কালপর্ব: পরিবর্তন ও পরম্পরা
শের-এ-মাস্তানের দরগায় ঝাড়ু দিতে দিতে তিনি যখন পেছনের দিকে গেলেন, দেখতে পেলেন কয়েকটি ফুল এইমাত্র যেন কেউ জলে ভিজিয়ে এনেছে। ফুলগুলো হাতে তুলে দরগায় প্রবেশ করার পর দেখতে পেলেন, চাদরও সিক্ত হয়ে আছে, মাত্রই যেন কেউ তাতে গোলাপজল ছিটিয়ে গেলো। সাধু অনেকক্ষণ ধরে খুঁজতে লাগলেন আশেপাশে কাউকে দেখা যায় কি না! কাউকেই পেলেন না। অবেশেষে সে ফুলগুলো সমাধিতে রেখে বেরিয়ে পড়লেন। কয়েকখানা বাতি নিভু নিভু করছে। দরগার চারদিকে প্রশস্ত খোলাবারান্দা কার্তিকের হাওয়ায় পূর্ণিমারাতকে প্রাণবন্ত করে তুলছে।
দোলপূর্ণিমার রাতে ফকির লালনের সমাধি ঘিরে লাখো মানুষের ভিড়ে যেমন হারিয়ে যায় ফকিরি স্পন্দন, তেমনি এই যে এইখানে জনমানুষহীন নীরবতার ভেতর আছড়ে পড়ছে বহুদূর থেকে ছুটে আসা মহাকালের ঢেউ; সেও তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না। মেঘালয় থেকে সাধু এবার কুষ্টিয়া এলেন, সাঁইজির কৃপা হলো বলে। আশ্রমের দীর্ঘবাসের পর এবার আর না হলেই নয়, তাই বেরিয়ে পড়লেন একা। সঙ্গী অনেকেই জুটতে চাইলো, কিন্তু তিনি একাই ভ্রমণে বেরুলেন। বহুদিন পর মুক্ত হওয়া গেলো, মানুষের নানান প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার শৃঙ্খল থেকে।
শের-এ-মাস্তানের কথা তিনি শুনেছিলেন তবারক ফকিরের কাছে। কালপর্বের পরিবর্তন ও বাংলার অধ্যাত্মজগতের অন্যতম কেন্দ্রভূমি হয়ে ওঠা, এই রকম একটি আগাম বার্তা শের-এ-মাস্তান পেয়েছিলেন। তাই বহুদূর থেকে ভ্রমণ করে পৌঁছান এই বঙ্গভূমিতে। একটুপর এসে উপস্থিত হলেন ফকির আসগর আলী। কুমিল্লা বাড়ি তার। তবারক ফকিরের কল্যাণে সাধুর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। আসগর ফকির বলে উঠলেন, এই দরগাটি অত্যন্ত নীরব। মানুষ এখানে কম আসে। আপনি এখানে যে আনন্দ পাচ্ছেন, তা আমিও পাই। আমিও মানুষের কোলাহল থেকে মুক্ত হতে এখানে প্রতিবার আসি। আচ্ছা বলুন তো, কালপর্ব পরিবর্তনের বিষয়ে আপনার মত কী?
কাল পরিবর্তন ছাড়া মহাকালকে ধরতে পারে না। প্রতিটি কালই একেকটি পরিবর্তনের মাধ্যমে মহাকালে যুক্ত হয়, নইলে যে তা হারিয়ে যায় কালের করালগ্রাসে। এই যেমন একটা ছোট পুকুর কতকাল আর টিকে থাকে বলুন; কিন্তু বৃহৎ বিলের মাঝখানে যেসব ছোট ছোট জলাপুকুর থাকে, তা কখনো মরে না। ওতে সংযোগ থাকে নদীর। কালকে অবশ্যই কোনো বৃহত্তর অর্থবহতার সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। নইলে তা মরে যায়। মহাকালের মহানদী-সঙ্গমে যুক্ত হতে পারে না।
বাউল-ফকিররা কালপর্বের পরিবর্তন সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্ক। এই পরিবর্তন কিভাবে ঘটবে, কে ঘটাবে; এসব বিষয়ও তারা আলোচনা করেন। তাদের সমাজবিশ্লেষণের রয়েছে নিজস্ব পদ্ধতি, যা তারা অত্যন্ত সহজভাবে করতে জানেন। পৃথিবীজুড়ে যে অস্থিরতা ও সংকট, তার পরিবর্তন কিভাবে ঘটবে, সে ফর্মুলা তাঁর জানেন না কিন্তু এটুকু বুঝতে পারেন যে, কাল ঠিক কোনসময়ে তার দিক বদলায়, মহা পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। আমরা তেমনি এমনই এক পরিবর্তনের মহাকাল-দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছি, যেখান থেকে সরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু খুব কম মানুষই এই পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন। কেউবা নিজেদের মতো করে একটা চিন্তা দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কেউ পরিবর্তনের নিজস্ব পদ্ধতির কথাও বর্ণনা করছে কিন্তু এসবই কেবল বুদ্ধিবৃত্তিকতা ছাড়া তেমন বেশি কিছু নয়।
আত্মময়তার সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো, তা অত্যন্ত গভীরতা থেকে বাস্তবতাকে ঝাপসা করে দেখে। কিন্তু যে আত্মসচেতন, সে কিন্তু সমাজ কাঠামোর সঙ্গে একটি যৌক্তিক সম্পর্ক রাখতে জানে। যে বুঝতে পারে, ঠিক কোনদিক দিয়ে গল্পটা শেষ হবে আর শুরু হবে নতুন কোন গল্পের। এই যেমন আমাদের শের-এ-মাস্তান। তিনি ঠিক কী কারণে এখানে এসেছিলেন, তা আমরা একভাবে জানি, কিন্তু তার ভেতরে আরও কত ভাবনা বিরাজ করছিল, সেসব কিন্তু অজানাই রয়ে গেলো। তবু, একটা পরম্পরা তৈরি হয়ে যায় ফকিরদের ভেতর, যারা নিরন্তর অস্তিত্বের বিনির্মাণের পথে নির্বাণ হতে চান।
আপনি তো একজন নাথ সাধু। আপনাদের পরম্পরা সম্পর্কে আমরা কমবিস্তর জানি। আপনারা কি বিশ্বাস করেন যে সময়ের এই পরিবর্তনে কোনো মহাপুরুষের আগমন ঘটবে?আসগর ফকিরের প্রশ্ন।
আমরা তো গোরক্ষনাথ পরম্পরার সাধক। এখন যার বারো আনাই সাম্প্রদায়িকতাদোষে দুষ্ট। তো পরিবর্তন আসতেই হবে। কোনো পরম্পরাই যুগের পর যুগ ধরে একরকম চলে না, তার ভেতর গুণগত, মানগত, সমৃদ্ধিগত পরিবর্তন যদি না ঘটে, তবে বুঝতে হবে সে বন্ধ্যা হয়ে আছে। এই যে এখন একেকটি ধর্মকে ধরে অন্য ধর্মের লোকজন নানান আক্রমণাত্মক কথা বলে, এটা কোথা হতে আসে? এ আসে নির্বোধ মানসিকতা থেকে। এটা যখন ঘটতে থাকে অত্যধিক, তখন বুঝতে হবে একটা বড় পরিবর্তন প্রয়োজন এবং তা অচিরেই ঘটবে। আমরা তো বিশ্বাস করি যে, এই পরিবর্তন ঘটবেই এবং তা একটা যোগ্য নেতৃত্বের দ্বারাই। সে নেতৃত্ব সম্পর্কে নানান ধর্মে নানান মত রয়েছে। কেউই এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেননি কিন্তু নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন।
এখন প্রস্তুতি নেওয়ার সময়। যার পক্ষে যতখানি সম্ভব, সে ঠিক ততখানি নিয়ে রেখেছেন। কিন্তু কথা হলো, এটা তো বুঝতে হবে আসলে কী ঘটতে পারে। আপনি যদি নাই বুঝতে পারেন, তবে কি করে ঠিক করবেন যে, আপনি আসলে কী চাইছেন? যেমন ধরুন, কেউ আপনাকে বললো, ‘আমি মিষ্টি খুব পছন্দ করি’, তো এখন এই কথা দ্বারা এটা ঠিক পরিষ্কার হয় না যে তা কি চিনি? না মধু? না মিষ্টান্ন? আপনি মিষ্টি খুব পছন্দ করতে পারেন, আবার পায়েসটা নাও পছন্দ করতে পারেন, আপনার হয়তো খেজুরের রস ভালো নাও লাগতে পারে আবার তালের রস পেলে আপনি কিছুতেই না খেয়ে থাকতে পারবেন না। বিষয়টি হলো আসলে এটা একটা বিন্দু, যেখান থেকে নানান দিকে সে রেখা টানতে পারে। এই বিন্দুরেখাটাই হলো একেকটি মত, যা ওই মূলবিন্দু হতেই সৃষ্টি। তাই আপনারা লালনশাহী ফকিররা যা ভাবছেন, আমরা নাথসাধুরা যা ভাবি, স্বয়ম্ভুনাথীরা যা ভাবেন, খ্রিস্টান ও ইহুদি সাধুরা যেমন করে ভেবে থাকেন, তার ভেতর ওই রেখার পার্থক্যটি থাকবেই কিন্তু বিন্দুটি সেই এক।
এই বিন্দু সম্পর্কেই আমি জানতে চাইছি, আসগর ফকির বললেন। এটি কি আসলেই সমস্ত রেখাকে উৎসমূলে ধরে টান দিতে পারবে?
কেন নয়? এটাই তো কাল নিয়ে মহাকালের খেলা। এর কেন্দ্রে যেটা ঘটে, সেখানে এমন একজন এসে দাঁড়ান, যখন তা আপনা থেকেই সব গ্রন্থি খুলে যায়। এরকম ঠিক সবসময় হয় না। আপনি দেখবেন, যখনই কোনো মহাপুরুষের আগমন ঘটেছে, যারা কালপর্বকে যুক্ত করেছেন মহাপরিবর্তনের সাপেক্ষে, তারা হয়ে উঠেছেন সেই কেন্দ্রবিন্দুর কর্তা। কালে কালে নানান জাতিতে ঘটেছে এমন ধারা। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটটি ভিন্ন। আজ পৃথিবী এতটাই ছোট হয়ে এসেছে, মানুষ এতকিছু জেনেছে, একে অন্যের প্রতি অনধিকার চর্চা এতটাই বেড়েছে যে, আজকের পরিবর্তনটি আর কেবল নির্দিষ্ট জাতির ভেতর সীমাবদ্ধ রইবে না, এটি হয়ে উঠবে সমগ্র পৃথিবীরই পরিবর্তন।
—আমরা কি এই পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে?
—দুয়ারটি খুললো বলে।
চলবে…
নির্বাণ গল্প-সাত ॥ আজহার ফরহাদ