেড়েছে। যেখানেই দ্বিধা আর দ্বন্দ্ব সেখানেই বাক আর বিতণ্ডা। যুক্তির যৌথপথ কোনোদিন মিলেছে, কখনোবা বেঁকে গেছে দুদিকে। পরদিন ল্যান্ডফোনে আলাপের পর আলাপ। প্রশ্ন আর উত্তরে চলেছে কাটাকাটি। এমনই ছাত্র ছিল, এমনই শিক্ষক ছিল শামীম।
অবস্থানগত—মানে বলতে চাইছি, বসবাসের মূল কেন্দ্র ছিল শহর বগুড়াতে। এপাড়া-ওপাড়া। তবু ঢাকাতেও এই জুটি যুক্ত হয়েছি অজান্তেই। অনেকবার। ঢাকা আমার চিরকালই অপছন্দের। তবু এই ঢকাতেও কত রাত বুয়েটে, কত রাত আজিজের বারান্দাতে, সিঁড়িতে কাটিয়েছি। উদার গলা ছিল ওর। আর কেমন মিষ্টি। টুকটাক আমিও গলা ছাড়তাম ওইসব দিনে, রাতে অযথায় কাঁটাবনে ঘুরে ঘুরে চলে গেছি হাতিরপুলের দিকে। আর অনেকবার হাজারীবাগের দিকে—বিচিত্র চোরাগলিতে হাতে হাত রেখে ঘুরেছি দুজন। কখনো অন্য বন্ধুজনা তাদেরও সাঙ্গ করে। মনে পড়ে একদিন বলেওছিলাম—আচ্ছা শামীম, এভাবে দেখলে সমকামী ভাববে না তো লোকে! আর কী অট্টহাসি। ওই হাসি, ওই চাহনি, ওই যুক্তিতর্কের খেলা, ওইসব ম্যাডনেস, ওইসব হঠাৎ ভ্রমণ কোনোদিন আর পাব কি ফিরে? কবিতার অন্তর্বাস কীকরে খুলতে হয়। কী করে ভাষার মধ্যে ভাবনার নতুন চকচকে চাকুকে গেঁথে দিতে হয়। এ সব দয়াল কার কাছে ব্যক্ত করি।
মনস্তাত্ত্বিক, দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক—এরা হয়তো ব্যাখ্যা দিতে পারবে। কিছুটা পারবে ফ্রয়েড। কিছুটা এলিম ডার্কহাইম। গতবাঁধা তাদের ব্যাখ্যাতে সেই একই প্যাঁচাল। আর সে সূত্রে হয়তো কামনা-বাসনার সুপ্ত ইচ্ছাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল শামীম। এ থেকেই জন্মাতে পারে ক্ষোভ, সংশয়, চরম হতাশা। অন্য গুরু বলবে এসব কিছুই না। অন্য অনেক মৃত্যুর ন্যায় এটাও অতি সরল আর সামাজিক। সম্মানীয় বটে। হায় রে বিশ্লেষণ! হায় রে তালাশ! আমি গবেষক নই। এসবে থোরাই কেয়ার করি আমি। আমার চোখে কবিতা আর শামীম একে একাকার। যেহেতু কবিতা টিকে আছে। আমি আছি কবিতার মাঝে। কাজেই প্রতিটি মুহূর্তেই তাকে খুঁজে পাই আমি। কষ্ট এটুকুই সময় আর সামাজিকতায় যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার নিকটে তাকে গঠন দিয়ে ফুটে তুলতে সামান্য সময় লেগে যায়। তফাৎ এটুকু আর কি!
নব্বই—কবিতায় জ্বালিয়েছে কৃষ্ণচূড়ার আগুন। কি ভাষায়, কি চিত্রকল্পে, কি অলঙ্কারে, কি ছন্দে, কি বোধে—চরম সব ইউটার্ন নিয়েছে। পেছনের দশককে সামান্যতম সিগন্যাল না দিয়ে। তাতে বিশুদ্ধ কবিতার বনভূমি নিয়ে ঝড় উঠেছে। নিন্দার ঢেউ বয়ে গেছে। নাদানে বলে, বন থাকবে স্নিগ্ধ আর সবুজে ভরপুর। বন দেখবে প্যারালাল, সমতলে হেঁটে হেঁটে। অথচ নব্বই তা দেখতে চেয়েছে পাশ থেকে, বনের গহীন ভেতর থেকে, মাঝারি উচ্চতা থেকে। সর্বোপরি ওপর থেকে। চিলের চোখ দিয়ে। অজস্র কোণ থেকে, জুমইন আর জুমআউট এর ব্যাখ্যা থেকে। নানান আলোকরশ্মিতে বাঁধতে চেয়েছে তাকে। আর এমনই নব্বই এর অনেক তুর্কি তরুণের একজন শামীম হতে পেরেছে। বা হবার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা বলছি এ কারণে, সময় তাকে সময় দিল না যে। সমাজ তাকে সাহায্য করল না যে। রাষ্ট্র তাকে রহিত করল যে।
সে-কালে প্রযুক্তির এত আস্ফালন আসেনি তখনো। তাছাড়া ঘটা করে ঘটনাকে ঘরবন্দি করতে চাইনি আমরা। মনেও আসেনি কোনোদিন। কাজেই বয়সের ভারে অনেক স্মৃতিই সাদা আর ফকফকা হয়ে গেছে আজ। তবু কিছু কিছু মুহূর্তের ছবি, গান, সুর, সময় অজান্তেই খুঁজে পাই। এরকমই দুচারটে ছবি, কবিতা, ওর লেখা, নোট, চিঠি আজও রয়ে গেছে আমার কাছে। বর্ণনাতীত বর্ষায়, হেমন্তের হিসাবী রৌদ্রে, সহনীয় শীতে, চৈত্রের চঞ্চলতায়—এ মন যখনই অস্থির, আবেগ আর অহঙ্কারে আঁকুপাকু করে, আমি মেলে ধরি গোপনে সে ছবি। প্রাণ ভরে দেখি। হাসতে হাসতে পুলকে যৌবন ফিরে আনি। গোপন কখনো কখনো ফাঁস হয়ে যায়। জেগে উঠে মাঝরাত্রিতে এমন দৃশ্যে আমাকে মুগ্ধ হতে দেখে, অগভীর সন্দেহে চেয়ে থাকে বউ। সন্দেহের তীর ছুড়ে মারে। তাকে আস্বস্ত করতে গল্পের ঝাঁপি খুলে নতুন কাহিনির বয়ান শুরু করি। সে হাই তোলে, এক সময় ঘুমিয়েও পড়ে। আমি শামীমের হাজারও আখ্যান অলিখিত পাত্রে ভরে ভরে ভরপুর করে তুলি।
মানুষ মানুষের জন্য—এ বাক্যে আজকাল ভাঁওতা আর ভসকা গন্ধ খুঁজে পাই আমি। কী করেছি আমরা, শামীমকে নিয়ে? এ কাতারে আমি নিজেও সমান অপরাধী। ভাব দেখাই সর্বহারা, আসলে পুঁজিবাদী। শহর ছেড়ে সামান্য কিলোর ব্যবধানে শামীমের প্রকৃত গ্রামের বাড়ি। একান্তই পারিবারিক চেষ্টায় সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—শামীম কবীর স্মৃতি পাঠাগার। বহুদিন পর গতমাসে গিয়ে দেখি, পাঠাগার ডাইভার্ট হয়েছে মাদ্রাসাতে। এ কিসের আলামত! আমি বুঝিনি। বোঝার ব্যাখ্যাও চাইনি। মৃত্যুর অপর নাম বেঁচে যাওয়া। বেঁচে গেছে শামীম।
এ লেখা লিখতে গিয়ে আমি ইচ্ছে করলেই শামীমের অনেক কবিতাকে কোড করতে, ব্যাখ্যায় উত্তর লাগাতে পারতাম। আমি ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলাম। আজ নয়, সে হবেক্ষণ, অন্য আর একদিন। আজ শুধু কবিত্বের, কী করে কোথা হতে ওহির আছর লাগে আজ শুধু সেইসব ভাববার দিন।
আসলে সহজাত, প্রাকৃতিক, হত্যা, আত্মহত্যা—মৃত্যুকে যে নামেই ডাকি না কেন, সকল মৃত্যুই শ্রদ্ধেয়। কিন্তু কিছু মৃত্যু মহান, যদি হয় বীরের মৃত্যু। বলি রাত বাড়ছে অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বেলে, আহ! একটু আস্তে চল না ধীর। এপারে সব চোরকাঁটাতে ভরা। আসছে শামীম, সবুজ শামীম, বন্ধু শামীম কবীর। দুলছে দূরে শিউলি শাখা, সঙ্গে নিয়ে ব্যূহ চক্র তীর!