পর্ব-৪॥ জন্মের ভেতরে জন্মসূত্র
এক.
মায়ের ডাক নাম লেবু। পোশাকি নাম বেগম রহিমা হাফিজ। চারবোন এক ভাইয়ের সংসারে পিতা মাতার সর্বকনিষ্ঠ কন্যাসন্তান তিনি। বেশ ছোট বেলায় পিতাকে হারিয়েছিলেন। মায়ের সযত্ন পরিচর্চায় শৈশব ছেড়ে যৌবনে পা রেখেছেন লাবণ্যময় এই অষ্টাদশী। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন, কিন্তু বড় ভাই আতাহার খানের অসহযোগিতায় মেট্রিক পরীক্ষা দিতে পারেননি।
মানিকগঞ্জের সন্নিকটে ঘিওর উপজেলার ‘জাবরা’গ্রামের সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব রাশেদ খান। জ্ঞানে-গুণে-আভিজাত্যে জাবরা গ্রামের ‘বড় বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত ছিল তাদের বাড়ি। পিতা রাশেদ খানের জীবদ্দশায় তারজমিদারির কিছুটা অংশ নীলামে উঠেছিল। কলকাতার বড় বাজারের ব্যবসার অবস্থাও তখন পড়তির দিকে। কাজেই বড় ছেলে আতাহার খানকে নিলাম উদ্ধারের জন্যে অনুরোধ করেছিলেন রাশেদ খান। তিনি অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন, সেই নীলামের অংশ নিজ নামে লিখে নেওয়ার শর্তে। যথাসময়ে তিনি লিখে নিয়েছিলেন নীলামের জমির অংশ বিশেষ। কিন্তু প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে পিতার মৃত্যুর পরে মিথ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, রাশেদ খানের পুরো সম্পত্তি তার নিজের। এই ঘোষণা দিয়ে মূলত তিনি তার সৎ ভাই-বোনদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন চির দিনের জন্য।
আমার মায়ের একমাত্র ভাই সামাদ মামাকে তার বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করেছিলেন। এই অভিমানে আমার নানি সেই বাড়ি থেকে এক কাপড়ে চলে এসেছিলেন প্রথমে আমার সাজি খালার বাড়িতে। সাজি খালার বিয়ে হয়েছিল জাবরা গ্রামের অন্য পাড়ায়। খালার ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে। যিনি কবি জাহানারা আরজুর মামা ছিলেন।
তখন বর্ষাকাল। অকস্মাৎ আমার নানির গৃহত্যাগের খবর পেয়ে খুবই অহায়বোধ করেন আমার মা। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে আব্বার সঙ্গে পরামর্শ করে পবন মাঝির একমাল্লার এক নৌকা পাঠিয়ে সাজি খালার বাড়ি থেকে আমাদের গরপাড়ার বাড়িতে নিয়ে আসেন। নানিকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন মা, কিন্তু তার এক কথা, ‘যে বাড়িতে আমার ছেলের জায়গা হবে না, সে বাড়িতে আমি থাকি কী করে?’
এই কথা শোনার পরে নানিকে তার বাড়িতে ফিরে যেতে আর পীড়াপীড়ি করেননি মা। কাজেই আমৃত্যু আমাদের বাড়িতেই ছিলেন নানি।আমার আব্বাও মহৎ প্রাণের পরিচয় দিয়ে মাকে বলেছিলেন, ‘আমার নিজের মায়ের কোনো স্মৃতি নেই, কাজেই আমি চাই, আমারও মা হয়ে আপনি আমাদের সংসারেই থাকুন।’
ফলে মনে থাকার বয়স থেকেই নানিকে নিজের করে পেয়েছি আমি। তিনি ছিলেন আমার মায়ের বিকল্প মা। মায়ের মুখেই শুনেছি এই গল্প। মা যখন আমার ছোট ভাই সেলিমকে জন্ম দিতে আঁতুড় ঘরে ঢুকেছিলেন, তখনই আমাকে নানির কোলে তুলে দিয়েছিলেন সেই যে; তারপর থেকেই নানি আমার একমাত্র আশ্রয়, আবদার, কান্নাকাটি, জেদ ও ভালোবাসার আধার।
সেই মুহূর্ত থেকে মায়ের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন প্রায়। পুত্র সন্তানের আদর-যত্ন ও নিরাপত্তার জন্যে অধিক ব্যস্ত মা আমাকে দেখার সুযোগ পান না। ফলে রাতেও আমি ঘুমুতে শুরু করলাম নানি-মা’র সঙ্গে। দিন সাতেক আঁতুড় ঘরের অপবিত্রকাল শেষে পরিশুদ্ধ হয়ে পুত্রকে কোলে নিয়ে মা তার নিজের পালঙ্কে ফিরে গেলেও আমি কিন্তু রয়ে গেলাম নানি মা’র বিছানায়। তার বুকেই মুখ ঘষে খুঁজে ফিরতাম মায়ের সৌগন্ধময় আদর।
নানিকে পেলাম যেন মায়ের বিকল্পে, মা যেন দিন দিন আমার কাছে দূর-দ্বীপবাসিনী এক মমতার নাম, যিনি কেবলই ছোট্ট ভাইটির মা হয়ে বেঁচে থাকলেন আমার শিশুমনজুড়ে। ফলে, শৈশব-কৈশোরজুড়ে ভাই-বোন মিলে বিভিন্ন খেলা-ধূলা, নানা ঘাত-প্রতিঘাত সংঘটনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ওই ছোট্ট বয়সেই আমি যেন বুঝেই গেলাম, মায়েরও পক্ষপাতিত্ব্রের ঝোঁক ওই পুত্র সন্তানের প্রতিই বেশি। এ কারণেই ইজেলের সামনে মায়ের একখানা অসমাপ্ত ছবি আমার মনে গেঁথে গেলো দীর্ঘকালের জন্যে।
বৃদ্ধ নানি আমার জন্যে ততটাই উদ্বিগ্ন আর কৌতূহলী থাকতেন, একজন প্রকৃত মা যতটা তার সন্তানের জন্যে। নানি, নিয়মিত গরম জলে আমার পা ধুইয়ে দিতেন প্রতি সন্ধ্যায়। ধুলাবালিতে খেলাধুলা করতাম বলে, পায়ে আমার মাঝে মধ্যেইপাঁচড়া হতো। এজন্যে আমার খেলা শেষের জন্যে বালতিতে গরম পানি নিয়ে উঠানের এক কোণায় বসে অপেক্ষা করতেন নানি। আমার ছি বুড়ি খেলা তো শেষ হতেই চায় না। নানি বিরক্ত হয়ে ডাকাডাকি শুরু করেন।
অবশেষে অধৈর্য হয়ে বলতেন, আসো দেখি, ময়ূরের পাও দুইখানা ধুইয়া দেই তোমার। নইলে তো আ-ধোয়া পাও দুইখানা নিয়া আমার বিছানায় উঠবা। আসো, আসো, আর কতক্ষণ বইসা থাকুম। আমার পায়ের প্রসংশা শুনে আমি তখন খুশি মনে সুড়সুড় করে নানির কাছে চলে আসতাম পা ধুতে। নানির মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম অনেকক্ষণ, তিতপটলের ছোবা দিয়ে ঘষে ঘষে নানি আমার ঘায়ের চামড়া তুলে নতুন করে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন। ওই কষ্টও সহ্য করে তবু পা ধুতাম নানির হাতে। তখন মনে হতো, পা তো আমার ময়ূরের মতো সুন্দর, আর চাই কী?
পরে বড় হয়ে যখন জানলাম, ময়ূরের নাচের সময় তার পেখমের যত না সৌন্দর্য, তার পা ততধিক কদাকার। নাচতে নাচতে হঠাৎ তার পায়ের দিকে দৃষ্টি পড়লে, ময়ূর তার নাচ থামিয়ে দেয়। আহা, আমার নানি-মা, কী নিদারুণ তামাশাই না করেছেন আমার সঙ্গে, বোকার হদ্দ আমি না বুঝে কী আনন্দেই না ছিলাম এতদিন! এরপর থেকে আমিও আমার পায়ের দিকে তাকাতাম না, ময়ূরের মতো।
তবে, একথা আজ একথা স্বীকার করতেই হবে যে, ওইটুকু শিশুকে তিনি মায়ের অভাব বুঝতে দেননি, তার ভালোবাসার আতিশয্যে। রাতে ঘুমের আগে পিঠ চুলকানো, চুলে বিলিকাটা সবই তিনি আনন্দের সঙ্গে সম্পাদন করতেন। তবে মনে হয়, আমিও দিনে দিনে তার একাকী বিছানায় বৈধব্যকালীন নিঃসঙ্গ সময়ের সঙ্গী ও সান্ত্বনা হয়ে উঠেছিলাম ধীরে-ধীরে।
নানির স্নেহে-আদরে-শাসনে ফুল্ল কুসুমের মতো ছিল আমার বর্ণাঢ্য শৈশব। কুঁড়ি থেকে ধীরে ধীরে পাপড়ি মেলতে শুরু করেছি তার বুকে ঘুমিয়েই বটে, তবু যেন ভেতরে ভেতরে আমার মাতৃতৃষ্ণা-কাতর এক অগাধ সলিল বয়ে যেতো নীরবে নিভৃতে। ‘আসলের চেয়ে সুদের মায়া বেশি’বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে, স্নেহকাতর নানি তার সবটুকু দিয়ে আমার জন্যে ভালোবাসার মুকুট গড়িয়ে দিয়েছেন যেন।
তোফা ভাইয়ের মাকে আপাতত, সংসারের ফসলাদি ও সন্তান সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে দিশাহীন আব্বা ঢাকায় চলে যান ব্যবসায়িক প্রয়োজনে।
কোনো কারণে মা ও নানির মধ্যে তর্ক বা মনোমালিন্য হলে ভীষণ দ্বিধায় পড়ে যেতাম, কার পক্ষ নেওয়া উচিত; কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না। মায়ের প্রতি আমার ভালোবাসার কমতি নেই, আবার সর্বক্ষণ নানি আমাকে দেখভাল করছেন। ফলে কোন্ জায়গাটিতে দাঁড়ালে ভারসাম্য রক্ষা হবে, এই নিয়ে রাজ্যের ভাবনার জট, বট-পাঁকুড়ের মতো আমার মাথার চারপাশে ঘুরপাক খেতো যেন।
কাউকে কিছু বলতে পারতাম না, বলতে ইচ্ছেও করেনি। তবে নিজের সঙ্গে নিজে অনবরত যুদ্ধ চালিয়ে যেতাম একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর মতোই যেন তা। মৃত্যুর পরে আমার এই অভিমানী নানির কবর হয়েছে শুধু নানার বাড়িতে, নানার কবরের পাশেই।
দুই.
আমার মায়ের প্রথম পুত্র সন্তানের নাম ছিল ফারুক। দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে রাজ্যের স্বপ্নালোক সঙ্গে নিয়ে জন্মেছিল সে পিতা-মাতার পরমধন। আহা! আজ থেকে সত্তর বছর আগে কথিত ‘দুধের বাতাস’ নামক রোগে ছয়মাস বয়সে সে মৃত্যুবরণ করে। বর্তমানে এই রোগকে কোনো রোগই মনে করা হয় না। নাম তার ডায়েরিয়া, যা সামান্য স্যালাইন খেলেই যে কোনো বয়সের রোগীশতভাগ ভালো হয়ে যায়।
তবে, এই আবিষ্কারে বিজ্ঞানীদেরও সময় লেগেছিল অনেক। ততদিনে শিশুদের মতো বহু মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে অকালে। এভাবেই প্রায় প্রত্যেক শতকে আত্মঘাতী একেকটা ভাইরাস আসে আর অসময়ে নিধন হয়ে যায় সংসারের সমূহ স্বপ্নবীথি। সন্তান হারানো মায়ের কষ্ট ও হাহাকার সব সময়েই তা ব্যাখ্যার অতীত। কিন্ত এই পুত্রশোক আমার আব্বাকে এক শেকড়হীন বৃক্ষে পরিণত করেছিল।
আব্বার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভে পর পর তিনকন্যা, পুত্রের মুখ দেখেননি তখনো। অন্যদিকে তার অঢেল সম্পত্তি, জায়গা-জমি পুত্র ছাড়া কে রক্ষা করবে? তৎকালীন এমন ভাবনা ছাড়াও বংশরক্ষার একমাত্র মূলমন্ত্র যে পুত্রসন্তান, কে না চায় পুত্রের সেইমুখ দর্শন করতে? আমার আব্বাও তার ব্যতিক্রম নন। কাজেই তিনিও একজন পুত্রসন্তান লাভের জন্যে উন্মুখ অধীর অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন তারমধ্য বয়স অবধি। অবশেষে পুত্র যাও এলো সংসারে রাজ্যের আনন্দ নিয়ে, ছয় মাসের মাথায় সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ করে চলে গেলো অকালে।
অথচ এই পুত্রের জন্মের সুসংবাদে খাসি মেরে, ঢাক-ঢোলের বাজনা বাজিয়ে গ্রামবাসীকে আপ্যায়ণ করেছিলেন তিনি। সেদিন বিরায়ানির সুগন্ধে কালিগঙ্গার বাতাস ছিল উড়ু উড়ু। নদীভাঙা মানুষ দলে দলে এসে পুত্রের মুখ দেখে কতই না আশীর্বাদ করেছিল। পুরো গ্রাম সেদিন আহারের আনন্দে জেগে উঠেছিল। পেটপুরে খেয়ে যেতে যেতে, গ্রামবাসীদের দোয়া ছিল, ‘যাক, শেষ পর্যন্ত মাইঝা মিয়া সাবের পুত অইলো। আল্লায় বাঁচিয়া রাহুক তারে।’ কিন্তু সেই পুত্র সন্তান ছয় মাসের বেশি আয়ু পেলো না।
বিধি এমনভাবে বাম হলো যে, গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাজধানী শহরের নামকরা সব চিকিৎসকের চিকিৎসায় কাজ হলো না। এমনকী সেই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও খ্যাতনামা চিকিৎসক ডাক্তার নন্দীর শত চিকিৎসা ব্যর্থ করে দিয়ে তিন মাস ভোগান্তি শেষে ছয় মাসের মাথায় চলে যায় সে ভাইটি আমাদের। সদরঘাটের কাছেই বুড়িগঙ্গার তীরে তার কবর হয়েছিল। ছোটবেলায় স্কুলছুটি পর্বে আমি ও সেলিম পিঠাপিঠি দুই বোন-ভাই যখন আব্বার প্রেসে বেড়াতে আসতাম মাকে ছাড়া, সে রকম এক সময়ে স্মৃতিকাতর আব্বা আমাদের দুজনের হাত ধরে একদিন সেই পুত্রের কবর দেখিয়েছিলেন। আমি ও সেলিম দুজনেই সেদিন কেঁদেছিলাম ভাইটির কথা মনে করে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, আমার প্রথম মা তিন কন্যা রেখে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর পরেই চামেলি বলে যে মেয়েটি ছিল তার, সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যায়। সেই সময়ে বসন্ত রোগেও বহু মানুষ মারা যেতো। এখন যেমন করোনায় মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। চামেলির মৃত্যুর পরে মায়া, হাওয়া নামে দুই কন্যা নিয়ে মহাসমুদ্রে পড়ে যান আব্বা। সকাল বিকেল আব্বার বিয়ের প্রস্তাব আসে, কিছুতেই মাথা পাতেন না। কিন্তু এত বড় সংসারের দেখভালের ব্যবস্থা না করলেও কিভাবে চলবে? সে চিন্তাও মাথায় কাজ করছে সারাক্ষণ।
দুজন মাতৃহীন কন্যা সন্তান, তাদের নিরাপত্তা, দেখভাল কে করবে, তাদের উপায় কী হবে? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। শোকার্ত এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে হঠাৎ পেয়ে যান তোফার মাকে। তিনি সদ্য তিন জন পুত্রসন্তান নিয়ে বিধবা হয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন। তোফা ভাইয়ের মাকে আপাতত, সংসারের ফসলাদি ও সন্তান সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে দিশাহীন আব্বা ঢাকায় চলে যান ব্যবসায়িক প্রয়োজনে।
অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়ের এই পরিবারগুলো ফলের মৌসুমে আম, জাম, কাঁঠাল, জামবুরা বিক্রি করে চলতো। ক্রেতাও যেহেতু পাড়ার, কাজেই তাদেরও জানা ছিল কোন বাড়ির কোন ফল বেশি সুমিষ্টি বা সুস্বাদু।
বিনিময়ে তোফা ভাইয়ের মা তার নাবালক সন্তানদের মানুষ করার একটা হিল্লে পেয়ে যান, এই ব্যবস্থার ফলে। সেই সময় তিনিও খুব অসহায় চোখে স্বামীহীন পৃথিবীর নির্মমতাকে অনুভব করছেন সত্যিকারের অবলা নারীর অসহায়ত্ব নিয়ে। ভদ্র ঘরের মেয়ে, অন্য ভদ্র গরিব পরিবারের বউ, কোথায়ই বা যাবেন। একেবারে অনাথ সমুদ্রে হাবুডুবু করা অনাথিনী এক; পালহীন নৌকার যেন অপর বেলার মাঝি। তার স্বামী এমন কিছু রেখে যাননি যে, তিনি তাদের খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করবেন একাকী জীবনে।
তিন.
মানিকগঞ্জ তখন মহকুমা শহর, একটু একটু করে তার শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। গভর্নরের হাত থেকে গোল্ড মেডেল পাওয়া আমার বাবা ও চাচাদের সেই চারটি দোকান তখন ভাড়ায় চলে। আমাদের অংশের ভাড়াটিয়া নতুন বস্তির ধলাভাই ‘হক স্টোর’ নামে তাদের পারিবারিক স্টেশনারি দোকান পরিচালনা করছে বহুকাল থেকেই। তার পাশেই ছিলো ‘চাঁদ হোটেল’ নামে একটি রেস্তরাঁ। রেস্তরাঁর মালিক নিজের নামেই তার হোটেলের নামকরণ করেছিলেন।
আমাদের এই চাঁদ মামা আব্বার খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন। তখন ঢাকা থেকে ভোর ছটার লঞ্চে রওয়ানা হলে বেলা বারোটার মধ্যে মানিকগঞ্জের বেওথার ঘাটে পৌঁছে যেতো লঞ্চ। অথবা দিনের কাজ শেষ করে আব্বা যেদিন রাত আটটার স্টিমারে চেপে আসতেন, সেদিন ভোর ছটায় মানিকগঞ্জ পৌঁছে যেতেন।
সম্ভবত, ষাট দশকের দিকে ঢাকা টু মানিকগঞ্জে বাস সার্ভিস চালু হয়েছিল। তাও আবার নয়ারহাট এসে ফেরীতে বংশী নদী পার হয়ে অন্য পাড়ে উঠে একটি মুড়ির টিনমার্কা বাস ধরে তবে ঢাকা সদরঘাট যেতে হতো।
আব্বা মানিকগঞ্জের বেওথা লঞ্চঘাটে নেমেই রিকশা যোগে দোকানের খোঁজখবর করতে আসতেন। অতপর দোকানের পাশের চাঁদ হোটেলে বসে খাবার খেতেন নিয়মিত। এইভাবে হোটেলের মালিক চাঁদ মামার সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। ফলে আব্বার স্ত্রীবিয়োগের ঘটনা তিনিও জানতেন।
চাঁদ হোটেলের মালিক সম্পর্কে আমার মায়ের যে ফুপাতো ভাই ছিলেন, সে কথা আব্বা জেনেছেন তার ঘটকালির পরের অধ্যায়ে। আমার পিতৃহীন মাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এই চাঁদ মামা, ওদিকে কবি জাহানারা আরজুরও তিনি আপন মামা ছিলেন, আমার মা ছিলেন সম্পর্কে জাহানারা আরজুর সমবয়সী খালা।
ইতোমধ্যে চাঁদমামার এই বোনঝি কবি জাহানারা আরজুর সঙ্গে অন্য বোনপুত্র তরুণ অ্যাডভোকেট এ কে এম নূরুল ইসলামের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই। অথচ পরিবারের মধ্যে একই বয়সী পিতৃহীন বোনটির তখনো বিয়ে হয়নি। এই নিয়ে চাঁদমামা খুব ভাবিত ছিলেন। আমার নানিও তাকে অনুরোধ করেছিলেন, ভালো একজন পাত্র খুঁজে দেওয়ার জন্যে। এ কারণে মামাতো বোনের জন্যে সুপাত্র পেতে চেষ্টা করতেন সব সময়। এই সময়ে আব্বার স্ত্রীবিয়োগের ঘটনাটিকে তিনি দুয়ে-দুয়ে চার করার কথা ভাবলেন। যথাসময়ে গল্পচ্ছলে চাঁদমামা একদিন আমার মায়ের মেধা, বিভিন্ন গুণপনা ও নানা রাশেদ খানের উচ্চ বংশমর্যাদার কথা আলাপে তুলে আব্বাকে বিবাহের জন্যে প্রায় সম্মত করে ফেললেন। আব্বাকে নিমরাজি হতে দেখে সুযোগ পেলেন। এই সুযোগ হাতছাড়া না করে চাঁদ মামা সেই রাতেই জাবরা গ্রামের ‘বড় বাড়ি’ বলে পরিচিত আমার নানাবাড়িতে নিয়ে গেলেন। মাকে ঘুম থেকে তুলে ঘুমজড়ানো চোখের এক অষ্টাদশী কনেকে দেখালেন আব্বাকে।
তৎক্ষণাৎ গিনি সোনা দিয়ে আব্বা আমার মায়ের মুখ দেখলেন এবং বিয়েতে তার সম্মতি কথা জানিয়ে সেদিনের মতো বাড়ি ফিরলেন। এরপরে সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে খুবই ধুমধামের সঙ্গে প্রচুর সোনার গহনায় মুড়িয়ে মাকে নিজের ঘরে এনে তুলেছিলেন আব্বা। যখন মায়ের বয়স ছিল আঠারো বছর। মাঝে-মধ্যেই স্মৃতিচারণ করে মা আমাকে বলতেন, তার বাসর রাতের গল্পগাছি। মায়ের বর্ণনা অনুযায়ী, তার বাসর রাতটিও ছিল অনন্য এক ব্যতিক্রমী কল্পনার রাত। আব্বার দ্বিতীয়বার হলেও মায়ের তো প্রথম বিবাহ। কাজেই তার মনের মধ্যে স্বপ্ন লতিয়ে ওঠা অমূলক নয়।
বাসর ঘরের খাটে হাঁটু মুড়ে বসে মা যখন অপেক্ষা করছেন আব্বার জন্যে, সেই সময় আব্বা তার মাতৃহারা দুই কন্যা মায়া-হাওয়াকে নিয়ে ঘরে আসেন। দুজনকে আমার মায়ের দুই রানের ওপর বসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আজ থেকে শুরু হলো আমাদের চার জনের সংসার, কেমন? আমার মাও নতমুখে তার দেবতা আজ্ঞা মেনে নিয়েছিলেন সংসারাশ্রমের প্রথম রাতেই।
জীবনের প্রত্যেকটি পর্বে বাসর রাতের সেই অঙ্গীকারকে তিনি ধর্মভাবে পালন করেছেন আমাদের অগ্রজ দুই বোনের ক্ষেত্রেই। ভালোবেসে তিনি তা করেছেন বলেই আমরাও তা অনুভব করতে পেরেছি মরমে মরমে। এজন্যে নিজের গর্ভজাত সন্তানদেরও আপন-পর ভাবতে শেখাননি।
পেটের এবং পিঠের সন্তান হিসেবে ভেদরেখা অঙ্কনের কোনো সুযোগ তিনি দেননি। এতটাই ধৈর্য, মমতা আর পরম সহিষ্ণুতায়লালন পালন করেছেন সব সন্তানকে। আমরা তিন ভাই তিন বোন এবং বড় দুই বোন মিলে আটজনেরই গর্ভধারিনী মা ছিলেন তিনি। আমাদেরও কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন এই দুই বোন। আমাদের বাড়ির পূর্বদিকের বিপরীত হালোটের ধারেই ছিল নেধুন দেওয়ানের বাড়ি। নিঃসন্তান ওই দম্পতির পালিত পুত্র বাছেত ছিল আমার সহপাঠী। দুজনেই আমরা তখন প্রাইমারি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।
বাছেতের বাড়ির জাম গাছে খুব ডাসা ডাসা জাম হতো। খেতে খুব সুস্বাদু ছিল বলে পাড়ার ছেলেপেলেদের কাছে তার চাহিদা ছিল খুব। আসতে-যেতে দুষ্টু ছেলেরা প্রায়ই সেই গাছে ঢিল ছুড়তো। আমরা ভদ্রঘরের সন্তান, পাড়ার লোকেরা মিয়া বাড়ির সন্তান হিসেবে তাই আমাদেরও বেজায় সমীহ করে চলে। কাজেই ঢিলমারা যে আমাদের সাজে না, তা বুঝে গিয়েছিলাম দূর শৈশবেই। ফলে জাম খেতে ইচ্ছে হলে মায়ের কাছে আবদার করতাম। তখন পঞ্চাশ পয়সা বা একটাকা দরে জাম কিনে আনতাম ওদের বাড়ি থেকে।
অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়ের এই পরিবারগুলো ফলের মৌসুমে আম, জাম, কাঁঠাল, জামবুরা বিক্রি করে চলতো। ক্রেতাও যেহেতু পাড়ার, কাজেই তাদেরও জানা ছিল কোন বাড়ির কোন ফল বেশি সুমিষ্টি বা সুস্বাদু।
আমাদের যৌথ পরিবারের একমাত্র ‘মুরব্বি’হিসেবে একমাত্র আমার মা সবার জন্যে আশার প্রদীপ হয়ে যেন চলার পথকে আলোকিত করে রেখেছেন।
আমি চাইলে, তবে মা আমাকে সেসব বাড়ি থেকে আম, জাম কিনতে যেতে অনুমতি দিতেন। অন্যথায় রাখালেরা নিয়ে আসতো কিনে।
চার.
সেই দিন প্রথম আমার সহপাঠী বাছেত গাছে উঠে জাম পেড়ে লুঙ্গির কোচরায় রাখতে রাখতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, ওই দিলু, মায়া-হাওয়া না কি তোর সৎ বইন? প্রথম আমি ‘সৎ’শব্দটি ওর মুখেই শুনেছিলাম। আমি বাছেতের প্রশ্নের কোনো জবাব দেইনি। কিন্তু ওর কথার ধরন শুনেই ওদের বাড়ির জাম কেনা ও খাওয়ার হাউস যেন মুহূর্তেই উবে গেলো, জাম না নিয়েই দৌঁড়ে এসে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘সৎ’ মানে কী, মা? বাছেত বললো, মায়া-হাওয়া আপা না কি আমার সৎ বোন?
আমার প্রশ্ন শুনে মনে হলো মাও যেন খানিকটা হতভম্ব। কাজেই আমি আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছি। বলেন না, মা, এটা কি সত্য? এখনো মনে আছে, মা আমাকে আঁচলে সাপটে নিয়ে বলেছিলেন, তোমরা সব আপন বোন-ভাই। বাছেত বাজে কথা বলেছে, মনে রাখবে, মায়া-হাওয়া তোমাদের আপন দুই বোন। কেমন? আচ্ছা, বলে আমি মাথা কাত করে, জন্মদিনের হাওয়ায় ওড়া আনন্দ বেলুনের মতো উড়ছিলাম সেদিন। আমাদের গ্রামে আদর্শ মা ও বিবেকবান ভালো সৎমায়ের উদাহরণ ছিলেন তিনি।
তিনি আমারও মহিয়সী মা। তার ধৈর্য, একলব্য নিষ্ঠা ও নিজে ডিগ্রি নিতে না পারার বেদনাবোধকে সন্তানের সাফল্যে ভুলতে চেয়েছিলেন বলেই ওই অজপাড়াগাঁ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল আমার। যে করেই হোক,দ আমাকে পড়ানোর বাসনা ও আকাঙ্ক্ষা তার এত তীব্র না হলে আমার মতো ফাঁকিবাজের পাঠ কখনো সমাপ্ত হতো না। তাই তো, ‘মা বলিতে প্রাণ করে আনচান/ চোখে আসে জল ভরে।’
আমরা বড় হতে হতে কোনো ভাই-বোনের কখনো কোনোদিন জন্মদিন পালন করতে দেখিনি মাকে। তাদের নিজেদের জন্মদিন পালনের তো প্রশ্নই ওঠে না। অনেক পরে আমি যখন আমার সন্তানদের জন্মদিন পালন করছি মায়ের উপস্থিতিতে, তখন মাকেও দেখি আনন্দে বেশ উদ্বেল হতে। ভাবলাম, সন্তানদের জন্মদিন পালন করি প্রতিবছর, একবার না হয় মায়ের জন্মদিন পালন করি, মা নিশ্চয় অনেক খুশি হবেন।
মা কিছুতেই তার সঠিক জন্মদিনের তারিখটি বলতে পারলেন না। কেননা, আমার মায়ের মতো তার মা জন্মদিনটি লিখে রাখেননি, মনেও করতে পারেননি। কাজেই সন্তান হয়ে মায়ের জন্মদিনের একটি দিন ঠিক করতে হবে। কী করি!
অনেক ভেবে ‘আন্তর্জাতিক মা দিবস সমিতি’ কর্তৃক নির্দিষ্ট তারিখ অনুসরণে ‘মে মাসের দ্বিতীয় রোববার’ এর মা দিবসের দিনটিকে আমাদের মায়ের জন্মদিন হিসেবে পালন করছি আমরা ২০১১ সাল থেকে। আমি মিরপুর বাঙলা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়েছি এর কিছুদিন আগে।
ধানমন্ডির বাসা থেকে প্রতিদিন কলেজে যেতে-আসতে কলাবাগানে নতুন প্রতিষ্ঠিত প্রিন্স রেস্তরাঁটি তাকিয়ে দেখি। কখনো যাওয়া হয়নি সেখানে। গুলশান-বনানীর পরে ধানমন্ডিতে প্রথম ব্যুফে সার্ভ করা হতো এই প্রিন্স রেস্তরাঁয়।
সেখানেই প্রথম মায়ের জন্মদিনের আয়োজন করি। চমৎকার কার্ড ছাপিয়ে, তিন চাচার উত্তরাধিকার যারা আছেন, তাদের অনেককেই নিয়ে প্রথম পালন করেছিলাম মায়ে জন্মদিন। সমান আগ্রহে আমরা ভাই-বোনেরা এই দিনটিকেই মায়ের জন্মদিন হিসেবে পালন করে চলেছি।
মা তার বিয়ের সময়ের বয়সকে কখনো ভোলেন না। সব সময় বলতেন, বিয়ের সময় তার বয়স ছিল আঠারো বছর। সেই হিসাবে আমাদের মায়ের বর্তমান বয়স পঁচাশি।
আমরা ভাই-বোনেরা বাই রোটেশন ঘটা করে জন্মদিন পালন করি প্রতিবছর। এখনো তিনি আমাদের মাথার ওপরে তাঁর স্নেহাঞ্চল বিছিয়ে রেখেছেন, এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কী হতে পারে?
আব্বাসহ তিন চাচা ও চাচিও গত হয়েছেন অনেকদিন আগে। আমাদের যৌথ পরিবারের একমাত্র ‘মুরব্বি’হিসেবে একমাত্র আমার মা সবার জন্যে আশার প্রদীপ হয়ে যেন চলার পথকে আলোকিত করে রেখেছেন।
চলবে…
বালিকার চরৈবেতি-৩॥ দিলারা হাফিজ