[পর্ব-২]
নতুন রাজধানী ঢাকা
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের এই সময়ে বাংলা পুনরায় বিভক্ত হয়। এর ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘পূর্ব বাংলা’ ও হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠ ‘পশ্চিম বাংলা’ প্রদেশ হিসেবে গঠিত হয়। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের এবং পশ্চিম বাংলা ভারতের প্রদেশ হয়। ১৯৫৫ সালের ১৪ অক্টোবর পূর্ব বাংলার নাম পাল্টে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়। পূর্ববাংলা থেকে ১৯৫০ সালে, ভারত থেকে ১৯৫১ সালে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৯৫৯ সালে জমিদার প্রথা বিলোপ হয়ে যায়।
এর ফলে আমার জন্মের পাঁচ বছর আগেই আমাদের পরিবারের জমিদারি চলে যায়। তবে তার চালচলন রয়ে যায় দীর্ঘকাল। আমার বড় কাকার একমাত্র পুত্র সন্তান সিরাজ। বংশের প্রথম পুত্রসন্তান হিসেবে জমিদার বাড়ির যুবরাজ ছিলেন একদা। তার অপরূপ সৌম্যকান্তি, বিনীত আচার-আচরণে স্থিতধী ব্যক্তিত্বের কারণে গ্রামবাসী ছাড়াও আলাদা এক মর্যাদা ছিল পরিবারের সবার কাছেই। তিনি তার যৌবনকালে ঘোড়ায় চড়ে ঠকঠক করে চলতেন সর্বদা, পোশাকেও ছিল নবাবি ভাব। এসব গল্পে শুনেছি, বড়দের মুখে।
আমি দেখেছি অন্য এক সিরাজ ভাইকে, যিনি জীবন যুদ্ধে পর্যদস্তু এক উদাসীন সেনানায়ক। বুর্কিনা ফাসো ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এসেছিলেন বাইসাইকেলে।
ফলে পরবর্তী সময়ে পারিবারিক জটিলতা তৈরি করেছিল বড় কাকার সেজো মেয়ে হেনা আপার স্বামী আমাদেরই ফুফাতো ভাই তামেজ উদ্দিন। সে কথা পরে বলবো।
আমরা যখন বড় হয়েছি, তখনো ঠাট ছিল কিন্তু ঐশ্বর্য তেমন ছিল না। এ কারণে সুযোগ পেলেই কবি রফিক আজাদ মাইট্টা জমিদারের কন্যা বলে আমাকে ক্ষেপাতেন, কী ভেবে, কে জানে! জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেলো। এর পর পৈত্রিক ও নিজেদের কেনা জমিজমা ৪ ভাইয়ের মধ্যে সমান হারে বণ্টন করে দিলেন আব্বা।
ইতোমধ্যে বড়কাকা যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। সেই সময়ে যক্ষা রোগ সম্পর্কে বলা হতো, যার হয় যক্ষা, তার নাই রক্ষা। তবু তার পিতৃতুল্য বড়ভাইকে রক্ষা করার প্রাণান্তকর চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি আব্বা। ডাক্তারের পাশাপাশি কবিরাজের নানা টুটকা চিকিৎসাও চলেছে তার জন্যে। কবিরাজের কথায় বড়ভাইকে কিছুদিন পানসি নৌকা ভাড়া করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফ্রেস হাওয়ায় রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন আব্বা। কিছুতেই কিছু যখন হলো না, তখন অন্য এক কবিরাজের কথা মতো তিনি যে ঘরটায় আলাদা থাকতেন, সেখানে ৫ /৬টির মতো ছাগল বেঁধে রাখা হতো। সেই সময়ে এমন বিশ্বাস ছিল যে, ছাগলের নাদি ও চুনার গন্ধে যক্ষা রোগ সারবে। রোগীও শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কিছুটা আরাম পাবেন।
এই ব্যবস্থার ফলে সারারাত ছাগলের ভ্যাঁ ভ্যাঁ চিৎকারে, দুর্গন্ধে ঠিক মতো ঘুমুতে পারতেন না বড় কাকা। তবু বেঁচে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে ওইসব সহ্য করে গেছেন আমৃত্যু। বছর তিনেক তিনি যক্ষারোগে ভুগে অবশেষে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
জমাজমির সব হিসাব রাখতেন বড় কাকা, আব্বা দেখতেন ব্যবসা। কলকাতা শহরের প্রেসের ব্যবসা থেকে টাকার জোগান দেওয়া ছিল তার প্রধান কাজ। বড়কাকার শারীরিক অবস্থা দিনে দিনে আরও যখন খারাপ হচ্ছিল, তখন বাঁচার আশা প্রায় নেই। কাজেই তার মৃত্যুর আগে আগেই আব্বা জানতে চাইলেন, দাদার জমি ছাড়া বাকি দেড়শ বিঘা জমি কেনার জন্যে আব্বা যে টাকা বিভিন্ন সময়ে পাঠিয়েছেন, সেই জমির দলিলে চার ভাইয়ের নাম আছে কি না।
বড় কাকা জানালেন, অধিকাংশ জমি আমার আর তোমার নামে কিনেছি, অল্পকিছু জমি আফসার আর ইনসারের নামে কেনা।
—তা কেন হবে ভাই?
সৎ ভাই হলেও ওরা দু’জনেই আমাদের ভাই। ওরা কাজ কম করুক, কিন্তু ওরা তো আমার ব্যবসার সঙ্গেই ছিল। কাজেই, আমি মনে করি, জমাজমি, প্রেস, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আমাদের যা কিছু আছে, সবই সমান হারে চার ভাগ হবে।
এই সিদ্ধান্তে আমার আব্বা এতটাই অটল ছিলেন যে, বাধ্য হয়ে বড় কাকা বললেন, যদি তুমি মনে করো তাই, তাহলে বাটোয়ারা দলিল করে দিলেই চলবে। জমি যার নামেই থাকুক, দখলি স্বত্ব হিসেবে ভোগদখল করতে পারবে সমান অংশে।
সেই মতে আব্বা বাড়িতে উকিল ডেকে দ্রুত সব জমি হিসাব করে সমান চার ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু রেজিস্ট্রি হওয়ার আগেই বড় কাকা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। ফলে পরবর্তী সময়ে পারিবারিক জটিলতা তৈরি করেছিল বড় কাকার সেজো মেয়ে হেনা আপার স্বামী আমাদেরই ফুফাতো ভাই তামেজ উদ্দিন। সে কথা পরে বলবো।
এই জমি ভাগাভাগির পরেই যার যার হাঁড়িতে পৃথক রান্নার ব্যবস্থা শুরু হলো। তবে আমাদের ঘরে বড় মাছ বা ভালো কিছু রান্না হলেই আব্বা তার ভাই-ভাতিজাদের নিয়ে এক সঙ্গে খেতে খুব ভালোবাসতেন।
জার্মানিতে বছর পাঁচের মতো কাটিয়ে ফিরে আসে দেশে। দেশে ফিরে রাজনীতির মারপ্যাচে পড়ে শেষাবধি প্রেসের পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে সেলিম।
ওদিকে বড় আম্মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, তার বারান্দায় যখন-তখন ডেকে খাওয়াতেন আমাদের। সিরাজ ভাইয়ের পরে এখনো সে ধারা বজায় রেখেছে তার সন্তান রুনু ও পল। ওরা দু’ভাই বাড়িতে এলে আম-জনতার পাত পড়ে শতবর্ষের সেই বারান্দায়। আব্বা আমৃত্যু এভাবেই সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলেছেন। মিলেমিশে বাস করার আদর্শ নিয়ে তিনি চার ভাইয়ের সংসারকে যেভাবে আলগে রেখেছিলেন দুই হাতে, আমাদের ভাই-বোনদের প্রতিও তার একই রকম নির্দেশ ছিল।
আব্বার সেই সমষ্টিগত চেতনায় নমিত থেকে তার ইচ্ছে ও বাসনাকে মূল্য দিতে চেষ্টা করেছি আমরা প্রত্যেক ভাই-বোনই। আব্বার এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যেমন ঘটেছে আমাদের জীবনে, তেমনি আজ এই কথা স্বীকার করতেই হবে—আমরা ভাই-বোন মিলেমিশে থেকে ঋদ্ধ হয়েছি পরস্পর। এজন্য আপন সংসারের বাইরেও আমদের অস্তিত্বের শেকড় কখনো প্রাণ-জলের অভাবে শুষ্ক হয়ে যায়নি।
কলকাতার বৈঠকখানা রোড থেকে ঢাকার সদরঘাটে প্রেস স্থানান্তরের পরে একইভাবে প্রেসের মিশিনারি যা কিছু চার ভাইয়ের মধ্যেসমান ভাগে ভাগ করে যার যার অংশ বুঝিয়ে দেন আব্বা। পারিবারিক এই উত্থানের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে আব্বার এই সামষ্টিক সাম্যবাদী চিন্তা-চেতনা। ইসলামিয়া স্টেটের প্রতিষ্ঠাতা হলেও সব কিছু চার ভাইয়ের মধ্যে সমান ভাগ করে নিয়েছেন। এক সুতোও তিনি কারও থেকে বেশি নেননি জীবনেও। এমন উদারনৈতিক সাম্যবাদী প্রকৃত মানুষের কথা বই পুস্তকেই দেখা যায়, কিন্তু আমরা বাস্তবেই এমন এক পিতার সন্তান ছিলাম।
আমার চাচারাও ভালো মানুষ ছিলেন, বড় কাকাকে আমরা দেখিনি, যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালেই পৃথিবী থেকে তিনি অনন্তের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিলেন। তিনিও প্রথম জীবনে কলকাতা গিয়ে ‘বদর অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে একটি বুকবাইন্ডিংয়ের এক কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। আব্বা প্রথমদিকে ভাইয়ের আহ্বানে সেখানে ব্যবসা শুরু করলেও তার খুব পছন্দ ছিল না, পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে আব্বা তার দাদার নামকরণে ‘দ্য বখসী আর্টপ্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ইতোমধ্যে বড়কাকার যক্ষারোগ শনাক্ত হলে আব্বার অনুরোধে তিনি জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে আমৃত্যু বাড়িতেই কাটিয়েছেন সময়।
তবে, কলকাতা জীবনের পরে আব্বা ছাড়া বাকিরা কেউ প্রেস ব্যবসায় থাকেনি। বণ্টনে পাওয়া তাদের প্রেসের মিশিনারি বিক্রিবাট্টা করে গ্রামের বাড়ি চলে যান দুই চাচাই। কিছুকালের ব্যবধানে বড়কাকার অংশের প্রেসের মিশিনারিও তার পুত্র (সিরাজ ভাই) বিক্রি করে দিয়ে মানিকগঞ্জ শহরে অন্যান্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করেছে। আব্বাই কেবল তার প্রেসের ব্যবসা ধরে রেখেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন তার পুত্র সন্তানদের হাতে তুলে দেবেন তার চাবি।
উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই লেটারহেড প্রেসের ব্যবসার আধুনিকায়ন করে সন্তানেরা হয়তো একদিন পিতাকেও ছাড়িয়ে যাবে। প্রেসের কলেবর আরও বৃদ্ধি পারে—এ রকমই স্বপ্নের সহিস ছিলেন তিনি। সে স্বপ্ন তার আংশিক সফল হয়েছিল, আমার ছোট ভাই সেলিম ১৯৭৪ সালে যখন ঢাকা কলেজে ইন্টামিডিয়েটের ছাত্র। তখনই ক্লান্ত, শ্রান্ত আব্বা প্রেসের চাবি তার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, বাবা আমি আর পারছি না, পড়াশোনার পাশাপাশি প্রেসের দায়িত্বটিও নিয়ে নাও।
তথাস্তু বলে সেলিম সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। বেশ কিছুকাল সে লেটারহেড প্রসের দায়িত্ব নিয়েই সংসারের দেখভাল করেছে। ততদিনে লেটারহেড প্রেসের দিনকাল শেষে অফসেটে প্রকাশের সময়। কিন্তু অত টাকা নতুন করে লগ্নি করায় আব্বাও রাজি ছিলেন না, বাধ্য হয়ে সেলিম ১৯৯২ সালের দিকে ভাগ্যের চাকা পাল্টাতে বিদেশ চলে যায়। জার্মানিতে বছর পাঁচের মতো কাটিয়ে ফিরে আসে দেশে। দেশে ফিরে রাজনীতির মারপ্যাচে পড়ে শেষাবধি প্রেসের পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে সেলিম।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনের মাধ্যমে দুই টার্ম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে। আব্বা সেই যে ১৯৭৪ সালের কোনো এক সময়ে সেলিমের হাতে প্রেসের চাবি তুলে দিয়ে কর্মজগৎ থেকে ভারমুক্ত হয়েছিলেন, সেই থেকেই বাড়িতে এসে মায়ের পাশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন দু’জনে মিলেই সংসার-যজ্ঞের পূজারি। তবে, ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে মায়ের বিবাহের পর থেকে মা একাই জমাজমির হালচাষের যাবতীয় দেখাশোনা করেছেন।
দুটো রোলিং মেশিনে সারাদিন দিস্তার পরে দিস্তা শাদা কাগজ রোল টেনে বেরুচ্ছে। শুরুতে প্রথমটা লাল ডাবল বর্ডার, এর পরেরগুলো নীলকালিতে দাগ টেনে বেরিয়ে আসতো সেসব পাহাড় সমান কাগজ।
বছরের শুরুতেই আব্বা বছর-সনকা কয়েকজন রাখাল রেখে দিতেন, মা সারাবছর তাদের দিয়ে কৃষিকাজ পরিচালনা করতেন এবং রান্না বান্নার জন্যে আরও দু’জন বাধা রাঁধুনী নিয়ে মা সংসারের সদর-অন্দর দুই-ই সামলাতেন। আব্বা তখন ঢাকায় ‘দ্য বখসী আর্ট প্রেস’-এর মালিক হিসেবে প্রেসের ম্যানেজার, বাঁধাইখানার কর্মচারী, খদ্দের, উজ্বালা মেসফ্যাক্টরিসহ নানা প্রকার ক্লাইন্ট নিয়ে নগর জীবনের হাজারও উপসর্গে নিমজ্জিত থেকেছেন।
নতুন রাজধানী ঢাকা, এবারই যে প্রথম কপালে তার রাজধানীর জয়টিকা পড়েছে তা নয়। পাঁচ বার এই ঢাকা শহর রাজধানীর মুকুট পড়েছে। প্রথমত, ১৬১০ সালের ১৬ জুলাই সুবেদার ইসলাম খাঁ বার ভুঁইয়াদের নেতা মুসা খাঁকে পরাজিত করে বাংলা দখল করেন এবং ঢাকার নাম রাখেন জাহাঙ্গীর নগর। এই সময় বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। দ্বিতীয়বার ১৬৩৯ সালে শাহ সুজা বাংলার সুবেদার হলে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে রাজমহলে স্থানান্তরিত করেন। ১৬৬০ সালে মীর জুমলা বাংলার সুবেদার হলে ঢাকাকে পুনরায় রাজধানী করেন।
১৯০৫ সালে বাংলা ও বিহার নিয়ে প্রদেশ করা হলে তার রাজধানী হয় ঢাকা কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারায়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানীর নাম হয় করাচি এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীর নাম হয় ঢাকা। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকাকে বাংলাদেশের রাজধানী করা হয়।
ঢাকা আসলেই এক রহস্য নগরী। বর্তমানে এই মেগাসিটি, মসজিদের শহর, রিকশার শহর হিসেবেও তার খ্যাতি রয়েছে। ১.২ মিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে তো পৃথিবীর জনসংখ্যাবহুল শহরের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। একদা সওদাগরি-পথ আর পাথেয় খুঁজে খুঁজে অর্থ উপার্জনে ততধিক ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সেই নতুন ঢাকার রাজধানী শহরে। আব্বার পায়ের কত চিহ্ন যে সেখানে পড়ে আছে, কেই বা তার হিসাব রাখে?
দেশ বিভাগের ফলে আব্বা কলকাতার বৈঠকখানা রোডের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসা ফেলে এসেছেন, সেই দীর্ঘশ্বাস যেমন আছে তেমনি নতুনভাবে, নতুন রাজধানী ঢাকা শহরের সদরঘাটে পুরোনো প্রেসের নবরূপায়ণ নিয়েও নানা শঙ্কা, হতাশা তো ছিলই। মা যেহেতু ঢাকায় নিয়মিত থাকতে পারতেন না, সেই জন্যে আমাদের স্কুল ছুটি থাকলেই মা আমাদের দুই বোন-ভাইকে আব্বার কাছে প্রেসে পাঠিয়ে দিতেন।
সদরঘাটে তখন অনেক বিশাল বাড়ি ভাড়া নিয়ে আব্বার প্রেস চলমান। কত ধরনের যে মেশিন, সেসব নামও ভুলে গেছি। অনেকটা জায়গা নিয়ে বসে থাকতো রোলিং মেশিন, তারপর কাটিং মেশিন, এরপর ছাপার মেশিন ছিল কয়েকটা। দুটো রোলিং মেশিনে সারাদিন দিস্তার পরে দিস্তা শাদা কাগজ রোল টেনে বেরুচ্ছে। শুরুতে প্রথমটা লাল ডাবল বর্ডার, এর পরেরগুলো নীলকালিতে দাগ টেনে বেরিয়ে আসতো সেসব পাহাড় সমান কাগজ।
মনে আছে, একবার এক তেলবাহিত জাহাজে আগুন ধরেছিল। রাত আটটার দিকে হবে। জাহাজটির অবস্থান ছিল বুড়িগঙ্গার নদীর ওপর ঠিক আমাদের ‘দ্য বখশী আর্ট প্রেস’-এর মুখোমুখি। কী যে ভয়াল ছিল সেই লেলিহান আগুনের রাত। আকাশের তলে জলের ওপর ভাসমান আগুনের দৈত্যকে এভাবে লাফাতে কেউ দেখেছে কি না—জানি না। তবে আমার ছোট্ট এক বর্ণের জীবনে তা ছিল মহাবিপর্যের রাত। কিছুক্ষণ পর পর বিকট শব্দে তেলের একেকটা ড্রাম ব্রাস্ট হচ্ছে আর চারদিকে কমলা রঙের আগুনে খইয়ের মতো আকাশ-বাতাস সমানতালে ফুটছে সব।
‘ইসলামি স্টেট’-এর জমিদারির স্মৃতিটুকু ছিল আব্বার উত্থান পর্বের বড় সাফল্য। রজনীকান্তের গানের ভাষায় আমার আব্বার মনের কথাগুলো ছিল হুবহু এই রকমই।
পুরো সদরঘাট, বাদামতলীজুড়ে মানুষের চিৎকার আর ছুটোছুটির হল্লা। আমাকে আর সেলিমকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে আব্বা দৌড়ুচ্ছেন। আব্বা বামহাতে শক্ত করে ধরে আছেন আমাকে, আমিও দৌড়াচ্ছি তার সঙ্গে সঙ্গে। সেলিম যেহেতু ছোট, আব্বা ওকে কাঁধে নিয়েছিলেন। সেই আগুনের আলোতে আব্বার মুখখানা খুব অসহায় মনে হচ্ছিল আমার। আকাশে চিলের উৎপাত দেখলে মুরগি যেমন তার ছানাপোনা নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে, আব্বাও সেদিন সন্তানদের বাঁচাতে তার বন্ধু পরিচিতদের বাসায় আশ্রয় খুঁজছিলেন। কিছুদূর দৌডে এসে একটা দোকানে এসে বসলেন আমাদের নিয়ে, সেখানেও যখন আগুনের হল্কা মুখ বাড়িয়ে তাড়া করছে, অনিরাপদ ভেবে সেখান থেকে দৌড়ে গিয়ে আরও ভেতরের একটা বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
সেই বাসাটি কি পরিচিতজনের না, অপরিচিতের ছিল, আজ আর কিছু মনে নেই। তবে মনে একটি প্রশ্ন সেদিন আগুনের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে আমারছোট্টমনকে নাড়া দিয়েছিলো যে, যে জলে আগুন নেভে, সেই জলের উপর আগুন কিভাবে জ্বলে, সেই আগুন যে তেলের আগুন, তা বোঝার বয়স এবং অবস্থা কোনোটাই ছিল না সে রাতে।
এই রকম বিভিন্ন ঘটনায় প্রথমদিকে আব্বা অনেকদিন মন থেকে নতুন ঢাকায় মন বসাতে পারেননি। ফিরে ফিরে কেবল কলকাতা রসেই উজ্জ্বল, উর্বর সময়ের কথা ভাবতেন এবং সেসব দিনের অনেক স্মৃতি শেয়ার করতেন আমাদের সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, একদিন এই প্রেসের ব্যবসা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে।
এই প্রেসের ব্যবসা সাফল্যেই তিনি অঢেল জমিজমার মালিক যেমন হয়েছিলেন, তেমনি বহুলকাঙ্ক্ষিত জমিদারের সুশোভিত উষ্ণীষ ধারণ করে কৃতার্থ হয়েছিলেন মহাপরমের কাছে। ‘ইসলামি স্টেট’-এর জমিদারির স্মৃতিটুকু ছিল আব্বার উত্থান পর্বের বড় সাফল্য। রজনীকান্তের গানের ভাষায় আমার আব্বার মনের কথাগুলো ছিল হুবহু এ রকমই।
আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছে, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি।তব আশীষ কুসুম ধরি নাই শিরে,
পায়ে দলে গেছি, চাহি নাই ফিরে;
তবু দয়া করে কেবলি দিয়েছ,
প্রতিদান কিছু চাওনি।