আনওয়ার আহমদ—নামটি কবি অভিধায় যত পরিচিত, তারচেয়ে বেশি পরিচিত সম্পাদক হিসেবে। আনওয়ার আহমদ মানেই সম্পাদক আনওয়ার আহমদ। অথচ তিনি কি শুধুই সম্পাদক পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ? তিনি গল্প লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যাও পনেরটি। প্রথম কবিতার বই ‘রিলকের গোলাপ’ এরপর প্রকাশিত হয়েছে, ‘মানবসম্মত বিরোধ’; ‘নির্মাণে আছি’; ‘হঠাৎ চলে যাব’; ‘নীল কষ্টের ডাক’; ‘শেষ সম্বল শেষ দান’; ‘অটল থাকা ধীর সন্ন্যাস’; ‘উড়ো খই গোবিন্দ নমঃ’; ‘ঊনষাটের পদাবলী’; ‘ষাটের প্রান্ত ছুঁয়ে’ ইত্যাদি। এছাড়া একটি গল্পের বইও রয়েছে। অন্যদিকে তিনি সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের চিঠি, রূপম, কিছুধ্বনি, সাহিত্য, সাহিত্য সাময়িকী ও মিউস নামের ছয়টি পত্রিকা। এই পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সাহিত্যের চিঠি’ ১৯৬৩ সালে। এরপর ১৯৬৫ সালে সিনে পত্রিকা ‘রূপম’। পরবর্তীকালে ‘রূপম’ সাহিত্য পত্রিকায় রূপান্তরিত হয় এবং গল্প পত্রিকা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ‘কিছুধ্বনি’ নামে কবিতা বিষয়ক পত্রিকা প্রথম প্রকাশ করেন ১৯৬৬ সালে। এই পত্রিকাটির আয়ু ছিল ২০০৩ পর্যন্ত। এছাড়া তার সম্পাদিত অন্য পত্রিকাগুলোর আয়ু অল্পদিনের।
আমাদের পুরো ষাটের (১৯৬০-৬৯) দশক জুড়েই চলতে থাকে সমাজ, রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ ও পালাবদলের সংগ্রাম। এই আন্দোলনের ঢেউ আমাদের ষাটের দশকের কবি-সাহিত্যিকদেরও প্রভাবিত করে। এ প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান সৈয়দের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায়— ‘জীবনকে আমরা বিভক্ত করব না, জীবনকে আমরা জীবনের মতো উপস্থাপিত করব, নিজেকে উৎসারণ করব জীবনের পাত্রে দুঃখের মতো সংলগ্ন করে। (৬০-এর লিটল ম্যাগাজিন ও আমাদের সাহিত্য; উত্তরাধিকার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭, পৃষ্টা-৩)। আর নিজেদের মতো করে উপস্থাপিত, তাদের প্রেমও তাই হয়ে উঠেছে তাদের সময়ের ক্ষত-বিক্ষত অনুভূতির স্পর্শ। এ দশকের কবিরা যেমন রাজনীতি সচেতনতার কারণে রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন রাগী, সাহসী উচ্চারণে। তেমনি প্রেমের প্রকাশে তাদের মানসপট আপ্লুত হলেও তাতে হতাশা এবং অপ্রাপ্তি ভর করেছে। ভালোবাসায় যেমন ব্যাখ্যেয় থাকে না—সর্বগ্রাসী ভালোবাসায় যেমন থাকে হারানোর বেদনা, বিচ্ছিন্নতার সুস্পষ্ট আভাস থাকে, অস্তিত্ব সংকটজনিত অস্থিরতা তারই প্রকাশ। আনওয়ার আহমদের কবিতায়:
ওকে
তোমরা করুণা করো
হে মেঘ, হে ফুটপাত, হে ব্যথিত ঘাস
পিচপথে শুয়ে থাকা হে করুণ শেষবৃষ্টি জল
. ক্ষমা করো ওকে।
চোখের পাতার কোনে লেগে থাকা গাঢ় নীল দাগ
ওকে তো চেনে না, ওকে চেনে শুধু শেষ হুইসিল
যেন প্রেম চলে যায় ইস্টিশনহীন কোন পথে
বয়সী কিশোরী এই মেয়েটির জন্যে সেই কাঁদে।
বুকের গহনে আছে আমতলা; সহসা মার্বেলে
কেটে যাওয়া কিশোরের কপালের শোণিতের দাগ
লজ্জায় রঙিন হলে তার গালে লাগে
অস্তআভা রৌদ্রের মতো।ওকে ক্ষমা করো হে কর্মঠ বাস, হে স্কাইস্ক্র্যোপার
নাঢ়িতে নাঢ়িতে তার বয়ে বয়ে চলে
সেই কিশোর প্রতি পদক্ষেপে ডাঙ্গুলি খেলা।আহা! সেই বয়সী কুমারী।
(কোনো বয়সী কুমারীকে)
কবিতায় যে তীব্র অবক্ষয়, রোধ, অস্তিত্ব ও সংকট তার সঙ্গে সঙ্গে তাকে কখনো স্বীকার করে কখনোবা অগ্রাহ্য করে দেশকালের সংকট এবং সমকালীন প্রভাবকে ধারণ করে এ কবিরা আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে এসে অপ্রতিরোধ্যতার সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। ফলে তাদের কবিতা হয়ে উঠেছে চেতনার নিঃসংকোচ প্রকাশ। কী আত্মকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা, কী সময়ের সরব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রকাশ—সবখানেই কবিতা হয়ে উঠেছে হতাশা আর অন্ধকারচ্ছন্নতার বিপরীতে নতুনের প্রেরণা। আনওয়ার আহমদের কবিতার অসংখ্য উদ্ধৃতি করে গদ্যটিকে ভারী করে তোলা সম্ভব হলেও তা দিয়েই শুধু একটি গদ্যে কবি আনওয়ার আহমদের মূল্যায়ন অসম্ভব।
ব্যক্তি আনওয়ার আহমদকে যারা জানতেন, তার সম্পাদক সত্তাকে যারা জানতেন, যাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে লেখা তৈরি করে নেওয়ার জন্য অনবরত তাদাগা দিয়েছেন, তাদের সবার সম্মিলিত মতের মধ্য দিয়েও আনওয়ার আহমদের যথাযথ পরিচয় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কারণ সেই সুযোগ সমালোচকদের হাতে নয়, তা নির্ভর করছে পাঠকের কাঠগড়ায়। সমালোচক, আলোচক শুধু তাকে পাঠকের কাছে নতুন নতুন দিক থেকে চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি সহজ করে তুলতে পারেন। আর তাই আনওয়ার আহমদ বলতেই তাকে সম্পাদক অভিধা অথবা সম্পাদক সত্তার যে পরিচয়ে আমরা তাকে ধরে রাখতে চাই, সে ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সম্পাদক হিসেবে তার মূল্যায়ন যেমন তেমনিভাবে কবি আনওয়ার আহমদের পরিচয়ও স্পষ্ট করা জরুরি।