বাংলাদেশে অফিস সংস্কৃতিতে যেমন আছে মধুরতা, তেমনি আছে তিক্ততাও। মাঝে মাঝে সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দেখা যায় দ্বন্দ্ব ও সংকট। গত কয়েক মাস আগে ফেসবুকে একটি বিষয় বেশ মুখরোচক আলোচনার সৃষ্টিও হয়েছিল এই সম্বোধনকে কেন্দ্র করে। কোনো এক উপজেলার একজন নারী নির্বাহী কর্মকর্তাকে জনৈক সাংবাদিক ‘আপা’ সম্বোধনের জন্য সাংবাদিককে হেনস্থা করা হয় এবং সেই সাংবাদিক হেনস্থার খবরটি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ায় পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকম মন্তব্য, কটূক্তি—ইত্যাদি ফেসবুকের ওয়ালে মুদ্রিত হতে শুরু হয়। এমন পরিস্থিতি বা অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—আসলে অফিসের কর্মকর্তাদের সম্বোধনের ভাষা কী হওয়া উচিত? এ নিয়ে নিজেরও ক্ষোভ আছে যা সর্বৈব প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সরকারি অফিসে বয়সে সিনিয়র হলেও যখন জুনিয়র স্টাফদের নাম ধরে ও তুমি করে যখন সম্বোধন করা হয়, তখন মেনে নিতে কষ্ট হয়। অথচ প্রটোকল অনুযায়ী অফিস পাড়ায় এই ঘটনা নিত্যপুরান। জুনিয়র পদের মানুষেরা যত বয়স্কই হোক না কেন, তারা সিনিয়রদের স্যার বা ম্যাডাম বলতেই অভ্যস্ত। আর সিনিয়ররাও তাদের নাম ধরে ডাকেন ও তুমি বলে সম্বোধন করেন। সরকারি প্রটোকল অনুযায়ী এটি চক্ষুলজ্জার বিষয় হলেও এখানে কিছু করার থাকে না। তবে এর ব্যতিক্রম দেখা যায় নমনীয় কর্মকর্তাদের বেলায়। তারা আপনি বলে সম্বোধন করেন, এমন অনেক নজিরও আছে। দাম্ভিক কর্মকর্তারা প্রটোকলের বাইরে একচুলও আপস করতে নারাজ।
সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেসরকারি কর্মকর্তাদের কাজ করতে গেলে বেসরকারি, বিশেষ করে এনজিও-র লোকেরা ‘ভাই’ বা ‘আপা’ বলে সম্বোধন করেন তাদের নিজস্ব অফিস সংস্কৃতির কারণে। দশ/পনের বছর আগেও অনেক সরকারি কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ হতেন এবং এই সংস্কৃতির বিষোদাগার করতেন। তবে বর্তমানে অনেক সরকারি কর্মকর্তা এনজিও-র এই সংস্কৃতিকে মানিয়ে নিয়েছেন। ফলে মানসিক সংকট অনেকাংশে কমে গেছে। বিভিন্ন অফিসে এখন মিশেল সম্বোধনের রেওয়াজের চল হয়ে গেছে।
অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সিনিয়রদের ‘ভাই’ বা ‘আপা’ বলে সম্বোধন করা হয়। ব্র্র্যাক এই সংস্কৃতি চালু করেছিল। এর ব্যবস্থাপনাকে অনুসরণ করে অনেক এনজিও এই সংস্কৃতি গ্রহণ করে। যা এখনও চালু আছে বলে আমাদের ধারণা। এনজিও-র মতো অনেক বেরসকারি প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে অনুরূপ সম্বোধনের বিষয়টি লক্ষ করা যায়। যেমন—পত্রিকা অফিস, কিছু কোম্পানি, কিছু ব্যাংক ইত্যাদি।
‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ শব্দ দুটি খুব বেশি সম্মানের না হলেও ঔপনিবেশিক দাসত্বের শব্দ মনে করে অনেকেই এই শব্দ দুটিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই সম্বোধনের ফলে দূরত্ব সৃষ্টি হয় বলে অনেকেই মনে করেন। ফলে, অনেকক্ষেত্রেই নৈর্ব্যক্তিক এই সম্বোধন এড়িয়ে গিয়ে ‘ভাই’ বা ‘আপা’ সম্বোধন করে নিজেদের ধন্য মনে করেন। একই অফিসে আবার যদি বিদেশি থাকে, তাহলে সবাই তাকে/তাদের নাম ধরে ডাকেন বয়স বা পদবি ধর্তব্য বিষয় নয়।
বাংলাদেশে ‘স্যার’-এর প্রচলিত ও ব্যবহৃত কী কী শব্দ আছে, একটু খতিয়ে দেখা যাক। যেমন—স্যারের বাংলাদেশে মহোদয়, জনাব, হুজুর ইত্যাদি শব্দ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রকৃত বাংলা শব্দ কোনটি? আর সেগুলোই আমরা কেন ব্যবহার করি না? মৌলানাদের আমরা খুব সহজেই হুজুর বলে সম্বোধন করলেও কোনো মানসিক চাপ উপলব্ধি করি না, যতটুকু করি স্যার সম্বোধন করতে গিয়ে। এখন একজন সরকারি সিনিয়র কর্মকর্তাকে যদি হুজুর ডাকা হয়, তাহলে অবস্থাটা কোন পর্যায়ে যাবে, একবার ভেবে বা পরখ করে দেখতে পারেন। অনুরূপভাবে জনাব বা মহোদয় বললেও তা খুব মানানসই হবে না আমাদের দীর্ঘকালের লালিত সংস্কৃতির জন্য। তাহলে পথ কী? ভাই বা আপা? এতেও তো বিড়ম্বনার সীমা নেই। উদাহরণ দিচ্ছি, আমার এক সহকর্মীকে আমি আপা ডাকি। তিনিও আমাকে নিয়োগী ভাই ডাকেন। একটি কাজের প্রয়োজনে তার ছেলেকে আমার কাছে পাঠালেন। ছেলেটিও আমাকে স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়োগী ভাই ডাকা শুরু করে দিলো। এখন তাদের বাসায় মাঝে মাঝে আমার যাওয়া হয়, কিন্তু আমি আর আমার সহকর্মীকে আপা ডাকতে পারি না তার স্মার্ট ছেলেটির জন্য। দ্বিতীয় উদাহরণ, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ক্লাসের এক আপার এক মেয়ে আমাদের অফিসে চাকরি পেয়েছে। কালক্রমে তার মায়ের পরিচয় আমাকে দিল বটে কিন্তু আমাকে ভাই ডাকা থেকে বিরত থাকল না। যদিও আমি বলেছিলাম, ওমুক আপার মেয়ে তুমি! এমন অনেক ঘটনা ঘটছে বিশেষ করে, আমাদের বয়সী মানুষদের ভাই সম্বোধনের সংস্কৃতির অফিসে এমন বিভ্রাটে পড়তে হচ্ছে।
আজ মনে হচ্ছে—সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসে বিরাম করের বাসার সম্বোধনের সংস্কৃতি যেন বাংলাদেশে ছাপিয়ে গেছে। বিরাম কর, তার স্ত্রী মভিং ক্যাসেল আর তিন মেয়ে একই নিশীথসহ অন্য আরও কিছু মানুষকে দাদা বলে সম্বোধন করে। যা ওরা সবাই জানে। বড় বিস্ময়কর ব্যাপার! মা-বাবা আর মেয়েরা একই সম্বোধন করে আবার সেই ছেলে কিনা এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমও করে।
যাই হোক, এ নিয়েই আমরা ভালোই আছি। তবে ঔপনিবেশিক দাসত্বের শব্দগুলো আমাদের গাত্রদাহের কারণ বটে, কিন্তু ভাই বা আপার কতটুকু ইজ্জত বাঁচলো, সে দিকটিও মনে হয় তাদের ভাবা উচিত, যারা ইনফরম্যাল রিলেশনশিপের জন্য এই সংস্কৃতি চালু করেছেন। সম্বোধনের যুতসই কোনো শব্দ দিয়ে এই বিভ্রাট থেকে উদ্ধারের কোনো শব্দ আছে কি না, তা শব্দ বিশেষজ্ঞরা একটু ভেবে দেখতে পারেন। না কি বিদেশিদের মতো নাম করে সম্বোধনই শ্রেষ্ঠ উপায়, তাও একটু ভেবে দেখবেন?