ভৃগু, পুলহ, অরুন্ধতী, শতভিষা—এমন হাজারো তারার ভিড়ে আছে আরও অনেক তারা। যারা অচেনা, অদেখাই রয়ে যায়। চির অন্ধকারে। চিরকাল। যদিও আলোকছটা, দ্যুতি আর দুরন্তপনা এতটুকু কম নয়; ব্যক্তিত্ববান ওইসব তারার চেয়ে। তারাও তারা হয়ে তাড়িত করে পৃথিবীর পথভোলা পথিকদের। দেয় নানা ঈশারা-ইঙ্গিত। কেবল আমাদেরই দেরি হয়ে যায় সময়মতো তাদের ইনডিকেট করতে।
সাহিত্যের স্রোতধারায় অনেক রথি-মহারথিই এমন নামকরা তারায় পরিণত হয়েছে। আজ এই বিষণ্ন বসন্তে, ক্ষুদ্র আমার ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি—ওইযে দক্ষিণে অতিরিক্ত আলোর আভা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন—উনি রবীন্দ্রনাথ। একটু বামপাশে, যাঁকে ঘেঁষে রোজ এক প্লেন উড়ে যায়, কেমন মিটিমিটি ধূসর হাসিতে বেদনার বাতি জ্বেলে আমাকে চমকায়। নিশ্চিত তিনি জীবনানন্দ দাশ। চকিতে মুখটি ফেরালে, উত্তরে বোঝা যায়—এ হলো শামসুর রাহমান। অতীব নীল রঙে সে তো সুনীল। পশ্চিমে দেখি সাহসী একজনা, হতে পারে সে শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এপাশে একেবারে নতুন একজনা। উনি ঠিক রফিক আজাদ।
এরকম আরও-আরও অনেক সাহিত্যের গ্যাংস্টার ক্ষণে-ক্ষণেই দেখা দিয়ে যায়। আমি বুঝি, নত হয়ে নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হতে চাই। তারা এই নিকটে তো এই দূরে চলে যায়। রাত বাড়ে। বসন্তের কচি হিমেল হাওয়া হঠাৎ দোলা দিয়ে যায়। ছুটে যায় তন্দ্রা আমার। বুঝি না কিসের টানে চশমাটা চোখে দিয়ে, আমাকে লম্ব ভেবে ফরটিডিগ্রি বরাবর চেয়ে দেখি—একদম পূর্বে ক্ষীণ এক আলোর জ্বলা-নেভা। মন আর মস্তিষ্কে মুহূর্তেই বোঝাপড়া হয়। ইনি তো আপন অতি আমার। দু’হাজার তিনে হারিয়ে যাওয়া সেই তো সুঠাম আর একহারা, তেজি আর জেদি, কবি-সম্পাদক আন্ওয়ার আহমদ।
হ্যাঁ, ‘মানব সম্মত বিরোধ’, ‘রিলকের গোলাপ’-এর কবি। কবিকে ছাপিয়ে আমি বলব, ছোটকাগজের পথিকৃৎ, অ্যাজ এ জেনুয়িন সম্পাদক আন্ওয়ার আহমদ। অতি প্রিয়, আপন, সুহৃদ আমাদের আন্ওয়ার ভাই। কারণ ছাড়াই কিছু কিছু কর্ম আছে, যা আমি করতে ভালোবাসি। ভাবের গুণেই ভাবতে ভালোবাসি।
_________________________________________________________________________________________________________________________________________
ছোটকাগজের সেই অগ্নিযুগে অনেকের মতো জন্ম হয়েছিল একটি ছোটকাগজের—যার নাম ‘কিছুধ্বনি’। যতদূর মনে পড়ে, ৩৭ বছর একটানা বেরিয়েছে পত্রিকাটি আন্ওয়ার ভাইয়ের সম্পাদনায়। সেইসঙ্গে গদ্য— তথা কথাসাহিত্য নিয়ে তাঁর আরও একটি পত্রিকা যার নাম ‘রূপম’। অনিয়মিত বেরিয়েছে ‘সাহিত্য সাময়িকী’।
_________________________________________________________________________________________________________________________________________
তখন ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ। আশি আর নব্বই-এর সেই বলয়ে টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে কবিতার নতুন রস। রসে রসাচ্ছিদ সাহিত্যের উত্তাল এক সময়। চাকরিসূত্রেই তাঁর ও আমার নিজ শহর বগুড়াতেই ঘটে প্রথম আলাপ। আলাপে আপন আর আশকারা যে পায় সে ভাগ্যবান। আমি ছিলাম সেই কোটাতে। বলতে গেলে তাঁর মৃত্যুঅবধি দীর্ঘ এক যুগ। মানুষের ক্ষুদ্র জীবনে বারোটি বছর একটানা একত্রে পথচলা বোধকরি একেবারে ফেলনাও নয়। যদি বলি বারো হাজার রকমের স্মৃতি—খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। ছিল তো সেই দিনগুলো, রাতগুলো। যা কেটেছে একান্তে, নিভৃতে আমার আর তাঁহার। পথে-ঘাটে কত আশনাই ফেলে গেছি মোরা।
সাহিত্যের সাতকাহন আজ যতটা বিস্তৃত, সেকালে ছিল না ততটা, তদ্রূপ। হাতেগোনা গুটিকয়েক দৈনিক। কাজেই তৎসংখ্যক তার সাহিত্যপাতা। স্বীকারে দোষ নেই বাঘা বাঘা পণ্ডিতের হাতের—ভিন্নার্থে, মগজের ছাঁকনিতে ছেঁকেই বেরুতো সেইসব পাতা। জেলা শহরগুলোতে বলতে গেলে দৈনিকের রাজত্ব একেবারে শূন্যের কোটায়। তো সারা বাংলায় ছড়িয়ে থাকা হাজারো তরুণলিখিয়ে তারা যাবে কই? অন্যভাবে ভাবলে বলতে হয়—তাদের নিজস্ব ভাবনা, চিন্তার প্রতিফলন তাহলে ঘটাব কোথায়? ঢাকা মানেই রাজধানী। তারা সেদিনের মতো আজও বাহিরে যা কিছু দেখে তা হলো মফস্বল। যদিও ভাবনাটা যথেষ্ট হাসির খোরাক যোগায় বটে। তো এইসব ব্যথা আর হাহাকার বুকে লালন করেই দেশের বিবিধ প্রান্ত থেকে গড়ে উঠেছিলো—বলতে গেলে একযোগে সেই আন্দোলন। যাকে আমরা বলছি লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজ।
ছোটকাগজের সেই অগ্নিযুগে অনেকের মতো জন্ম হয়েছিল একটি ছোটকাগজের—যার নাম ‘কিছুধ্বনি’। যতদূর মনে পড়ে, ৩৭ বছর একটানা বেরিয়েছে পত্রিকাটি আন্ওয়ার ভাইয়ের সম্পাদনায়। সেইসঙ্গে গদ্য— তথা কথাসাহিত্য নিয়ে তাঁর আরও একটি পত্রিকা যার নাম ‘রূপম’। অনিয়মিত বেরিয়েছে ‘সাহিত্য সাময়িকী’।
ছোটকাগজের সম্পাদক কেমন হয়? তার জ্বলন্ত উদাহরণ আমাদের আন্ওয়ার ভাই। ব্যক্তিগত জীবনে প্রভূত দুঃখ থেকেই জন্ম নেওয়া অগাধ দরদ দিয়েই বুকের দুপাশে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তাঁর দুটি পত্রিকাকে। একহাতে দেখভাল করতেন, যত্ন নিতেন, ঠিক যেন দু’হাতে দুটি সন্তানের হাত ধরে সারাদিন এপথে-ওপথে ঘুরে, ক্লান্ত কোন ফেরিওয়ালা রাত্রির বিছানাতে আদর আর আপ্পায়নে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়াতেন তাদের। মাঝে সম্পাদক, এপাশে কিছুধ্বনি ওপাশে রূপম।
অনেক বিখ্যাত পক্ষান্তরে অখ্যাত প্রভূত কবির পথচলা সত্যি বলতে এই কিছুধ্বনি আর রূপমের হাত ধরে। নাম ধরে ফিরিস্তি দিতে গেলে সূর্য ডুবে যাবে। আজকাল অনেককেই লজ্জিত হতে দেখি। এ-প্রসঙ্গে এলেই তারা বেছে নেন অন্যগতি। বুঝি না কারণ কী হেতু। সে যাক প্রসঙ্গ পশ্চাতে। আমি জানি যতটুকু সেখানেই থাকি।
__________________________________________________________________________________________________________________________________________
এ তো গেল তাঁর পত্রিকা নিয়ে মাতামাতি। গুণ তো তাঁর শুধু এখানেই প্রশ্নবিদ্ধ নয়। পত্রিকার নামেই—রূপম প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে যত বই, বলি সেখানেও কম উদার নন এই কবি। নিজের গাঁটের পয়সায় এত এত গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে জানি না তিনি কতটা লাভবান হয়েছেন? বাট সেই কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক অবশ্যই পাঠকের দরবারে এসেছেন। নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ তো পেয়েছিলেন। আর এসূত্রেই বগুড়াতে এসে বলতে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন ষাটের উল্লেখযোগ্য মেধাবী কবি-প্রাবন্ধিকদের বেশকিছু গ্রন্থ। এ তো সত্যি যে, বলতে গেলে তাঁদের শুরুর পথটা বাতলে দিয়েছিলেন তিনি।
__________________________________________________________________________________________________________________________________________
শেষ অধ্যায়ে নিজ শহর বগুড়াতেই কেটেছে তাঁর জীবনের শেষ পরিণতি। মানুষ কতটা বহেমিয়ান হতে পারে দেখেছি আমি তাঁর মাঝে। কখনো দিনের পর দিন হোটেলে, কখনো জলেশ্বরীতলায় তাঁর বোনের বাড়িতে। কখনো সেউজগাড়ির তাঁর নিজস্ব বাড়িতে। বেরুতেন সকালে। বহুদিন এক সিগারেট আর চা ছাড়া তাঁকে আমি কিছুই খেতে দেখিনি। একি স্বভাবিক মানেুষের কাজ! আমি সাবধান করে বলতাম— আন্ওয়ার ভাই এভাবে চললে তো আলসারে আটকে যাবেন। তিনি হাসতেন। আরে ছাড়ো তো—কাল ট্রেসিং বেরুবে। প্রেসে কাগজ-প্লেট কিনে দিতে হবে। চলো চলো। সত্যি বলতে জ্বালা আর যন্ত্রণাই মনে হতো মাঝেসাঝে। তারও আগে সেই জটিল যুগে, কয়েকটি সংখ্যা করেছেন করতোয়ার তীরে তৎকালে অধুনালুপ্ত বাণী প্রেসের লেটার টাইপে। গাদা গাদা ফাইল আর ফোল্ডরে নিমজ্জিত হয়ে তিনি ঢুকতেন। সঙ্গে একঝাঁক তরুণ কবির দল। সারাদিন চলতো সিসার টাইপে কম্পোজ, প্রুফ দেখা। বিদ্যুৎ দা’র সেই প্রেস ছিল সকলের জন্য অবারিত। আমি অনেকদিন দুপুরে একচোট ঘুমিয়েও নিয়েছি মনে পড়ে।
সে যুগে ছিল না সেলফোন। ল্যান্ডফোন থাকলেও আন্ওয়ার ভাইকে আমি দেখেছি প্রায় যোগাযোগ চিঠিতেই সারতেন। কী পরিমান চিঠি যে লিখতেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। অদ্ভুত বড় বড় অক্ষরে, বলতে গেলে মূল দাবি তাঁর একটিই—পরের সংখ্যার জন্য লেখা চাই। শেষে আন্ডারলাইন করে একটি কথা জুড়ে দিতেন, ‘দ্রুত’। ওপাশ থেকে উত্তর আসেনি। ফের চিঠি। সে সময় শুনতাম সারাদেশেই কবিদের কাছে পাঠনো আন্ওয়ার ভাইয়ের এই চিঠি এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। রাজশাহীর এক পাঠশালাতে পাঠ নিতে গিয়ে সে সময় আমাকে প্রায় বগুড়া-রাজশাহী করতে হয়েছে। তবুও শ খানেক চিঠি তো আছে এক আমার কাছেই। আর এ থেকেই অনুমান করা যায় দূরের কবি-সাহিত্যিকদের কাছে তিনি কী পরিমাণ প্রেসারক্রিয়েট করতেন তাঁর এই চিঠির মাধ্যমে—শুধুমাত্র লেখা চেয়ে। আজ কোথায় সেইসব সম্পাদক? এমনই বিচ্ছু আর নাছোড়বান্দা সম্পাদক ছিলেন আমাদের আন্ওয়ার ভাই।
আমি একথাও বলব, এই অবাধ চাওয়ার কারণে শেষের দিকে তাঁর পত্রিকার মান কিছুটা হলেও খর্ব হয়েছিল। শেষদিকে কিছু ব্যক্তিত্বের ওপর আস্ত সংখ্যাও করেছেন। বিষয়টা প্রসংসার যোগ্য। বাট তড়িৎ গতির কারণে সংখ্যাগুলো সেইমানে দাঁড়াতে পারেনি। যাই হোক—এটুকুই বা কে করে? এমনও দিন গেছে লেখা দেইনি, এই ভয়ে তাঁকে এড়িয়ে অন্যপথে বাড়ি ফিরেছি।
এ তো গেল তাঁর পত্রিকা নিয়ে মাতামাতি। গুণ তো তাঁর শুধু এখানেই প্রশ্নবিদ্ধ নয়। পত্রিকার নামেই—রূপম প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে যত বই, বলি সেখানেও কম উদার নন এই কবি। নিজের গাঁটের পয়সায় এত এত গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে জানি না তিনি কতটা লাভবান হয়েছেন? বাট সেই কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক অবশ্যই পাঠকের দরবারে এসেছেন। নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ তো পেয়েছিলেন। আর এসূত্রেই বগুড়াতে এসে বলতে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন ষাটের উল্লেখযোগ্য মেধাবী কবি-প্রাবন্ধিকদের বেশকিছু গ্রন্থ। এ তো সত্যি যে, বলতে গেলে তাঁদের শুরুর পথটা বাতলে দিয়েছিলেন তিনি।
আমার কেন জানি মনে হয়, জীবনের সমস্ত উপার্জন এক সাহিত্যেই ঢেলে দিয়েছেন তিনি। নিরলসভাবে। এ নিয়ে অনেকেই তাঁকে সাবধান করতেন। ওই যে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। তিনি ছুটবেন তাঁর পথে। সেই তো তাঁর নিয়তি।
জীবনের শেষদিকে কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছিল তাঁর সঙ্গে আমার দেখাদেখি। মানুষমাত্রই যেমনটা ঘটে থাকে আরকি! উভয়ের ব্যস্ততাই কারণ হিসেবে ছিলো দায়ী। তবু খবর পেতাম। যতটা পারি রাখতাম। সময়ই জানে সকল মতিগতি। তেমনি এক শুরুর সকালে টেলিফোনে জানতে পারি, তিনি নেই। প্রিয় আন্ওয়ার আহমদ চলে গেছেন চিরস্থায়ী। মনে পড়ে অজান্তেই রুটি আর মাখনে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুতে সেদিনের নাস্তা হয়েছিল মাটি।
১৩ মার্চ ১৯৪১। এ পৃথিবীতে এসে বিরলপ্রজ এই মানুষটি—যিনি একাধারে কবি, সম্পাদক—আন্ওয়ার আহমদ কোনও চিঠি, কোনও ফোন, বস্তুত কোনও আভাস না দিয়েই চলে গেলেন ২৪ ডিসেম্বর ২০০৩-এ। বাঙালি যতটা ব্যাকুল হয়, হয়তো হয়েছিল কেউ-কেউ সেদিন। তারপর যা হয় ঘটেছে তাই। গিভ অ্যান্ড টেকের সহজ আর সরল সমীকরণে আন্ওয়ার ভাই কেবল দিয়েই গেলেন। সামান্য কিছুই কি পাবার ছিল না তার? ইতিহাস নীরব। ভাবি—এক অর্থে ভালোই তো! এত দল আর উপদলে সাহিত্য আজ এতটা কলুষিত। এতটা পঙ্কিল। সেখানে না গিয়ে আমাকে লম্ব ভেবে ফরটিডিগ্রি বরাবর ওই যে হাস্যেজ্জ্বল রয়েছ তুমি। তোমাকে স্যালুট। কথা হবে। এ ঝরা বসন্তে দেখো হে কবি। ওহে সম্পাদক, আমি মাতাল তোমাতে মদ। আমার মতো অনেকেই আছে তোমাকে কেন্দ্র করে—আন্ওয়ার আহমদ।