মনের গভীরে জমে থাকা অনেক কথা মুখে বলা যায় না। কথাগুলো বলার জন্যে একদিন কলম তুলে নিলাম হাতে। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে, কৈশোরের খুচরো আবেগ, কোমল হৃদয়ের ক্ষরণ এবং মানবিকসত্তা আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে, লিখতে বাধ্য করিয়েছে। তারপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এগোতে থাকলাম। সেই যে হাঁটতে শুরু করেছি, আর থামাথামি নেই। আজ অব্দি হেঁটেই চলেছি। হারকিসিমের বাধাবিপত্তি, তিরস্কার-ষড়যন্ত্র আমাকে এতটুকু টলাতে পারেনি।
মূলত নিজের ভেতরের কথাগুলোকে জিইয়ে রাখতে, ব্যক্তিগত দীর্ঘশ্বাসগুলো কাগজের তস্তুরিতে সাজিয়ে রাখতে এবং সতেজসত্তার রসদ জোগাতে একদা সাহিত্যচর্চায় যুক্ত হই। তখন ভাবতেও পারিনি লেখালেখি করে একদিন মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠবো কিংবা পুরস্কার-পদক পাবো। তাছাড়া শিল্পসাহিত্যে যে এত রকমের পদক-পুরস্কারের প্রচলন আছে, সেটাই তো জানতাম না।
আমার ভেতরেও একসময় এমন ধ্যানধারণা ছিল যে, কবি-সাহিত্যিক মানেই মৃত প্রজাতির ব্যক্তিবিশেষ; একজন কবি যে বেঁচে থাকতে পারেন এবং সমাজের আট-দশটা মানুষের মতো পৃথিবীতে বিচরণ করতে পারেন সেটা ভাবনায় আসেনি তখন। সুতরাং লেখালেখি করে বেশি কিছু পাবো, এমন ভাবনা মাথায় আসার প্রশ্নই ওঠে না।
সাহিত্যের দিকে আমি বেশি ঝুঁকেছি কবি জসীমউদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার আবৃত্তি শুনে। এ কবিতার আবৃত্তি শোনার পর ভেতরটা ওলটপালট হয়ে গেলো। এরপর পেলাম তার ‘কবর’ কবিতা। আমি যেন পৃথিবীতে নতুনভাবে জন্ম নিলাম। তখন হোস্টেলে থাকতাম। কাছেই ছিলো পৌরপাঠাগার, নিয়মিত সদস্য হয়ে গেলাম। জসীমউদ্দীনের আরও কিছু কবিতার বই পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। গোগ্রাসে গিলে ফেললাম সব। যতই পড়ি, ততই মুগ্ধ হই।পড়বার তৃষ্ণা বেড়ে গেলো।
পড়তে পড়তে একদিন পরিচিত হয়ে উঠলাম জীবনানন্দের সঙ্গে, ঠিক যেন মেঠোপথে চাঁদের দেখা পেয়ে গেলাম। চমৎকার মলাটে মোড়ানো একটি বই, প্রচ্ছদে সুন্দরী এক তরুণী কাশফুলের সঙ্গে মিশে আছে। লেখকের নাম, জীবনানন্দ দাশ! বইটা হাতে তুলে নিলাম। মূলত প্রচ্ছদের সৌন্দর্য আমাকে চুম্বকের মতো টেনে ধরলো। প্রথমে উল্টেপাল্টে দেখলাম। বেশ সুন্দর একটি বই। পড়া শুরু করলাম। তারপর তো থ মেরে রইলাম। শব্দের সুললিত ঝঙ্কার আর ভাষার লালিত্যে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলাম। এমন চমৎকার একজন লেখকের নাম আমি মাত্র জানলাম! সেই যে জীবনানন্দকে চিনলাম, এরপর আর তার পিছু ছাড়িনি। তার রচনাসমগ্র পড়ে ফেললাম। পড়তে গিয়ে যে খুব বেশি বুঝি এমন নয় কিন্তু তারপরও পড়ার মধ্যে যেন আনন্দ অসীম। কোথায় যেন একটা মায়াটান আমাকে পেয়ে বসলো।
জীবনানন্দকে চেনার পর বদলে গেলো চিন্তার জগৎ। এরপর আল মাহমুদ ও আবুল হাসানকে পেয়ে যাই কবিতার পথে, পেয়ে যাই শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, হুমায়ুন আজাদ, সিকদার আমিনুল হক ও আবদুল মান্নান সৈয়দকে। সন্ধান পাই কবিতাপত্র লিটলম্যাগসহ অনেক মূল্যবান ছোটকাগজের। শিল্পসাহিত্যের ভূত আমার কাঁধে ভালো করেই জেঁকে বসে তখন।
উপন্যাস কিংবা বড় ধরনের গল্প পড়বার সুযোগ খুব কমই পাওয়া যায় পাঠাগারে। মাত্র তিনচার ঘণ্টা খোলা থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বিকেল বেলায় খুলে সন্ধ্যার পরপরই বন্ধ করে ফেলে। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতাম। এরপরও প্রায় পনেরো ষোলো দিন করে সময় নিয়ে আস্তে আস্তে পড়ে শেষ করেছি এক-একটা উপন্যাস। একদিন বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ হাতে নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম! পড়ার তৃষ্ণা বেড়ে গেলো। পাঠাগারে বসে এই বই পড়ে মজা পাবো না। লাইব্রেরিতে খুঁজে সংগ্রহ করে নিলাম। পুরো বই পোর পর মনে হলো সারাজীবনে আর যদি বই নাও পড়ি, আমার কোনো দুঃখ থাকবে না। একটা ‘পথের পাঁচালি’ পড়ার মধ্যে যে মুগ্ধতা আমি পেয়েছি, পৃথিবীর আর কোনো বইয়ে সে রকমটা আজও পাইনি।
আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও দীর্ঘ হতে লাগলো। পড়ার ফাঁকে তাল মিলিয়ে চললো লেখালেখি। একটু পথ দেখিয়ে দেওয়ার মতো কোনো মানুষ পাইনি কাছে। নিজের আত্মবিশ্বাস এবং পঠনপাঠন সামনে চলার সাহস জোগাতে লাগলো। পড়তে পড়তে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু ইসহাক, শওকত ওসমান, শহীদুল জহির, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আহমেদ, তারাশঙ্কর, অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও মানিকের দেখা পেয়ে গেলাম। তাদের লেখা প্রেরণা জোগাতে শুরু করলো। আমার হাঁটার গতি আরও বাড়তে লাগলো।
স্তম্ভিত হয়ে ভাবতাম, তারা কি আমাকে লেখক না ভেবে বইয়ের দোকানদার ভাবে, যে দুই-তিনশ কপি বই নিজে নিয়ে বিক্রি করবো?
তখন দারুণ অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছিলাম। বই কেনার সামর্থ্য ছিল না। পুরাতন লাইব্রেরিতে গিয়ে উল্টেপাল্টে ছেঁড়াফাড়া বই কম দামে কিনে আনতাম। একবার ছোট্ট একটা বই দেখে আমার চোখ আটকে যায়, অদ্ভুত রকমের প্রচ্ছদে সাজানো বইটি। একেবারেই ছোট্টমতো। তারপরও মনে হলো এতে বোধহয় কিছু একটা লুকিয়ে আছে। কিনে আনলাম। পড়ে তো রীতিমতো হতভম্ভ হয়ে গেলাম! সফোক্লিসের মতো মহান লেখকের সন্ধান পেয়ে গেলাম! আন্তিগোনে নামের বইটা পড়ে আমার ধারণা আরও বেশি পাল্টাতে শুরু করলো। বিশ্বসাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগলো। কিছুদিনের মধ্যে পেয়ে গেলাম জ্যাক লন্ডনের ‘হোয়াইট ফ্যাঙ’ বইটি। সেইসঙ্গে ফ্রান্স কাফকা, জোনাথন সুইফট, ইভান তুর্গেনেভ ও ফেদেরিকো লোরকার কিছু বইয়ের অনুবাদ পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। আহা! আমি যে কতটা ক্ষুদ্র, এসব বই না পড়লে বুঝতেই পারতাম না। পড়তে পড়তে লেখক হওয়ার পথটা আমি নিজেই খুঁজতে লাগলাম। পত্রিকায় পাঠাতে শুরু করলাম লেখা। আসতে শুরু করলো। আমার আর পেছনে তাকাতে হয়নি। টাকার অভাবে বই কিনতে না পারায়, কবি জসীম মেহেদীর বুক স্টল থেকে প্রত্যেক শুক্রবারে জাতীয় পত্রিকার সাহিত্যপাতাগুলো কিনে আনতাম। পড়ার আগ্রহ দেখে দুই-একটা ফ্রিতে দিয়ে দিতেন তিনি। সেখানে কালি ও কলম আসতো, বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার আসতো, সাপ্তাহিক রোববার, অনন্যা ও অন্যদিন ম্যাগাজিন আসতো, ভারত থেকে আসতো দেশ পত্রিকা ও সানন্দা পত্রিকা। এগুলো অল্পদামে পেতাম, কিন্তু বিচিত্র লেখায় ঠাসা থাকতো। টিউশনি করে, টিপিনের টাকা বাঁচিয়ে, জমাকাপড় না কিনে, কিনে আনতাম বই এবং এক লহমায় পড়ে শেষ করে ফেলতাম। শহরের অন্য পাঠাগারগুলোতেও মাঝেমধ্যে হানা দিতাম। জেলার লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে শুরু করলাম। কারও কারও কাছ থেকে ধার
করে বই এনে পড়তে শুরু করলাম এবং নিজের জগৎটাকে প্রসারিত করে তুলতে চেষ্টা করলাম।আঁটঘাট বেঁধে নেমে পড়লাম লেখক হওয়ার বাসনা নিয়ে।
আমার লেখা ছাপা হওয়ার পেছনেও রয়েছে একটি ব্যতিক্রম ইতিহাস। যখন লেখালেখিতে পুরোদস্তুর ব্যস্ত, তখন হোস্টেলের বন্ধুরা পরামর্শ দিয়েছে এগুলো পত্রিকায় পাঠাতে। তাদের মতে লেখাগুলো নিজের ডায়রিতে লুকিয়ে রাখলে প্রতিভা বিকশিত হবে না। কিন্তু পত্রিকায় লেখা পাঠানোর নিয়ম তো আমি জানি না। ঠিকানাও জানি না। আমাকে তো কেউ চেনেও না। তবে মনে মনে ভরসা পেলাম অন্যভাবে। আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি লোকাল পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। বড় আগ্রহ নিয়ে তার কাছে ছুটে গেলাম। কবিতাগুলো দেখালাম। তিনি বললেন, লেখা ছাপানো যাবে। তবে প্রতি লেখায় ১০০ টাকা করে দিতে হবে। আমার মন ভেঙে গেলো। তখন আমি টিউশনি করে চলি। মাত্র অল্প কটা টাকা মাস শেষে পাই। ১০০ টাকা খরচ করা আমার জন্যে অনেক কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া প্রতিবার যদি এমন টাকা দিয়ে লেখা ছাপাতে হয়, তাহলে তো আমি ফকির হয়ে যাবো। জেদ আড়াল করে ফিরে এলাম মন খারাপ করে। লেখা ছাপা হলো না। তারপরও পাঠাগারে গিয়ে বই পড়ার পাশাপাশি পত্রিকা পড়তাম নিয়মিত। একদিন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকায় লেখা আহ্বান দেখে ঠিকানা টুকে রাখলাম। হলুদ খাম কিনে পোস্ট অফিসে গিয়ে পাঠিয়ে দিলাম কবিতা। পরের সপ্তাহে এক সন্ধ্যায় আমার বন্ধু মুনীর উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমার লেখা পত্রিকায় দেখলাম! অভিনন্দন।
আমি যেন আসমান থেকে পড়লাম। বলে কী! তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস। টাকা ছাড়াই ছাপাশুরু হয়ে গেলো আমার কবিতা। হোস্টেলে আমাকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। একটু সুযোগ পেলেই পত্রিকাটি উল্টিয়েপাল্টিয়ে কেবল নিজের নামটা দেখি। নিজের লেখাটাই পড়ি। আর মনে মনে নিজেকে অনেক বড় কবির আসনে বসাতে শুরু করি। আমার দেখাদেখিতে হোস্টেলে নতুন করে অনেকে কবিতা লিখতে শুরু করলো কিন্তু তাদের আবেগ বেশি দিন টিকলো না। সেসব কবি কয়েক মাসের মধ্যেই হারিয়ে গেলো। লেখা প্রকাশ করে দেওয়ার কথা বলে যেই স্যার ১০০ টাকা চেয়েছিলেন, তাকেও দেখালাম আমার প্রকাশিত কবিতা। তিনি খুশি হলেন, মন্তব্য করলেন না। তবে শুভকামনা জানিয়েছিলেন।
তখন প্রচুর লিখতাম। পত্রিকায়ও নিয়মিত ছাপা হতে থাকে। এভাবেই পত্রিকা অফিসের সঙ্গে ধীরে ধীরে সম্পর্ক তৈরি হয়। বুদ্ধিপরামর্শ পেতে থাকি। লেখায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে থাকি। তখন লেখাগুলো যে খুব বেশি ভালো ছিল, সেটা কোনোভাবেই বলা যায় না। তবে আত্মবিশ্বাস ছিল অনেক। মনে মনে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে নিজের পাল্লাটুকুই ভারী ভেবে রাখতাম। নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে একদিন একটা সাহসী কাজ করে বসলাম। সে কাজটুকু বোধহয় আমার সাহিত্যের চর্চাকে আরও বেশি শানিত করেছে।
আমাদের বাংলার প্রভাষক ছিলেন আবদুল আজিজ স্যার। স্যারের সাহিত্যজ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়। প্রচুর পড়ুয়া একজন মানুষ তিনি। একদিন আমার কিছু কবিতা স্যারের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, এগুলো আমার লেখা। পড়লে আমি খুশি হবো। স্যার খুব আন্তরিকতার সঙ্গে লেখাগুলো নিলেন এবং আমাকে একটা উপহারও দিলেন। মুগ্ধ হলাম তার আচরণে। ভাবলাম, স্যারের একটু প্রশংসা পেলেই আপাতত বড় কবির স্বীকতিটা পেয়ে যাবো। তাই পরের দিন ক্লাসে স্যারের কাছে জানতে চাইলাম আমার কবিতাগুলো কেমন হয়েছে।
স্যার বললেন, তোমার কবিতাগুলো পড়েছি। এখন আমার কথা হলো, তুমি কি কবি হতে চাও?
বললাম, জি স্যার।
তিনি বললেন, তাহলে লেখা কেমন হয়েছে, এটা না ভেবে লিখতে থাকো এবং পড়তে থাকো। বছর দুয়েক পরে তুমি নিজেই টের পাবে তোমার এগুলো কেমন হয়েছে। আমার পরামর্শ হলো, লিখতে থাকো আর পড়তে থাকো। আপাতত এরচে বেশি কিছু বলবো না।
সেদিন বুঝলাম, আমার লেখায় হয়তো কোথাও ঘাটতি দেখেছেন তিনি। পাছে উৎসাহ নষ্ট হয়, সে কারণে কিছু বলেননি। স্যারের কথামতো এগোতে লাগলাম। দুই বছরও সময় লাগেনি। এক বছর না যেতেই সে সব কবিতা আমি নিজেই আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম লজ্জায়। বুঝতে পেরেছি এ ধরনের লেখা দিয়ে লোকাল শহরে কদিন লেখক লেখক ভাব নিয়ে হাঁটাচলা করা যায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। সেদিন স্যারের কৌশলী জবাবের কারণে হয়তো নিজের ঘাটতিটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছি। এরপর প্রায় বছরখানেক লেখালেখি থামিয়ে পড়াশোনায় ডুবে রইলাম। নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার চেষ্টায় মত্ত রইলাম। দীর্ঘ বিরতি শেষে প্রথমবারের মতো গল্প লিখলাম ‘নির্বাক টাইপ মেশিন’। স্থানীয় পত্রিকায় গল্পটা প্রকাশের পর দারুণ প্রশংসা পেলাম। কেউ কেউ বললো, এটা জাতীয় মানের গল্প। তুমি জাতীয় কাগজে পাঠাতে পারো। কাউকে না জানিয়ে চুপিসারে একদিন পাঠিয়ে দিলাম বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকারে। ওমা! পরের সংখ্যায় আমার গল্প প্রকাশিত হয়ে গেলো উত্তরাধিকারে! জীবনে শ্রেষ্ঠতর একটি আনন্দের দিন যেন আমার জীবনে নেমে এলো। কয়েকমাস পর সে লেখার জন্যে জীবনে প্রথমবারের মতো পেলাম লেখক সম্মানী দুই হাজার টাকা! এসব আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগলো। জীবনে এত বড় অর্জন তো স্বপ্নেও ভাবিনি। আরও মজার ঘটনা হলো যে, উত্তরাধিকারে আমার গল্প প্রকাশের পর ‘ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম’ কর্তৃপক্ষের নজরে পড়েছে সেটা। সে বছরই প্রথম বারের মতো তারা চালু করছে সাহিত্য পদক। গল্পের জন্যে আমি পেয়ে গেলাম ‘ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম সাহিত্য পদক-২০১৩’। আমাকে পদকের জন্যে মনোনীত করেছে, এটা একদিন আগেও জানায়নি। অনেকটা জোর করে আমাকে অনুষ্ঠানে দাওয়াত করে নিয়েছিল তারা। বারবার অনুরোধ করায় অনেকটা বাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম। গিয়ে তো অবাক! পদক বিজয়ী হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করার পর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। জীবনে প্রথমবার ক্রেস্ট হাতে নিলাম। তাও কী আশ্চর্য রকমের অনুভূতির মধ্য দিয়ে। আমি বুঝতে শুরু করলাম এবার আমাকে কাজে মনোযোগী হতে হবে। আমি কাজের কাছে নিজেকে সঁপে দিলাম। তারপর ধীরে ধীরে জাতীয় পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতায় লেখা আসতে শুরু করে। সারাদেশের লিটলম্যাগ সম্পাদকরাও লেখা চাইতে শুরু করে। আমি দুই হাতে লিখে চললাম। আরও কিছু পুরস্কার/সম্মাননায় অভিষিক্ত হলাম। লেখক হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠলাম। আমাদের একটা সার্কেল গড়ে উঠলো। নিজেদের শানিত করতে বের করলাম লিটলম্যাগ ‘মৃত্তিকা’। চাঁদপুরের নবপর্যায়ের লিটলম্যাগ আন্দোলনের তিন অগ্রসৈনিকের মধ্যে আমিও ঠাঁই পেলাম ইতিহাসে।
এবার কাছের জনেরা তাড়া দিতে লাগলেন বই প্রকাশ করার জন্যে। কিন্তু মন তো চায়, বললেই তো আর বই হয়ে যায় না। কিন্তু লেখক যেহেতু হয়েছি, বই তো করতেই হবে। তবে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটা কাঠখড় পোহাতে হয়েছে সেটা কবি মামুন
রশীদ সম্পাদিত ‘সংক্রান্তি’তে একবার লিখেছিলাম।
প্রথম বইয়ের ভেতরে যে রোদ-কুয়াশার ছটা জড়ানো আছে তা বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। অতীতের কিছু বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের কথা বাদ দিলে আমি বলবো আমার প্রথম বইয়ের নাম ‘দুই শহরের জানালা’। বইটি প্রকাশের আগে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন প্রকাশকের দরোজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কেউ কথা দেয়নি। বড় অবাক হয়েছিলাম সেদিন, একটা গল্পের বই প্রকাশ করার আশ্বাস দেননি বাংলাদেশের একজন প্রকাশকও! সবাই আকারে ইঙ্গিতে কেবল টাকা আদায়ের ধান্ধায় মত্ত ছিলেন। ‘নতুনদের বই চলে না, বইয়ের বাজার মন্দা, কাগজের দাম বাড়তি, আজকাল বই বিক্রি করে বাঁধাই খরচও ওঠে না’ইত্যাদি আপ্তবাক্য শুনিয়ে আমার উৎসাহটুকু নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন তারা। কেউ কেউ আবার দুইশ কপি, তিনশ কপি বই কিনে আনার শর্তে রাজি থাকলে বই প্রকাশ করবে বেল সাফ জানিয়ে দিয়েছে। স্তম্ভিত হয়ে ভাবতাম, তারা কি আমাকে লেখক না ভেবে বইয়ের দোকানদার ভাবে, যে দুই-তিনশ কপি বই নিজে নিয়ে বিক্রি করবো? তারপরও বলতাম, ভাই, আমার লেখা বিভিন্ন জাতীয় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। আমাকে অনেকেই চেনে, বই করলে অন্তত চালানটুকু হারাতে হবে না।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। টাকা ছাড়া কি বই করা অত সহজ!
আমি নিজেকে গড়েছি নিজের হাতে, শিল্পসাহিত্যে আমিই আমার ঈশ্বর; আমিই আমার কারিগর।
মন ভেঙে গিয়েছিল। একবার ভাবলাম বইই করবো না কখনো। সব লেখা চুলোয় দেবো। পত্রিকায়ও লেখা পাঠাবো না। অভিমান করে কিছুদিন পত্রপত্রিকায় লেখা পাঠাইনি। লেখা ও পড়া সবই প্রায় থামিয়ে দিয়েছি। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে সাহিত্যের পথ থেকে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু রক্তে যার সাহিত্য তোলে ঢেউ, তাকে কি আর রোখতে পারে কেউ?
একদিন ফেসবুকে কবি অচিন্ত্য চয়নের একটা পোস্ট দেখলাম। দেশ পাবলিকেশন্সের পক্ষ থেকে পাণ্ডুলিপি আহ্বান করেছেন তিনি। বিজয়ী লেখককে পুরস্কার হিসেবে নগদ অর্থ, ক্রেস্ট দেওয়ার পাশাপাশি পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে প্রকাশ করে দেওয়া হবে। লোভ সামলাতে পারলাম না। আগে গুছিয়ে রাখা লেখাগুলোকে একটু ঠিকঠাক করে পাঠিয়ে দিলাম। পাঠানোর পর কোনো খোঁজ-খবর এলো না অনেকদিন। হতাশার মেঘ ঢাকতে লাগলো প্রত্যাশার সূর্যকিরণ। এরই মধ্যে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন থেকে প্রথমবারের মতো আহ্বান করা হয় পাণ্ডুলিপি। ‘চাঁদপুর জেলা প্রশাসক পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৮’ আহ্বানপত্রটি ফেসবুকে দেখে আবারও লেখা পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। এখানে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হবে নগদ তিরিশ হাজার টাকা! তিরিশ হাজার টাকা হাতে পেলে অন্তত বই প্রকাশের টাকা নিয়ে আর ভাবতে হবে না, এই ভাবনা নিয়ে পাঠিয়ে দিলাম পাণ্ডুলিপি। পাঠানোর পর এখানেও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমার বই প্রকাশের আশা বড় ক্ষীণ হয়ে উঠলো।
হঠাৎ একদিন দেশ পুরস্কারের শর্টলিস্ট প্রকাশিত হলো। সংক্ষিপ্ত তালিকায় নিজের নাম দেখে বুকের ভেতরে কইমাছের তো খলবলিয়ে উঠলো একগুচ্ছ আশা। আমার বিশ্বাস ছিল রিয়েল বিচার করলে পুরস্কারটা পেয়ে যাবো। বইও হয়ে যাবে। ক্রেস্ট আর নগদ অর্থ গোল্লায় যাক, বইটা বেরুলেই বাঁচি। হ্যাঁ, আমার ধারণা সত্য হলো। তরুণ কথাসাহিত্যিক হিসেবে আমি পেয়ে গেলাম দেশ পুরস্কার! পুরস্কার ঘোষণার পর বেশ মাতামাতি শুরু করে দিলাম। আনন্দ আর ধরে রাখতে পারলাম না। বই তাহলে হচ্ছে এবারই! নতুন স্বপ্নের চর জেগে উঠলো বুকের ভেতরে। জেলার প্রায় সবগুলো পত্রিকা নিউজ প্রকাশ করলো আমার পুরস্কার প্রাপ্তির। নিউজ প্রকাশের একদিন পার না হতেই আবারও এলো খুশির সংবাদ! এবার চাঁদপুর জেলা প্রশাসক পাণ্ডুলিপি পুরস্কারটিও পেয়ে গেলাম আমি, কথাসাহিত্যে!এবার আর আমায় পায় কে? বইও হবে। টাকাও পাবো। আমার কোনো ল্যাপটপ বা কম্পিউটার নাই। অনেক কষ্ট করে লিখতে হয়, বন্ধুদের দুয়ারে দুয়ারে লেখা কম্পোজের জন্যে হানা দিতে হয় অথবা কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতে হয়। তাই জেলা প্রশাসক পুরস্কার পেয়ে ভেবেছিলাম তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার কিনবো। যেহেতু ফ্রিতে বই বেরুচ্ছে দেশ পুরস্কার পেয়ে সুতরাং জেলা প্রশাসক পুরস্কারের টাকায় আমি ল্যাপটপ কিনবোই কিনবো। আমার আর দুর্দিন থাকবে না। লেখালেখিটা অন্তত স্বস্তিতে করতে পারবো। কিন্তু না। জেলা প্রশাসক পুরস্কার কমিটির সঙ্গে আমার বনিবনা হয়নি। ফলে সে পুরস্কার আমি গ্রহণ করিনি। জেদ করে পুরস্কার বর্জনের ঘোষণা দিলাম। এ নিয়ে ঘটে গেলো লঙ্কাকাণ্ড, তুমুল হৈচৈ। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম না, সুতরাং গ্রহণ করিনি জেলা প্রশাসক পুরস্কার।
যেহেতু দেশ পুরস্কার পেয়ে বইটা বের হওয়ার নিশ্চয়তা পেলাম, তাই জেলা প্রশাসক পুরস্কার গ্রহণ না করার সাহস আরও বেড়ে গিয়েছিল। অবশেষে একটু দেরিতে হলেও বইটা প্রকাশিত হয়েছে মেলায়।
তবে মজার বিষয় হলো এই যে, বইটা দ্রুত হাতে পাওয়ার লোভে ভালো করে প্রুফও দেখিনি। প্রুফ দেখে বিলম্ব করার মতো ধৈর্যটুকুও হারিয়ে ফেলেছি তখন। কেবলই বইটা দেখার তৃষ্ণা পেয়ে বসেছিল। অপার আগ্রহ নিয়ে বসে ছিলাম কখন পাবো জোড়াপুরস্কারে অভিষিক্ত আমার গল্পের বই ‘দুই শহরের জানালা।’
এদিকে প্রকাশক আমাকে বারবার হতাশায় ফেলে দিচ্ছে। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু; এভাবে সময়ক্ষেপণ করতে করতে উৎসাহটুকু বিষাদে পরিণত করেছে। কয়েকবার রাগ করে ফোন করা বন্ধ করে দিয়েছি কিন্তু বইটা যে আমার! এ যে আমারই সম্পদ, অভিমান করলে যে আমারই ক্ষতি, ওকে যে পৃথিবীতে আনা দুষ্কর হয়ে পড়বে। তাই আবারও অভিমান ভেঙে ডায়াল করি ফোনে, আবারও হই হতাশ। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে যে বই মেলায় থাকার কথা, সে বই ২০ তারিখও আসেনি! এদিকে নাগরিক বার্তা নামের একটি অনলাইন পত্রিকা পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং বই প্রকাশের খবর পেয়ে আমাকে সম্মাননা দেওয়ার কথা জানিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমিসহ ৭ জনকে দেওয়া হবে এ সম্মাননা। কিন্তু বইটা তখনো আসেনি। চয়ন ভাইকে সেটাও বললাম। তিনি শুনলেন না। খুব মন খারাপ হয়েছিল তখন। সম্মাননাটুকু অনেকটা ঘুষখোরের মতো চুপিচুপি গ্রহণ করলাম। লজ্জায় এতটুকু হয়ে গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানস্থলে। মনে মনে ভাবলাম সম্মাননা তো নিয়ে এলাম, বইটা যদি না বের হয়!
না। আমাকে আর হতাশ হতে হয়নি। ২৫ তারিখ বইটা মেলায় চলে এলো। কষ্টের মধ্যেও খুশিতে নেচে উঠলো মন। দুই-একদিনের মধ্যেই ছুটে যাবো মেলায়। উষ্ণ পরশ নেবো আমার বইয়ের। কিন্তু হায় রে বিধি! বই আসার পরের দিন থেকেই সারাদেশে শুরু হলো তুমুল ঝড়-তুফান! মেলার অবস্থাও কাহিল। প্রায় ফেব্রুয়ারি মাস পার করে দিলো এ ঝড়। অবস্থা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ একদিন মেলা বাড়িয়ে দিলেন। সেদিনই মেলায় গিয়ে হাজির হলাম। বুকে তুলে নিলাম আমার নিজের বই! তারপর ভুলে গেলাম আগে ও পরে কতটা বন্ধুর পথ অতিক্রম করে ছুটে এসেছি আমি। বইটা প্রকাশের কয়েক মাসের মাথায় ‘এবং মানুষ তরুণ লেখক পুরস্কার ২০১৯’ পেয়ে পুরোপুরি ভুলে গেলাম ফেলে আসা বিষণ্ন মুহূর্তের কথা।
এখন তো ভাবতেই অবাক লাগে, এক বছরে প্রায় ৪ খানা বই প্রকাশিত হয় আমার কিন্তু এক টাকাও দিতে হয় না প্রকাশককে! একটু দেরিতে হলেও বুঝেছি এদেশে ভালো প্রকাশকও আছে। যে কবিতার জন্যে রাতদিন একাকার করে ফেলেছি, সে কবিতার পাণ্ডুলিপির জন্যে পেয়েছি ‘জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার ২০১৯’! পুরস্কার হিসেবে নগদ অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি পাণ্ডুলিপিটিও বই আকারে বাজারে আনে তারা। ভাবতেই অন্য রকম শিহরণ জেগে ওঠে শরীরে।
এভাবেই একদিন বই হলো। আমার চর্চার গতি বৃদ্ধি পেলো। তারপর স্বপ্ন দেখলাম নিজেকে নতুন করে গড়তে সংগঠন তৈরি করবো। সে মনোবাসনা থেকে প্রতিষ্ঠা করলাম চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি। সারাদেশের মানুষ এখন আমার চেয়ে বেশি চেনে আমার হাতে গড়া প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি। এ সফলতার পেছনেও ছিলো ঘামঝরা শ্রম, একরোখা জেদ এবং সারথিদের ভালোবাসা। আমি উলিয়াম ফখনারের একটি কথাকে কঠোরভাবে বিশ্বাস করি, ‘মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নাই’।
আমি যতটুকু এগিয়েছি সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় এগিয়েছি, পেছন থেকে কেউ ধাক্কা মেরে এগিয়ে দেয়নি। বরং বারবার থামিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে অনেকে। কিন্তু অদম্য ইচ্ছেশক্তি এবং একরোখা জেদ আমাকে সাহসী করে তুলেছে। বলা যায়, আমি নিজেকে গড়েছি নিজের হাতে, শিল্পসাহিত্যে আমিই আমার ঈশ্বর; আমিই আমার কারিগর।