তখন শহীদবাগে থাকি। দুই চৌকিতে মেসের বাসিন্দা পাঁচজন। গার্ডিয়ান হিসেবে আছেন আমার ফুপাতো ভাই মোস্তফা। মেসের পরিচালকও তিনি। কাকে মেসে তুলবেন, কাকে নামাবেন, সেটা তার এখতিয়ার। আমরা তার কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিলাম। গাদাগাদি করে থাকলেও ব্যাচেলর জীবনে খরচ কমানোর জন্য এ ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। জগন্নাথে ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাবলিক লাইব্রেরিতে কাটাই। শুধু রাতের খাবারটা মেসে বরাদ্দ রাখি। গভীর রাতপর্যন্ত আড্ডা দিয়ে যে যেখানে পারি শুয়ে পড়ি। ফ্লোরিং করলেও ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। বড় উপভোগ্য সময় ছিল সেটা। সময়টা ছিল কবিতারও। ঠিক কবিতার বলা যাবে না। বরং কবিতার হাতেখড়ি। আল মাহমুদ পড়ছি। পড়ছি জয় গোস্বামী। আর তিরিশের কবিদের ওপর আলোচনা পড়তে পড়তে বাংলা কবিতার এই ঋদ্ধ সময়টা বুঝতে চেষ্টা করছি আপ্রাণ। মেসে সিট খালি হলে কালাম ভাই নামে একজনকে জায়গা দিলেন মোস্তফা ভাই। বাড়ি নোয়াখালী। মেসের ভাড়া ও মিলের টাকা চাইলে তিনি গড়িমসি করতেন। মাঝেমধ্যে কাঁদতেনও। বিশেষত রাতে শুয়ে-শুয়ে। আমাদের সবার ধারণা ছিল, এটা তার ভান। কিন্তু হৃদ্য তৈরি হলে বুঝলাম সবটা তার ভান নয়। একটা বেদনাবোধ তাকে তাড়া করে। তার ভাষ্যমতে তিনি নিঃসন্তান। কোনো ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। সন্তান না থাকার কারণে দুঃখে ভারাক্রান্ত তার জীবন। জীবনের বহু চড়াইউৎরাই পার হয়ে এখন প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় আছেন। মেয়র হানিফের দারুণ ভক্ত কালাম ভাই। তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ভাগ্যান্বেষণ করছেন বলে জানালেন। আমি কবিতা লিখি বলে ভালো কদর করতেন। বলতেন, তার বেদনার কথা আমার কবিতায় উঠে এলে বিখ্যাত কবি হয়ে উঠবো আমি। অনেক রাতে মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে রিকশা দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। একবার পল্টনে একটা হোটেলে নিয়ে গেলেন। একজন সুদর্শন হোটেল বয়কে দেখে বললেন, মালটা হ্যাভি না? দেখতাম কিশোর বয়সী ছেলেদের ব্যাপারে তার ভীষণ আগ্রহ। হঠাৎ হঠাৎ দুই-একজন সুন্দর বালক নিয়ে মেসে আসতেন। এরকম নিরীহ বাচ্চাদের সঙ্গে তার সখ্য দেখে আমার অন্য রকম সন্দেহ হতো। কিন্তু সন্দেহ প্রমাণের সুযোগ ছিল না। তো একদিন তিনি তার বেদনার কথা জানালেন। আট-দশ বছর আগে সংসদ ভবনের সামনে থেকে সাত/আট বছরের এক বাচ্চাকে তিনি কুড়িয়ে পান। কোনো কারণে বাচ্চাটি মা-বাবার সঙ্গে অভিমান করে চলে এসেছে। ধনী ঘরের সন্তানই হবে। সে আর ফিরতে চায় না। ফলে ঠিকানাও বলে না। নিঃসন্তান কালাম ভাই ছেলেকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেন। কওমি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করান। কিন্তু এখন ছেলেটির বয়স যখন ১৬/১৭; তার বাবা-মা কোনোভাবে ছেলেটির সন্ধান পেয়ে তাদের কাছে নিয়ে যান। ধনীর দুলাল ওই ছেলেটিকে তার বাবা-মা কালাম ভাইয়ের কাছে আর ফেরত দিতে চান না। কালাম ভাই ছেলেটির সঙ্গে যোগাযোগ করতেই ঢাকায় থাকছেন। তার বিশ্বাস, ছেলেটি তার সঙ্গেই ফিরবে। একদিন প্রাইভেট কারে ১৬/১৭ বছরের এক ছিমছাম দেহের সুদর্শন যুবক এলো। বেশ লম্বা। পরনে পাঞ্জাবি-পাজামা। মাথায় টুপি নেই অবশ্য। ভালোই স্মার্ট। সমস্ত অবয়বে আভিজাত্য। কালাম ভাই তাকে ভালো আপ্যায়ন করালেন। খুব কথা বলতে দেখলাম না যুবক ছেলেটিকে। আমি ছেলেটির সঙ্গে কালাম ভাইয়ের সম্পর্ক জড়িয়ে খারাপ ইঙ্গিত করেছিলাম। এতে ভালো মাইন্ড করেছিলেন কালাম ভাই। বলেছেন এই যুবকটিই সেই কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে। তিনি মানুষ করেছেন। এখন তার হাতছাড়া হলো। সেই দুঃখে তিনি কাঁদেন। একবার হলো কী, মেসের বিল দিতে দেরি হলো আমার। আব্বা যে টাকা পাঠিয়েছিলেন, তা শেষ করে ফেলেছি। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কালাম ভাই বুঝতে পারছিলেন। রাতে টেবিলের সামনে ঝিম মেরে বসে আছি চেয়ারে। হঠাৎ কালাম ভাই প্রস্তাব করলেন তার দুঃখের কাহিনী নিয়ে একটা কবিতা যদি লিখে দেই, তিনি আমাকে তৎক্ষণাৎ পঞ্চাশ টাকা দেবেন। আমিও সুযোগটা লুফে নিলাম। দুই-একদিনের হাত খরচটা তো হবে! ঝোঁকের মাথায় তড়িঘড়ি করে বসে পড়লাম কবিতা লিখতে। আধঘণ্টা সময় লেগেছিল। পুরো কবিতাটা নামাতে। কালাম ভাই কথা রেখেছিলেন। তবে টাকা পেয়ে নয়, আমার ভালো লেগেছিলো এজন্য যে, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের মধ্যে একটা কবিতার জন্ম হয়েছিল। বাস্তব সত্যের সঙ্গে কাব্যিক সত্যের ফারাক যতই থাকুক, একজন মানুষের বেদনাকে অবলম্বন করতে পেরেছিল এই কবিতা। কবিতার চেয়েও ওই বেদনাকে মহৎ জানি আমি। কবিতার নাম ‘কুকুরীর জন্য সংবেদনা’। আমার লখিন্দরের গান কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত আছে কবিতাটি।
অনেকটা সিনেমার মতো ঘটনা। কুড়িয়ে পাওয়া ওই ধনীর দুলালের সঙ্গে কালাম ভাইয়ের সম্পর্ক নিয়ে এখনো আমার মনে রহস্য কাটেনি। যে কাহিনী কালাম ভাই বর্ণনা করেছেন, তার সত্যতা যাচাইয়ের আগ্রহ বা সুযোগ কোনোটাই আমার ছিল না। একটি কবিতার জন্মবৃত্তান্ত হিসেবে এই উপাদেয় ঘটনাটি আপ্লুত স্মৃতি হয়ে আছে। দুই-এক মাসের মধ্যেই কালাম ভাই মেস ছেড়েছিলেন। তারপর বেশ কয়েক বছর দেখা হয়নি তার সঙ্গে। কিন্তু মাস্টার্স ডিগ্রি পরীক্ষার পরপর বা আগে আগে ফার্মগেটের ওভার ব্রিজের সিঁড়িতে দেখা হলো তার সঙ্গে। আমি তাকে দেখিনি। কালাম ভাই আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরেছিলেন। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আমার ওই কবিতার মুখস্থ কয়েকটি লাইন তিনি শুনিয়ে দিলেন:
আঘাতে আঘাতে মানুষ দস্যু হয়ে যায়।
চিতই পিঠার মতো জালি জালি কলিজায়
রক্ত ফিনকি দিয়ে ওঠে তার।
বুকের গহিনে অদৃশ্য চুলোয় স্বপ্নরে পুড়ে দেয়
যে স্বৈর দহন,
তারই বিধ্বস্ত পাড়ে পড়ে থাকে একাকী
জ্বলন্ত অঙ্গার মানুষ।অতঃপর আবুল কালাম
আরেক উদ্বাহু স্বপ্নের কোলে ঘুমোতে চায়।
হতচকিত হয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বললেন, পৃথিবীটা গোল। আবার দেখা হবে। পেছন থেকে এত ডাকলাম, কালাম ভাই, কালাম ভাই। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। ফিরে তাকালেন না।
দুই.
আমার অনুজ প্রতিম বন্ধু হারাধন। অল্প বয়সে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতো। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় আমার দুই-একটা নাটক কলেজের মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল। সেখানে চরিত্রের প্রয়োজনে ওকে দিয়ে ছোটদের অভিনয় করাতাম। যখন অনার্সে পড়ি, তখন হারাধন সেই অর্থে আর ছোটটি নেই। সম্ভবত অনার্সের মাঝামাঝি সময়টা। পূজার ছুটিতে বাড়ি এসেছি। হারাধন তখন কলেজে পড়ে। সাংস্কৃতিক জগৎ ছেড়ে দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। রাস্তায় দেখা হলো ওর সঙ্গে। বললো, দাদা, আজ এক জায়গায় নিয়ে যাবো আপনাকে। একজনের বাসায়। প্রথমটায় অনাগ্রহ দেখালেও পরে রাজি হয়ে যাই। যে-মেয়েটির বাসায় সে আমাকে নিয়ে গেলো, তার নাম অশোকা। যে-ঘরে আমাদের বসতে দিলো, সেই ঘরের সামনের আঙিনায় একটা শিউলি ফুলের গাছ ছিল। কিছু সাদা ফুল ছড়ানো ছিল মাটিতে। ঘরের মধ্যে মৃদু ঘ্রাণ টের পাচ্ছিলাম আমি। আপ্যায়নের জন্য মুড়ির মোয়া, নারকেলের লাড্ডু এবং আরও কী সব নিয়ে যেন ঘরে ঢুকলো অশোকা। শ্যামলা মতো এই মেয়েটির মুখের মধ্যে কি এক মায়া যেন ছড়ানো ছিল। দেখে আমারও ভালো লাগলো। সে বললো, দাদা, আপনি আসাতে খুব খুশি হয়েছি। ওর মুখে মুচকি হাসির রেশ দেখে নাড়া লাগলো মনে। দেখলাম হারাধন ফিসফিস করে কথা বলছে অশোকার সঙ্গে। একটা চাপা আমুদ খেলা করছে উভয়ের মনে। বুঝলাম ওরা পরস্পরের প্রেমে পড়েছে। হয়তো বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাপারটা চলছে। অতটা গোপনও বোধহয় নেই আর। লাড্ডু খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি ওদের দেখছিলাম আর ঈর্ষায় জ্বলছিলাম খুব। হারাধনের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতেই ভালো লাগছিল তখন। কিন্তু তা তো হওয়ার জো ছিল না। অবুঝ মনে কত কিছুই যে খেলছিল! মনে মনে একটা কবিতা ফাঁদলাম। সৃষ্টি চেতনায় খুব আনন্দ হচ্ছিলো আমার। বাসায় এসে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নামিয়ে ফেললাম কবিতাটি। কী নাম দিয়েছিলাম মনে নেই। বই করার আগে নাম পরিবর্তন করে রাখলাম ‘জলবিদ্রূপ’। কবিতাটি লেখার পর সাত আট মাস আর হারাধনের সঙ্গে দেখা হয়নি। সম্ভবত ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে হারাধনের খোঁজ করলাম আমি। খবর শুনে অদ্ভুত লাগলো আমার। হারাধন নাকি নেশা টেসা করে এখন। কেন সে নেশা ধরলো তার বিশদ কারণ কেউ অবশ্য বলতে পারলো না। সহসা দেখাও হলো ওর সঙ্গে। দেখলাম মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুল বড় বড়। কিন্তু নেশা করলে শরীরে যতটা ভাঙন ধরে ওরকম তীব্র কিছু মনে হলো না। হারাধনকে কবিতাটা শুনালাম। কিন্তু বিশেষ কোনো ভাবান্তর হলো না ওর। অশোকার কথা জিজ্ঞেস করলাম। ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। পরে ওর এক আত্মীয় বা বন্ধুস্থানীয় কেউ আমাকে জানিয়েছিল, অশোকার সঙ্গে হারাধনের বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়েছিল। কিন্তু মাস দু’য়েক আগে ব্রেন টিউমারে মারা গেছে অশোকা। আমি থ মেরে গেলাম। অশোকার আপ্যায়ন আর হাসিমাখা ওই কথাটা মনে পড়লো আমার, দাদা, আপনি আসাতে খুব খুশি হয়েছি।
হারাধনের সঙ্গে বহু বছর দেখা নেই। মাঝখানে একবার শুনেছিলাম সে ভারত চলে গেছে। সে ফিরেছে কি না, বা আদৌ তার ফেরা হবে কি না, আমার জানা নেই। কাউকে নিয়ে কবিতা লিখতে গেলেই এখন আমার ভয় হয়। যদি সে মরে যায়?
তিন.
তখন মাসুদ আমার ভ্রমণসঙ্গী। আমাদের থানা এলাকায় যে গ্রামগুলো আছে তা চষে বেড়ানোই আমাদের কাজ। পায়ে হেঁটে নয়, ভ্যান রিকশায় চড়ে। নতুন বাজার থেকে ভ্যান নিয়ে খিলগাতি, খেরুয়াজানি পার হয়ে দাপুনিয়া বাজারের সামান্য আগে ভ্যানওয়ালাকে বললাম বাঁ দিকে মোড় নিতে। ওটা ছিল কাঁচা রাস্তা। চারদিকে ধানী জমিন। ধানে শীষ ফোটেনি তখনো। ফসলে ঢেউ তুলছিল বিপুল বাতাস। আমার মনে হচ্ছিল চরাচরে সবুজ ছাড়া আর কিছু নেই। আরও মনে হচ্ছিল জীবনকে এইভাবে চলমান রাখতেই বোধহয় আমার ভালো লাগে। ঠিক চলমান নয় বরং বলা চলে ভাসমান। সবকিছু ছুঁয়ে যাচ্ছি কিন্তু স্থিত হচ্ছি না কোথাও। কিন্তু কী ছুঁয়ে যাচ্ছি? প্রকৃতি? না কি জীবন? এইসব ভাবনার কোনো কুলকিনারা হচ্ছিল না। ইতোমধ্যে সুতিয়া নদীর পাড় ঘেঁষে শষ্যমালা গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো ভ্যান। সুতিয়া নদী কেবল নামেই নদী। সরু খালের আকৃতি পেয়েছে এখন। ওখানেও খালের পাড়ের নিচের দিকে কৃষকেরা ধান বুনে রেখেছে। শষ্যমালা বাজারে এসে মনে হলো এটি একটি প্রগৈতিহাসিক বাজার। কেন মনে হলো বলতে পারবো না। বাজারের ভেতরকার আবহ এমনটাই বোধহয়। মনে হচ্ছিল একটা বিচ্ছিন্ন পরাবাস্তব জায়গায় এসে পড়েছি আমরা। ভ্যান-রিকশা ছেড়ে দিয়ে পায়ে হাঁটা দিলাম আমরা। মনে পড়ছে সুতিয়া নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কবি তানভীর রাতুলের ফোন পেলাম। রাতুল ইংল্যান্ড থাকে। লাস্টবেঞ্চ নামের একটা লিটলম্যাগ সম্পাদনা করে সে। ওর নিজের প্রকাশনির নাম অ্যান্টিভাইরাস। অ্যান্টিভাইরাস থেকে আমার লখিন্দরের গান-এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছে রাতুল। সে যাই হোক, হাঁটতে হাঁটতে বৃক্ষবেষ্টিত এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলাম মনে হলো ছোটখাটো একটা বনজ অঞ্চল। একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুলও চোখে পড়লো। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের কলরব শুনতে পেলাম না। শুধু একজন কম বয়সী সুন্দরী ম্যাডামকে দেখলাম স্কুলের আঙিনায় দাঁড়িয়ে খোঁপায় ফুল গুঁজে দিচ্ছেন। একটি কবিতার জন্মের জন্য ওই সামান্য রোমান্টিক আবহই যথেষ্ট ছিল। ভ্রমণের পরের দিন কবিতাটি নামিয়ে ছিলাম। ‘শষ্যমালা’ বানানটা নিজের মতো পরিবর্তন করে লিখে নিয়েছিলাম ‘শস্যমালা’। বেশ কয়েক বছর পরে আমি ওই গ্রামে আবার গিয়েছি। কিন্তু বৃক্ষের এত সমারোহ চোখে পড়েনি। খুঁজে পাইনি ওই সুন্দরী ম্যাডামকেও। অশ্রুপার্বণ কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত শস্যমালা কবিতায় পাঠক হয়তো খুঁজে পাবেন। এই কবিতার স্মৃতির সমর্থনে আমি কিন্তু আজও বলে উঠি: আহা নারী! আমাকে ছোবল দাও।
কুকুরীর জন্য সংবেদনা
আঘাতে আঘাতে মানুষ দস্যু হয়ে যায়।
চিতই পিঠার মতো জালি জালি কলিজায়
রক্ত ফিনকি দিয়ে ওঠে তার।
বুকের গহিনে অদৃশ্য চুলোয় স্বপ্নরে পুড়ে দেয়
যে স্বৈর দহন,
তারই বিধ্বস্ত পাড়ে পড়ে থাকে একাকী
জ্বলন্ত অঙ্গার মানুষ।
অতঃপর আবুল কালাম
আরেক উদ্বাহু স্বপ্নের কোলে ঘুমোতে চায়।
ঔরসের রক্তের মতো যে ছিল আপন,
জান্তব পুরুষের টানে ছেড়ে গেছে বহুদিন।
খান খান হৃদয়ের পাতে অশোধিত ঋণ কিছু রেখে গেছে সে।
ঐন্দ্রজালিক সময়কে যে মানে বান্ধব
উতরোল কান্নায় কে ফেরাবে তারে?
তবুও তো মনিবের আড়ালে গেলে নিরীহ পশু
কর্কশ চিৎকারে মমতার স্বকীয় চিহ্ন রাখে;
প্রেমের গলিত লালার ওপর অমির সৌরভ রেখে
মানুষ মানুষকে ছেড়ে যায় দ্ব্যর্থহীন।
তবুও আশা থাকে—
বেদনার বিমূর্ত কফিনে লা-ওয়ারিশ কুকুরীর মতো
নির্বেদের আঙিনায় যদি সে ফেরে।
আবুল কালাম!
মানুষের কলিজা নিয়ে ধাপ্পা খেলে যে নিষ্ঠুর,
অন্তহীন অঙ্কের অকূলপাথার নিয়ে
উদ্ধত যৌবনে তারও পড়ন্ত বিকেল নামে।
প্রেমের বিনয়ী জল হাতে পরিপূর্ণ মাটির বাসন—
অপেক্ষা করে সে।
প্রাণের কুকুরী, আহা, আপন মানুষ
যদি ফিরে আসে…
জলবিদ্রূপ
কোয়েলের ডিমের খোসায় কালো কালো ফুটকির মতো
স্পষ্টতর সন্ধ্যা ছিলো।
শিউলির গন্ধভরা ভেজা বাতাস ছিলো
আরও ছিলো ভালোবাসার মেরুন দ্রবণ—
অশোকার আলতো হাতে গড়া বিবিধ লাড়ৃর
মৃদু আপ্যায়নে।
অশোকার আনাড়ি প্রেমিকও পাশে ছিলো কাল।
অর্থহীন কথার তোড়ে ঠোঁট দুটো ভারী ছিলো প্রেমিকের।
তবু এক নিগূঢ় মায়ায়
অলৌকিক টান বুঝেছিলো অশোকা প্রেমিকের দিকে।
নবীন আগন্তুক আমি স্থবির বিন্দুর মতো বিছানায় ছিলাম বসে।
হঠাৎ এক দুর্বোধ্য শয়তান প্রাচীন কাক হয়ে হৃদয়ে ঠোকর দিলো।
প্রতিপক্ষ মরা কাক নিস্তেজ পড়েছিলো পাশে?
তবে কি আমিও প্ররোচিত হয়েছিলাম কাবিলের মতো আদিম ঈর্ষায়?
বোনের লোভে জ¦লে উঠেছিলাম পৃথিবীর প্রথম হন্তারক?
এই লোভ, এই ঈর্ষাও প্রচ্ছন্ন ভালোবাসা ছিলো কাল সন্ধ্যায়,
দারুণ কৌতূহলে আগুনের পি- মুখে নেওয়া শিশু মুসার মতো অবুঝ।
কিংবা এ ছিলো হৃদয়ের শূন্যতায় শুধুই নিমগ্ন হতাশা আমার।
তবু এন্টার্কটিকার আচ্ছন্ন বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায়
অশোকা যখন বললো, দাদা, আপনি আসাতে খুব খুশি হয়েছি।
ব্যাঙের পেচ্ছাপ খেয়ে মুহূর্তেই নিভে গেলো অন্তরের বৈরী আগুন।
শস্যমালা
বাজারের নাম শস্যমালা
সুতিয়া নদীর পাশে অতনু দেহের মতো সাবলীল মানুষের ভিড়
তামাগলা সূর্যের সিথানে তবু অরণ্যশোভন এই নীরবতা খান খান ভেঙে যাবে আজ
সরব উত্থানে কোন্ উজ্জীবন
জড়িয়ে রয়েছে এই প্রাণের পেখম জনতার?
তেমাথায় গোল হয়ে সুতিয়া নদীর পাশে অভিলাষহীন?
পণ্যের জঠরে বসে কেউ বুঝি জাদুর দোলক শুধু দু’হাতে নাড়েন
চিলতে রোদের মতো প্রতিপাদ্য সোনার হৃদয় এখানে দারুণ বেচাকেনা হয়।
মনের ব্যঞ্জনে খুব শিখর ছুঁয়েছি বলে মানুষের
আজ বাঁশি হয়ে যাই; উড়ে আসি রঙিন ফানুস আমি হাওয়ায় হাওয়ায় পলাতক।
উলম্ব গতির দিকে মুখ করে প্রতিভায় জেগে আছে গগন শিরীষ
একটি সজনে গাছ, পাতা নাই, ডালে ডালে নিরীহ বিকেল
মনে হয় ভৌতিক কঙ্কাল, শুধু নিরন্ন আঙুলগুলো থাবা মেলে আছে।
পাঁচটি সতীর্থ পাখি এই মাত্র সহসা দুর্বার উড়ে গেল
জীবনের ভাঁজে ভাঁজে পরিবৃত স্বাধীনতা কোথায় লুকিয়ে থাকে এতটা সুলভ?
শুকনো নদীর বুকে ফসলের ঢেউ…
প্রতিবর্ণ সভ্যতার সবুজ আগুন বুঝি জল কেড়ে নিল!
সুবর্ণ কৃষক ছাড়া লোল অভিশাপ তবে কে বোঝে এমন?
বনেদি বাড়ির দিকে ওইযে মেয়েরা তাই গগনবিদারী সুখ, তবু
নিরুপায় একটি বেদনা শুধু আঁচলে বেঁধেছে।
আর বুড়ো বৃক্ষের কোটরে থাকা কুণ্ডুলিত সাপের মতন
অনন্য খোঁপায় তারা গুঁজে নিচ্ছে ফুল, সাদা জবা।
মোড়ল বাঁশের মতো আমার যৌবন কেন স্ফীত হয়ে যায়?
নিজেকে খরচ করে সজল ঋণের ভারে নুয়ে পড়ি।
আকাশ এখানে রোজ সহস্র মেঘের কুঁড়েঘর
হিমের কুন্তলে আজ জেগে আছে রমণী সুলভ।
আহা নারী! আমাকে ছোবল দাও,
সভ্যতা বিলীন করে অরণ্যবাসরে সমধিক নীলকণ্ঠ হয়ে উঠি।