জীবনে প্রথম লেখক সম্মানী পেয়েছিলাম প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে গল্প লিখে। গল্পের শিরোনাম ছিল ‘মাছপ্রেমিকা’। তখন মফস্বলে থাকি। ঢাকা আসি যাই। হঠাৎ কী মনে করে একদিন প্রথম আলোর রিসিপশনে গল্প জমা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। তার দুই-এক মাস পর বেশ যত্নের সঙ্গে সে গল্প ছাপাও হলো। আমি তখন জানি দৈনিকে ছাপা মানেই পয়সাও পাওয়া যায়! ছাপার তিনমাস পর ঢুঁ দিলাম অ্যাকাউন্টে, দায়িত্বরত অ্যাকাউন্টেন্টকে বললাম লেখার বিষয় ও ছাপার সময়টা। ভদ্রলোক ফাইলের ভেতর চোখ রেখে বললেন, ওই মাসের হিসাব তো ক্লোজ! আমি কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। শুধু বললাম, আমি তো মফস্বলে থাকি,কিভাবে কখন বিল হয়, তাও জানি না! এ কথায় মনে হলো ভদ্রলোক সদয় হলেন। বললেন, ও আচ্ছা তাহলে পাবেন। দাঁড়ান দেখছি। পাঁচশ টাকার চকচকে একটা নোট ততক্ষণে আমার হাতে। না পাওয়ার পাল্লাই যেখানে ভারী ছিল, সেখানে এই প্রাপ্তির আনন্দ তখন দেখে কে!
এরপর সংবাদে কবিতা ছাপা হলো। অ্যাকাউন্টে খোঁজ নিলাম, বিল-টিল হলো কি না। অ্যাকাউন্টের ভদ্রলোক আমি লেখার সম্মানীর জন্য এসেছি শুনে একটু বিচলিত। ঢোকও গিললেন মনে হয়। এরপর পরামর্শ দেওয়ার মতো করে বললেন, সাহিত্য সম্পাদককে বলেন। তার সঙ্গে কথা হয়নি? আমি বললাম, না ওনার সঙ্গে কথা হয়নি। সম্পাদককে বলার পর তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারলেন না। শুধু আমার নামটা দু’বার উচ্চারণ করলেন! পরে বুঝলাম এই সম্মানী চাওয়াও বিড়ম্বনা! সাহিত্য সম্পাদক তখন ওবায়েদ আকাশ।
ভোরের কাগজে আমার কবিতা প্রায় প্রায়ই ছাপতেন তখন অশোকদা। অশোক দাশগুপ্ত। ওই কাগজ লেখকদের বিলটিল দিতে পারত না। লেখা ছাপার পর যেটা হতো অশোকদা বাংলামটরের সোনার তরী টাওয়ার (ভোরের কাগজ তখন ওই টাওয়ারেই)থেকে নিচে নেমে এসে লেখক-আপ্যায়ন করতেন সাধ্যমতো। সেক্ষেত্রে সম্মানীর দায় কিছুটা হলেও কমত বৈকি!
যুগান্তরে লিখেছি অনেকদিন। সাময়িকীতে মাঝে-সাঝে কবিতা ও গল্প। কবি মারুফ রায়হানের হাতে ছিল তখন প্রকাশের ভার। আর নিতুপূর্ণা তার ‘বই নিয়ে একপৃষ্ঠা’য় আমার বই নিয়ে আলোচনাগুলো ছেপেটেপে অ্যাকাউন্টে ধার্যকৃত সম্মানীর লিস্ট পাঠিয়ে দিতেন। একটু ফুলেফেঁপে উঠলে অংকটি আমি কখনো হাতে নিয়ে গেছি চেক, কখনো ডাকে পেয়েছি। একটি বই নিয়ে লিখলে তখন পাঁচশ টাকা। কবিতায় তিনশ /চারশ টাকা, তখনকার হিসেবে মন্দ কি! সম্মানীর টাকায় গরম-গরম পরোটা আর ডিম মামলেট!
আর একটু বইয়ের দোকানে ঢুকে সাহস করে বই কেনাটাও হয়ে যেত! কখনো নতুন শার্ট!
মনে আছে লেখক সম্মানী দিয়ে একবার একটি হ্যান্ডসেটও কিনেছিলাম! অধুনা বিলুপ্ত দৈনিক ডেসটিনিতে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তখন সদ্য জয়েন করেছেন ফেরদৌস মাহমুদ। আমার গল্প তিনি সমানে ছাপলেন। ডেসটিনির সপ্তডিঙার জন্য বেশ ঘোরের ভেতর থেকে একটি গল্প লিখেছিলাম। শামসুর রাহমান তখন সদ্য প্রয়াত, গল্পটি তাঁকে নিয়েই। তবে দয়িতার স্মৃতিতে কবি কিভাবে জীবন্ত হয়ে ওঠেন কিংবা থেকে যান, তাই ছিল গল্পের বিষয়। গল্পের নামটি ছিল অনেকটা এরকম ‘কবিদয়িতা ও ফাউন্টেন পেন’। মনে আছে গল্পটি ছাপার পর অনেক জায়গা থেকে ফোনও পেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় গল্পটি আমার সংগ্রহে নেই। তো যাই হোক, ডেসটিনিতে বেশ কিছু গল্প ও কিছু কবিতা ছাপার বিল একসঙ্গে হলো আড়াই হাজার টাকার মতো! সেই টাকায় নতুন হ্যান্ডসেট, আহা কি শান্তি আকাশে-বাতাসে! পরে শারমিনুর নাহার একদিন ফোন দিলেন চেক নেওয়ার জন্য। তিনিও ওই একই জায়গার (সাহিত্য পাতা সপ্তডিঙা) দায়িত্ব পেয়েছিলেন পরে। কবে-কবে লিখেছিলাম তারই আরেকটা চেক। শারমিনুর নাহার থাকতে খুব সম্ভব আমি ডেসটিনিতে কিছু লিখিনি। ডেসটিনি তখন ভেঙে-ভেঙে চেক করত। অথচ একবারে সব লেখার সম্মানী বাবদ একটা চেক হলে প্রতিষ্ঠানের এমন কী ক্ষতি হয়, যা আমার মাথায় ঢোকে না। বরং সে টাকাটা লেখকের বইপত্র কেনাকাটায় দারুণ কাজে লাগে!
একবার খুব অর্থকষ্টে পড়েছিলাম। তখন মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো একটা চেক পেলাম বিটিভি থেকে। তার মাস চারেক আগে বা একটু-ওদিক হতে পারে, সময়টা ঠিক মনে নেই, বিটিভিতে নিজের দীর্ঘ কবিতা পড়েছিলাম, তারই সম্মানী বাবদ এই চেক। বিটিভির ওই অনুষ্ঠানটি তখন আমিনুর রহমান সুলতানের গ্রন্থনায় নিয়মিত হতো। আমি তখন ভ্রাম্যমাণ,পরিবেশ ভালো না লাগলে বাসা ঘন-ঘন চেঞ্জ করি। আমার ঠিকানা তাই দিয়ে রেখেছিলাম ইত্তেফাক অফিসের (তখন ইত্তেফাক মতিঝিলের কাছে। ইত্তেফাক মোড় বলে যে জায়গাটি আছে ওইখানে।)প্রযত্নে ছিল ঔপন্যাসিক মঞ্জু সরকারের নাম। মঞ্জু ভাই হুট করে একদিন ফোন দিয়ে বললেন, অথির তোমার নামে একটি সরকারি চিঠি আছে। এসে নিয়ে যাও! আমি প্রথম বুঝতে পারিনি সরকারি চিঠি আমার নামে! পরে হঠাৎ মনে হলো বিটিভির কথা! উড়ে গিয়ে সে চেক নিয়ে এলাম! বিপদে খুশির হাওয়াবাহী ওই চেক! মঞ্জু ভাই না জানালে হয়তো জানতামই না সে চেকের কথা। ততদিনে ইত্তেফাকের অফিসও চেঞ্জ! ইত্তেফাক মোড় থেকে কাজলায় স্থানান্তরিত। কিন্তু আমার চেক মতিঝিলের ঠিকানায় হলেও কাজলায় নতুন ঠিকানায় ঠিক ঠিক পৌঁছে গেছে!
সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে ভালো গদ্যের অভাব সবসময়ই। আর ফায়-ফরমায়েশি লেখাগুলোতে একটু ফাঁকিও কি থেকে যায় না? একাডেমিক আর মননশীল রচনা এক হতে পারে না। ফরমায়েশি লেখা আমাকেও যে লিখতে হয়নি তা বলব না। তবে লেখার পুরো বিষয় উঠিয়ে আনাটাও একটা কাজ বটে! বিচ্ছিন্নভাবে তখন কিছু গদ্য এদিক-ওদিক লিখছি। জনকণ্ঠে আগে লিখলে নাকি সম্মানী পাওয়া যেত। আমি যখন লেখা শুরু করেছি সম্মানী-টম্মানী বলে যে একটা ব্যাপার আছে, তার টিকিটিও দেখলাম না। সেটা ২০০৭/০৮ সালের দিকে। এরইমধ্যে হঠাৎ শুনলাম জনকণ্ঠে কবিতার বিল নাহলেও গদ্য লিখলে বিশেষ ব্যবস্থায় বিল করে দেবেন সাহিত্য সম্পাদক। সাহিত্য সম্পাদক মামুন রশীদকে তখন কিছু টাটকা গদ্য দিলাম এবং মামুন ভাই বিলও করলেন। তার কিছুদিন পর হঠাৎ দেখি সে চেকের ভ্যালিডিটি টাইম চলে গেছে। ওই চেকটি তখন আমার কাছে ঠেকল রীতিমতো করুণ ও নিষ্প্রাণ। আমার বেশ অস্বস্তি হলো। চেকটি ছিঁড়ে ফেলতেও ইচ্ছে করলো! এ রকম বিড়ম্বনা কদিন আগেও হলো বাংলা একাডেমির ‘উত্তরাধিকার’-এর চেক আনতে গিয়ে! আমার টাইম আর চেকের টাইম যে একসাথে দৌড়ায় না! চেক ভ্যালিডিটি টাইম চলে যাওয়া মানে আপনার পকেটশূন্য অবস্থা হলে ভুক্তভোগী মাত্রই জানবেন সেটা মনের জোরও কমিয়ে দেয়।
সমকাল ও ইত্তেফাকের সম্মানী নিয়ে না হয় নাই লিখলাম বিশদে। তারা যে কবে কখন বিল করে, সেটাও স্পষ্ট নয় আমার কাছে। সমকাল চার মাস পর একটা চেক ইস্যু করলো আমার নামে, সেটা আবার কবিতার বিল। আর ইত্তেফাক থেকে একদিন হঠাৎ ফোন পেয়েছিলাম আমার ঠিকানা চেয়ে। এর ক’দিন পর একটি হলুদ খামে প্রেমের চিঠির মতো দক্ষিণা এসে পৌঁছালো আমার কাছে। কোন্ লেখার জন্য? আর কোনো চেক হবে কি না? পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময়! আমি মনে মনে বললাম লেখক সম্মানী আমাকে গিয়ে আনতে হয়নি সেটাই বা কম কী?
তবে একইসঙ্গে আনন্দিত ও সারপ্রাইজড হওয়ার ঘটনাও আছে। ভীষণ নাকাল অবস্থায় কালি ও কলম অফিসে একবার ফোন দিয়েছিলাম, তার মাসখানেক আগে কালি ও কলমে একটা বুক রিভিউ বেরিয়েছিল আমার। এই ভরসায় ফোন। সম্মনী পাব কি না, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নই। কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করা হলো কোন মাসে লিখেছি। আমি আগের মাসের কথা উল্লেখ করতেই বলা হলো, আসুন। কালি ও কলম ক্যাশ দেয়। রেজিস্টার্ড খাতা খুলে আমার নাম ও লেখার বিষয় দেখে ওখানের একজন ভাউচার এগিয়ে দিলো আমার দিকে। আমি ভাউচারে সিগনেচার করতেই সাড়ে সাতশ টাকার চকচকে নোট ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। আমি প্রথম বুঝিনি। ভাবলাম ভুল করে আড়াইশ টাকা বেশি এলো কি না। পরে জানলাম ওরা গদ্যের বিল বাড়িয়েছে। অথচ কী অবাক কাণ্ড, ওখানে যাওয়ার আগে আমার মন বিল বাড়ানোর ব্যাপারে সুপারিশ করেছে, আর কর্তৃপক্ষ তা টের পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই, নইলে এমন কী করে হয়!
তবে এখন পর্যন্ত একবারই কবিতার জন্য অগ্রীম সম্মানী পেয়েছি। এক হাজার টাকা নগদ! একুশের কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী স্মারকগ্রন্থের জন্য কবিতা লিখেছিলাম, যা সম্পাদনার ভার ছিলো ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের হাতে।
সর্বশেষ লেখক সম্মানী ‘সাম্প্রতিক দেশকাল’ থেকে এলো। সেটাও ক্যাশ! ওই পত্রিকার সাহিত্য পাতা দেখেন সৈয়দ শিশির। শারীরিক উপস্থিতিতে অপারগ যারা, তাদের লেখক সম্মানী বিকাশযোগে নাকি পাঠানো হয় ওই পত্রিকা থেকে! নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ! লেখকদের লেখায় সাহিত্যপাতাগুলো সচল থাকে সারাবছর, সেই লেখক সম্মানীতে পত্রিকাগুলো কার্পণ্য করবে না আশা করি! তাহলে সম্পাদক ও লেখক সম্পর্কও থাকবে মধুর বৈকি! বাণিজ্যিক পত্রিকার জন্য উচিত হবে ভালোবাসার ইন্ধন জুগিয়ে এই সম্পর্কে জিইয়ে রাখা!