পর্ব-৫: স্কুলপ্রীতির হাতেখড়ি
মায়ের প্রথম পুত্র সন্তান হারানোর দুই বছর পরে আমার জন্ম হয়েছিল বাংলা অগ্রহায়ণ মাসের চতুর্থ তিথিতে। শীতের ফিনফিনে চাদরে লুকিয়ে পৃথিবী যখন কেবলি ঘুম-স্বপ্নের আর্দ্র বাতাস বোনে মাটি ও জলের আত্মমেহনে, কাঙ্ক্ষিত সেই সময়ের সিঁড়ি ভেঙে মাতৃসদন থেকে পশ্চিম ভিটার আঁতুড় ঘরের জানালাবিহীন বদ্ধ দরোজা ভেদ করে প্রথম দৃষ্টি মেলে দিয়েছিলাম আলোর পৃথিবীতে।
বলাই বাহুল্য, মা-বাবার যৌথ জীবনের তীব্র হাহাকার ও শূন্যতার পটভূমিতে কন্যা সন্তান হয়ে আমার এই আগমন অগ্রহায়ণ মাসের পারিবারিক বাতাসকে ভারী করে তুলেছিল আরও গভীরতর শূন্যতায়।
অন্যদিকে মায়ের শোকসন্তপ্ত হৃদয়ের শূন্য মাতৃক্রোড় পূর্ণ করে দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে এসেছিলাম বলে মায়ের উপচেপড়া মাতৃত্ববোধের হাহাকার সামান্য হলেও দিনে দিনে স্তিমিত হয়ে এসেছে। কিন্তু আব্বা পুত্রশোক ভুলতে পারেননি কিছুতেই। যে জন্যে ঢাকা থেকে বাড়িতে এসে কন্যার মুখ দর্শনে অভিমানী পিতার সময় লেগেছিল প্রায় দুই মাসের মতো।
সেই যুগে কেন, এ যুগেও বহুকাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তান হারিয়ে কন্যার মুখদর্শন করে সন্তুষ্ট হওয়া যেকোনো পিতার পক্ষেই কঠিনই বটে। আমার জন্মের দুই বছর পরে জন্ম নিলো মায়ের দ্বিতীয় পুত্র সন্তান। মোঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট নুরুদ্দীন মহম্মদ সেলিমের নামানুসারে মা তার পুত্রের ডাকনাম রাখলেন সেলিম। সেলিম শব্দের অর্থ ভাগ্যবান, ধার্মিক, নিরাপদ, মুক্ত ইত্যাদি। মা নিশ্চয় ভাগ্যবান অর্থ জেনেই রেখেছিলেন এই নাম।
তবে, সেলিমের জন্মের পেছনে মায়ের ত্যাগ তিতীক্ষা ছিল অতুলনীয়। মায়ের মাসাধিককাল রোজা, নামাজ, মানত, পীর-ফকির-দরবেশ, তাবিজ-কবচ, ধারানি, উপবাসসহ—কোনো চর্চায় বাকি ছিল না। একজন পুত্র সন্তান উপহার দিয়ে আমার পিতাকে সুখী করার ব্রত নিয়েই সব করেছেন। আল্লাহ দয়া করে তবু যদি একজন পুত্র সন্তান দান করে, এই আকাঙ্ক্ষা মূলত ক্রিয়াশীল ছিল অন্যান্য নারীর মতো আমার মায়ের মনেও।
ফলে, এই পুত্র সন্তানের প্রতি মা এত বেশি মনোযোগী ছিলেন যে, দুই বছর বয়স থেকেই মায়ের বুক থেকে ছিটকে সরে গিয়ে মাতামহীর বুকে আমার আশ্রয় হয়েছে। নানির বিছানা এখন আমারও ঘুমের আস্তানা। তার পরম যত্ন-আত্তিতে আমার বাক-বাকুম সময় কাটে বাড়ির অন্যান্য চাচাতো ভাই-বোনের সঙ্গে খেলাধুলা করে। আমার সমবয়সী ছোট চাচার ছেলে কালু, মেয়ে আলেয়া, আমাদের চাচাতো চাচার মেয়ে শেফালি, মায়ের রাঁধুনী টুলির মায়ের মেয়ে টুলিও আমার খেলার সঙ্গী। আমাদের দীর্ঘ লম্বমান উঠানে ওদের নিয়ে কখনো কুতকুত, ছি বুড়ি, গোল্লাছুট, হাডুডুও খেলি।
ছোটভাই সেলিম ছোট বলে ওকে নেই না এ সব খেলায়। তবে অবসর সময়ে বৃষ্টি বাদলার দিনে যখন উঠানের খেলাধুলা বন্ধ হয়ে যায়, তখন মায়ের খাটে বসে মাঝেমধ্যেই বালিশ ছোড়াছুড়ি খেলি সেলিমের সঙ্গে। চার পায়ে ঘোড়া হয়ে ওকে পিঠে তুলে খাটজুড়ে টগবক করে দৌঁড়াই। কখনো বা খাটের সঙ্গে লাগোয়া জানালার শিক ধরে উদাস বিহ্বল আমি দক্ষিণমুখো মেঘলা আকাশ দেখি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
নানি-মা রান্না ঘর থেকে কাঁঠালের বিচি ও চালভাঁজা পাঠিয়ে দেন, আমাদের জন্যে, দুজন মিলে তা খাই ভালোবেসে। সেইসব বর্ষা বাদলার দিনে মাটির চুলার জ্বালানি হিসেবে শুকনো বাঁশপাতা, পাটখড়ি, নাড়া, গরুর গোবর দিয়ে তৈরি ঘোষি, গোবর ও পাটকাঠি দিয়ে তৈরি লম্বা লম্বা নলা ব্যবহার করা হতো।
বিশেষ ধরনের মাটির চুলা বানিয়ে কেউ কেউ ঢেঁকিছাঁটা ধানের তুষের আগুনে রান্না করতো। তবে স্বল্প পরিমাণ রান্নার জন্যে তা আদর্শ ছিল। আর বর্ষাকালের জন্যে আগেভাগেই গাছ ফেঁড়ে লাকড়ি তৈরি করে রান্না ঘরের মাচায় তুলে রাখা হতো। সেই রকম এক আমগাছের পাতাসহ ডাল ছোট ছোট করে কেটে সারা উঠোনে শুকাতে দিয়েছে বাড়ির রাখালেরা। সেদিন মায়ের শোবার ঘরের উঁচু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সেলিম, আমি বারান্দা সংলগ্ন নিচু উঠানে দাঁড়িয়ে আধাশুকনো আমপাতাসমেত ডাল নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলছি। সেলিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে বারবার আমাকে ডাল ছুড়ে দিতে বলছে। আমি নিচে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছি, সেলিম ক্যাচ ধরছে। হঠাৎ একটা ছোট্ট ডাল ওর হাত ফসকে কপালে গিয়ে লাগছে, আর যায় কোথা! জোরে কান্না শুরু করে দিলো। উচ্চস্বরে কান্না শুনে ঘরের ভেতর থেকে মা দ্রুত বেরিয়ে এসে আমাকে আচ্ছাচে একটা বকা দিয়ে সেলিমকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেলেন অবলীলায়।
আমি সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, কী নিষ্ঠুর আমার মা, কী হয়েছে, তা জানতেও চাইলেন না, একতরফা আমার ওপর দোষ চাপিয়ে, ছেলেকে নিয়ে ঘরে চলে গেলেন। আমার কোনো দোষ নেই, তবু মেয়ে বলে বুঝি আমাকেই মা বকা দিলেন!
আমার বয়স হয়তো তিন অথবা চার। সেদিনই আমি প্রথম অনুভব করেছিলাম আমি মেয়ে, আমার ভাই ছেলে বলে আমার চেয়ে আব্বা-মায়ের কাছে তার কদর অনেক। সেলিম যদি হয় সোনালি শস্য, আমি তবে খড়বিচালি বৈ কিছু নই। সংসারে ছেলে-মেয়ের মধ্যে এই বৈষম্য-চিত্রিত হলে মেয়েটির মনের তলদেশে যে হীনণ্মন্যতা দেখা দেয়, শিশুর মনোজগতে তা এক বিশাল ফাটলের সৃষ্টি করে তার অজান্তেই। সংসারের ইচ্ছে অথবা অনিচ্ছাকৃত এই অবহেলার ফাঁকফোঁকর গলিয়ে নারী-পুরুষের বৈষম্য অতিক্রম করতেই নিরন্তর তার মধ্যে যেন এক ধরনের সংগ্রাম-চেতনার জন্ম হয়, শিশুকালের সুবর্ণ সময়ের বাতাবরণ থেকেই।
দুই.
প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে পড়াতে বসান মা। হ্যারিকেনের আলো আর লম্বা শীতল পাটিতে বসে দুই বোন-ভাই ঝুঁকে ঝুঁকে মায়ের বুলির সঙ্গে সুর করে অ, আ, ক, খ পড়ি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’। স্লেটে হাত ঘুরিয়ে লেখা শেখান। তারপর আব্বা একদিন স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসেন। আমার আব্বাই ওই স্কুলের সভাপতি।
গলায় সোনার চেইন পরে সে কী আনন্দ আমার মনে, সোনার একটা বলের মতো নিজেই সারাবাড়িজুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম যেন। আমাকে ঘিরেই সেই দিনের সবটুকু ঈদের আনন্দ বাতাস দুলছিল সারাক্ষণ।
আমাদের হেডস্যার ইসহাক আহমেদ, অঙ্কের গিয়াস স্যার দুজনেই অত্যন্ত স্নেহের সঙ্গে আমাকে গ্রহন করে শ্রেণী কক্ষে নিয়ে বসিয়ে দিলেন। হেডস্যার আব্বাকে চা-বিস্কুটে আপ্যায়ন করে বিদায় দিলেন মাঠ পর্যন্ত এগিয়ে এসে। বললেন, স্যার, আপনি চলে যান। কোনো চিন্তা করবেন না। ওদের প্রতি আমি খেয়াল রাখবো। স্কুল যেন কামাই না করে, সেইটা আপনি মেজো আম্মাকে একটু স্মরণে রাখতে বলবেন শুধু। বাকিটা আমরা শিক্ষকেরা মিলেই দেখবো।
পরের বছর দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠি। রোল নম্বর আমার হয়ে গেলো ওয়ান। মা-আব্বা দু’জনেই খুব খুশি। মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে তারা আশাবাদী হয়ে ওঠেন। এখনো মনে পড়ে, অধিকাংশ ঈদের সময় আব্বা ঢাকা থেকে ঈদের দিনের আগের রাতে বাড়ি আসতেন। বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বিল আদায় করে প্রেস ম্যানেজার ও কর্মচারীদের বেতন বোনাস পরিশোধ করে তবেই।
বিশেষভাবে ঈদ-উল-ফিতরের চাঁদ রাইতে সদরঘাট মার্কেট থেকে আমাদের জন্যে নুতন জামা কাপড় কিনে তবে বাড়ির দিকে রওয়ানা হতেন। কাজেই সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার পরে আমরা আব্বার জন্যে অপেক্ষায় থেকে থেকে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম। মা ভোরবেলা ঈদের গোসলের জন্যে ডেকে উঠাতেন যখন, চোখ কচলে মাকে প্রথম জিজ্ঞেস করতাম, মা, আব্বা আসছে?
হুম। তোমার আব্বা এখন বাংলা ঘরে, জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিলাচ্ছে।
মাইজা মিয়া সাব বাড়ি আসছে, এই খবর রটতে সময় লাগতো না মোটে। একজন জানলেই হতো। গ্রামবাসীরা ছুটে আসতো জাকাতের কাপড় নিতে।
আব্বার উপস্থিতি মানেই আমাদের বাড়ির সদর-অন্দর জুড়ে আনন্দের ঢেউ। সেই আনন্দের ম-ম গন্ধে আমিও যেন রাজকন্যার আবির মেখে জেগে উঠতাম রাজপুরীতে। কে পায় তখন! পুকুরের ঘাটে গিয়ে এক ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে এপার থেকে ওপারে গিয়ে উঠতাম জলের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে।
ভিজে কাপড় ছেড়ে ঈদের নতুন জামা ফ্রক পরতাম। সেলিম পরতো পাঞ্জাবি-পাজামা। আব্বার সঙ্গে এক পাটিতে বসে খিচুড়ি-সেমাই খেয়ে, আমার ছোট বোন রানু, চাচাতো বোন আলেয়া, বৈরানী, শেফালী মিলে পাড়া ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম।
আব্বা ঈদের মাঠ থেকে ফিরে এলে আমাদের নিজস্ব সমাজের সমাজি লোক এসে বাংলা ঘরে বসতো। রাখালেরা বড় বড় গামলাভরে ক্ষীর খিচুড়ি নিয়ে তাদের আপ্যায়ন করতো। দুপুরে মা আমাদের জন্যে পোলাও মাংস রান্না করতেন। নানিও মাকে সাহায্য করতেন এই রান্নায়।
আমি সেই বছর আবারও পঞ্চাশ জন ছাত্রের মধ্যে ক্লাসে প্রথম হয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেছি। ঈদ-উল-ফিতরের ঈদ পরের দিন। ঈদের কুয়াশাঘেরা সকালে মা, চুলার পারে বসে রান্না করছেন। নানি এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছেন আর কথা বলছিলেন। গভীর রাতে আব্বা ঢাকা থেকে ফিরেছেন। আমরা ঘুমে ছিলাম, কেউ কিছু জানি না। নানিকে মা জানালেন, সবার জন্যে জামা কাপড়, যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি ছাড়াও আব্বা একটা সোনার চেইন কিনে এনেছেন আকিক পাথরের। চেইনটি ছেলে সেলিম অথবা মেয়ে দিলুর মধ্যে কাকে যে দেবেন, বুঝতে পারছেন না।
সেই সোনার চেইনের পেছনে অশুভ এবং করুণ এক ইতিহাস রয়েছে, সেটিও নানিকে খুলে বললেন।
চেইনটি যে আব্বা ইচ্ছে করে কিনেছেন, তা নয়। প্রায় বাধ্য হয়ে অন্য এক প্রেস ব্যবসায়ীকে সাহায্য করতেই কিনেছিলেন তিনি। কেননা, আকিক পাথরের সোনার ওিই চেইনটি কিনে গলায় পরার পরে সাত দিনের মাথায় কী কারণে যেন ওই ভদ্রলোকের জেল হয়ে যায়। ফলে তিনি তা দ্রুত বিক্রি করে দিয়েছেন আব্বার কাছে।
কুসংস্কার ছাড়াও সম্ভবত তার টাকারও দরকার ছিল খুব। এই কথা শোনার পরে মাকে নানি বললেন, তোমরা যদি সেলিমকে ওই চেইন পরাতে ভয় পাও তবে, আমি কিনতে চাই। শোন লেবু, আমি তো তোমার কাছে সাত হাজার টাকা এখনো পাই, ওই টাকার বিনিময়ে চেইনটি কিনেদিলুকে পরাতে চাই।
নানির ইচ্ছের কথা আব্বাকে মা জানালেন। আব্বা বললেন, ঠিক আছে আম্মা যা চান, তাই করো। সেই ঈদের দিন সকালে মা ও নানি আমাকে ডেকে চেইনটি পরিয়ে দিলেন। গলায় সোনার চেইন পরে সে কী আনন্দ আমার মনে, সোনার একটা বলের মতো নিজেই সারাবাড়িজুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম যেন। আমাকে ঘিরেই সেই দিনের সবটুকু ঈদের আনন্দ বাতাস দুলছিল সারাক্ষণ।
তিন.
তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে যেদিন প্রথম ক্লাস করতে যাই, সেদিনই কী মনে করে মা আমাকে বলে দিয়েছিলেন, শোনো মা, কেউ যদি তোমার হাতে বা বইয়ের ভাঁজে কোনো চিঠিপত্র দেয়, আমাকে এনে দেখাবে। আমি মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে স্কুলে চলে আসি। সবসময় আমি ক্লাসের ফার্স্টগার্ল ছিলাম, শিক্ষকদের প্রিয় শিক্ষার্থী। চেহারাটি বুদ্ধিদীপ্ত, কিন্তু চালাক-চতুর নই। বোকাসোকা গোছের। সহজ-সরল বিশ্বাসের আস্ত এক দস্তরখানা।
পরবর্তী সময়ে হলে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি লাভের সেই এক দীর্ঘ ইতিহাস। পরে আসবে সেসব কথার অনন্য এক ঝাঁপি।
আমাদের ‘মিয়া বাড়ির’ ছেলে-মেয়েদের মেশার মতো একটা পাড়া ছিল কোয়ার্টার মাইলের মধ্যে। ‘জমাদ্দার পাড়া’ বলতাম আমরা। কেন, সেই পাড়াকে জমাদ্দার পাড়া বলা হতো, আজও তা অজানা। যাদের কাছ থেকে জানা যেতো এই ইতিহাস, তাদের অধিকাংশই পৃথিবীতে নেই। যারা অবশিষ্ট, তারাও নদীভাঙনের ফলে ছড়িয়ে পড়েছে আরব উদ্বাস্তুদের মতোই।
যা বলছিলাম, জমাদ্দার পাড়ার ভদ্রগোছের ছেলে বকুল আমার সহপাঠী। আমার ক্লাসের সেকেন্ড বয় সে, মাইনউদ্দিন থার্ড। সে আসতো বৈকুণ্ঠপুরের কাছেই বিল্লালাই পাড়া থেকে। দ্বিতীয় বেঞ্চে বসতো চান মিয়া। শান্ত একহারা গড়নে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা ছেলে। দূর সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় ছিল বলে আমাকে সে ফুপু ডাকতো। পরবর্তী সময়ে আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। শহীদ চান মিয়ার সমাধিটি আমাদের সেই প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গণে জেগে আছে দেশপ্রেমের মহান গৌরবে।
আমরা এই তিন জন প্রায়দিন পাশাপাশি বসি, আমার অন্য পাশে আমার পাতানো সই পপি বসে। পপিও আসে জমাদ্দার পাড়া থেকে। স্কুল ছুটির পরে জমাদ্দার পাড়ার অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে সেও চলে যায় তার নানা বাড়িতে।
জমাদ্দার পাড়ার মাথা হিসেবে তিন জন ব্যক্তির নাম প্রায়ই শুনতাম আব্বার মুখে। সই পপির নানা মোহন মিয়া, নয়া মিয়া ও জলিল মিয়া সাব। জলিল মিয়া মেম্বার ছিলেন আমাদের এলাকার। মোহন মিয়ার একমাত্র কন্যা বেবীর প্রথম সন্তান ছিল আমার সই পপি। বিয়ের পর পরেই বেবী খালা করাচিতেই চলে যান স্বামীর সঙ্গে।
পপির পরে বোন ফ্যান্সি, ভাই মুরাদ ও তারিক জন্ম গ্রহণ করে করাচিতেই। দুই মেয়ে দুই ছেলে নিয়ে বেবী খালার সুখের সংসার। স্বামী বড় চাকরি করেন তখন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী করাচি শহরে। এরমধ্যে হঠাৎ একদিন খবর এলো সিলিংফ্যানে দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছেন পপির বাবা। এরপর চার সন্তান নিয়ে বেবী খালা তার বাবার সংসারে ফিরে এলেন। আমৃত্যু রয়ে গেলেন সেখানেই।
পপির চাচারা কেউ কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, তারা টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে বটে, কিন্তু নানা-নানি ও পপির একমাত্র মামা চাতক মিয়ার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিলেমিশে এক বাড়িতেই ওদের বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, বিয়ে-শাদি সবই হয়েছে নানার তত্ত্বাবধানে। আমাদের ‘মিয়া বাড়ি’থেকে স্কুলের দূরত্ব সবচেয়ে কম।
স্কুলের নাম ‘চর গরপাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা হয়। এরপর তিন কিলোমিটার দূরে ‘গরপাড়া হাইস্কুল’ নামে একটা স্কুল আছে। সেই স্কুলের পাশেই ‘ইমাম বাড়ি’ নামে এক পীরবাড়ি আছে। ওইসময়ে গদ্দিনশীন পীর খলিল মিয়া সাবের বায়েত ও আশেকান হিসেবে আমার চাচা, আব্বার যাতায়াত ছিল বটে মাঝে-মধ্যে।
কিন্তু এতদূর পায়ে হেঁটে প্রতিদিন আমাদের বাড়ির মেয়েদের স্কুল যাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। যেহেতু পায়ে হাঁটা ছাড়া তখনো বিকল্প যানবাহনের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না, উপরন্তু বর্ষার মৌসুমে পাটক্ষেত, ধান ক্ষেত মাড়িয়ে চলাচল মেয়েদের জন্যে খুব বিপজ্জ্বনক ভাবা হতো, কাজেই মেয়েদের লেখাপড়ার আগে তার নিরাপত্তা ও মান-সম্মান ও ইজ্জতের কথা আগে ভাবা হতো।এই নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজনে ওই স্কুলে না পড়ে খালার বাড়ি, বোনের বাসায় থেকে এসএসসি পাড়ি দিতে হয়েছিল আমাকে। পরবর্তী সময়ে হলে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি লাভের সেই এক দীর্ঘ ইতিহাস। পরে আসবে সেসব কথার অনন্য এক ঝাঁপি।
চার.
আমাদের বাড়িটি পড়েছে গরপাড়া ওয়ার্ডে। আমাদের ওয়ার্ডের নামানুসারে ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়েছিল গরপাড়া ‘ইউনিয়ন’। আমাদের বাড়ির সীমানা ছেড়ে রাস্তায় পা দিলেই চরগরপাড়া ওয়ার্ড। স্কুলটিও ছিল চরগরপাড়া মৌজায়। রাস্তা তো নয়, তখন আমরা হালট বলতাম। হালের গরু চলাচলের জন্যে গ্রামের নিচু কাঁচা রাস্তা মাত্রই হালট। একই হালটে তখন মানুষ ও গরু দুই-ই চলাচল করতো।
তবে স্কুলের বাইরে আমাদের বাড়ির হালট দিয়ে যাতায়াতের সময় দৈবাৎ কখনো দেখা হলে শাসন-বারণ ভুলে কেমন যেন এক রসালো দৃষ্টিত তাকাতে চেষ্টা করতো সে।
সেই নিচু হালট থেকে আমাদের বাড়ির প্রবেশ পথ ছিল বেশ উঁচু এবং হাতের বামপাশে আমার জন্ম থেকে দেখা ভারী এক ইন্দারা পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো সর্বক্ষণ। আশে পাশের শতাধিক পরিবার সেই কুয়ার পানি সংগ্রহ করতো দূর দুরান্ত থেকে এসে। তখনো টিউবওয়েলের যুগ শুরু হয়নি। তার পাশেই একটা ছিল স্বাস্থ্যবান নারিকেল গাছ, যে গাছে কোনোদিন ফল ধরতে দেখিনি।
একদিন স্কুলশেষে বান্ধবীদের সঙ্গে কুতকুত খেলে একটু দেরিতে ফিরেছিলাম বলে মা খুব রাগ করলেন। খেলার জন্যে দেরি হয়েছে জেনে বললেন, বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে এসে খেলবে। স্কুল ছুটির পরে একমিনিটও যেন কোথাও দেরি না করি, কড়া নির্দেশ আরোপ হলো নতুন করে। একটু একটু করে বড় হচ্ছি বলেই এই সাবধানতা মায়ের।
মায়ের কথার বাইরে যাইনি কোনোদিন। মায়ের খুবই বাধ্যগত সন্তান ছিলাম আমরা। মা কখনো মুখ ফুটে বকা দেননি আমাদের। তার চোখের শাসনই যথেষ্ট ছিল। আমার ছোটবেলায় ঘটেছিল ঘটনাটি। আমাদের প্রত্যেক চাচারই সন্তান সংখ্যায় বেশ। এক বাড়িতে সংকুলান হচ্ছে না ভেবে আমাদের সেজো চাচা আফসার উদ্দিন আহমেদ তার পিতা ও পিতামহের আদি বাড়ি ছেড়ে অনেক জমি নিয়ে নতুন বাড়ি করলেন।
আমাদের বাড়ি সংলগ্ন তিনটি বাড়ি পরেই পশ্চিম দিকে অগ্রসরমান নতুন বাড়িতে উঠে গেলেন সেজো চাচা। ওদের সঙ্গে চলে গেলো আমাদের দু’জন খেলার সঙ্গী টুটু ভাই ও পুটু। টুটু ভাই আমার থেকে ছয় মাসের বড় ছিল বলে মুরব্বীদের আদেশ মান্য করে টুটু নামের সঙ্গে ভাই জুড়ে দিয়ে ডাকতাম টুটু ভাই। তপ্ত রোদের উদাস দুপুরে গাছ থেকে কামরাঙা পেড়ে আমাদের বাংলা ঘরের বারান্দার বেঞ্চে বসে কলাপাতায় নুনমাখা কামরাঙা খেয়েছি যে কতদিন, তার শেষ নেই। পুটু ছিল আমার ছোট কিন্তু আমার ছোট ভাই সেলিমের থেকে কয়েক মাসের বড়। ওরা দুজনেই ছুটে ছুটে ভেতর বাড়ি থেকে নুন আর কলাপাতা নিয়ে আসতো। বাংলা ঘরের সিমেন্টের ফ্লোরে ঝিনুক ঘষে ধারালো করে দিতো টুটু ভাই, আমি সেই ঝিনুক দিয়ে কামরাঙা কেটে তা মাখাতাম কলা পাতায়, তারপর খেতাম চার জন মিলে। কোনো কোনোদিন ছোট চাচার ছেলে কালু ও মেয়ে আলেয়া এসে ভাগ বসাতো সেই কামরাঙা ভর্তায়।
আমাদের মধ্যে আলেয়া ছিল দস্যি স্বভাবের মেয়ে। আমার ছোট বোন রানুর চেয়ে বয়সে সামান্য বড়। আমার চেয়ে বেশ ছোট হলে হবে কী, সাহস ছিল ভয়ানক। একদিন ওদের উঠানে দাঁড়িয়ে পাকা কলা খাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ সে আমার কলার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তবু তাকে অফার করিনি খেতে সেদিন। হঠাৎ দেখি এক খামচা দিয়ে আমার হাত থেকে ছিলাকলা নিয়ে দৌঁড়। আমি বোকার মতো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলাম আমাদের ঘরের বারান্দায়। পুচ্চি একটা মেয়ের এক থাবায় হেরে যাওয়ার বিষণ্নতা নিয়ে পড়তে বসে গেলাম।
আমার মা কিংবা ওর মাকেও কিছু বলিনি সেদিন। কিন্তু খুব অবাক হয়েছিল আমার শিশুমন সেদিন, এমন ব্যবহার পরিচিত কেউ করতে পারে? নতুন বাড়ির খেলার সঙ্গী টুটু ভাইদের বাড়ি যেতাম মাঝেমধ্যেই। বেশিরভাগ সময় খেলার জন্যে ওরা দু’ভাই আসতো আমাদের পুরনো বাড়িতে।
ওদের বাড়ির কাঁচামিঠা আমের ভর্তা খাওয়ার জন্যে কখনো গেলে, অবশ্যই মায়ের অনুমতি নিয়ে যেতো হতো আমাকে। অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়া মা পছন্দ করতেন না। তবে মাকে বলে যেতেই ভালো লাগতো আমার। আমার জন্যে যেন মাকে অহেতুক কোনো দুশ্চিন্তায় পড়তে না হয়, সেদিকে সতর্ক থেকেছি সব সময়। সেদিন দ্বিতীয় পিরিয়ডে ইংরেজির স্যার এসেছেন ক্লাসে। ইংরেজি বই হাতে নিয়ে খুলতেই দেখি, পেন্সিলে লেখা চার ভাঁজ করা একটা কাগজ।
সব সময় প্রথম বেঞ্চে বসি বলে, স্যারদের নজরও থাকে আমার দিকে। কাজেই কাগজখানা না খুলে বাংলা বইয়ের মধ্যে চালান দিয়ে দিলাম সাবধানে। স্কুল শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে, আমাদের বাগানের কোণায় দাঁড়িয়ে খুলেই বুঝতে পারি—আমার উদ্দেশে লেখা চিঠি, বাৎসায়নের কামসূত্রের বাজে ইঙ্গিতে ঠাসা। দুটো বাক্য পড়েই আমার গা গুলিয়ে ওঠে। বাকিটা না পড়েই বাড়িতে পৌঁছেই আমি মায়ের হাতে তুলে দিলাম তার পূর্ব নির্দেশমতো।
ভয়ে ভয়ে অপেক্ষায় আছি মায়ের পরবর্তী নির্দেশের জন্যে। পরের দিন আমাকে স্কুলে যেতে দেবে কী, দেবে না, কে জানে? মনে হতে লাগলো, দোষ বুঝি আমারই, নইলে আমাদের ক্লাসে এত ছাত্রী, তবু আমাকেই কেন সহিদ লিখলো ওই চিঠি? ওই বয়সেই এক ধরনের অপরাধবোধে কেমন যেন মরমে মরে যাচ্ছিলাম নিজের মনে। মা আমাকে স্কুলে যেতে নিষেধ করলেন না, তবে চিঠি লেখা ছেলে সহিদের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করে দিলেন।
যথারীতি আমি স্কুলে যাই-আসি কিন্তু সহিদের সঙ্গে কথা বলি না আর। এর দুদিন পরে সহিদের বাবাকে মা ডাকিয়েছেন বাড়ির রাখালকে দিয়ে। তার ছেলের কুকীর্তি সম্পর্কে তাকে জানিয়ে বিচারের ভার তাকে দিয়ে বিদায় করলেন। পরের তিন দিন সহিদ আর স্কুলে এলো না। আমার সই পপির মুখে শুনলাম, সহিদের বাবা তাকে আচ্ছাচে পিটুনি দিয়ে হাত-পা খুলে দিয়েছেন।
এই ঘটনার পরে সহিদ স্কুলে এলেও আমার দিকে আর তাকায়নি, যে কদিন ওই স্কুলে পড়েছি। তবে স্কুলের বাইরে আমাদের বাড়ির হালট দিয়ে যাতায়াতের সময় দৈবাৎ কখনো দেখা হলে শাসন-বারণ ভুলে কেমন যেন এক রসালো দৃষ্টিত তাকাতে চেষ্টা করতো সে।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-৪॥ দিলারা হাফিজ