আমার লেখার হাতেখড়ি মূলত কবিতা দিয়ে। হ্যাঁ, প্রথমে কবিতা লিখতে থাকি। কবিতাগুলো ঠিক কবিতা হয়ে উঠতো না। বই পড়তাম প্রচুর। সব ধরনের বই। ছোট বেলা থেকেই আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। নিজের গণ্ডির মধ্যে থাকতে ভালো লাগতো খুব। আমার বাবা একজন প্রান্তিক কৃষক। নিজের কিছু জমিজমা ও অন্যদের জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করতেন। তিন বেলা হয়তো ভাত খেতে পারতাম। তবে অন্যান্য দিক থেকে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। আমি আসলে লেখক হয়ে ওঠার গল্প লিখতে চাইছিলাম না। তবে চিন্তাসূত্রে কবি তানিয়া হাসানের লেখক হয়ে ওঠার গল্প পড়ে অনুপ্রাণিত হলাম।
যেটা বলছিলাম, তা হলো বুঝতে শেখার পর থেকে পারিবারিক ভায়োলেন্সের শিকার। ভালোবাসা বিষয়টাকে এখনো বিশ্বাস করতে পারি না। পারিবারিক বন্ধন, ভালোবাসা, মায়া এ-সব আবহ পাইনি। তাই এখনো ঠিকঠাক সামাজিক হতে পারিনি। বরাবরই আমি পড়াশোনায় যথেষ্ট মনোযোগী ছিলাম। তখনকার সময়ে প্রাইভেট টিউশনির চল কম ছিল। তারপরও বছররান্তে দু-এক মাস ক্লাস টিচারদের নিকট প্রাইভেট পড়া লাগতো। এমনো হয়েছে মা-বাবা দু’জন মিলে আমার সব বই খাতা বেঁধে কোথাও লুকিয়ে রাখতেন। খুঁজে খুঁজে আবার স্কুলে যেতাম। অতীতের স্মৃতি মনে পড়লে আমার মধ্যে এক অমানুষ জেগে ওঠে।
নিজের শরীর সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। দাদিই আমাকে নারী-পুরুষের সম্পর্কের কথা জানান।
যখন একটু একটু করে সব বুঝতে শুরু করি, তখন মা-বাবার প্রতি ঘৃণা বাড়ে। আমার দৈনন্দিন জীবন মায়ের চোখে অসহ্য হয়ে ওঠে। শরীরের পরিবর্তন, প্রথম পিরিয়ড শুরু সবই অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। যুদ্ধ করে পড়াশোনা করা খুব রেয়ার। এসএসসিতে একবার ড্রপ করার পর বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা আরম্ভ হলো। পাত্রদের কেউ গাড়ির ড্রাইভার, অটোচালক, কেউ বাড়ি কিংবা জায়গাজমি দেখাশোনা করে, মোটা ভাত, মোটা কাপড়। ডিফেন্সে চাকরি করা অর্ধশিক্ষিত পাত্রের অযোগ্য ছিলাম আমি। এমানটাই শুনেছি সবসময়। এক সাগর কষ্ট প্রতিনিয়ত চূর্ণবিচূর্ণ করতো। এর থেকে পরিত্রাণ চাইতাম। আমি খারাপ, এটা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। কিন্তু নিজের অপরাধ বিষয় ছিলাম অজ্ঞ। এসএসসি পাস করার পর এবার কলেজে ভর্তি হতে বাধা। আসলে মা-চাচিরা আমার বিরুদ্ধে ছিলেন। একে তো বাবা দরিদ্র, তারপর চাচারা অবস্থাপন্ন। তাই ভায়োলেন্স আরও প্রকট ছিল।
জীবনে কখনো স্নেহময় স্পর্শ পাইনি। যেমন এখন কাঁদছি, কষ্টগুলো গুমরে উঠছে আবার। কলেজের নতুন পরিবেশে নিজেকে বেখাপ্পা লাগতো। পোশাক ছিল না। বাবা-মায়ের অসহযোগিতা আমাকে মারাত্মক বিপন্ন করে তোলে। গ্রামের বাচ্চাদের পড়াতাম, পড়িয়ে যা পেতাম, তাই দিয়ে নিজের চাহিদা কাটছাঁট করে চলতাম। কলেজে কারও সঙ্গে মিশে থাকতে পারতাম না, ম্যাচিউরিটি ছিল না মোটেই। বাইরের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে একবারে অজ্ঞ থাকায় নিজেকে ভিনদেশি মনে হতো।
আগে খুব অসহায় লাগতো। একা লাগতো। এখন আর লাগে না। আমি নিজেকে নিয়ে ভালো থাকা শিখে গেছি। তাই অন্যদের কাছে যেটা অস্বাভাবিক, সেটা নিজের কাছে তুচ্ছ বিষয় মনে হয়।
এরমধ্যে পরিচয় হয় কবি পরিতোষ হালদারের সঙ্গে। তিনি আমার কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ছিলেন। কলেজের পাশে তার বাসা থাকায় প্রায়ই দলবেঁধে আমরা যেতাম। সাহিত্য আড্ডা হতো। কবিতা লিখি আর স্যারকে দেখাই। আমি জানি তখন আসলে কবিতা হতো না, অথচ স্যারের উৎসাহ ছিল অপরিসীম। একজন ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলে জীবনটাই পাল্টে যায়।
স্থানীয় পত্রিকায় কবিতা ছাপা হতো। কবিতা লেখার অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে ভায়োলেন্সের রিক্টার স্কেল আরও প্রকট হলো। এইচএসসি পাস করার পর উচ্চশিক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেলো। বাড়ি থেকে জানালো যে, উচ্চ শিক্ষিত হলেই উচ্চ শিক্ষিত স্বামী পাবো না। অতএব ভাগ্য সুপ্রসন্ন হচ্ছিল না। নিজের স্বামীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুবাদে তিনি আমাকে পছন্দ করলেন। পড়াশোনায় ভালো থাকায় তিনি আগ্রহী হলেন। বাদ সাধলো তার পরিবার। প্রেম না করেও অপরাধী হলাম, বাড়ির পরিস্থিতি চরমপন্থী হলো। আমি নিরুপায়। এরপর বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হলো উত্তপ্ত ছাই থেকে জলন্ত আগুনের মধ্যে পড়ে গেলাম। শ্বশুর বাড়ির নির্যাতনে আবারও দিশেহারা। কারণে অকারণে দোষ, তবে, স্বামী পড়াশোনায় সহায়তা করেছেন। এ-র মধ্যে তিনটি বাচ্চার জন্ম।
লেখালেখি একদম চাপা পড়ে গেলো। কবি তানিয়া হাসানের সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, নারীদের সাহিত্য রচনা আসলেই গালির নামান্তর। যখন ফেসবুক আইডি খুললাম, স্বামীর সব মুখোশ খুলে গেলো, চাকরি কেন পাচ্ছি না তার খোটা শুনতে শুনতে বধিরে পরিণত হলাম। অবশেষে একটা চাকরিও জুটে গেলো।
দুই হাজার একুশ সালের বই মেলায়, বেহুলা বাংলা প্রকাশনী থেকে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, ‘যত দীর্ঘ হোক’ প্রকাশিত হয়। যদিও বইটির এককপিও হাতে পাইনি। করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বই মেলায় যাওয়া হয়নি।
জীবন গড়ে দেওয়ার জন্য পৃথিবীর কোনো মানুষ পাশে থাকে না, কেউ সাহায্য করে না, নিজেকে নিজের সাহায্য ছাড়া।
লেখা প্রকাশের মাধ্যম চিন্তাসূত্র, দৈনিক খোলা কাগজ ও প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকা। কারণ এই তিন জন সম্পাদকের সঙ্গে আমার কোনো আলাপ হয় না। কিন্তু লেখা পাঠালে তারা প্রকাশ করেন। ভালো লাগে এজন্যই।
ব্যক্তিগত জীবনে আমি অতি মাত্রায় বাস্তববাদী। অন্যায় অনিয়ম আমি মোটেই প্রশ্রয় দেই না। বন্ধু নেই বললেই চলে। আপনজনও নেই। আসলে কোনো মানুষের আপনজন থাকে না। শ্রদ্ধা করার মতো একজন মানুষকেও এই পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। তবে সহানুভূতির কমতি নেই। লেখক হতে পেরেছি কি না, জানি না। কিন্তু বিশ্বাস করি আমি আপাদমস্তক একজন কবি। আমার শিল্পবোধ ব্যক্তিত্বের সংমিশ্রণে তৈরি। অন্যায় তোষামোদ এসব নিয়ে কারও সঙ্গে আপস করি না। ভবিষ্যতে করবোও না।
উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা পেলে হয়তো লেখালেখি আরও গতিময় হতো, কয়েকটি বইয়ের মালিক হতাম, বিধিবাম থাকায় খুব চেষ্টা করেও ঠিক হলো না। এখন আমার পাঠক তৈরি হয়েছে, তবে আমার লেখা কবিতা বা প্রবন্ধ সর্বজনীন হতে সময় লাগবে। কেউ কেউ যোগাযোগ করেন, সম্মান করেন। তারা আমার মতো লোকজন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এখনো সঠিকভাবে কেউ আমাকে বা আমার লেখাকে অনুধাবন করতে পারে না। নিজের বলয় খুব সীমিত, এটা ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাই। অযাচিত সবকিছু বিরক্তিকর। তবে লেখক হওয়ার পেছনে কোনো দুঃখ বা ভালোবাসা দায়ী নয়। এটা আমার সহজাত প্রবৃত্তি।
আমি জ্ঞানপিপাসু কিন্তু বইপিপাসু নই, নিয়ম করে বইপত্র পড়ি না, আমি পড়ি মানুষ, জীবনবোধ। আর ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাস। তাই নিজের ধর্মানুভূতি বলতে কিছু নেই। কারণ যিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন, সেই রচিত গ্রন্থ বাদ দিয়ে রচয়িতার জীবনপ্রণালী জেনে বুঝে এক অশ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। আমি বিশ্বাস করি, কাজে-কথায় এক না থাকলে সে যেই হোক, ভণ্ড। দেখে শেখা আর ঠকে শেখা এক নয়। আমার মা তার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছেন। বাবাও তাই। অতএব এই দুজন মানুষের জন্য আমার কোনো টানাপড়েন নেই। এরা ইচ্ছে করে আমার জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। আগে খুব অসহায় লাগতো। একা লাগতো। এখন আর লাগে না। আমি নিজেকে নিয়ে ভালো থাকা শিখে গেছি। তাই অন্যদের কাছে যেটা অস্বাভাবিক, সেটা নিজের কাছে তুচ্ছ বিষয় মনে হয়।