ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র বিষয়ে বিপুল গবেষণা, মধুসূদন, নজরুল, তিরিশের কবিতা—বিশেষত বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন, কবিতার আধুনিকতা, স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রবন্ধ, চিকিৎসাবিষয়ক পরিভাষা কোষ, অনুবাদ ইত্যাদি বহুমাত্রিক রচনার এক নিরলস শিল্পকর্মী আহমদ রফিক।
তার কবিতাসমগ্র নিয়ে কবি-প্রাবন্ধিক মুনীর সিরাজ লিখেছেন একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ। ‘আহমদ রফিক: জীবন বাস্তবতার নান্দনিক কবি’ শিরোনামের ওই গ্রন্থে মুনীর সিরাজ লিখেছেন, ‘জীবন বাস্তবতার নিরিখে নান্দনিক কাব্যচর্চাই তাঁর কাব্য রচনার মূল বিষয়। প্রগতি চেতনার ধারাবাহিতাকে তিনি চল্লিশ-পরবর্তী কালে বহন করেছেন এবং তা পৌঁছে দিয়েছেন জীবনবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত পরবর্তী উত্তরাধীকারীদের হৃদয় পর্যন্ত।’
তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ—শিল্প সংস্কৃতি জীবন (১৯৫৮, ২০০৭), আরেক কালান্তরে (১৯৭৭,২০০০), বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি (১৯৮৬), ছোটগল্প: পদ্মাপর্বের রবীন্দ্রগল্প (১৯৮৭), একুশের ইতিহাস আমার ইতিহাস (১৯৮৮), আদি মানবের সন্ধানে (১৯৮৮), ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য (১৯৯১), ভাষা- আনেআদালনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা (১৯৯৩), বাঙলা বাঙালি আধুনিকতা ও নজরুল (১৯৯৫), রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প (১৯৯৬), এই অস্থির সময় (১৯৯৬), জাতিসত্তার আত্ম অন্বেষা (১৯৯৭), রবীন্দ্র ভুবনে পতিসর (১৯৯৮), জীবনানন্দ: সময, সমাজ ও প্রেম (১৯৯৯), বাংলাদেশ: জাতীয়তা ও জাতি রাষ্ট্রের সমস্যা (২০০১), ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস ও উত্তর প্রভাব (২০০২), রবীন্দ্র সাহিত্যেও নায়িকারা: দ্রোহে ও সমর্পণে (২০০৩), বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চার একটি অধ্যায় (২০০৬), চিত্রে ভাস্কর্যে রূপসী মানবী (২০০৭), বিষ্ণু দে: কবি ও কবিতা (২০১০), শ্রেষ্ট প্রবন্ধ (২০১১), নানা আলোয় রবীন্দ্রনাথ (২০১১), দেশ বিভাগ: ফিরে দেখা (২০১৪), ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো (২০১৩), বাংলাদেশের কবিতা: দশক ভাঙা বিচার (২০১৪), নির্বাসিত নায়ক (১৯৬৬), বাউল মাটিতে মন (১৯৭০), রক্তের নিসর্গে স্বদেষ (১৯৭৯), ইচ্ছামতির ঘরে (২০১০), অনেক রঙের আকাশ ( ১৯৬৪), সবপাখি ঘরে ফিরে (২০০৭)। এর বাইরে রয়েছে তার বিপুলায়তনিক রচনা।
সাহিত্যে গবেষণার জন্য তিনি ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এছাড়া পেয়েছেন অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২), অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক (১৯৯৫), রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য (কলকাতা, ১৯৯৭), ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি পদক, রবীন্দ্র পুরস্কার ১৯৯৮)।
গত বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার ‘ভাষা আন্দোলন: সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে’ শীর্ষক গ্রন্থ। যাকে ভাষা আন্দোলনের প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে গণ্য করা যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনই বোধহয় এমনতর এক আন্দোলন, যার প্রভাব ছিল বহুমাত্রিক। এর শুরুটা হয়েছিল বেদনাহত হৃদয় থেকে শেষ হয়েছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের নিজস্ব ভূমির স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে। আর কোনো আন্দোলনের এত দীর্ঘ প্রসারী প্রভাব আছে বলে আমাদের জানা নেই। যদিও শুরুতে এর সুদীর্ঘ প্রভাব তথা স্বাধীনতার সূচনা-আন্দোলন হিসেবে এর কুশীলবগণ অতটা দূরদর্শী ছিলেন না কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রয়োজন হিসেবে এর গুরুত্ব সবাই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। এর পেছনে ছিল বাঙালির জাতীয় জীবনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ইচ্ছা। এখানেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, বিশেষ করে একুশের আন্দোলনের ব্যাপক গুরুত্ব, ততোধিক মহিমা। ফলে এর প্রভাব ও বিস্তার ছিল শহর থেকে মফস্বলে, মফস্বল থেকে গ্রামে গঞ্জে।
এরকম একটি প্রভাব বিস্তারি আন্দোলনের একটি প্রামান্য দলিল থাকা জরুরি। রাজনৈতিক বিভাজনের এই দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যখন ইতিহাস পরিবর্তন হয়ে যায়, তখন নিষ্ঠাবান ইতিহাসবেত্তাগণ একটি নির্ভেজাল, নিরপেক্ষ ও প্রামাণ্য ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ঠিক এই জায়গা থেকে চিন্তা করে আহমদ রফিক লিখলেন, ‘ভাষা আন্দোলন: সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে’ নামীয় গ্রন্থখানি। গ্রন্থটির গুরুত্ব ইতিহাসের জায়গা থেকে যেমন, তেমনি দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেও। কারণ আহমদ রফিকও ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রগামী সৈনিক। ফলে ইতিহাসের বাহিরে থেকে তাকে ইতিহাস লিখতে হয়নি। ইতিহাসের অংশ হয়েই তিনি লিখেছেন সে ইতিহাস। ফলে স্বাভাবতই তা হয়ে উঠেছে অধিকতর বিশ্বস্ত, অধিকতর সত্যনিষ্ঠ, অধিকতর প্রামাণ্য।
লেখক ভাষা সৈনিক আহমদ রফিক এই মহৎ কার্য সম্পাদন করতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভিন্ন ভিন্ন নামীয় চৌদ্দটি গদ্যের। গদ্যগুলো এমন ধারাবাহিকভাবে সাজানো যে পাঠক সহজেই লেখকের অভীপ্সা সম্বন্ধে জেনে যায়। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ উনিশ শত বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে হলেও এর একটা পূর্বাপর ইতিহাস রয়েছে। লেখক সে-ইতিহাস বলতে ভুল করেননি। কারণ যেকোনো আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ প্রকাশের পূর্ব প্রেক্ষাপট থাকে। থাকে পরবর্তী পরিণতি। লেখক দুটিই দেখিয়েছেন তার গ্রন্থে।
যেমন প্রথম গদ্য ভাষা, মাতৃভাষা নিয়ে কিছু কথা’য় তিনি জানাচ্ছেন ভাষা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীই যে প্রথম ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, তা নয়। মধ্যযুগের বাঙালি কবি আবদুল হাকিমের কবিতার উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, এ ষড়যন্ত্রের পূর্ব ইতিহাসও। পশ্চিম পাকিস্তান যেমন তাদের শাসন ও শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য উর্দু ভাষা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, তেমনি মধ্যযুগ থেকেই বিভিন্ন কারণে বাঙলা ভাষার ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত ছিল। এগুলোর পেছনে কারণ ছিল স্থানীয় ধর্মপ্রচারকদের বাকতর্ক। ছিল শাসকশ্রেণীর কূট ও চতুর শিক্ষানীতি। ছিল ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্য আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, তথাকথিক শিক্ষিত শ্রেণীর কায়েমি স্বার্থের প্রভাব। রাজনৈতিক স্বার্থে যখন বাঙালি সমাজ ধর্মীয় ধারায় ও সম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্রে বিভাজিত হযে পড়ে, তখনো এর প্রভাব পড়ে বাঙলা ভাষার ওপর।
দ্বিতীয় গদ্য ‘মাতৃভাষা নিয়ে বিতর্ক’। তৃতীয় গদ্য, ‘পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক: উর্দু বনাম বাংলা’। মূলত এই গদ্য থেকেই লেখক মূল ইতিহাস বলতে চেয়েছেন। বিতর্কের কুশীলবদের অভীপ্সার পরই স্পষ্ট হযে ওঠে মূল করণীয়। তা তিনি জানান ‘আটচল্লিশে প্রথম সংগঠিত ভাষা আন্দোলন’ নামীয় গদ্যে। তারপর জানান ভাষা নিয়ে আরেক ষড়যন্ত্রের কথা। ভাষা নিয়ে, হরফ নিযে শাসকদের ষড়যন্ত্র। তারপর আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপের ইতিহাস জানান তিনি। ‘একুশের সূচনা একুশের প্রস্ততি এবং একুশে ফেব্রুয়ারি: আন্দোলন থামাতে গুলি’ নামীয় গদ্য দুটিতে তিনি একুশের আন্দোলনের আসল কুশীলবদের অবদান তুলে ধরেন। তারপর আরও স্পষ্ট করে ফেব্রুয়ারির দিনগুলোর কথা বলেন। তারপর বলেন শহীদ মিনারের ইতিহাস। একুশের পর একুশে পালনের ইতিহাস বলতেও তিনি ভোলেন না। শেষ দুটি গদ্য ‘একুশের চেতনা ও আমাদের করণীয়’ এবং ‘ভাষা আন্দোলনের উত্তরপ্রভাব’।
বলতে দ্বিধা নেই, ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি যে আক্ষেপ করেননি, তা নয়। শেষ দুটি গদ্যের শিরোনামের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। কেন এ আক্ষেপ? তিনি ভূমিকায় জানাচ্ছেন, ‘তাই আজ সবার বিশেষত তরুণদের জানা দরকার একুশের লক্ষ্য, এর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা। যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম এ বিষয়ে তাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক দায় পালনে, একুশের পূর্ণাঙ্গ অর্জনে এগিয়ে আসতে পারে। স্বাধীন দেশে মাতৃভাষা যে রাষ্ট্রভাষা হয়েও জাতীয় ভাষা হয়ে ওঠেনি এ সত্য তাদের জানা ও বোঝা দরকার।’
ইতিহাসের প্রকৃত কুশীলব যখন ইতিহাস বলেন, তখন তা অধিকতর প্রকৃত হয়ে ওঠে। আহমদ রফিক সেই কুশীলব, যার হাত দিয়ে উঠে এসেছে সেই প্রকৃত ইতিহাস যা সরকার বদলের সঙ্গে বদল হওয়ার নয়।
বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করেন ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সালে কুমিল্লার শাহবাজপুরে। জন্মদিনে তাকে শুভেচ্ছা জানাই। এই মহান শিল্প-সাধকের জন্ম দিনে প্রণতি জানাই।