২০০৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আমি তখন অধুনালুপ্ত দৈনিক আজকের কাগজে সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করি। একদিন দুপুরে রূপম ভাইয়ের ফোন পেলাম। রূপম ভাই মানে কবি-সম্পাদক আন্ওয়ার আহমদ-এর বড় ছেলে। বললেন, আজ সন্ধ্যায় আসতে পারবেন শাহবাগে? কিছু কথা ছিল। মনি হায়দার আসতে চেয়েছেন। মাযহার ভাইও (আহমাদ মাযহার) আসবেন। আপনি আর শাওন (মাহমুদ শাওন) এলে খুব ভালো হতো। ‘কিছুধ্বনি’ ও ‘রূপম’ বিষয়ে কথা বলতে চাই।
বুঝলাম, বাবা আন্ওয়ার আহমদ-এর এক জীবনের সাধনা সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর ছেলে নাজিম আন্ওয়ার রূপমের ভেতরেও। রূপম কবিপুত্র। ‘রূপম’ একটি গল্পের কাগজ। সুদীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে যে-কাগজটি বের হয়েছে। ছেলের নামে কাগজের নাম কিংবা কাগজের নামে ছেলের নাম, যেভাবেই দেখি না কেন- বিষয়টির ভেতরে শিল্পকে নিজের আত্মার সঙ্গে ধারণ ও যাপন করার এক তীব্র মানসিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত। আন্ওয়ার ভাই এ রকমই। ২০০৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর, তাঁর মৃত্যুর পর স্মরণ অনুষ্ঠানে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন, ‘তিনি ছিলেন শিল্পের শহীদ।’ শিল্পকে তিনি নিজের মর্মে ধারণ করেছিলেন এতই নিবিড়ভাবে যে, এর জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। সাহিত্য করতে গিয়ে সংসার পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন। কবিতাপত্র ‘কিছুধ্বনি’ গল্পপত্র ‘রূপম’ এবং প্রকাশনী রূপমের ব্যয় সংকুলান করতে তিনি নিজের রিটায়ারমেন্টের সব টাকা খরচ করে ফেলেছিলেন। শুধু তাই নয়, মায়ের দেওয়া একমাত্র স্মৃতি বগুড়ার সেউজগাড়ীর বাড়িটি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলেন। জীবনব্যাপী এ রকম নিবেদন এবং ত্যাগের উদাহরণ খুব বেশি নেই।
ছাগল হইও না। গরু হও। ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না
রূপম ভাইয়ের কথা অনুযায়ী আমি আর কবিবন্ধু মাহমুদ শাওন সন্ধ্যায় গেলাম শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে। তিনি আবারও ‘রূপম’ ও ‘কিছুধ্বনি’ প্রকাশের আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। আমাদের সহযোগিতা চাইলেন। জানালেন আমাদের সঙ্গে থাকবেন আরও অনেকেই। এখানেও আজ তাদের আসার কথা আছে। আরও জানালেন তিনি ‘আন্ওয়ার আহমদ ফাউন্ডেশন’ গঠন করতে চান।
সেদিন আর কেউ এলেন না। রূপম ভাই দীর্ঘশ্বাস লুকানোর চেষ্টা করলেন। শেষে আমরা তিনজন এলাম আন্ওয়ার ভাইয়ের অন্তিম শয্যা দেখতে। মোহাম্মদপুরে। আমি ও মাহমুদ শাওন আগে আসিনি এখানে। রূপম ভাই কবর শনাক্ত করতে গিয়ে থতমত খাচ্ছিলেন। বলছিলেন, এ দিক থেকে গুনলে চার নম্বর কবরটিই আব্বার। কিন্তু নামফলক পাঁচনাম্বারে কেন। কবরস্থানের তত্ত্বাধায়ককে ডাকা হলো। তিনি জানালেন, আগে আরেকটি কবর দেওয়ায় ওটা এখন পাঁচ নাম্বারে চলে গেছে। রূপম ভাই অভিব্যক্তি জানালেন, তিনি এই কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কারণ নামফলক নতুন করে বসানোর মতো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন একরোখা, খ্যাপাটে, আগ্রাসী। তাঁকে দুই মিনিট সহ্য করা যেত। আড়াই মিনিটের মাথায় অসহ্য লাগত। কারণ তাঁর তো একটাই প্যাচাল। ‘কিছুধ্বনি’র এই সংখ্যাটা এখন প্রেসে, ওই সংখ্যাটার কম্পোজ চলছে, তুমি লেখাটা দিচ্ছ না কেন, তোমার সমস্যা কী, কবে দিচ্ছ, আচ্ছা ঠিক আছে, ওটা ওই তারিখে দিচ্ছ কিন্তু আমার ওই সংখ্যাটার ওই লেখাটা কে লিখবে, তুমি এই লেখাটা শেষ করার তিনদিন পরেই ওই লেখাটা দেবে, জরুরি। রূপমের জন্য গল্পটা? সেটা কে দেবে শুনি? কায়েস আহমেদের ওপরে যে সংখ্যাটা করছি, তার জন্য লেখাটা ওই তারিখের মধ্যেই দিতে হবে। তারপরই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ওপর লেখাটা। তুমি খুব খারাপ। আহমদ ছফার ওপর লেখাটা তো দিলেই না। তোমার কি খুব কোষ্ঠকাঠিন্য? এ ক’টা লেখা লিখতে কয়দিন লাগে? ছাগল হইও না। গরু হও। ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না।
ষাঁট ছুঁই ছুঁই একজন মানুষের এরকম আগ্রাসীভাবের সামনে পড়লে একজন লেখকের কী অবস্থা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আন্ওয়ার ভাই এ রকমই। এটাই তাঁর সৌন্দর্য। তাঁর ‘কিছুধ্বনি’র সব সংখ্যার লেখকতালিকা মুখস্ত। কে লেখা দিয়েছে, কে দেয়নি, কে টালবাহানা করছে, কে ফোন ধরছে না, কে চিঠির উত্তর দিচ্ছে না, সব তার মুখস্ত। সামনে যাকে পাচ্ছেন, তাকেই এসব কথা বলছেন। আর ধমক দিচ্ছেন।
যার ভেতরে রয়েছে তাঁর কবরের নম্বর চার না কি পাঁচ; সেই সন্দেহও
এই পাগল মানুষটি জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ। তিনি আরও একাধিক কাগজ সম্পাদনা করেছেন। শুধু গদ্য নিয়ে ওই কাগজটির নাম ছিল ‘সাহিত্যপত্র’। ‘দ্য মিউজ’ নামে একটি ইংরেজি কাগজের সম্পাদনাও করতেন । স্বাধীনতার পর গণকণ্ঠে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনে প্রবেশ। কাস্টমসের চাকরি করে অবসর নিয়েছিলেন। তাঁর পনেরটি কাব্যগ্রন্থ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রিলকের গোলাপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গ্রন্থ- ‘মানবসম্মত বিরোধ’, ‘নির্মাণে আছি’, ‘হঠাৎ চলে যাবো’, ‘নীল কষ্টের ডাক’, ‘অঙ্গ তোমার কাব্য করে’, ‘উনষাটের পদাবলী’, ‘ষাটের প্রান্ত ছুঁয়ে’, ‘উড়ো খই গোবিন্দ নমঃ’। চারটি গল্পগ্রন্থ- ‘সতর্ক প্রহরা’, ‘অন্ধকারের সীমানা’, ‘অন্ধ অন্ধকার’, ‘আন্ওয়ার আহমদের গল্প’। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকা লিখেছিলেন তাঁর কবিবন্ধু আবদুল মান্নান সৈয়দ। সম্পাদনা করেছেন পাঁচ কবির কবিতা নিয়ে গ্রন্থ ‘পঞ্চস্বর’, Selected Poems of Aabdul Mannan Syed, Selected Poems of Kabir Chowdhury.
স্বীকৃতি বলতে পেয়েছেন, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনায় বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার (১৯৯৩), জাতীয় সাহিত্য পদক (২০০৩), লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র, কলকাতা, (২০০৪) (মরোণোত্তোর)। বগুড়া লেখক চক্র তাঁর নামে প্রবর্তন করেছে ‘কবি আন্ওয়ার আহমদ স্মৃতি পুরস্কার’। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে তাঁর মৃত্যুদিবসে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদান করা হয়।
কবিপুত্র রূপমের ইচ্ছে ছিল ‘কিছুধ্বনি’, ও ‘রূপম’-এর প্রকাশনা অব্যাহত রাখা। হয়নি। ইচ্ছে ছিল আন্ওয়ার আহমদ ফাউন্ডেশন গঠন করার। হয়নি। ইচ্ছে ছিল তাঁর চিঠিগুলো নিয়ে একটা গ্রন্থ করার। হয়নি। ইচ্ছে ছিল আন্ওয়ার আহমদ স্মারক গ্রন্থ বের করার। হচ্ছে না। এতগুলো হয়নি এবং হচ্ছে না’র ভেতর দিয়ে আমরা মূল্যায়ন করছি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কথিত ‘শিল্পের শহীদ’-এর একজীবনের ত্যাগ। যার ভেতরে রয়েছে তাঁর কবরের নম্বর চার না কি পাঁচ; সেই সন্দেহও।