আবৃত্তি একটি হৃদয়-সঞ্জাত মাধ্যম। মানুষ তার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির চর্চার মাধ্যমে কবিতা হৃদয়ঙ্গম করে। কবিতার শব্দ ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নেই। একটা গানে যেমন সুর-তাল-লয়ের বাইরেও বাদ্যের অলংকার আছে, নৃত্যে এসবের সঙ্গে আছে দর্শনধারী দেহবল্লরি, নাটকের বহু চমক—কবিতা তা নয়। এখানে কবি শব্দে-বাক্যবন্ধে যা বলেন, তাকে অনুভব করতে মস্তিষ্ক, চেতনা ও হৃদয় দিয়ে আরও গভীরতর দরোজাটি খুলতে হয়। সবার পক্ষে সেই দরোজা খোলা অথবা কবির অনুভূতি ধারণ ও প্রকাশ করা সহজ নয়। তবু আবৃত্তিশিল্পীরা সেই কঠিন কাজটি নিরন্তর করে যাচ্ছেন।
আবৃত্তিশিল্পীদের আমি ভালোবাসি। কেননা—তারা কবিতা ভালোবাসেন। কিন্তু ইদানীং একটি বিষয় আমাকে ভীষণই ভাবাচ্ছে, আর তা হচ্ছে—আবৃত্তিশিল্পীরা যে-সব কবিতা নির্বাচন করেন অথবা আবৃত্তির জন্যে বাছাইকৃত কবিতার সংকলন করেন—সেগুলোর একটি মোটা দাগের বৈশিষ্ট্য আছে। তা হচ্ছে—তাদের বাছাই করা কবিতা প্রয়াশ গল্প, সংলাপ, আখ্যাননির্ভর। তারা সেসব কবিতা তালিকায় তোলেন, যা সহজে দর্শক শ্রোতার সঙ্গে অন্বয় ঘটাতে পারে। আর এই কাজটি করতে গিয়ে তারা সমসময়ের বাংলা কবিতার বাঁকবদলের গতিপ্রকৃতিটি ধরতে পারেন না।
পাঠক হয়তো বলবেন—এই কাজ করার কী দায় তাদের? আমি বলবো—কিছুটা তো বটেই। কেননা—আজকের বাংলা কবিতা বাঁক বদলিয়ে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু আবৃত্তিশিল্পীরা সেই বিমূর্ত কল্পদৃশ্যের কবিতা বাছাই না করে এখনো রবীন্দ্র, নজরুল থেকে মধ্য আশির আখ্যাননির্ভর বিবৃত কবিতার মোহে আটকে আছেন (এমনকী একালে রচিত হলেও)। কেননা— সেইসব কবিতায় আখ্যান আছে, নাটকীয়তা আছে। সেজন্যে তারা আজকের নতুন কবিতা নির্বাচন করেন না। কিন্তু এতগুলো দশকে বাংলা কবিতা সম্পূর্ণভাবে না হলেও মোটামুটিভাবে তার খোলনলচে পালটে ফেলেছে।
তবে বাঁকবদলের আজকের কবিতা একেবারে নতুন টেক্সচারে পূর্ববর্তী বাংলা কবিতার ভাঙন, বদল, নতুন ও সম্প্রসারিত, জটিল ও সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর ধারা ধরে বহুদূর এগিয়ে একটি পরিপূর্ণ রূপে এসে দাঁড়িয়েছে।
কবিতা এখন তার ভাষা, আঙ্গিক, চিত্রকল্প, অলংকার—সব বদলিয়ে নতুন যাত্রায় এগোচ্ছে। এই যে অভিযাত্রাটা শুরু হয়েছিল নব্বই পরবর্তী সময়ে, আজ তা ব্যাপক ঔজ্জ্বল্যে কাব্যমঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বাঁকবদল, ভঙ্গি ও বচনের নবায়ন, ক্যামোফ্লাজের দৃশ্যান্তর জটিল ও বহুস্তরী। কবিতা এখন আর দৃশ্য বা বিষয় লেখে না। লেখে ভাবনাপুঞ্জ। ফলত সেখানে বিষয় আশয় থাকে বহু স্তরীয়, সূক্ষ্ম, গভীর, বিমূর্ত।
আজকের কবিরা তো এখন আর দৃশ্যকল্প লেখেন না, লেখেন ভাবনাকল্প। আর কল্পানুভূতিটি ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বহুধা বিভক্ত—যাকে দর্শকশ্রোতার মানসে চাক্ষুষীকরণ আবৃত্তিশিল্পীদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এইসব কবিতা নিভৃতপাঠের। প্রত্যেক নিভৃত পাঠই নতুন উপলব্ধিতে পৌঁছানোর। যদিও এই বাঁকবদলের ধারায় নতুন চিন্তা ও শব্দ বাহারে, কল্পদৃশ্যে উৎকৃষ্ট অথচ মঞ্চআভার কতক কবিতা যে রচিত হচ্ছে না, তাও নয়। তবে বাঁকবদলের আজকের কবিতা একেবারে নতুন টেক্সচারে পূর্ববর্তী বাংলা কবিতার ভাঙন, বদল, নতুন ও সম্প্রসারিত, জটিল ও সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর ধারা ধরে বহুদূর এগিয়ে একটি পরিপূর্ণ রূপে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্নটি এখানেই:
১। এই পরিবর্তন কি আবৃত্তিশিল্পীরা ধরতে পেরেছেন?
২। যদি ধরতে না-ই পারেন, তাহলে তাদের এবং দর্শকশ্রোতার গড্ডালিকা প্রবাহের কী হবে?
নতুনধারার কবিতাবঞ্চিত শ্রোতাদর্শগণ তবে কি জানবেনই না আজকের সাংকেতিক, ভাবনাকল্প, বহুস্তরী কবিতা?এই সমস্যাটি কিন্তু শিল্পীদেরও ভেতরে ভেতরে হচ্ছে! তারা আজকাল ছোট ছোট গল্পও আবৃত্তি করছেন! আমি এর বিপক্ষের নই। যেকোনো শিল্পই অবারিত উন্মুক্ত হোক নান্দনিকতায়। আমার শঙ্কাটা নিভৃত অন্তর্মুখী কবিতা নিয়ে—যা আবৃত্তির অনুপযোগী। এই যে দেশ জুড়ে এত এত আবৃত্তি সংগঠন, ভিজুয়াল আবৃত্তি—মনে কি করতে পারি কবিতার কদর বেড়েছে? যদি বাড়ে—তো কোন কবিতার? শ্রোতারা কি নতুন কবিকে, কবিতাকে চিনতে পারছে? তাহলে তো নতুন কবিতার বই শ’য়ে শ’য়ে বিক্রি হতো!
ভাবনা প্রকরণে, ভাষায়, কল্পদৃশ্যে, কৌশল ও কবিত্বে বিভাময় সেই সব কবিতা কিভাবে শ্রোতার কাছাকাছি নেয়া যায়—তা নিয়ে তাদের নিবিড় ভাবতে হবে। কেননা—কবিতা যুগে যুগে সময় ও সমাজের আত্মাকে ধারণ করে। সেটি অবশ্যই আবৃত্তিশিল্পী যিনি সত্যসন্ধ ও কাব্যপ্রণয়ী তিনি অনেক দ্রুত পৌঁছে দিতে পারেন মানুষের কাছে।
আবৃত্তি সংগঠনগুলো বা শিল্পীরা যে দৌত্য করেন শ্রোতার সঙ্গে তা কী অগ্রসর কবিতার স্বরটি পৌঁছে দেয়? না। যুগ যুগের মতো সমকালের প্রকৃত কবিতা জনপ্রিয়তাহীন দুর্বোধ্য হয়ে নদীর অতল জলের নিচে মুক্তোর মতো পড়ে থাকে।
আমরা যারা কবিতা লিখি—মঞ্চে পাঠের সময় তাই আমাদেরও শ্রোতাকে মাথায় রেখে ‘প্রায় সর্বজনবোধ্য কবিতা’ সাধারণ দর্শকের চিন্তা করে পাঠ করতে হয়। কিন্তু কবিতার একটি ঋদ্ধ সভায় আমরা সবচেয়ে ভালো কবিতাটিই পাঠ করি। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? সাধারণ শ্রোতার কাছে আমরা কবি আবৃত্তিশিল্পী নির্বিশেষে একই রকম। আমরা ব্যতিক্রম লিখলেও সেই ব্যাপক শ্রোতা ব্যতিক্রম নিতে পারছেন না। অনেক আবৃত্তিশিল্পী বলেন—বিখ্যাত অমুক কবির কবিতা আবৃত্তি করেছি।একটা কথা খুব পরিষ্কার—যিনি একসময় ভালো লিখেছেন, কিন্তু বেশ কয়েক দশকের কাব্যবদলে যাওয়ায় নিজেকে নবায়ন করতে পারেননি—তিনি কিন্তু সেই কয়েক দশক আগেই সব প্রতিভা নিয়ে থেমে গেছেন!
নতুন সময়ের স্বরকে তিনি চিনতে পারেন নি।এক সময়ের বড় কবি শেষদিকে আর যদি নিজেকে নবায়ন করতে না পারেন, তবে তিনি বড় থেকে ছোট না হলেও দশকের ভেতর হারিয়ে যাবেন। কোনো মই ছাড়াই কবিকে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দিয়ে বৌদ্ধিক হার্দিক কবিতা লিখতে হয়। সেই কবিতাকে নিয়ে কাজ করেন আবৃত্তিশিল্পীরা। কাজেই এই বিষয়ে তাদের প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। ভাবনা প্রকরণে, ভাষায়, কল্পদৃশ্যে, কৌশল ও কবিত্বে বিভাময় সেই সব কবিতা কিভাবে শ্রোতার কাছাকাছি নেয়া যায়—তা নিয়ে তাদের নিবিড় ভাবতে হবে। কেননা—কবিতা যুগে যুগে সময় ও সমাজের আত্মাকে ধারণ করে। সেটি অবশ্যই আবৃত্তিশিল্পী যিনি সত্যসন্ধ ও কাব্যপ্রণয়ী তিনি অনেক দ্রুত পৌঁছে দিতে পারেন মানুষের কাছে।