আমি যেদিন ঘামে ভিজে শরীরে প্রচণ্ড জ্বর ঢুকিয়েছিলাম, সেদিনের সেই অসুস্থ ঘোর আমার মস্তিষ্কে এখনো জ্বলজ্বলে। কিছু ক্রোধের কোমল প্রশান্তি কখনো গভীরতা ছুঁয়ে—কিছু কবিতার কাছে নতজানু হয়ে আছে—এখনো মনের কোণে অস্ফুট হয়ে আছে। কেননা, কবি তো বলেছেন—
আমি এমন এক তরুণের কথা জানতাম,
যে তার কবিতার আলালের ঘরের দুলাল, মেনিমুখো শব্দাবলি ঝেড়ে ফেলে
অপেক্ষা করত সেদিনের জন্যে,
যেদিন তার কবিতা হবে মৌলানা ভাসানী
এবং শেখ মুজিবের সূর্যমুখী ভাষণের মতো।
মূলত. আমি ‘রৌদ্র করোটিতে’ পড়ে কবি শামসুর রাহমানের কাব্য-আকাশ দেখেছি। তখন আমি সবেমাত্র লিখিটিখি। তো কবিকে আবিষ্কারের নেশায় প্রতিনিয়ত তাঁর নিয়মিত কাব্যের পাঠক হয়ে যাই। আমার শরীরে কবিতার জ্বর যেন বাড়তেই থাকে। প্যারাসিটামলেও কিন্তু কমছে না। কবির রাজনৈতিক ঘরানার কবিতা; কাব্যের নবাঞ্চলে—তখন আমার প্রত্যক্ষ রাজনীতির অনুপ্রেরণা—প্রস্তুতি! মিছিলে মিছিলে আরও সাহসী হয়ে উঠি। কবির সে সব নিজস্ব ফর্ম—চিন্তার ইমেজারি। একেবারেই আলাদা লিরিক্যাল আঁধার-অধেয় তখন আমার ভেতরের কাব্যঘূর্ণিঝড় বয়ে চলে। আমি টের পাই, কবির চিত্রকল্পের ভিন্নতর এক নাগরিকত্ব; আরও ভিন্নতর তাঁর নগর পরিভ্রমণ-নান্দনিকতা। সেই নগরের নাগরিক উপাদান; দৃশ্যাবলীর সৌন্দর্য ও ভাষার রহস্যময়তা এবং তাঁর পর্যবেক্ষণ এতটাই অভিনব যে, আবিষ্কারের মোহে আজও আমাদের ইউটোপিয়ার দিকে নিয়ে যায়। শুদ্ধ নাগরিক সত্ত্বার কল্পনাগুলো ব্যপ্তির স্মৃতির মধ্যে ডুবিয়ে রাখে। যেন ব্যতিক্রমী সেই আকর্ষণ-উত্তাপ উজ্জ্বলতা।
সেদিন কেবল কবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাঁর কবিতার নয়, আমার দুর্বোধ্যতা আবিষ্কার করেছিলাম। কবির ঘরের অজস্র পঙ্ক্তির মৃদুগুঞ্জন—সিম্ফনি শুনতে-শুনতে তাঁর বহু কবিতার—মুখস্ত পঙ্ক্তিগুলো আমি সেদিন, কেন যে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার তন্দ্রায় স্বপ্নের জমাট ধরেছিল।
আজও কি অভূতপূর্ব সেই ছাত্র (ইউনিয়ন) রাজনীতির সঙ্গে। মিছিলের সঙ্গে। বক্তৃতার সঙ্গে। কবির একেকটি কবিতার অবিচ্ছেদ্য টান। যতবার পড়েছি তাঁর কবিতায় খুঁজে পেয়েছি অঙ্গীকারের সে ভাষা :
যখন শহরে ফাটে বোমা, হাতবোমা অকস্মাৎ
ফাটে ফৌজি ট্রাকের ভেতর,
মনে হয়, স্বধীনতা গর্জে ওঠে ক্রোধান্বিত দেবতার মতো।
বিশেষত, যখন দেশে স্বৈরাচারের শাসন এলো; তখন শামসুর রাহমান-নির্মলেন্দু গুণ ও মোহম্মদ রফিক—এই তিনজনের কবিতা পড়তাম অন্ধের ব্রেইল গ্রন্থের মতো—মন্ত্রধ্বনির মতন একেকটি শব্দ-অক্ষর ধরে ধরে—ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমিও বলতাম, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছি, এ আমার এক ধরনের অহঙ্কার।’
এইসব পঙ্ক্তির উচ্চারণগুলো গিলে ফেলতাম। চিরতার জলে তখনকার জ্বর সারলেও, এখনো শামসুর রাহমানের প্রতিটি কবিতার পঙ্ক্তিই আমার অফুরন্ত রোগের দাওয়াই।
শেষবার অসুস্থ কবির মুখোমুখি হয়ে, তার মুখের সরলতা খুঁজতে গিয়েছিলাম। অন্যভাবে। সেদিন কেবল কবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাঁর কবিতার নয়, আমার দুর্বোধ্যতা আবিষ্কার করেছিলাম। কবির ঘরের অজস্র পঙ্ক্তির মৃদুগুঞ্জন—সিম্ফনি শুনতে-শুনতে তাঁর বহু কবিতার—মুখস্ত পঙ্ক্তিগুলো আমি সেদিন, কেন যে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার তন্দ্রায় স্বপ্নের জমাট ধরেছিল। তখনো আমি কবির চেনাসব কবিতার মুখস্ত ছন্দের অক্ষরবৃত্ত ভুলে গিয়ে—মনে মনে কিছুই স্মরণে আনতে পারিনি। কিন্তু কেন? কেন? এমনটি ঘটল!
তবে, শামসুর রাহমানের কবিতার ক্রোধ-উদ্বেল ক্রমে আমার মধ্যে বুদবুদ ছড়িয়েছে। সে বিস্ময় আজ থেকে অনেক বছর আগেও যতটা গর্জেছিল, এখনো সেরকম ভীষণ স্ফুলিঙ্গ ছড়ায়। তাই, আজও কবির অভিনব চিত্রকল্প শুভ্র কাশের ঝাড়—‘রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।‘ যদিও এখন আর, আমার চিন্তায় বিচ্ছুরিত সেই আকাশ নেই। বিশ্বাসের ভগ্নস্তূপে—নির্মাণ-বিনির্মাণের নিয়ন্ত্রণ সূত্রে ফেলে, তবেই তো বাস্তবতার সিদ্ধান্ত মিলিয়ে নিতে হয়। তাহলে আমি কি শামসুর রাহমানের কবিতার সবচেয়ে ভালো পাঠক ছিলাম? না, মোটেই না ! তা হলে? সেদিন আমি তাঁর পয়ারের ধ্বনিগুলো এত সহজে ভুলে যেতে পারতাম না—বহুদূরে লোকালয় উন্মীলিত মাধবীর মতো।’