[পর্ব-১: আমার চেতনার রঙে]
আমার বয়স কত ছিল, তখন? সাত-আট মতো হবে কিংবা কিছু কম অথবা বেশি। আমি তখন আমি হয়ে উঠেছি, কী এক জাদু-সিঞ্চনে। যতদূর মনে পড়ে, তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম তখন। আজ যখন লিখতে বসেছি, তখন ষাটোর্ধ্ব স্মৃতির জারক রসে নিমজ্জিত সেকালের কথামালা রৌদ্রে মেলে দিয়েছে তার পাখা।
বাস্তবতা ছেড়ে পরাবাস্তবতার মুখোমুখি হলে এভাবেই বুঝি শুরু করতে হয় ঘটনা-গল্পের সূতোহীন-কথন। শৈশব তো স্বপ্নের এক মায়াবী শহর। যেন ঘনসবুজের এক কুঞ্জলতায় আরক্তিম ফুল। দুই-পায়ে ঝুমকো লতার পক্ব ফলে গাথা নুপূর। ঝুনঝুন শব্দ করে হাঁটি উঠোনজুড়ে। তাতেই উন্মাতাল আনন্দ পায়ের’পরে এসে লোটে। মন হাসে নিমকদানির মতো।
আমার ছায়াঘেরা গ্রামের বুক চিরে ধানের ক্ষেতে টুকরো টুকরো ঢেউ খেলানো আকাশ-নদী যেভাবে বয়ে যেতো অধীর, সেই পথের বাঁকে আমি আজও দাঁড়িয়ে আছি। আমার দু’পায়ের পাতায়, গোড়ালিতে লেগে আছে হারিয়ে যাওয়া কাইকা ধানের উং, হলিদঝরণ ধানের সোনালি আভা।
যে গ্রাম আমি ফেলে এসেছি, তার পাতায় পাতায় আমার নাম আর বাংলার নিরন্ন মানুষের যাপিত জীবনের ছবি। চারুনেত্রে, সমুদয় চিত্রকল্পে আজও খুঁজে বেড়াই সেই ছায়া-অরণ্য, মনের গভীরে যার নিত্য বসবাস। সেদিনগুলো যেন আরক্তিম রহস্যে আবৃত চির-অচেনা এক পাখির রঙিন পালক ঝরা বিকেল। আমার আব্বা হাফিজ উদ্দীন আহমেদ। মাইঝা মিয়াসাব, হিসেবে পরিচিত আবালবৃদ্ধ বনিতাজনের কাছে। একদা, কলকাতার বৈঠকখানা রোডে চার, চারটি প্রেস ছিল তাঁর। বড় ভাই বদর উদ্দীন আহমেদ বাড়িতে থেকে জমিদারি দেখাশোনা করতেন, বাকি ছোট দুই ভাই আফছার উদ্দিন আহমেদ ও কনিষ্ঠ ইনসার উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে আব্বা প্রেস পরিচালনা করতেন।
আমার আব্বার মুখে প্রায়ই শুনেছি কথাটি, বলা যায় তাঁর প্রিয় বাক্য ছিল এটি। প্রায় সময়ে বলতেন, যে ছেলে খেলতে জানে, সে কানাকড়ি দিয়েও খেলতে পারে। কিংবদন্তীতুল্য এই কথা তাঁর নিজের জীবনের ক্যানভাসে এঁকেছেন বিমুগ্ধ এক প্রাতিস্বিক চিত্রকরের মতো।
আমার দাদা মাঈন উদ্দিন আহমেদের চার ছেলে দুই মেয়ে। প্রথম পক্ষে আমার আব্বা হাফিজ উদ্দীন আহমেদ ও বড়কাকা বদর উদ্দীন আহমেদ। এক ফুপু জমিলা খাতুন। আমার দাদি অকালে মৃত্যুবরণ করায় দাদা দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। সেই পক্ষে রয়েছে দুই ছেলে এক মেয়ে। আমার দাদার বাবা ছিলেন তালুকদার, তার নাম বখশী তালুকদার। এজন্য আমার আব্বা তার দাদার নামানুসারে প্রেসেরনামকরণ করেছিলেন ‘দ্য বখশী আর্ট প্রেস’।
১৯৪৭-পরবর্তী দেশভাগের পরে নতুন ঢাকায় আব্বার সে প্রেসটি ছিল সবচেয়ে বড়। এমনকী, পদ্মা প্রিন্টার্সের মালিকও একদা আমার আব্বার প্রেসে কাজ শিখে পরে প্রেসমালিক হয়েছিলেন বলে আব্বার মুখে শুনেছি।
মায়া-হরিণের মতো সে দৌড়ে পালায়, কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে বর্তমানকে তুলে নিয়ে যায় তার মোহনীয় অতীতের পান্থশালায়। ‘আমি’হয়ে ধরা দেয় সে রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো।
জানা যায়, বখশী তালুকদারের পূর্বপুরুষের কেউ একজন কাশ্মীর থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। গোড়া থেকেই মোটামুটি অবস্থাপন্ন, সম্ভ্রান্ত এক পরিবার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও। তবে পরদাদার তালুকদারির পরে আমার দাদা বিষয়-সম্পত্তি কিছু বাড়াতে পারেননি। উপরন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তাঁর বাবার যে পাটের মহাজনী ব্যবসা ছিল, তাও রক্ষা করতে পারেননি।
বাড়িতেই বিশাল পাটের গুদামের জন্যে আলাদা দুটি ঘর ছিল। পাট বোঝাই গুদাম ঘর দুটিই একদিনে আগুনে পুড়ে ছাইভস্ম হয়ে গেছিল দাদার সেজো ছেলে আফছার উদ্দীনের ডাং-পুত্তি খেলার সুবাদে। খেলতে খেলতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এই সময়ে ডাঙের চালে পুত্তি উড়ে চলে গেলো দূরে, সোজা গুদাম ঘরের খাটালে। ঘর বোঝাই পালা করে সাজানো পাট আর পাট। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা অন্ধকার, দেখা যায় না কিছুই। অগত্যা, আফসার উদ্দিন চাচা কেরোসিনের চেরাগ হাতে নিয়ে পুত্তিখুঁজতে গিয়ে আগুনের সূত্রপাত করেন। বাকিটা সর্বস্বান্ত হওয়ার ইতিহাস।
ওই সময়ে আব্বা সংসারের করুণ দশায় উপায়ান্তর না দেখে ১০ আনা পয়সার পুঁজি হাতে নিয়ে কলকাতা শহরে চলে যানজীবন ও জীবিকার উদ্দেশ্যে। আমাকেই তিনি তার এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রার বয়ান অনেকদিন শুনিয়েছেন। দেশ বিভাজনের অনেক আগে থেকেই মানিকগঞ্জ এলাকাবাসীর অধিকাংশের প্রধান ব্যবসা ও পেশাও ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক প্রেস ব্যবসার সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত।
গ্রামের চেনা-পরিচিত অনেকেই প্রেসে চাকরি-বাকরি করে তাদের সংসার নির্বাহ করতো অনায়াসে। তাদের অনেকের সঙ্গে আব্বার পরিচয়ও ছিল নিবিড়। সেই ভরসায় তিনি সরাসরি বৈঠকখানা রোডের কোনো একটা প্রেসে কাজ খুঁজে নিয়েছিলেন। কিছুকাল সেই প্রেসের মালিকের অধীনে আব্বা খুব যত্ন সহকারে কাজ শেখেন অতি দ্রুত সময়ের মধ্যেই। মালিকও খুব খুশি ছিলেন আব্বার প্রতি। পুত্রপ্রতিম স্নেহ করতেন তাকে।
পরে ওই প্রেস আব্বার কাছেই স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে দেন মালিক। প্রেসের মালিকানা পেয়ে তিনি গ্রাম থেকে ছোট দুটি ভাই আফসার উদ্দিন আহমেদ ও ইনসার উদ্দিন আহমেদকে এনে কাজ শেখান। প্রেস পরিচালনার কাজেও নিয়োজিত রাখেন দু’জনকেই। অল্প বয়েসী সৎ, তরুণ ব্যবসায়ী হিসেবে আব্বার বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে অল্প কিছুদিনেই। ফলে, এই সময়ে জমিদারদের কাছ থেকে অনেক কাজের অর্ডার পেতে থাকেন তিনি। স্বউদ্যোগেও আব্বা বিভিন্ন জমিদারের কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে কাজ সংগ্রহ করতেন। এই এক প্রেসের আয় দিয়ে তিনি আরও তিনটি প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন পর্যায়ক্রমে।
নিজ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইসলামিয়া স্টেট’ নামে জমিদারি। যার দেখাভালের পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন বড় ভাই বদরউদ্দিন আহমেদকে। প্রেসের কাজের সূত্রেই কলকাতার প্রতিষ্ঠিত বেশ ক’জন জমিদারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ধারণা করি, এই যোগসূত্রের কারণে তাঁর মধ্যেও জমিদার হওয়অর উদ্যম ও বাসনার উদ্রেক হয়েছিল। যে কারণে আমাদের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরটিকে আব্বা সেভাবেই হরিণের তিনটি শিং, মহিষের বৃত্তাকার একটি সমআয়তনের শিং, বাঘ ও হরিণের চামড়ায় মোড়ানো কোচ দিয়ে সাজিয়েছিলেন সেই সময়ে।
শত বছরের প্রাচীন সেই শিংগুলো আমার ভাইদের ঘরে আব্বার জমিদারির ঐতিহ্য বহন করে এখনো তার কিছুটা শোভা বিলিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীনেরও এক ধরনের শোভা থাকে, সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে থাকে তার গন্ধ বিধুর ধূপ। মায়া-হরিণের মতো সে দৌড়ে পালায়, কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে বর্তমানকে তুলে নিয়ে যায় তার মোহনীয় অতীতের পান্থশালায়। ‘আমি’হয়ে ধরা দেয় সে রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো।
আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ
. চুনি উঠলো রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে—
. জ্বলে উঠলো আলো
. পুবে-পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’—
সুন্দর হলো সে।
চলবে…