প্রথম কিস্তি
এক.
অন্যমনস্ক হলে প্রায়ই ভাবি ২০১২ সালের কথা। অসম্ভব কর্মব্যস্ত সময় কাটছিল আমার। সময়ের অভাবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘সবার জন্যে শিক্ষা’অনুষ্ঠানটি আমাকে বাদ দিতে হয়েছিল। বয়স্ক শিক্ষার এই অনুষ্ঠানটি আমি একাধারে দীর্ঘ বাইশ বছর গবেষণা ও উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলাম। মাটি ও মানুষের পাশাপাশি আমার এই অনুষ্ঠানটি টার্গেট পিউপলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তবু সেখান থেকে সরে আসতে হয়েছিল আরও বৃহত্তর দায়িত্বের কথা ভেবে।
২০১১ সাল থেকে সরকারি তিতুমীর কলেজের পঞ্চাশ হাজার ছাত্রের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলাম তখন। ১৯টি বিষয়ে অনার্স ও এম.এ ক্লাসের পাঠক্রম পরিচালিত হতো দু শ জন শিক্ষকের মাধ্যমে। ছাত্রদের দেখভাল ছাড়াও বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক ছাত্রদের দুষ্টুমি সামলানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। রাস্তায় বাস কন্ট্রাকটর কিংবা ড্রাইভারের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে হয়তো বচসা হয়েছে—কথা কাটাকাটি, মারামারি—অতপর একপর্যায়ে বাসসহ কন্ট্রাকটর ও ড্রাইভারকে ধরে এনে কলেজ মাঠের মধ্যে জিম্মি করে রাখতো। তারা অপেক্ষা করতো অধ্যক্ষের জন্যে। ছাত্র ও তাদের দলনেতাদের ডেকে প্রায়ই এসব ঘটনার মীমাংসা করতে হতো আমাকে। কাজেই শুরুতেই বুঝে গেছিলাম অধ্যক্ষ হলে শিক্ষাদান আর চলে না। কলেজের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখাই অধ্যক্ষের প্রধান কাজ। তিনটি ছাত্র-হোস্টেল, শিক্ষক-কর্মচারীদের নানা সমস্যা—ছাড়াও মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের অর্পিত দায়িত্ব পালনেই রাত্রি-দিন আমার ভারাক্রান্ত ছিল। ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষের শিক্ষাদানের মহৎ উদ্যোগ ও স্বপ্ন থেকে আমাকে সেদিন এভাবেই পিছিয়ে আসতে হয়েছিল।
তবু দিনশেষে সন্তানের স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা এবং সেই ইচ্ছে পূরণও মা-বাবার অন্যতম দায়িত্ব-কর্তব্যের অংশ বিশেষ হয়ে দেখা দিলো। অভিন্ন অব্যয়ের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না কিছুতে। পিতা রফিক আজাদও দেখি সন্তানদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছে। আমার অনুপ্রেরণা, শক্তি, সাহস, ভালোবাসার মিহি সুর—সব যখন এক তারে বেজে উঠছে, তখন আমি একলা বাইরে থাকি কী করে?
পরিশেষে অভিন্নের উদ্যোগে ও অনুরোধে কুড়িদিনের ছুটি নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম সপরিবারে। ছোটভাই হাবীবের নিমন্ত্রণে সুইজারল্যান্ডের ডেলিমন্ড শহরে তার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলাম। জীবন সংগ্রামের এক পর্যায়ে সুইজারল্যান্ডের একমাত্র বাঙালি ডেভলপার হিসেবে আমার ভাইটিও—তখন বাঙালি, অবাঙালি এমনকি স্যুইস নাগরিকের কাছেও প্রিয় হাবীব ভাই হিসেবে সমাদৃত ও প্রশংসিত। বলাবাহুল্য যে, সুপ্রসন্ন ভাগ্যের সূর্য তার তখন মধ্যগগনে। তার নির্মিত বাড়ি বানানো শেষ হতেই বিক্রি হয়ে যায় সব সুইস নাগরিকদের মধ্যেই।
দীর্ঘকাল বাদে এরকম সুসময়ে আমরা প্রথম তার অতিথি হয়েছিলাম। কবি (দাদাভাই) রফিক আজাদ, বোন, ভাগনে অভিন্ন অব্যয়কে নিয়ে সুইসের দর্শনীয় স্থান দেখাতে কোথায় কোথায় নেবে, কী খাওয়াবে—দাদাভাইয়ের প্রিয় পানীয় ব্ল্যাক লেভেল ও সিভাস রিগাল, সঙ্গে বরফকুচি জল নিয়ে যেন—আনন্দ উৎযাপনের প্রহর গুনছিল। ডেলিমন্ড শহরে তার বাড়ির মনোমুগ্ধ আতিথেয়তায় দু’দিন কাটাতেই অভিন্ন তার ইচ্ছের কথা জানালো মামাকে। ইউরোপ ও ভূস্বর্গের বিস্ময় আলেপ্স পর্বত দর্শনের আগে প্রথমে সে রোমের ভ্যাটিক্যান সিটির সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিং আঁকিয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মিকেলেঞ্জেলোর পেইন্টিং দেখতে চায়।
অভিন্নের ইচ্ছের মূল্য দিয়ে তার মামাও আমাদের চারজনের জন্যে প্লেনের টিকিটসহ হোটেল বুক করে দিলো। পরের দিন গাড়ি চালিয়ে জেনেভা এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে এলো। ব্যবসায়িক ব্যস্ততার জন্যে এই যাত্রায় সে আমাদের সঙ্গী হতে পারলো না। সন্ধ্যারাত নাগাদ আমরা রোমে পৌঁছুলাম। বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য, ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।’
এই সেই রোম?
ইতিহাসের সেই শহর এটি?
রোমান সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট নিরোর দেশ,এই সেই রোম।
অজানা এক রোমান্সে গা আমার ছমছম করছিল।
রোম শহরের বীভৎস অগ্নিকাণ্ডের পর সেই ধ্বংসস্তূপের ওপরই নিরো তার স্বপ্নের ডোমাস অরিয়া বা স্বর্ণগৃহ নির্মাণ করেছিলেন। আর এই ডোমাস অরিয়া স্থাপত্যকলারও অবিস্মরণীয় এক অনন্য নিদর্শন। বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না কিছুতেই। আমি আজ প্রত্যক্ষ করছি নিজে ও সপরিবারে—এমন আনন্দঘন সময় আমাদের ভাগ্যে অপেক্ষা করছিল—এই যেন আমার কল্পনাতেও উঁকি দেয়নি কখনো।
স্রষ্টাও সৃষ্টির অপরিমেয় এই চিত্রকর্ম নিজের ক্যামেরায় নিজের হাতে তোলার বোধ করি আনন্দই আলাদা, সেজন্যে অভিন্ন এই সুযোগটি হাতছাড়া করেনি বলেই মনে হলো আমার।
গরিব কবি বাবা-মাকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণের উচ্চবিলাসী এই স্বপ্ন-বাস্তবায়নের জন্যে এককভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলো আমাদের পরম সন্তান অভিন্ন। বন্ধু শায়েরের কাছ থেকে পাঁচ হাজার ডলার ধার নিয়ে এসেছিল—তার একরোখা জেদের জন্যে সম্ভব হয়েছিল অদেখাকে দেখা ও অজানাকে জানার এমন মাহেন্দ্রক্ষণ। ফলে স্মৃতি বিহ্বল অবিস্মরণীয় একটি রাত কাটিয়েছিলাম রোম-শহরে। কবি রফিক আজাদ এতটাই চঞ্চল আর অস্থির হয়ে উঠেছিল যে, যেভাবেই হোক এই রোম শহরে বসে তার প্রিয় পানীয় ব্ল্যাকলেভেল পান করতেই হবে। কিন্তু আমাদের হোটেল সংলগ্ন বিভিন্ন বার রেস্তোরাঁয় শুধু ওয়াইন পাওয়া যায়। রেড কিংবা হোয়াইট ওয়াইন যাই চাও না কেন।
ফলে অর্ধরাত্রি অনুসন্ধানেও সেদিন—কোনো হার্ড ড্রিংস পাওয়া যায়নি। রেস্তোরাঁর মালিক, ম্যানেজার অধিকাংশ ইতালীয় ভাষায় কথা বলে, ইংরেজি প্রায় বলে না। ৩/৪ টি রেস্তোরাঁয় পছন্দমতো খাদ্য ও পানীয় না পেয়ে অভিন্ন অন্য একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকেছে আমাদের নিয়ে।
সেখানে কিছু ইন্ডিয়ান খাবার পাওয়া গেলেও ব্ল্যাকলেভেল জাতীয় কিছু নেই শুনে রফিক আজাদের অস্থিরতা যেন পাগলামি পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। বাংলাদেশের পটভূমিতে রফিক আজাদকে নিয়ে একটা প্রবাদের মতো কথা প্রচলিত ছিল যে, রফিক আজাদ কখনো ভাতের নিমন্ত্রণে যায় না। কিন্তু যেখানেই যায়, সেই সব নিপাট অঞ্চলেও রফিক আজাদ চাইলে মাটি থেকেও ফিনকি দিয়ে মদ বেরোয়। তো, এই প্রবাদ নিরোর রোম শহরে খাটছে না কিছুতেই। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ছেলেটি অগত্যা ভাঙা ইংরেজিতে অভিন্নের কাছে জানতে চাইছে, পাপা প্রবলেম, পাপা প্রবলেম, এনি প্রবলেম? হুম, তুমি বুঝবে না এই বাঙালির প্রবলেম। বরং তোমার রেড লেভেলের তলানীতে যেটুকু পড়ে আছে, সেটুকু আপাতত দাও আমার বাবাকে। শান্ত করি তাকে।
এভাবেই সেদিন কবি ও বাবার সামান্য ইচ্ছে পূরণ করতে অভিন্ন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। আমাদের হোটেল সংলগ্ন এলাকায় যেহেতু অন্য কোনো ড্রিংস পাওয়া যাচ্ছিল না—কাজেই ফেরার সময় অভিন্ন অগত্যা হোয়াইট ওয়াইনের দুটো বোতল সঙ্গে নিয়ে বাবাকে শান্ত করলো। রাত দুটো নাগাদ আমাদের নিয়ে হোটেলে ফিরে এলো।
এই বিদেশ বিভূঁয়ে এসে হঠাৎ করেই আবিষ্কার করতে পারলাম যে, মা-বাবা দু’জনকেই টেককেয়ার করার মতো সন্তানটি আমাদের বড় হয়েছে, হঠাৎ করেই যেন সপ্রাণ, সহমর্মী এক অভিভাবক হয়ে উঠেছে আমাদের মাথার ওপরে। মনে হচ্ছিল নির্ভরতা ও আশ্রয়ের একটা নতুন দ্বীপ জেগে উঠেছে আমার জন্যে। একথা ভেবে সেই রাতে মা হিসেবে আনন্দে যেন বুকটা ভরে গেলো আমার। রফিক আজাদ ঋষিতুল্য মানুষ বটে, কবি হিসেবে ততোধিক মানবিক, স্পর্শকাতর, নির্মোহ, সাধক ও ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাও বটে।
কিন্তু স্বামী হিসেবে? একে তো কবি স্বামী, অতপর সংসার উদাসী, নির্মোহ, বিষয়হীন, উপরন্তু তিনি সারাজীবন বিশ্বাস করেছেন বিষয়ই বিষ—ওদিকে তাকাতে নেই। টাকা হলো হাতের ময়লা—অনর্থের একশেষ, এই শিক্ষা তার দু’জন সন্তানকেই দিয়েছেন তিনি। কাজেই সংসারের দীর্ঘ যাত্রায়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কখনো তাকে ভরসা করতে পারিনি, যতটা ভরসা করেছি স্বয়ং আল্লাহকে এবং নিজের বুদ্ধি-মত্তা, শক্তি ও সাহসের। এতকাল পরে সংসার যাত্রায় হাত বাড়ানোর মতো একটা বলিষ্ঠ কাঁধ যেন খুঁজে পেলাম সন্তানের। মাতৃত্ব রসের অতুলনীয় এই অনুভূতি একজন মা-ই শুধু উপলব্ধি করতে পারেন। একথা সত্যি যে, সেই রাতেই আমার সব ব্যর্থতার বোধ ঘুচে গেছিল। মনে হয়েছিল একটি স্বয়ং সম্পন্ন পরিবার গড়তে আমি সমর্থ হয়েছি। একজন মা হিসেবে আমি বিজয়ী। আমার সব শ্রম-ঘাম-কষ্ট, অনিশ্চয়তা সব? সব সার্থক আজ।
দুই.
ভোরের সূর্যোদয় হতেই অভিন্ন প্রথমে কলোসিয়াম দেখার টিকিট বুকড করলো অতপর ৫০১ জনগণ নিয়ে গঠিত বিশ্বের ক্ষুদ্রতম সিটি ভ্যাটিক্যান সন্দর্শনে সারা দিনমান কাটানোর প্ল্যান করে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অজানাকে জানার অতুলনীয় এক সুযোগ সৃষ্টি করে দিলো অভিন্ন। সিস্টিন চ্যাপালের প্রবেশমুখ থেকেই পৃথিবী বিস্ময়ের পর্দা এক এক করে খুলে যাচ্ছে আমাদের সামনে। নয়ন সমুখে যেন দেখতে পাচ্ছি জীবন্ত মিকেলাঞ্জেলোকে। রেনেসাঁস যুগের ইতালীয় এই শিল্পী, যিনি ছিলেন একাধারে ভাস্কর, চিত্রকর, স্থপতি, কবি ও প্রকৌশলী। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছাড়া তার বহুমুখী প্রতিভার সঙ্গে তুলনীয় কেনো শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৫০৮ সালে শুরু করে ১৫১২ সালে পর্যন্ত মিকেলাঞ্জেলো কোনো সাহায্যকারী ছাড়াই সিস্টিন চ্যাপেলের সিলিংয়ের ফ্রেস্কো আঁকার কাজ শেষ করেছিলেন।
চ্যাপেলের প্রবেশপথ থেকে আঁকতে আঁকতে পেইন্টিং শেষ করেছেন উপাসনা বেদীর ওপরে গিয়ে। সিলিংয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি আঁকা Creation of Adam। যেটা কিনা চিত্রকলার জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠকীর্তি আর সবচেয়ে বেশিবার আঁকা একটা চিত্রকর্ম। এই চিত্রে বাইবেলের জেনেসিস বা সৃষ্টিতত্ত্বের ঘটনা অনুসারে পৃথিবীর প্রথম পুরুষ আদম ও ঈশ্বরকে দেখা যাচ্ছে। মূলত, এই ছবিতে চিত্রিত হয়েছে মানবজাতি সৃষ্টির অনন্য এক পরম মুহূর্ত। কাজেই উপাসনা বেদীর এই কক্ষে ছবি তোলা একদম নিষিদ্ধ। বারবার বাঁশি বাজিয়ে এই বেদীকক্ষে ছবি না তুলতে সতর্ক করা হচ্ছিল দর্শনার্থীদের।
অধিকাংশ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের দর্শনার্থী প্রার্থনায়রত ছিল, পরিবেশও শান্ত স্নিগ্ধ যেকোনো ধর্ম উপাসনালয়ের মতো-নীরব, সুনসান। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমাদের তিন জনের আড়ালে ঢুকে নিচু হয়ে সিলিং তাক করে অভিন্ন টুক করে ২/৩টা ছবি তুলে নিলো তার ক্যামেরায়। স্রষ্টাও সৃষ্টির অপরিমেয় এই চিত্রকর্ম নিজের ক্যামেরায় নিজের হাতে তোলার বোধ করি আনন্দই আলাদা, সেজন্যে অভিন্ন এই সুযোগটি হাতছাড়া করেনি বলেই মনে হলো আমার। তবে পরিদর্শন শেষে Creation of Adam-এর একটি রেপ্লিকা পেইন্টিং কিনে এনেছিলাম আমি। যা বাঁধাই করে রেখেছি ধানমন্ডির বাসার বারান্দায়।
তিন.
রোম থেকে ফিরে এসে পরের সপ্তাহে গেছিলাম ফ্রান্সে। সেখানে থাকে ছোট বোন রানুর একমাত্র পুত্র রনি। তাকে দেখার আকুল বাসনা যেমন ছিল, তেমনি প্যারিসের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অতীত খুঁড়ে দেখার স্বপ্ন তো লুকানো ছিলই বুকের খুব গভীর তলদেশে। ইতিহাস বিধৌত জলের ছিঁটায় জেগে উঠেছে সেই অজানা তৃষিত প্রাণ। প্রবল তৃষ্ণায় যেন কাঁপছে ঠোঁট। প্যারিসের যে পথে হেঁটেছেন কবি শার্ল-পিয়ের বোদলেয়ার (১৮২১–১৮৬৭), সেই পথে হাঁটবো আজ আমি ও রফিক আজাদ বাংলাদেশের দু’জন কবি।
এই সাজানো প্রকৃতির চিরকালীন সংগীতের মূর্ছনায় তিনিও নিশ্চয় জেগে উঠেছেন বারবার। তাই তো সহজেই পরাজয় মেনে নেননি। তার পাশে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহত প্রাণের মানুষ।
যিনি পঙ্কে ফোটাতে চেয়েছিলেন পদ্ম, যিনি আধুনিকতার পুরোধা কবি হিসেবে আজো সারাবিশ্বে সমান সমাদৃত। বাঙালি কবিদেরও তিনি প্রভাবিত করেছেন তুমুলভাবে—এমন কি আধুনিকতার গতিপথকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এই কবির শহর—প্যারিস বা প্যারি। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, কাব্যচর্চার সেই ফসলি মাঠে তার পদচ্ছাপ এতকাল পরে খুঁজে পাবো কি? এই অনুভূতি যেন স্বপ্নের চেয়ে বেশি বিস্ময়ের ঘোরলাগা এক জ্যোৎস্নালোক।
এই যাত্রায় আমরা এক পরিবার নই শুধু, ভাই হাবীবের পরিবারও সঙ্গী হবে। সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও আনন্দময় ভ্রমণযাত্রা। কাজেই তার প্রস্তুতিতে রয়েছে ভিন্নতা। ডেলিমন্ডের পাশের শহর ‘বাসেল’ থেকে ভাই হাবীব ১২ সিটের একটি এসইউভি গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে এলো আগের দিন সন্ধ্যায়। পরেরদিন খুব সকালেই ফ্রান্সের উদ্দেশে যাত্রা করলাম ভাই-বোনের দুই পরিবারের আটজন সদস্যের একটি ইউনিক গ্রুপ। ভাইয়ের স্ত্রী রেণু প্রয়োজনীয় কিছু খাবার আগেরদিন তৈরি করে রেখেছিল—সেসব জল-খাবার নিয়ে উঠে পড়লাম খুব সকাল করেই। ব্রেকফাস্ট হবে গাড়িতে বসে, শুধু কাফে খেতে নামবো আমরা পথের ধারের যেকোনো কফিশপে।
ড্রাইভংসিটে এককভাবে ভাই হাবীব ক্লান্তিহীন। তার পরিবারের চারজনই চমৎকার গাড়ি চালায় কিন্তু এই ভ্রমণযাত্রায় সেই আমাদের একমাত্র ভরসা। পথিমধ্যে কফিবারে থেমে ডাবল শর্ট এক্সপ্রেসো পান করলেই ফুল এনার্জিতে আবার ড্রাইভিং সিটে বসে যায় ভাইটি আমার। দুপাশে সর্ষে ক্ষেত দেখে অবাক বিস্ময়ে আমি অভিভূত। ঠিক যেন বাংলাদের সর্ষে ফুলের মতো একটু ঝাঁজালো সুগন্ধের সঙ্গে স্বদেশের আবির মাখা সময়—যা আমাকে বার বার আনমনা করে দিচ্ছিল।
ফ্রান্সের বর্ডার সংলগ্ন মাইল মাইল শর্ষেক্ষেতে হলুদ ফুলের বিস্তারে আমার এমন বিস্ময় দেখে ভাই হাবীব একটা গ্যাস স্টেশন চেইনশপ মার্সের পাশে থামলো। নেমে কফি ও ক্রোঁসো খেলাম সবাই। আমাকে কিনে দিলো বিভিন্ন প্রকারের কয়েকটি ডিজন মাস্টার্ড স্যাম্পল। এদেশের লোকেরা শর্ষের ব্যবহার কিভাবে করে বা খায়—হাতেনাতে তার উত্তরটি যেন দিয়ে দিলো আমার ভাই। গাড়ি পুনরায় চলতে শুরু করলে—অভিন্ন গান ধরলো, ‘গ্রাম ছাড়া এই রাঙামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে’।
সুইজারল্যান্ডেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা আমার ভাইয়ের কন্যা অনন্যা এবং পুত্র প্রীতম মন প্রাণ দিয়ে গানের বাংলা সুর ওকথাগুলো যেন বুঝতে চেষ্টা করছিল। এই সময় ডিজন মাস্টার্ডের কৌটাগুলো আমার হাত থেকে নিয়ে রফিক আজাদ নেড়ে চেড়ে দেখলেন। এরমধ্যে আমরা ফ্রান্সের বর্ডারের কাছাকাছি চলে এলাম। প্যারিস থেকে ভার্সাইয়ের দূরত্ব দশ মাইলের মতো। কাজেই সিদ্ধান্ত হলো ভার্সাইয়ের বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ভার্সাই প্রাসাদ দেখবো আগে, পরে রনির বাসার ক্যান্ডেল ডিনারের নিমন্ত্রণ রক্ষা করবো। খেতে খেতে ভাগনে রনির নতুন বৌয়ের মুখ মুখবো।
পাঁচ ঘণ্টার জার্নি শেষে আমরা পৌঁছে যাই ভার্সাই প্রাসাদের সমুখে গাড়ি পার্কিং লটে। সেখানে গাড়ি রেখে হাবীবসহ আটজনই আমরা প্রবেশ করি ভার্সাই প্রাসাদে। ভাতিজা প্রীতম টিকিট কেটে নিয়েছিল আগেই। দলবদ্ধভাবে আমরা প্রাচীন এই প্রাসাদের রূপ-সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে ঢুকে এবং থেমে ছবিও তুলছিলাম। ভার্সাই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রাজপ্রাসাদের মধ্যে অন্যতম একটি এবং এর দেয়ালে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নিজের হাতেরআঁচড়ে তৈরি শিল্পকর্ম স্থান পেযেছে। না, পেইন্টিং হিসেবে নয় বরং ওয়ালপেপার হিসেবে।
রফিক আজাদ কিছুক্ষণ দেখার পরেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন, জানি এসব ঝলমলে বৈষয়িক ব্যাপার-স্যাপার তার পছন্দ নয়। তবে এর ইতিহাস যে কাউকে কৌতুহলী করে বৈকি। ফরাসি সম্রাট ত্রয়োদশ লুই সর্বপ্রথম ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে ইট ও পাথর দিয়ে ভার্সাইয়ে একটি হান্টিং লজ নির্মাণ করেন। সেটিই ছিল শাঁতো দ্যু ভার্সাইর সূচনা। তার মৃত্যুর পর প্রায় ১৮ বছর এই প্যালেস অব্যবহৃত ছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় ফরাসি নৃপতি লুই চতুর্দশ নিজের বাস ভবন হিসেবে বিশাল প্রাসাদ ও উদ্যান সম্প্রসারণ করেন। ফ্রান্সের অসীম ক্ষমতাধর রাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ভার্সেই রাজপ্রাসাদ। এই প্রাসাদে আছে দুই হাজার কক্ষ। এর চেয়ে কয়েকগুণ দরজা-জানালাবিশিষ্ট এ প্রাসাদটির সংগ্রহে আছে ছয় হাজার ১২৩টি পেইন্টিং ও দুই হাজার ১০২টি ভাস্কর্য। অথচ ৪৫০ বছর আগে ভার্সাই মূলত প্যারিসের অদূরের একটি সাধারণ গ্রাম ছাড়া আর কিছু ছিল না। প্রথমে সম্রাট ত্রয়োদশলুই এর চারপাশে চল্লিশ হেক্টর জমি ক্রয় করেন। ইতিহাস-খ্যাত বিখ্যাত স্থপতি ‘লুই লা ভাউ’ প্রাসাদটির ডিজাইন এবংনির্মাণকাজ তদারকি করেছিলেন।
একথা অস্বীকার করা যায় না যে, ঝলমলে আলোকখচিত রাজপ্রাসাদটি যেন সোনালি উর্মিমালার মতো ঢেউ খেলে যাচ্ছিল নয়ন থেকে নয়নে। বিস্মিত, বিস্ফারিত নয়নে নয়ন রেখে দেখছিলাম সেসব। স্থাপত্য কলার অনন্য নিদর্শন ছাড়াও প্রাসাদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম নয়। ১৭৮৩ সালে ‘পিস অব প্যারিস’ চুক্তি এখানে সম্পাদিত হয়, ১৯১৯ সালে ‘ভার্সাই চুক্তি’ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয় এই রাজপ্রাসাদ থেকেই। চতুর্দশ লুইয়ের হাতে গড়া এই প্রাসাদটি ১৬৮২ সাল থেকে ফ্রান্সের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় যা ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অবলুপ্তি ঘটে।
বারবার মনে পড়ছিল এই ভার্সাই নগরে একদা বাস করেছেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। একবার যদি তার বাসস্থাটি দেখতে পেতাম নয়ন মেলে—আহা, বাংলা সাহিত্য পাঠ যেন আমার সার্থক হতো চিরজনমের মতো। কিন্তু জানি, এই অল্প সময়ে তা সম্ভব হবে না। কাজেই এই রাজপ্রাসাদ পেছনে বাগানের শেষদিকে পুরোনো দিনের একটি ছোট ‘ক্যাফে বার’ আছে। এখানেই আসতেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সেই ক্যাফে বারটি হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম তখন। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে চোখে পড়লো সবুজ বৃক্ষবেষ্টনীর মধ্যে এক অপরূপ অপেরা হাউজ—যা নির্মিত হয়েছিল পঞ্চদশ লুইয়ের সময়ে।
রাজপ্রাসাদের পেছনে এসে দেখলাম মনোরম এক লেক, ঝর্ণা, বিচিত্র সব ভাস্কর্য—অব্যয় প্রতিটি ভাস্কর্যে হাত বুলিয়ে অনুভব করছিল শিল্পের মহিমা। আর মাঝে মধ্যেই তার বাবার সঙ্গে দুষ্টুমি করছিলো সেসব মানবমূর্তির আকৃতি প্রকৃতি নিয়ে। অভিন্ন এবং অনন্যা অবশ্য খুব সিরিয়াস ইতিহাস প্রেমীর মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল বেশ সময় নিয়ে। পরিতৃপ্ত শিক্ষার্থীর মতো জ্ঞানের আনন্দে কিছুটা উদ্বেলিত, একই সঙ্গে বিস্ময়ে বিমোহিতও বটে। বাতাসে ভেসে বেড়াচেছিল যেন অতীত ইতিহাসের মৃদুমন্দ সুরভিত সুন্দর। জ্যামিতিক ফুলের বিছানা ও কালারফুল সব ফুলের সাজ-সজ্জা দেখে আমি তো সবিস্ময়ে হতবাক।
কত যে ছবি তুলেছিলাম পাগলের মতো ভাবা যায় না। গাছের খাঁজে খাঁজে সজ্জিত বাগান—সেও এক পরম বিস্ময়। নানা রকম ফলের গাছে ফল ধরে আছে, বিচিত্র রঙের বিভিন্নপাখির কল-কাকলিতে মুখর হয়ে আছে চারপাশ। দীর্ঘ লেকটি চলে গেছে দক্ষিণের প্রান্ত পর্যন্ত। এই বাগানের পথ ধরেই কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে খুঁজে পেলাম পুরোনো দিনের একটিছোট ‘ক্যাফে বার’। এই ক্যাফেতে মধুসূদন এসে বসতেন। সময় কাটত প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখে। নিশ্চয় মনে পড়ত তার বাংলার পথ-প্রান্তরের কথা।
বঙ্গ ভাণ্ডারে বিবিধ রতনের কথা ভেবে নিশ্চয় আকুল ও উন্মনা হতেন তিনি। রফিক আজাদ হঠাৎ বলে উঠলেন, আমিও তো এই মাইকেল ঘরানার কবি। যে কিনা শেষ পর্যন্ত মোমের দু’ধারের সলতে আগুনদিয়ে সবকিছু শেষ করছে দ্রুত। প্রকৃত কবির ভাগ্য এমনি হয়! আহা, সনেটের কবি। বাংলা ভাষার কবি। আধুনিক মহাকাব্যের এক বাঙালি কবি। যিনি এই রাজপ্রাসাদের আঙিনায় চরম কষ্টের মধ্যেও ঘুরে বেড়িয়েছেন। হয়তো সন্তানদের নিয়েও এসেছেন। লেকের পাশে বসেগল্প শুনিয়েছেন তার নিজের বাংলা প্রকৃতির। হয়তো হেনরিয়েটাও তখন কবির পাশে বসে মনোবল উৎসাহ দিয়েছেন কাব্য রচনায়। মেঘনাদবধ মহাকাব্যে রাবনের লঙ্কাপুরীর প্রমোদ উদ্যানের যে বর্ণনা পাই, এতেই বুঝি কতটা প্রকৃতি পূজারি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত নিজেই। এই সাজানো প্রকৃতির চিরকালীন সংগীতের মূর্ছনায় তিনিও নিশ্চয় জেগে উঠেছেন বারবার। তাই তো সহজেই পরাজয় মেনে নেননি। তার পাশে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহৎ প্রাণের মানুষ।
সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছেন বলেই একজন বঙ্গভাষার কবি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশ্ববাসীর কাছে। শত দর্শনার্থীর ভিড় এড়িয়ে বাংলাদেশের আরও দু’জন কবি এই ভার্সাই প্যালেসের ছোট্ট একটি ক্যাফে বারে এসে তাকেই খুঁজে ফিরছে। একেই বুঝি বলে শতবর্ষ পরেও কবির বেঁচে থাকা?
চলছে…