বেগম রোকেয়া (১৮৮০—১৯৩২) ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালের একজন মুসলমান নারী লেখক; বর্তমানের বিবেচনায় একজন ‘বাঙালি লেখক’। তিনি ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরবঙ্গের রংপুরের পায়রাবন্দের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের, মাতার নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। অভিজাত মুসলমান পরিবারের সন্তান হিসাবে পর্দাপ্রথার মধ্যেই তিনি বড় হন, আর সে কারণেই বাড়ির বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করা তাঁর হয়ে ওঠে নাই। রোকেয়া যথারীতি গৃহপরিবেশে পড়াশোনা করেন। তাঁর জন্মের সময়ই বড়বোন করিমুন্নেসা খানম (১৮৫৫—১৯২৬) পারিবারিকভাবে, হয়তো সাহিত্যিক মহলেও একজন প্রতিষ্ঠিত কবি। করিমুন্নেসার উচ্চ শিক্ষিত দুই বিখ্যাত পুত্র স্যার আবদুল করীম গযনভী (১৮৭২—১৯৩৯) এবং স্যার আবদুল হালীম গযনভী (১৮৭৯—১৯৪৬) রোকেয়ার প্রায় সমবয়সী। কাজেই এ-যুগে যারা মনে করেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে শিক্ষাগ্রহণ কেমন করে সম্ভব, তারা ভুল করেন। কবি আবদুল কাদির জানান, বড় বোনের বাসায় ইউরোপীয়ান গভর্নেসের কাছে রোকেয়া প্রথমে ইংরেজি শেখেন। রোকেয়ার পারিবারিক পরিবেশ অবশ্যই শিক্ষার অনুকূলে ছিল। বড় ভাইয়েরা ও ভাগ্নেরা শিক্ষিত ছিলেন। ভাগ্নেরা পরে আইনসভার সদস্য হন, বড় ভাগ্নে করীম তো মন্ত্রীও ছিলেন অনেক বছর, বিদেশে কূটনীতিবিদ হিসাবেও চাকরি করেছেন, ছোট ভাগ্নে হালীমও আইনসভার সদস্য এবং কলকাতার শেরিফ ছিলেন। চিঠিপত্রে একজন চাচাতো বোনের কথা পাওয়া যায়—মরিয়ম রশীদ, তিনিও শিক্ষিত ছিলেন। পারিবারিক পরিবেশে পড়াশোনা করে রোকেয়া বাংলা, ইংরেজি এবং মুসলমান আভিজাত্যের প্রতীক উর্দু আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি ফারসিভাষাও বেশ ভালোভাবে জানতেন, বিভিন্ন রচনায় ফারসি সাহিত্যের অনেক উদ্ধৃতি দেখে তেমনই ধারণা হয়।
সম্ভবত গদ্য রচনার মাধ্যমে রোকেয়া লেখালেখি শুরু করেন। জীবিতকালে আরএস হোসেন, মিসেস আরএস হোসেন, রোকেয়া খাতুন, রোকেয়া খানম, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ইত্যাদি নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বর্তমানে বহুল পরিচিত নাম ‘বেগম রোকেয়া’-কে মান ধরেই বর্তমান আলোচনার প্রয়াস। বেগম রোকেয়া বাংলাসাহিত্যের অনেক শাখায় বিচরণ করেছেন। যদিও তাঁর প্রধানত প্রাবন্ধিক পরিচয়টাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি দুটি উপন্যাস লিখেছেন, পদ্মরাগ (১৯০৯) ও সুলতানাস ড্রিম (১৯২৮)। ছোটগল্প লিখেছেন সাতটি: ‘ভ্রাতা ও ভগ্নি’, ‘প্রেম-রহস্য’, ‘তিনকুঁড়ে’, ‘পরি-ঢিবি’, ‘বলিগর্ত্ত’, ‘পঁয়ত্রিশ মণ খানা’ ও ‘বিয়ে-পাগলা বুড়ো’। এছাড়া কিছু কবিতা রচনা করেছেন। এই সামান্য (এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত পনেরোটি) কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করা কেন প্রয়োজন হয়ে গেলো—এটা একটা সম্ভাব্য প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বেগম রোকেয়ার কবিতা নিয়ে কিছু সংশয় উত্থাপন করা প্রয়োজন। এর কারণও আছে। যেমন,
১। বেগম রোকেয়ার কবিতাগুলো ঠিকমতো চিহ্নিত করা হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। তাঁর অপ্রকাশিত কবিতা উদ্ধার করা, প্রকাশিত কবিতাগুলো পুনরুদ্ধার করা এবং যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে কি?২। তথ্যে পাওয়া যায়, রোকেয়া ইংরেজি কবিতা লিখে পুরস্কার পেয়েছিলেন১, সেই ইংরেজি কবিতাটি তো তাঁর রচনাবলির কোথাও দেখা যাচ্ছে না, তাহলে কবিতাটি রয়ে গেলো কোথায়? তিনি কি ইংরেজি কবিতা শুধু ঐ একটিই লিখেছিলেন, নাকি একাধিক? তাঁর হারিয়ে যাওয়া কবিতার সংখ্যা কত?৩। ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে কয়েকটি কবিতা আছে।২ সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি উদ্ধৃতিচিহ্নযুক্ত এবং কয়েকটি উদ্ধৃতিচিহ্নবিহীন। চিহ্নবিহীন কবিতাগুলো সাধারণ নিয়মেই বেগম রোকেয়ার রচনা বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য, কিন্তু সেগুলো রোকেয়ার কবিতা অংশে গৃহীত হয় নাই, কেন?
সংখ্যায় অল্প হলেও বেগম রোকেয়ার কবিতার গুরুত্ব কিছু তো অবশ্যই আছে। কারণ, তিনি অন্য লেখকদের মতো কিশোরী বয়সে কবিতা রচনার মাধ্যমে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করে, পরে অন্য শাখায় স্থিত হন নাই। বরং বলা যেতে পারে, তাঁর পরিস্থিতি ছিল অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। তিনি প্রথমে প্রবন্ধ রচনা করেছেন, পরে কবিতা লিখেছেন। তবে সময়ের ব্যবধান খুব বেশি দূরের নয়। সমসাময়িক কালেই তিনি গদ্য ও পদ্য রচনায় হাত দেন। এসব লেখালেখি তিনি শুরু করেছেন বিবাহিত জীবনে। তাঁর বিয়ে হয় ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে, ১২৯১ বঙ্গাব্দে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ পিপাসা নবপ্রভা পত্রিকার চৈত্র ১৩০৮ ও বৈশাখ ১৩০৯ (যুগ্ম) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বড়ভাই হরেন্দ্রলাল রায় ও জ্ঞানেন্দ্রলাল রায়।৩ আর প্রথম কবিতা বাসিফুল প্রথম প্রকাশিত হয় নবনূর পত্রিকার ফাল্গুন ১৩১০ সংখ্যায়। এতে বোঝা যায় তিনি কবিতা লিখেছেন পূর্ণ বয়সে সাবালিকা হওয়ার পরে, সজ্ঞানে এবং সম্পূর্ণ সচেতনভাবে। তিনি কবিতা লিখেছেন যে কথা গদ্যে লেখা যায় না সে কথাগুলো প্রকাশ করার জন্য। কাব্যভাষা আর অলঙ্কারের রূপক-উপমা-উৎপ্রেক্ষার আড়ালে নিজের দীর্ঘশ্বাসগুলো মোজাইক করে রাখতে চেয়েছেন। যদিও তাঁর কবিতা সৌন্দর্যপ্রধান নয়, বরং বক্তব্যপ্রধান এবং বেদনাবাহী। তাঁর কবিতায় রয়েছে ব্যক্তিজীবনের বেদনা এবং বিষণ্নতার কতগুলো প্রত্নলিপি। সেগুলো পাঠ করলে তাঁর মনের গোপন দিকটি একটি দৃষ্টিতে অবলোকন করে নেওয়া যায়।
দুই
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত আবদুল কাদির সম্পাদিত বেগম রোকেয়া রচনাবলীতে রোকেয়ার কবিতার সংখ্যা বারোটি। ১। বাসিফুল, ২। শশধর, ৩। প্রভাতের শশী, ৪। পরিতৃপ্তি, ৫। নলিনী ও কুমুদ, ৬। স্বার্থপরতা, ৭। কাঞ্চনজঙ্ঘা, ৮। কাঞ্চনজঙ্ঘা (ভিন্ন কবিতা), ৯। প্রবাসী রবিন ও তাহার জন্মভূমি, ১০। সওগাত, ১১। আপীল ও ১২। নিরুপম বীর।৪
সন্তানহীনতা, সন্তানের অকালমৃত্যু এবং স্বজন হারানোর বেদনার সাথে সবকিছু মিলে মিশে সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধস্রোতে এগিয়ে চলার জন্য বেগম রোকেয়াকে কত যন্ত্রণা সইতে হয়েছে এই কবিতা তার নিদর্শন।
২০০৬ খ্রিস্টাব্দে আবদুল মান্নান সৈয়দ, সেলিনা হোসেন ও অন্যান্য সম্পাদিত বাংলা একাডেমী থেকে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ বেগম রোকেয়া রচনাবলীতে তেরোটি কবিতা পাওয়া যায়। এখানে দশম অবস্থানে স্থান পায় আমি ও মন কবিতাটি।৫ নতুন সংস্করণের ভূমিকায় সম্পাদনা পরিষদ জানান, নতুন সংকলনে কয়েকটি প্রবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। “লায়লা জামান সংকলিত ও সম্পাদিত ‘দি মুসলমান পত্রিকায় রোকেয়া প্রসঙ্গ’ (১৯৯৪) এবং অভিজিৎ সেন সম্পাদিত ‘অগ্রন্থিত রোকেয়া’ (১৯৯৮) অনুসন্ধানের সহায়ক হয়েছে।” নবযুক্ত কবিতাটি কোথা থেকে, কীভাবে সংগৃহীত হয়েছে সে তথ্য ভূমিকায় নাই। তবে রোকেয়ার অগ্রন্থিত কবিতার সংখ্যা হলো, তেরো।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘কালি ও কলম ডট কম’-এ প্রকাশিত ড. আবুল আহসান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘রোকেয়ার অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত চিঠিপত্র ও রচনার সন্ধানে’ নামক রচনায় গবেষক জানান, “রোকেয়ার দুটি অগ্রন্থিত গদ্যরচনা এবং অপ্রকাশিত দুটি চিঠি ও একটি অগ্রন্থিত চিঠি এখানে সংকলনের সুযোগ আমাদের ঘটেছে।”৬ এরপর তিনি লেখাগুলো তুলে ধরে আলোচনা করেছেন। রচনার শেষের দিকে জানিয়েছেন, “রোকেয়ার অপ্রকাশিত লেখার সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।” তবে আবুল আহসান চৌধুরী সে সম্ভাবনা ক্ষীণ বললেও অসম্ভব বলেন নাই, সম্ভবই বলেছেন।
সম্প্রতি কলকাতার একটি সাহিত্যবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘মিলন-সাগর ডটকম’ রোকেয়ার পনেরোটি কবিতা প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশে প্রাপ্ত তেরোটি কবিতার সাথে নতুন যুক্ত হয়েছে আরো দুটি কবিতা, ১। গ্রীষ্ম ও ২। ব্যর্থ স্বপ্ন। ওয়েবসাইটের অ্যাডমিন কবিতা দুটির প্রাপ্তিস্থান বা সূত্র উল্লেখ করে দিয়েছেন। সে সূত্র অনুসারে গ্রীষ্ম কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে মৌলবী আবদুল হাকিম সম্পাদিত ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার ভাদ্র, ১৩৩০ সংখ্যায়। আর ব্যর্থ স্বপ্ন কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় মাওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার ৫ম বর্ষ, বৈশাখ ১৩৩৯ সংখ্যায়। ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেসের শেষে ‘হ্যাশ ১৪’ দেখে ধারণা করা যায় কবিতা দুটি ২০১৪ সালে আপলোড করা হয়েছে।৭
তিন
রোকেয়ার প্রথম প্রকাশিত কবিতা বাসিফুল। এটি সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত নবনূর পত্রিকায় ফাল্গুন ১৩১০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। কবিতাটি বাৎসল্য এবং করুণ রস দিয়ে লেখা একটি শোকগীতি। পড়লে বোঝা যায় তাঁর কোনো শিশু ভাইপোর অকালমৃত্যুতে কবিতাটি লেখা হয়েছে। যে শিশু সুন্দর করে কথা বলতে পারত, ফুফুর জন্য বাসিফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসত। সেই শিশুর অকালমৃত্যুর সাথে জড়িয়ে আছে বেগম রোকেয়ার মাতৃস্নেহ বিচ্ছিন্ন দুটি অকালমৃত শিশুসন্তানের শোক। রোকেয়া তখন ভাগলপুরবাসী। তাঁর স্বামী তখন উড়িশ্যার কনিকা এস্টেটের কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ম্যানেজার পদে ছেড়ে নিজদেশ বিহারের ভাগলপুরে কমিশনারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে চাকরি নিয়ে এসেছেন। স্ত্রীকে সময় দিচ্ছেন সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। যদিও দুজনের বয়সের ব্যবধান অনেক, তবু কন্যাবয়সী স্ত্রীকে সময় দিয়ে, নানাভাবে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে পর পর দুই বছর রোকেয়ার দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে, কিন্তু স্বল্পায়ু সেই কন্যারা অচিরেই পিতা-মাতার কোল খালি করে চলে গেছে। এখানেই রোকেয়াকে ধীর এবং শান্ত মনে হয়, নিজের দুটি সন্তানের মৃত্যুতে তিনি এভাবে বেদনা প্রকাশ করেন নাই, যেভাবে করেছেন ভাতিজার মৃত্যুতে।
আসলে নিজের সন্তানের মৃত্যুতে রোকেয়ার শোক জমাট বেঁধে ছিল, এরই মধ্যে কথা বলতে পারা শিশু ভাতিজার মৃত্যুর শোকের সাথে নিজের সন্তানহারা মায়ের আকুতি যুক্ত হয়ে এই কবিতাটির জন্ম দিয়েছে।
পাব না প্রাণের ধন, পাব না সে ফুল।আর শুনিব না প্রাণ সে রলিত কণ্ঠতানপ্রেমের পীযূষ-ভরা রাগিণী মঞ্জুল।
কবিতাটিতে বিধির সর্বশক্তিমানতা নিয়ে কিছুটা দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে তিনি ভুল বলে মনোভাব প্রকাশ করেছেন, পরে আবার বিশ্বাসে ফিরে এসেছেন।
‘শশধর’ কবিতাটি চৈত্র-১৩১০ বঙ্গাব্দে নবনূর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই কবিতাটির প্রকাশকাল আগের কবিতার একমাস পরের। এটি একেবারেই মন্ময় কবিতা। এখানে রোকেয়ার নিঃসঙ্গতা ও রিক্ততার গোপন বেদনা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি চাঁদকে সম্বোধন করে কবিতাটি রচনা করেছেন, কিন্তু কবিতায় চাঁদ আসলে নিজেরই রূপক। এ কবিতায় মানুষের একাকীত্বের গভীরতর স্তরের গোপন অশ্রু প্রকাশ করেছে। সামাজিক একাকীত্ব একরকম— এটা বলা যায় রোকেয়ার ছিল। যদিও তিনি পরপর দুজন সন্তান হারিয়েছেন, প্রিয় আদরের ভাতিজাকে হারিয়েছেন, কিন্তু স্বামী তো উড়িশ্যা ছেড়ে বিহারে স্ত্রীর কাছে চলে এসেছেন, স্ত্রীকে সঙ্গ দিচ্ছেন। তাতে কি একজন সৃষ্টিশীল মানুষের সামাজিক এককীত্বের ভেতরের গোপন একাকীত্ব ঘোচে? যদি তাই হতো, তাহলে এমন কথা তিনি লিখলেন কেন?
না বুঝে’ অবোধ নরে কত অনুমান করেঅথবা অমিয়া ভ্রমে ভীষণ গরলহৃদয়ে পুরিয়া—মুখে হাসিছে কেবল!
এ কবিতায় মনে হচ্ছে স্বামীকেও রোকেয়ার আপনজন মনে হচ্ছে না। স্বামীর আগের স্ত্রীর কন্যা রোকেয়ার বয়সী, তিনি বিবাহিতা হলেও বাপের বাড়িতে তার ছিল ভালো দাপট। এটাও একটা ঝামেলা মনে হতে পারে। হতে পারে কি, সত্যিই বিরাট বিপদের কারণ কয়েছে রোকেয়ার সেই সৎকন্যা। স্বামী সাখাওয়াতের মৃত্যুর পরে রোকেয়া সেই সৎকন্যার মানসিক উৎপীড়নে বেশিদিন ভাগলপুরে থাকতে পারেন নাই। সেই কন্যা রোকেয়াকে স্বামীর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। স্বামীর মৃত্যুর পরপরেই বিধবা রোকেয়াকে ভাগলপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ আবদুল মালেকের বাসভবনে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। এরপরে সৎকন্যার অত্যাচারে ভাগলপুরে টিকতে না পেরে পরের বছর চিরতরে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে, সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে কলকাতায় আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে যেতে হয়েছে। কলকাতায় গিয়ে কোনও আত্মীয়ের বাসায় না উঠে সেই ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ আবদুল মালেকের ছোট ভাই সৈয়দ আবদুস সালেকের বাসায় উঠেছেন। ভুলে গেলে চলবে না, রোকেয়ার আপন দুই ভাগ্নে তখন দেশের ও দশের মাথার উপরে অবস্থান করছেন— সাংসদ ও মন্ত্রিপর্যায়ের মানুষ, বিরাট তাঁদের ক্ষমতা। রোকেয়া তাঁদের কাছে বিচার চাইলে, নালিশ করলে অবশ্যই সুবিচার পেতেন। কিন্তু তিনি নিজের দুঃখের কথা কাউকে জানান নাই। তাই তিনি চাঁদকে জানাচ্ছেন সকল বেদনার কথা, ফেলছেন গোপন অশ্রু, আর লিখে যাচ্ছেন কথাবলা শব্দমালা।
দুটি সান্ত্বনার কথা তোমারে যে বলে,নাই কি এমন কেহ বিশ্ব-ভূমণ্ডলে?এত তারা আছে, কেহ তোমারে করে না স্নেহ?তাই তুমি, শশধর! বসিয়া বিরলে,নিশীথে জুড়াও প্রাণ ভিজি’ আঁখিজলে।
এখানে একেবারে স্পষ্ট যে স্বামীর উপস্থিতি ও ভূমিকা কবির কাছে যথেষ্ট ছিল না। তিনি সারা ভূমণ্ডলে নিজেকে একা দেখতে পাচ্ছেন, আকাশের চাঁদ ছাড়া আর কাউকে মনের কথা বলার জন্য খুঁজে পাচ্ছেন না। গোপন অশ্রুপাতের কথাও তিনি চাঁদকে ব্যক্ত করছেন। এরপর,
কি দেখিছ, শশধর! আমার হৃদয়?তোমারি কলঙ্ক-সম অন্ধকারময়!শুধু পাপ, তাপ, ভয়, শোকে পূর্ণ এ-হৃদয়,এ নহে উজ্জ্বল শুভ্র সরলতাময়।কি দেখিবে, শশধর, এ পোড়া হৃদয়?
কবিতার স্তবকের পর স্তবকজুড়ে কবি নিজেকেই বুনে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে নিজেকে প্রকাশ করছেন। এখন বোঝা যাচ্ছে কবি রোকেয়াকে সামাজিক নানা গঞ্জনা সইতে হয়েছে। সন্তানহীনতা, সন্তানের অকালমৃত্যু এবং স্বজন হারানোর বেদনার সাথে সবকিছু মিলে মিশে সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধস্রোতে এগিয়ে চলার জন্য বেগম রোকেয়াকে কত যন্ত্রণা সইতে হয়েছে এই কবিতা তার নিদর্শন।
অনেক পরিব্রাজক দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করেও মেঘমুক্ত পর্বত দেখার সুযোগ পান না, কিন্তু কবি সেটি পেয়েছেন।
‘প্রভাতের শশী’ পরের বছর নবনূর পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় বৈশাখ সংখ্যায়। এটিও সমকালীন কবিতা, পরের মাসে প্রকাশিত হয়েছে। এখানেও কবি মনের কথা প্রকাশ করেছেন চাঁদের কাছে। এখানেও নিজের মনোবেদনা প্রকাশ করেছেন কবি। বিধবার কলঙ্ক এবং কলঙ্কভীতি শুধু মধ্যবিত্তের নয়, রোকেয়ার মতো সমাজের উচ্চবিত্তেও এ সমস্যা বেশ প্রকট ছিল। কবিতাটি পড়ে মনে হতে পারে, এটি বুঝি বিধবা হওয়ার পরের কবিতা, কিন্তু তা না; এটি সধবা থাকার সময়ই লিখেছেন। স্বামীর মৃত্যুর অনেক বছর আগের লেখা এটি। বারবার তিনি এই কলঙ্কের কথা লিখেছেন। চাঁদের নানা গুণের কথা লিখে শেষে জানাচ্ছেন চাঁদ শুধু পরের জন্যই সুধা বিতরণ করে, এতে সে কী পায়? কিছুই পায় না।
বুঝিলাম এতক্ষণে কলুষিত এ ভুবননাই স্বার্থহীন আর তোমার মতন।
এখানেও কবি চাঁদের রূপকে নিজেকে প্রকাশ করেছেন বলেই কবিতাটি গীতিকবিতা। চাঁদের বস্তুগত উপস্থিতির চেয়ে চাঁদের প্রাণসত্তাকে কবিতায় বিশেষ স্থান নিয়েছেন বলেই কবিতাটি মন্ময়। সবশেষে চাঁদের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে নিজের কথাটা এভাবে প্রকাশ করেছেন,
আর ভাই শশধর! এই আশীর্ব্বাদ কর,পরদুঃখে পারি যেন করিতে রোদন,জাগি দীর্ঘ নিশা শশি! দুঃখীর শিয়রে বসিঢালি যেন শান্তি সুধা তোমার মতন।
কবিতাটির এ স্তবক রোকেয়ার ভবিষ্যতের পথরেখা। তিনি পরবর্তী জীবনে যা করে গেছেন, তার একটি প্রতিজ্ঞাপথ যেন এ কথাগুলো।
‘পরিতৃপ্তি’ কবিতাটি পরের মাসে, অর্থাৎ ১৩১১ সনের জ্যৈষ্ঠ মাসের মহিলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন গিরীশচন্দ্র সেন। এ কবিতায় একটি গল্প আছে। এক রাজার সাথে একজন ফকিরের তৃপ্তি নিয়ে বিতর্ক হয়। রাজা ঐ পথের ফকিরকে নিজের গায়ের পোশাক দান করলে ফকির তা নিতে অস্বীকৃতি জানায়,
ফকির তখন কয়, “শুন রাজা মহাশয়,শীত গ্রীষ্ম মোর তরে একই সমান।ধন লয়ে কি করিব? অযতনে পেলে দিব,—নাই যে আমার রাজ্য। রাখিবার স্থান,—তব শাল, মুদ্রা তাই করি প্রত্যাখ্যান।”
এ কবিতায় এখানে আসার পরে মনে হয় রোকেয়ার দাম্পত্যজীবনের কোনো গোপন বঞ্চনা ও আশাভঙ্গের কাব্যরূপ এটি। ‘গৃহ’ প্রবন্ধে যে জানিয়েছেন নারীর কোনো ঠিকানা নাই, এখানে বুঝি তারই পূর্বাভাষ! তৃপ্তি নিয়ে তাঁর মনের কথাগুলো এখানে পরিস্ফুটিত হয়েছে। সবশেষে লিখেছেন,
তৃপ্তি বিধাতার দান, তৃপ্তি দিয়ে যে পরাণবিধি তুষিয়াছে— তৃপ্তি সেইখানে রয়।
রাগ, ক্ষোভ, অভিমান যে কোনো ঘটনাই হোক, কিছু তো ঘটেছে, আর তারই পরিণতিতে নিজের একটা অবস্থান করে নিয়েছেন কবি। এখানেই তাই মনে হয়। নিজেকে ‘বোরহানা’ বা পথের ফকিরের সাথে তুলনা করে কবি সারাবিশ্বের নারীর অবস্থাটা তুলে ধরেছেন। সমাজের যে শ্রেণীতেই অবস্থান হোক না কেন, ফকিরের মতো জীবন যাপন করতে পারলেই শুধু তৃপ্তিলাভ সম্ভব, না হলে পরের সম্পদ তার কাছে বোঝা হয়ে ঝুলে থাকবে। কবিতার এসব কথা তাঁর পরবর্তী জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধেরই ভূমিকামাত্র।
‘নলিনী ও কুমুদ’ কবিতাটি আষাঢ়, ১৩১১ সংখ্যা নবনূর পত্রিকায় প্রকাশিত। এটি দু’জন নারীর সংলাপের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত একটি মন্ময় কবিতা। এখানে বিশ্বপ্রকৃতির অপরূপ লীলাবৈচিত্র্য দেখে বিমুগ্ধ হয় কুমুদ, কিন্তু তার সখা নলিনীর মন-প্রাণ বিষাদে বিষণ্ন, বেদনায় দগ্ধ। নলিনীর এখন আর বেঁচে তাকার আকাক্সক্ষা নাই। রোকেয়ার আগের কবিতাগুলোর দুঃখবোধ এখানে এতটাই তীব্রতা লোভ করেছে যে, জীবনের কোনো দিকের প্রতি আর আকর্ষণ নাই তার। সব দিক অন্ধকার হয়ে গেছে। এমনকি বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাও হারিয়ে গেছে।
কবিতাটি শুরু হয়েছে নলিনীর এই সংলাপ দিয়ে,
দুর্বল হৃদয় পারে না বহিতে দারুণ যন্ত্রণা হেন;জীবন-সর্বস্ব হারায়েছি যদি, পরান যায় না কেন?শরীর-পিঞ্জরে এ প্রাণ-বিহগ থাকিতে চাহে না আর,এস মৃত্যু। ত্বরা কর বিদূরিত দুঃসহ জীবন-ভার।
নলিনীর জীবনে আশার আলো জাগানোর চেষ্টা করে কুমুদ। এখানে নাটকীয়ভাবে কুমুদের পাঁচটি সংলাপের মধ্য দিয়ে জীবনকে ইতিবাচকভাবে দেখার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু নলিনী ছয়টি সংলাপের মধ্য দিয়ে তাঁর মনের গোপন দুঃখবোধ, জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধা আর মৃত্যু-আহ্বান প্রকাশ করেছে। রোকেয়ার দুঃখবোধ এতটা যে তীব্র হয়েছিল, তা তাঁর প্রবন্ধসাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যায় না, কিছু হয়তো অনুমান করা যায়। তাঁর কবিতাগুলো বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পড়লে সে দুঃখের অতরে একবার ডুব দিয়ে আসা যায়। আর দুঃখের সেই অতল থেকে উঠে আসার পরে রোকেয়ার জীবনীসংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তিকে নিয়েই ঘোরতর সন্দেহ জাগে। আসলে কি রোকেয়াকে কেউ বুঝতে পারতেন? কোনো কবিকেই কি কেউ বুঝতে পারে?
কবিতাটি শেষও হয়েছে নলিনীর সংলাপে, যেখানে রয়েছে তীব্রতম মৃত্যুকামনা।
হায় যম! আর কতক্ষণ হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?দেখি, পাই কি না শান্তি-বারিকণা ডুবিলে এ সরোবরে!!
‘স্বার্থপরতা’ কবিতাটি মহিলা পত্রিকার আষাঢ়, ১৩১১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘নলিনী ও কুমুদ’ এবং এই কবিতাটি একই মাসে দুটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সে কারণেই ধারণা করি রচনাও সমকালের। এ কবিতার বিষয়বস্তুতেও কবির মনের খেদ স্পষ্ট বোঝা যায়। স্বার্থপরতা আর পরার্থপরতা নিয়ে সমাজের মানুষের ধারণাগুলো তিনি তুলে ধরে সাধারণ বিচার করেছেন।
সকলে কেবল খোঁজে “আত্মসুখ”—“স্বার্থহীন” কে আবার?স্বার্থপর হেরি বিশ্ব চরাচরকে আছে “পরার্থপর”?এত ছল কেন? সোজা কথা বল,“সকলেই স্বার্থপর।”স্বার্থপরতাই প্রচ্ছন্ন যেখানেপরার্থ তারেই কয়।”
কবিতার শেষে কবি জানান, পরার্থপরতা একটি ছলমাত্র। এ সময়ের কবিতায় কবির মানসিক অবস্থা একটি সংকটময় পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বলে বোঝা যাচ্ছে। কবির এই মানসিক অবস্থা বোধহয় তাঁর স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন সাহেব বুঝতে পেরেছেন। কবিতাগুলো যেহেতু ছাপা হচ্ছিল, তাই কবির স্বামীর চোখে না পড়ে পারে না। এসব কবিতায় প্রকাশিত যত অভিযোগ, তা তো সৈয়দ সাহেবের ওপরই বর্তায়। দিনে দিনে রোকেয়ার অবস্থা তীব্র সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। এসব ঘটনা ১৯০৩-৪ সালের দিকের। রোকেয়ার মানসিক অবস্থা টের পেয়েই সম্ভবত সাখাওয়াত সাহেব রোকেয়াকে নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় পরিদর্শনে যান ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে। তবে এই পার্বত্যভ্রমণ কোন মাস হয়েছিল তা জানা গেল না। কাঞ্চনজঙ্ঘা ভ্রমণ করার পরে রোকেয়ার মানসিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটেছে বলেই ধারণা করা যায়। কারণ, এর পরের কবিতাগুলোতে আগের মতো হতাশা, ব্যর্থতা, সন্দেহ, মৃত্যুকামনা এসব নেতিবাচক মানসিকতার দিকগুলো অনেকটাই অপসৃত হয়ে গেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বত নিয়ে কবি একই নামে দুটি কবিতা রচনা করেন। দুটি কবিতাই প্রকাশিত হয় ১৩১১ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে; একটি নবনূর এবং অন্যটি মহিলা পত্রিকায়। তবে কোনটি কোন পত্রিকায় তা স্পষ্ট জানা যায় নাই। দুটি কবিতার নামই ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। এর একটির প্রথম পঙ্ক্তি:
আহা!কি শান্তির কোলে নীরবে ঘুমাও রানীতুষার অস্বরে মোহন মূরতিখানি।অন্য কবিতাটির প্রথম পঙ্ক্তি:কুজ্ঝটিকা মাত্র নাই গগন-মণ্ডলে;এ-সময় কাদম্বিনী কোথা গেছে চলে?
কবিতা দুটি পড়লে নিসর্গের রূপটাই চোখে পড়ে। কিন্তু ভেতরে আছে মানসিক পরিবর্তন। বোঝা যায় রোমান্টিকতায় কবি প্রভাবিত হয়েছেন। পর্বত দেখে কবি প্রথমোক্ত কবিতাটি সরল পয়ারে আর পরেরটি ত্রিপদী পয়ারে রচনা করে শব্দালঙ্কারে সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন। হর্ষ, মুগ্ধ, মুগ্ধতা, আহা মরি এরকম আবেগসূচক শব্দ ব্যবহার দেখেই কবির মানসিক পরিবর্তনটা অনুমান করা যায়। প্রথমোক্ত কবিতাটিতে জানা যায় কবি সেখানে মাসাধিক কাল অবস্থান করেছেন। অনেক পরিব্রাজক দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করেও মেঘমুক্ত পর্বত দেখার সুযোগ পান না, কিন্তু কবি সেটি পেয়েছেন। মেঘের আস্তরণমুক্ত বিশুদ্ধ পর্বতের সৌন্দর্য তিনি প্রাণভরে সুধার মতো পান করেছেন। কবির নিজের ভাষায় তা এভাবে প্রকাশ করেছেন,
হেরিতে তোমারে তাই কত শত ভক্ত এসেনা পেয়ে দর্শন তব ক্ষুণ্নচিত্তে ফিরে দেশে।আমিও এসেছি রাণি! তোমারে দেখিব বলেমাসাধিক কাল হতে আছি তব পদতলে।কি মনে করিয়া বালা। দিলে মোরে দরশন?(চাতকীর পক্ষে যেন বিনা মেঘে বরিষণ।)হেরিয়া তোমায় ওগো! কি হর্ষে ডুবিল মনএক মুখে কি প্রকারে করিব তা বরণন।
‘প্রবাসী রবীণ ও তাহার জন্মভূমি’ একই বছর মাঘ মাসে মহিলা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশকালের নৈকট্য থেকে অনুমান করা যায় রচনাকালও হয়তো নিকটবর্তী। তবে এ কবিতায় রোকেয়ার মধ্যে ভিন্ন এক মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়, যিনি দেশে নিয়ে, সমাজ নিয়ে ভাবছেন। বাঙালি মুসলমান নারীর মধ্যে স্বদেশ-ভাবনার এটাই বোধহয় প্রথম প্রকাশ। এ বিষয়ে সুতপা ভট্টাচার্য জানান, “এই সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যে ধর্মঘটের পথ নেবার কথা কজনই বা জানত, আর নিজেকে ভারতবাসী হিশেবে ভাবতই বা কজন। রোকেয়া ভাবছেন এসব, আর চাইছেন, সব মেয়েই তা ভাবুক, ভাবাক!”৮
কবি হিসাবে রোকেয়ার জীবনের অন্তিমকালের কবিতায় অপূর্ণতা এবং অসন্তুষ্টি প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। রোকেয়ার কবিতাগুলো বিষণ্ন পাখির গানের সাথে তুলনা করা যায়।
দুই বছর পরে ১৩১৩ সনের শ্রাবণ মাসে মহিলা পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা ‘আমি ও মন’। এ কবিতায় কবির প্রেমচেতনা ভিন্নমাত্রা লাভ করে। কবির নিজের এবং মনের উক্তির নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রকাশিত এ কবিতায় কবি ঈশ্বরসন্ধানে ব্যাপৃত হন। কবিতটিতে ঈশ্বরের বিচিত্ররূপের প্রকাশমানতা তুলে ধরেছেন কবি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, তখনো রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে নিয়ে কবিতা রচনা শুরু করেন নাই। তখনও তিনি মানসসুন্দরীকে নিয়ে লিখে চলেছেন।
এরপর রোকেয়া এক যুগ আর কবিতা রচনা করেছেন কিনা জানা যায় না। ১৩২৫ সনের অগ্রহায়ণ মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত সওগাত পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় রোকেয়া ‘সওগাত’ নামে একটি কবিতা ছাপাতে দেন। কবিতাটিতে শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া আর কোনো বিশেষত্ব নাই। ১৩২৮ সনের ফাল্গুন মাসে সাধনা৯ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘আপীল’ কবিতাটি। পরের বছর আশ্বিন মাসের পাঁচ তারিখে প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নিরূপম বীর কবিতাটি। দুটি কবিতাই সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। প্রথম কবিতাটি ব্যঙ্গসুরে লেখা। ব্রিটিশ সরকার যখন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে না এমন রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর খেতাবধারীদের খেতাব কেড়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়, তখন রোকেয়া এ ‘আপীল’ কবিতাটি রচনা করেন। ঐসব খেতাব রোকেয়ার ভাষায় ছিল লাঙুল বা লেজ, সে লেজখসা নিয়েই এ ব্যঙ্গকবিতা। লাঙুলধারী আর খেতাবধারীদের অবস্থা নিয়ে এ কবিতা। পরের কবিতাটি বিপ্লবী কানাইলালের মৃত্যুদণ্ডাদেশের প্রতিবাদে রচিত।১০ এখানে কবি বিপ্লবী কানাইলালের প্রশস্তি গেয়েছেন, বীরত্বব্যঞ্জক বর্ণনা দিয়েছেন।
বীর সন্তান জাগিয়া প্রভাতেস্মরিবে কানাই নাম;প্রাতঃস্মরণীয় কানাই মোদের,বল “বন্দে শ্যাম।”
‘গ্রীষ্ম’ কবিতাটি প্রকাশিত হয় মৌলভি মোহাম্মদ আবদুল হাকিম সম্পাদিত ইসলাম দর্শন পত্রিকার ভাদ্র ১৩৩০ সংখ্যায়। এ কবিতায় ঋতুবর্ণনার মধ্য দিয়ে কিছু জীবনজিজ্ঞাসা প্রকাশ করেছেন কবি। কিছু বিস্ময়ও প্রকাশ করেছেন। এসব জিজ্ঞাসার পেছনে আধুনিক যুগের আত্মপরিচয়ের সংকট যেমন দেখা যায়, তেমনি রয়েছে ঈশ্বর সন্নিধান।
কোন দেশে বাস তার বাড়ী কোন গাঁয়সেখানে কি মেঘ ডাকে ঘন বরষায়?
এ পর্যন্ত প্রাপ্ত কবিতার মধ্যে রেগম রোকেয়ার সর্বশেষ কবিতা ‘ব্যর্থ স্বপ্ন। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় মাওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার বৈশাখ, ১৩৩৯ সংখ্যায়। রোকেয়ার জীবন তখন অনেক দূর পেরিয়ে গেছে। জীবনের হিসাব মেরানোর চেষ্টা দেখা যায় এ কবিতা। যদিও এটি ছোট কবিতা, কিন্তু জীবনসায়াহ্নে রোকেয়ার হাহাকার বেশ বড় হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। সর্ম্পূণটা এখানে তুলে ধরা যায়।
জীবনের পূর্ণতম পরিপূর্ণ খনেআজি তুমি বহি দিলে পরাজয় ভার,শিথিল ইন্দ্রিয় মোর হল বার বারকমল কণ্টকে ক্ষত; বেদনা অপার—সহিলাম নিতি নব। দূর আশা সনেকরিলাম পরিচয় অশুভ লগনে।অগ্নিদাহ সম আজি জ্বলে মোর হিয়া,আঁকিনু বেদনা বাণী বক্ষ রক্ত দিয়া।পরিশ্রান্ত জীবনের শ্লথ অবেলায়নিজ করে তুলি দিলে বেদনা হেলায়।ব্যথাই হানিলে যদি হে প্রিয় নিঠুর,কেন ভালে দিয়েছিলে মিলন সিঁদুর;অন্ধ আমি পুঁজিলাম পাষাণ বেদিকাপরিনু ললাটে মোর কলঙ্কের টীকা।
শেষের দিকের ‘পুঁজিলাম’ শব্দটি মুদ্রণপ্রমাদ বলে মনে হয়; শব্দটি ‘পূজিলাম’ হওয়াই যথোপযুক্ত। বেগম রোকেয়া কবি ছিলেন না, কবি হলে দীর্ঘ দিনের পরে কবিতায় আধুনিক লক্ষণ কিছু দেখা যেত, ভাষায় নতুনত্ব আসত। তবে তিনি ত্রিপদী পয়ার ছন্দ থেকে যে সরে গেছেন, শেষের দিকের কবিতাগুলোতে তা লক্ষ্য করা যায়। এতে মনে হয়ে তিনি সমকালে প্রকাশিত কবিতা ভালো করে লক্ষ্য করতেন। কবিহিসাবে রোকেয়ার জীবনের অন্তিমকালের কবিতায় অপূর্ণতা এবং অসন্তুষ্টি প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। রোকেয়ার কবিতাগুলো বিষণ্ন পাখির গানের সাথে তুলনা করা যায়।
টীকা:১। বেগম রোকেয়া ১৯১৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ইংরেজি কবিতা প্রতিযোগিতায় কবিতা লিখে জমা দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে রুপার শামাদান (মোমদানি) পুরস্কার লাভ করেন।দ্রষ্টব্য, জীবনপঞ্জি: বেগম রোকেয়া রচনাবলী (আবদুল কাদির সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৬৩৪।২। বেগম রোকেয়া: পদ্মরাগ, রোকেয়া রচনাবলী (আবদুল মান্নান সৈয়দ, সেলিনা হোসেন ও অন্যান্য সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ, ডিসেম্বর, ২০০৬, পৃষ্ঠা- ২৫৯—৩৭৮।৩। সুতপা ভট্টাচার্য: রোকেয়া, (ব্যবহৃত সংস্করণের প্রকাশনী ও প্রকাশকাল অজ্ঞাত, বইটি পরে ঢাকার নালন্দা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়।) কলকাতা, পৃষ্ঠা-৪১।৪। বেগম রোকেয়া: অগ্রন্থিত কবিতা, রোকেয়া রচনাবলী (আবদুল কাদির সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৪৪৩—৪৬০।৫। বেগম রোকেয়া: অগ্রন্থিত কবিতা, রোকেয়া রচনাবলী (আবদুল মান্নান সৈয়দ, সেলিনা হোসেন ও অন্যান্য সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত নতুন সংস্করণ, ডিসেম্বর, ২০০৬, পৃষ্ঠা- ৪৬৮।৬। আবুল আহসান চৌধুরী: রোকেয়ার অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত চিঠিপত্র ও রচনার সন্ধানে, কালি ও কলম, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।৭। মিলন-সাগর ডট কম, বেগম রোকেয়া/কবি- রোকেয়া/ কবিতা২/এইচটিএমএল হ্যাশ ১৪৮। জীবনীকার সুতপা ভট্টাচার্য ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ‘মতিচুর’ প্রথম খণ্ডের ‘সুগৃহিণী’ প্রবন্ধটির কথাও এখানে স্মরণ করেছেন। যেখানে স্বদেশপ্রেম প্রকাশিত হয়েছে। দ্রষ্টব্য, সুতপা ভট্টাচার্য: রোকেয়া, কলকাতা, পৃষ্ঠা-৩৪—৩৫।৯। এ পত্রিকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত সাধনা নয়। এ মাসিক সাধনা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আবদুর রশীদ সিদ্দিকী। দ্রষ্টব্য, পরিশেষ: রোকেয়া রচনাবলী (আবদুল কাদির সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৫৪০।১০। সুতপা ভট্টাচার্য: রোকেয়া, কলকাতা, পৃষ্ঠা-৩৮-৩৯।
মন্তব্য