যে বইটা নিয়ে অনেক লিখবো বলে কিছুই লেখা হয়নি, সেটা কাজুও ইশিগুরোর The Unconsoled.
সম্ভবত বড় বড় কষ্ট মানুষকে এগিয়ে দেয়। তাকে মারে তার ছোট ছোট কষ্ট মনে পড়ে। ছোটবেলায় একবার আব্বা আম্মাকে আমাদের জন্যে দোর্রা পাকাতে দেখেছিলাম। এমনিতে তারা আমাদের খুবই আদর করতেন। এমন আদর যে, অগনিত উদাহরণ তৈরি হতো চেনাশোনাদের মাঝে। যে কারণে আমার মন হঠাৎ ওই দৃশ্যটা একেবারেই আশা করেনি। কী খেয়াল হয়েছিল আমার বাবার মনে কে জানে।
হয়তো হুট করে মনে হয়েছিল, অফিস থেকে ফিরতে অকারণ সারপ্রাইজ জিম করবেটের বই, দুমুখো রংপেন্সিল, দাবার বাক্স উপহার কিনে আনাই যথেষ্ট নয়, মাঝে মাঝে ভয়ও দেখানো চাই। হয়তো কাউকে বলতে শুনে পছন্দ হয়েছে৷ বাড়ি ফিরে মাকে বললেন, মাও হয়তো একবার দ্বিধা করে রাজি হয়ে গেলেন। আমি অন্য কোনো এক ঘরে যাওয়ার সময় বাবামাকে একসঙ্গে দেখে আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পেলাম। খাটের কিনারে দুজন বসে দুটো তার এককরে হাতের তালুতে ঘষে পাকাচ্ছেন। একটা তার লাল, অন্যটা কালো। ঘরটায় একটা ষাট ওয়াটের বাল্ব জ্বলছিল। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার আব্বু, আম্মু, এটা কী?
আব্বু বললেন, ‘এটা দোররা। কখনো যদি তোমরা কথা না শোনো।’
একটা গোলা যেন আমার বুকে এসে লাগলো। মায়ের দিকে তাকালাম। দেখি তার মুখটা অন্ধকার, তবু মৃদু করে হাসলেন। আমি কিছুক্ষণ ঝুলে থেকে আস্তে আস্তে হেঁটে বেরিয়ে এলাম। ব্যাপারটা যে নিছক ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে ছিল, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ পরবর্তী সময়ে সে জিনিস কোনোদিন আমার বা আমার বড় বোনের গায়ে ওঠেনি। আমি আর আমার বোন অবিকল পাড়ার অপু-দুর্গা ছিলাম (ছোটবোনের জন্ম হয়নি তখনো)। আমার বাবা এমন মানুষ, কখনো আমাদের গায়ে হাত তুললে পরমুহূর্তে নিজেই ঝাঁপিয়ে জড়িয়ে ধরতেন। আমি পরে দোররাটাকে প্রায়ই এখানে ওখানে দেখতাম। পড়ে থাকতে থাকতে একসময় সেটা আরশোলার নাদিতে ভরে উঠলো। তারপর একদিন কী এক বাঁধাছাঁদার কাজে লেগে ওটা বাড়িছাড়াই হয়ে গেলো। কিন্তু বুকভার করা ঘটনাকে আমার স্মৃতিছাড়া করা গেলো না।
নিয়েছিলাম ঝকমকে নতুন একটা বই। ফেরত দিয়েছি আধময়লা নোটের মতো একটা কিছু। বইটার পাতায় দারুণ এক কাগুজে ঘ্রাণ ছিল।
এর প্রায় কুড়ি বাইশ বছর পর আমি একদিন আব্বু আম্মুকে বলছিলাম সেই দোররা পাকানোর কথা আমাকে আজো কষ্ট দেয়।
‘ওটা আপনারা কেন করেছিলেন?’
তারা ঠিক মনে করতে পারলেন না।
‘এটা আবার কখন হলো?’
পরেও আবছা কিছু যেন পড়লো মনে, তবে তা না পড়ারই নামান্তর। টুকরো টুকরো কত ঘটনাই তো জীবনে ঘটে। তার সবকটার প্রাধান্য সবার কাছে সমান নয়। সবাই তা একপথে মনেও রাখেন না, মার্কেজ দেখিয়ে গেছেন। আমার বাবা-মায়ের কাছে হয়তো এটা একটা অপ্রধান স্মৃতি ছিল, মস্তিষ্ক তাই সরিয়ে রেখেছে। মনে না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আবার কে জানে, এমন কিছু ঘটেইনি হয়তো। কাছের মানুষেরা জানে, আমার দুর্বল স্মৃতিশক্তির অভাব পূরণকারী কল্পনাশক্তি আশৈশব আমার সঙ্গী।
আমি কৈশোরে একদিন বাবা মাকে মুখ ঝামটে বলেছিলাম, এত আশা করেন কেন? হতে পারে তারা আমার কোনো কাজের একটা কোনো ফল চেয়েছিলেন পড়াশোনা বা অন্য কিছু নিয়ে, কোথাও। তো, আমি নাকি এটা বলেছিলাম। শুনে বাবা অবাক হয়ে বলেছিলেন, আশা করবো না? আমি একইরকম তেজে চোয়াল শক্ত রেখেই বলেছিলাম, না! ব্যস। সেই মুহূর্তটা বাবা-মায়ের মনে গেঁথে গেলো। বাবা বহু বছর পর যখন সে কষ্টের কথা বলতেন, আমি ঠিক মনে করতে পারতাম না, এটা কখন ঘটেছে। একটা ঝাপসা তর্কের স্মৃতি মনে ভাসতো, স্পষ্ট হতো না। সেইরকম তো কতই রেগেছি, কিন্তু ঠিক এ কথাটা বলার স্মৃতি কেমন অনেক পরতে ঢাকা। যেন ওটা আসলে বাবা বলার পর আমার স্মৃতিতে জন্ম নিলো, আগে ছিল না, যেমন মাতৃজঠরে শিশুর আবির্ভাব হয়। অথচ বাবার আক্ষেপটা সত্য ছিল। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি আমাকে বলেছেন সেদিনের কষ্টটা তার বুকে আজো বাজে।
আমি বলছি, এত আশা করেন কেন?
আশা করব না?
না…
বিস্মরণের মেমব্রেনের আড়ালে ঢাকা পড়া এমন অসংখ্য ছোট কষ্টের স্মৃতি, যার কোনো সান্ত্বনা কখনো আমরা কোনোদিন পাইনি, যা আদৌ ঘটেছে কি না, নিশ্চিতও নই, কিন্তু তা আমাদের ক্রমশ ক্ষয় করে, ভুলোর ভূতের মতো নাম ধরে ডেকে ডেকে আজো একেকদিন স্বপ্নের ভেতর মৃত্যুনদীর কাছ পর্যন্ত ডেকে নিয়ে যায়। আয়…আয়…না…না…কী বাতাস, কী স্রোত, কী ঘোলাটে অন্ধকার! সেই ডাক থেকে কেউ মন্ত্রগুণে কিছু আয়ু বিসর্জন দিয়ে মুক্তি পায়, কেউ একবার হাত তুলে তলিয়ে যায়, কেউ ভেসে আসা গাছের গুঁড়ি ধ’রে, মনের শরীর খুব হালকা হলে কেউ কচুরিপানার পুরু মাদুর আঁকড়ে ভেসে থাকে। তারা পাড়ে ওঠে, কি ওঠে না জানা হয় না, কেউ কেউ হেসে আস্তে অবলম্বনটা ছেড়ে দিয়ে ইচ্ছে করে ডুবে যায়, ব্যথার স্বীকৃতিহীন; আমার কাছে উপন্যাস The Unconsoled সেই মানুষগুলোর গভীরতর গল্প।
Unconsoled সোয়া পাঁচশ পৃষ্ঠার বই। পড়তে পড়তে ঘরে বাইরে স্বপ্নে জাগরণে এই বই আমার সম+সারের অংশ হয়ে উঠেছিল। আমার সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিল কম হলেও ছ’ সাতশ মাইল। রিশাদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলাম। স্বর্গ থেকে এসে প্রেম স্বর্গে গেছে চলে। রিশাদকে আবার ফেরত দিয়ে এসেছি গত ডিসেম্বর। নিয়েছিলাম ঝকমকে নতুন একটা বই। ফেরত দিয়েছি আধময়লা নোটের মতো একটা কিছু। বইটার পাতায় দারুণ এক কাগুজে ঘ্রাণ ছিল। টেক্সটের সঙ্গে ঘ্রাণটাও পশে গেছে স্মৃতির ভেতর।