উদাত্ত হাওয়ার মতো আমরা ভেসে চলেছি। কোথাও আমাদের থামা নেই। শুধুই এগিয়ে চলা। আমরা তো রোজ কোথাও না কোথাও যাই। সবসময় যে সেসব যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি থাকে তাও নয়। একেবারেই যে থাকে না, তা কিন্তু নয়। আবার সেসব কিছু প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নয়। এমনিই যেন মনকে বলা আমি কোথাও একটা যাচ্ছি। নিজেকে বলেও সে যাত্রা সম্পূর্ণ নাও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে মনে মনে আমি যখন কোথাও যাচ্ছি না, নিজেকে শুধু কোথাও টেনে নিয়ে যাচ্ছি তখনই হয়তো সেই যাত্রাটা ঘটে গেল।
কত কিছুকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমাদের এগিয়ে চলা। আমরা কি জানি আমাদের যাত্রাপথে কোন কোন মানুষেরা এসে দাঁড়াবে? আমাদের যাত্রাপথের আবহাওয়ার রূপবদল ঠিক কী রকমভাবে বদলে বদলে যাবে? ঠিক কোন কোন ঘাট বা দুয়ার পেরিয়ে আমরা আমাদের যাত্রাযানকে ছুটিয়ে নিয়ে যাব? আমরা কিছু জানি না। তবে একেবারেই যে জানি না তা কিন্তু নয়। আমরা মনে মনে আমাদের যাত্রাপথে যাদের চাই, তাদের কোনো কোনো সময় হঠাৎ করেই পেয়ে যাই। আবার এমনও হয়, নিজের বিশ্বাসের ওপর ভর করে আমাদের মনকে বলতে ভালো লাগে যে, আমার সে-ই মানুষটি ওই বিশেষ জায়গায় থাকবেই। থাকেও এবং এক্ষেত্রে একটা প্রস্তুতি অবশ্যই থাকে। আমি জানি সে থাকবে কিন্তু সে তো জানে না আমি তার কাছেই যাচ্ছি। শুধু তার জন্যই আমার পথ চলা না হলেও আমার পথের একটা বিশেষ চিহ্ন তো সে। আমি তাকে আমার ভাবনার মধ্যে গেঁথে নিয়েছিলাম ওই বিশেষ সময়ে। তার ভাবনার মধ্যেও আমি ছিলাম কিন্তু ওই বিশেষ সময়ে নয়। আবার হয়তো হতেও পারে ওই বিশেষ মুহূর্তে তার ভাবনায় আমি। তবে না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আমার ভাবনার মধ্যে যখন কেউ ঢুকে পড়ে সেটা তো হঠাৎ করে নয়। আমি তাকে ভাবতে চেয়েছি বলেই সে এসেছে। হতে পারে তার আসাটা হঠাৎ। কিন্তু এটা ঠিক যে, আমার মনে সে কোথাও একটা প্রশ্রয় পায়। আবার এমনও হতে পারে, কোনো একটা বিশেষ মুহূর্তে তাকে নিয়ে আমি ভাবছি, তাকে নিয়ে সেই আমার প্রথম ভাবনা। অর্থাৎ তখনই তার মনের মধ্যে ঢুকে পড়া আর আকাঙ্ক্ষিত জায়গা পেয়ে যাওয়া। তাই আমি ভাবতে না চাইলে আমার ভাবনায় কারও জায়গা নেই। কারণ সে এসে বসা দূরের কথা, দাঁড়াবেই বা কোথায়?
আমি তাকে নিয়ে শুধু যে ভাবি তা-ই নয়, তাকে আমি সাজাইও। আমার মনের মতো রঙে। কোথায় আমি তাকে দেখব, কোন সময় আমি তাকে দেখব, এসব তো আমার মনে মনে একটা জায়গা পেয়েই যায়। আমি তাকে চাই মানে তো এই নয় যে আমার প্রতিটি মুহূর্ত তার রঙেই গাঁথা হবে? সবসময়ের সবকিছু ভাবনায় তার অনুপ্রবেশ ঘটবে? কখনোই তা নয়। তাই জন্যই তো আমার বিশেষ মুহূর্তে সে আসে। তার আসার সময়ে অবশ্যই তার সময়ও সম্পৃক্ত থাকে। কিন্তু কখনোই তা আমার দেওয়া সময়কে অতিক্রম করে না। আমি বলেছি তাকে আসতে, দেখতে চাই আমি তাকে। তাই আমার প্রিয় মুহূর্তে সে আলো হয়ে দেখা দেবে।
ঠিক একইভাবে আমার যাত্রাপথের দিকে চেয়েও তো কেউ নিজ আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে বলে উঠতে পারে আমি আসবই। তার মনের অনেকখানি জায়গাজুড়ে এসব কথাই হয়তো তাকে কেউ বলে চলেছে। এটা তো ঠিক, মনের জায়গা এক্ষেত্রে অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করে। ছোট্ট একটু জায়গা থেকে যখন উঠে আসে তার কথা তখন বেশিরভাগ সময়ই তা আমাদের কানে এসে পৌঁছতে পারে না। কিন্তু মনের অনেকখানি জায়গাজুড়ে যখন তার আসবার ধ্বনি উত্থিত হয়, তখনই আমাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, সে আসবে। আসবেই।
অথচ এসবের তো আমি কিছুই জানি না। আমি তো যাওয়ার আনন্দে মত্ত। আমাকে শুধু এগিয়ে যেতে হবে। অথচ আমার যাত্রাপথ অনেকে অনেক কিছু ভেবে ফেলেছে। আমি যখন তার দুয়ারে এসে দাঁড়াই তখন সেটা তো আমার নিয়মের পথ ধরে বয়ে চলা। অন্যজনের কাছে যা প্রাপ্তির আনন্দে মুখরতার মুহূর্ত। কারণ সে তো আগে থেকেই ভেবে রেখেছে এইসময়ে এইপথ দিয়েই আমি এগিয়ে যাব। আমি তার সময়মতোই এসে হাজির হয়েছি। অথচ আমি কিন্তু জানতাম না ঠিক এইসময়েই এই জায়গায় এসে আমি হাজির হব। এই প্রসঙ্গে অনেকদিন আগে পড়া খলিল জিব্রানের একটা কবিতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘লোকগুলি একটু পরেই / এখানে এসে পড়বে / কারণ তাদের / আসার কথাই ছিল / লোকগুলি এলো, ঠিক সময়েই / তবে এটা না জেনেই / যে তাদেরই / আসার কথা ছিল।’