অর্ধযুগ আগে এইদিনে ঝরে গিয়েছিল একটি প্রিয়তম পাতা—কবি আপন মাহমুদ। আপন মাহমুদ—বোধকরি আমাদের সময়ের সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি। চলে গেলেন খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। বড্ড অসময়ে। অসময়—ব্যক্তি আপন মাহমুদের জন্য যাকে ঘিরে আরও কয়েকজন আপনজনের সুখ, অসময়—বাংলা কবিতার জন্য যখন ফাঁপা আর শব্দসর্বস্ব পদ্যে ভরে যাচ্ছে চারিদিক। চলে যাওয়ার দিনটি ১২ সেপ্টেম্বর। নিষ্ঠুরতম দিনগুলোকে আরও একটু দীর্ঘ করার কালো একটি দিন। এরকম নিষ্ঠুর দিন যেন কখনো না আসে।
আপন মাহমুদ কেন প্রতিভাবান কবি, কেনই বা প্রিয়কবি হয়ে ওঠেন তার সমসাময়িকে? এগুলোর সমান্তরালে কিভাবে হয়ে ওঠেন প্রিয় ব্যক্তি? প্রতিভাবান এজন্য যে তার সময়ের অন্যরা যা লেখেন, যেভাবে লেখেন, তিনি সে রকম বা সে রকমভাবে লেখেন না। প্রিয়কবি হয়ে ওঠেন—কারণ তার বোধ ও অভিব্যক্তিকে তিনি অন্যদের ভেতর বিপুলভাবে সঞ্চারিত করতে পারেন। এগুলোর সমান্তরালে তিনি প্রিয় ব্যক্তি হয়ে ওঠেন তার অমায়িকতায়, সহজতায়, নিজেকে রাজধানীর জটিল দলাদলি থেকে মুক্ত রেখে কবিতায় ও নিজ পেশায় আত্মনিবেদিতায়।
তিনি যে এত তাড়াতাড়ি বাস্তবের অতীত হয়ে যাবেন, এত তাড়াতাড়ি স্মৃতি হয়ে যাবেন আমরা কেউ ভাবিনি। আমরা কেউই ভাবিনি এভাবে তাকে মূল্যায়ন করতে হবে। লিখতে হবে অকাল প্রয়াত। তার প্রথম ও একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘সকালের দাঁড়ি কমা’ পড়ার পর সেলফোনে একটা খুদেবার্তা পাঠিয়েছিলাম। লিখেছিলাম, কবি, এগুলো কী লিখেছেন আপনি! এভাবে কেউ লেখে! আপনাকে জড়িয়ে ধরে যদি কাঁদতে পারতাম!’ কোনো ফিরতি বার্তা আসেনি। মন খারাপ করেছিলাম একটু। পরে ভেবেছিলাম এ আর নতুন কী? ব্যস্ততা তো আমাদের অনেক কিছুই কেড়ে নিচ্ছে। এটাও হয়তো বা তাই। কিন্তু না, আমার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে দুই দিন পর কবি নিজেই ফোন করলেন আমাকে। বললেন, আপনার এএমএসটা আমি অনেককে দেখিয়েছি। আমি বললাম, আমার বিবেচনায় আমাদের দশকের অন্যতম কাব্যগ্রন্থের জনক আপনি। বোধকরি শ্রেষ্ঠতম। তিনি হেসেছিলেন অনেকক্ষণ। বলেছিলেন, ‘কই, কেউ তো এভাবে বলে না। হয়তো বা পড়েই না।’ কবির কণ্ঠে অভিমান।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হওয়ার পর মেলায় দেখা হলো। সেই চিরাচরিত লাজুক আর বিনয়ী মানুষটা। অটোগ্রাফে লিখে দিলেন, এমরান কবির, আমাদের মেঘগুলো বৃষ্টি না হয়ে মেঘদূত হতে ভালোবাসে। আমি বললাম, ওই কবিতাটি না থাকলে এ বই আমি নেব না। কবি হেসেছিলেন তখন। কোন কবিতা? ‘মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে/ শুনেছি সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো/ পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি।’
মনে পড়ে এই কবিতাটি যখন প্রথম পাঠ করেন তখনকার কথা। অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজের অফিস। সন্ধ্যা। কবি শামীম রেজাকে মধ্যমণিতে রেখে আমরা কতিপয় তরুণ। মাসুদ হাসান, মাহমুদ শাওন, জুয়েল মোস্তাফিজ, সফেদ ফরাজি। আপন মাহমুদ এলেন। নতুন লেখা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছি। আপন মাহমুদকেও বলা হলো। অত্যন্ত লাজুক ভঙ্গিতে তিনি পাঠ করলেন এই কবিতা। আমরা অভিভূত। আমরা তখনো জানি না। এই কবি কতটা আগ্নেয়গিরি বুকের ভেতরে লালন করে চলেছেন।
জানলাম টাঙ্গাইলে গিয়ে। ২০০৬ সালে কবিতা উৎসবে। আমাদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা হয়েছিলো সেভ আওয়ার চিলড্রেন নামের এক এনজিওর রেস্ট হাউজে। গভীর রাত পর্যন্ত সার্কিট হাউজে আড্ডা দিয়ে যখন আমাদের নির্ধারিত জায়গায় ফিরছিলাম তখন আপন মাহমুদ গান ধরলেন, ‘তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম।’ রাতে শুয়ে থেকে আড্ডা চলছিল। অন্ধকারে। বললাম, কবি আপন, মুজিব ইরমের একটি কবিতায় অন্ধকারে হেড দেওয়ার একটি প্রসঙ্গ আছে। আপনি পড়েছেন? বললেন, না তো। আমি তখন কবিতাটি বললাম। খুব যেন লীন হয়ে গেলেন কবিতার সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, চলেন তাহলে আমরা এখন অন্ধকারে হেড দিতে দিতে শিশিরের কাছে যাবো। যেই কথা সেই কাজ। আমরা বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। খালি পায়ে। কবিকে যেন কথায় পেয়ে বসেছিল। বলে যাচ্ছিলেন তার অনেক ব্যক্তিগত কথা। বেদনায় বেদনায় কাতর হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। আর হাঁটছিলাম খালি পায়ে শিশির মেখে মেখে।
একবার আমরা গেলাম নারায়ণগঞ্জে। গঙ্গাফড়িং নামের এক সংগঠনের অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমরা চলে গেলাম নদীর কাছে। একটা নদী পার হয়ে যেন আমাদের পেয়ে বসলো নদীর নেশা। পর পর কয়েকটা নদী পার হলাম। নৌকা এগিয়ে চলছে। আমরা তার সঙ্গে সঙ্গে। আমরা মানে কবি শামীম রেজা, গণসংগীতশিল্পী কফিল আহমেদ, মাসুদ হাসান, জুয়েল মোস্তাফিজ, আপন মাহমুদ। হঠাৎ কবি শামীম রেজা নৌকা থেকে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে দেন। নদীহীন এলাকার মানুষ আমি। ভয়ে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠি। তখনই কবি আপন মাহমুদ গান গেয়ে ওঠেন, আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দীগন্ত ছুঁয়ে এসেছো।’ মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠ ছাপিয়ে কবি আপন মাহমুদের কণ্ঠ আরও আপন হয়ে ওঠে আমাদের কাছে।
এভাবেই কবি আপন সবার আপন হয়ে ওঠেন। আর আপন হওয়ার জন্য বেদনাটাও বেশি লাগে। কেন এত আপন হয়ে উঠলেন কবি আপন মাহমুদ? যদি হয়েই উঠলেন কেন তবে চলে গেলেন এভাবে? যদি চলেই যাবেন, তাহলে কেন একবার আপনাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করার সুযোগ দিলেন না? আমার এই ব্যক্তিগত প্রত্যাশাটা তো অন্তত মেটাতে পারতেন!