আল মাহমুদ—পাঠ ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা। বিশ্বকবিকে নিবীড়ভাবে পাঠ, পর্যক্ষেণ ও আলোচনা করেছেন আল মাহমুদ। তার ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আশ্রয়ের মতো। নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে তেমনি জীবনধারণের এক অর্থবহ বিশ্রাম বা আশ্রয়ের মতো। যখন সমকালীন জীবনের উচ্চরোল আমার জীবন ও শ্রবণ ক্ষমতাকে বধির করে ফেলে আমি তখনই রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হই। শুধু রবীন্দ্রনাথের গান নয়, রবীন্দ্র সাহিত্যের অম্লান ভান্ডারই আমার অধিক প্রিয় ও শ্রেয়তর পাঠ্য বলে মনে হয়। আমি প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রকাব্যের মধ্যে আমার তৃপ্তিকর বিষয়গুলো বেশি আবিস্কার করে আনন্দ পাই।’
রবীন্দ্রনাথকে আল মাহমুদ উদারতা দিয়ে দেখতেন। তাকে নিস্তরঙ্গ হ্রদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একজন একালের কবির কাছে রবীন্দ্রনাথ হলেন একই সাথে ভয় ও বিস্ময়ের নিঃস্তরঙ্গ হ্রদের মত। বিশাল সরোবরে সুপেয় জলরাশি কোনোদিন শুকোবে না। জয় এ জন্য যে, এর বিশালতা আমাদের সীমাবদ্ধ সংকীর্ণ হৃদয়কে এমন এক উদারতার দিকে আহ্বান করে যাতে সমকালীন মানুষ হিসেবে, কবি হিসেবে আমরা অভ্যস্ত হই।’
সমকালীন কবিতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথকেই উদাহরণ হিসেবে নিয়েছিলেন আল মাহমুদ। দৃষ্টান্ত হিসেবে তাকেই বলেছেন। আল মাহমুদ বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমকালীন কবিতার মুক্তি কোন পথে তা অনুসন্ধান করতে হলে মহাকবিই হলেন আমাদের সহায়ক। ফেরদৌসী, কালিদাস ও মওলানা রুমীর দৃষ্টান্তও আমরা সামনে রাখতে পারি। তবে রবীন্দ্রনাথ যেখানে সহজে আমাদের আত্মায় ও অন্তপুরে প্রবেশ করেন তা তেমনি সহজভাবে আত্মসাৎ করে সাম্প্রতিক কবিতার দিগন্তকে প্রসারিত করাই আমি বাঞ্জনীয় মনে করি।’
কারণ প্রথম দিনের সূর্যকে আমি যখন প্রশ্ন করছি, তখন এটা জেনেই করেছি যে, উত্তর আমাকে খুঁজতে হবে। উত্তর আমাকেই বের করতে হবে। সূর্যটা কোনো উত্তর দেবে না।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার শুধু পাঠকই ছিলেন না আল মাহমুদ, তাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণও করতেন। এ প্রসঙ্গে আল মাহমুদ বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ এখন আমার কাছে, নিজের কবিতা ও উদ্ভাবনা শক্তির জন্য এক অপরিহার্য পাঠ্য বিষয় হয়ে উঠেছে।..আমাদের সাহিত্যের মুক্তির সবগুলো উপাদনই রয়েছে রবীন্দ্র-সাহিত্যে’।
দুই.
জীবনের পরিণত পর্বে এসে মানুষের মধ্যে এমন কিছু উপলব্ধি হয়, যা অসাধারণ, অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে উপলব্ধিটা হয়েছিল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। সভ্যতা সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে। মানুষের উত্থান-পতন সম্পর্কে। একজন কবি হিসেবে মানুষ যখন জীবনের পূর্ব-প্রন্তের দিকে তাকায়, তখন তার কী উপলব্ধি হয়? এ প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদ বলেছেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ খুব উত্তমরূপে পড়েছি। ভাসা ভাসা না। থরোলি পাঠ করেছি। রবীন্দ্রনাথের সব ঠিক আছে, সব অসাধারণ। কিন্তু শেষ বয়সে এসে তিনি জবাব খুঁজতে গিয়ে বলেছেন, প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল, কে তুমি? তারপর শেষ দিনের অস্তাচলগামী সূর্য প্রশ্ন করেছে, কে তুমি? কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না। রবীন্দ্রনাথ এ বেদনাটা উপলব্ধি করেছিলেন। এ বেদনাটা আমার মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম। কারণ প্রথম দিনের সূর্যকে আমি যখন প্রশ্ন করছি, তখন এটা জেনেই করেছি যে, উত্তর আমাকে খুঁজতে হবে। উত্তর আমাকেই বের করতে হবে। সূর্যটা কোনো উত্তর দেবে না। [আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার, মাহবুব মোর্শেদ, ফেব্রুয়ারি ২০১৯]
তিন.
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন আল মাহমুদ। কবিতাটি হলো,
এ কেমন অন্ধকার বঙ্গদেশ উত্থান রহিত
নৈশব্দের মন্ত্রে যেন ডালে আর পাখিও বসে না।
নদীগুলো দুঃখময়, নির্পতগ মাটিতে জন্মায়
কেবল ব্যাঙের ছাতা, অন্যকোন শ্যামলতা নেই।
বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের
বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন।
গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে
পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই
শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা
আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতেথাকি
নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবেনা
আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর!
অবিশ্বস্ত হাওয়া আছে, নেই কোন শব্দের দ্যোতনা,
দু’একটা পাখি শুধু অশত্থের ডালে বসে আজও
সঙ্গীতের ধ্বনি নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাক্যালাপ করে;
বৃষ্টিহীন বোশেখের নিঃশব্দ পঁচিশ তারিখে।
তথ্যসূত্র:
১। আমার সামনে রবীন্দ্রনাথ-আল মাহমুদ
২। সমকালে রবীন্দ্রকাব্যের উপযোগিতা-আল মাহমুদ
৩। শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ-আল মাহমুদ
৪। আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার, মাহবুব মোর্শেদ, ফেব্রুয়ারি ২০১৯
আরও পড়ুন: ছন্দ ছাড়া কবিতা হয় না ॥ আল মাহমুদ