পর্ব-১॥ ব্রাত্য বসুর নাটক: বোমা
কলকাতার নাট্যকার ব্রাত্য বসুর যে নাটকটি প্রথম দেখেছি সেটির নামই বিস্ফোরক ‘বোমা’। নাটকটি দেখার শুরু থেকেই মনে হয় নতুন কোনো নাট্যকারের জগতে প্রবেশ করেছি। আগে কোথাও এমন নাটক বোধহয় দেখি নাই। কেন এমন হয়? পরে ব্রাত্য বসুর অন্য নাটক দেখতে গিয়ে বুঝতে পারি এ নাট্যকার দর্শকের চোখে চোখ রাখতে জানেন। তিনি দূর থেকেও দর্শকের চোখের মণির ঘূর্ণি বোঝেন। ধারাবাহিক এ রচনায় তার অন্য নাটকের চমক নিয়ে লিখতে ইচ্ছা প্রকাশ করছি। প্রথমে তো ব্রাত্য বসুকে মনোজ মিত্রের মতো বয়সী ভেবেছিলাম, পরে দেখতে পাই তিনি এখনও আমার কাছাকাছি বয়সী, বড়জোর পাঁচ-ছয় বছরের বড় হবেন। এরমধ্যে তিনি সাফল্যের সাতমহলার অনেকগুলো দুয়ার পেরিয়ে গেছেন।
‘বোমা’ নাটকে লক্ষ করলাম তিনবার বিস্ফোরণ ঘটে। এর প্রথম বিস্ফোরণ হলো, আমরা যারা ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতি সম্পর্কে সামান্য ধারণা রাখি, তারা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী এবং পূর্ববঙ্গের বিনয়-বাদল-দিনেশ ও সূর্যসেনকে ইতিহাসের ভেতর থেকে আনা বিপ্লবী শিল্প ও সাহিত্যের চিরস্থায়ী নায়ক বলে মনে করি। বিশেষ করে পশ্চিমের ক্ষুদিরাম এবং পুবের সূর্যসেনকে। এই নাটকটি দেখার পরে বোঝা যায়, ঐ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের শেকড় ছিল অন্যত্র এবং আরও গভীরে। আর সেই গভীর শেকড়টি মঞ্চে এনে এর শাখা-প্রশাখাগুলো চিনিয়ে দিয়েছেন ব্রাত্য বসু।
দ্বিতীয় বিস্ফোরণ হলো, শ্রী অরবিন্দের মতো ভারতবিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধনাসিদ্ধ মহাপুরুষকে কত সহজে মঞ্চে এনে উপস্থিত করা হয়েছে। এখানে ভারতীয় মহাপুরুষদের সম্পর্কে ব্রাত্য বসুর পক্ষপাতিত্ব রয়েছে বলে অনুমান করি। গত বছর লকডাউনের সময় ‘কাপুরুষ-মহাপুরুষ’ সিনেমাটি দেখেছিলাম। সেখানে স্বামী বিবেকানন্দকে ইনসাল্ট বা কটাক্ষ করা হয়েছে বলে মনে হয়েছিল। ফেসবুকে ছোট একটি পোস্টে সে কথা প্রকাশও করেছিলাম। মন্তব্যে কেউ কেউ আমার সাথে একমত হয়েছেন। সেই সিনেমায় ব্রাত্য বসু নিজেও অভিনয় করেছিলেন, তবে তখনও তাঁকে চিনতাম না। বর্তমান আলোচ্য নাটকে শ্রী অরবিন্দকে যথেষ্ট মর্যাাদার সাথেই উপস্থিত করা হয়েছে।
যাই হোক, দ্বিতীয় বিস্ফোরণের কথা বললাম, এবার আসি তৃতীয় বিস্ফোরণের কথায়। তৃতীয় বিস্ফোরণ হলো উল্লাসকর দত্তের নির্দেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজে নিহত বিপ্লবী প্রফুল্লর বিধবা স্ত্রী কল্পনার মাধ্যমে সকল বিপ্লবীর নাম প্রকাশিত হয়ে যাওয়া এবং আলিপুর মামলার সকল আসামির গ্রেপ্তার। এ মামলায় অরবিন্দ ঘোষ ছাড়াও তাঁর ছোটভাই বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি প্রমুখ গ্রেপ্তার হন এবং অরবিন্দ বেকসুর খালাস পান কিন্তু অন্য অভিযুক্তদের সাজা হয়। ক্ষুদিরামের ফাঁসি এবং অপরদের দ্বীপান্তর। বিচার চলাকালে নরেন গোসাঁইকে কারাগারেই হত্যা করেন কানাইলাল আর সত্যেন। সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য পিস্তল সরবরাহ করেছিলেন প্রয়াত প্রফুল্লের স্ত্রী কল্পনা।
নাটকটি দেখার পরে শ্রী অরবিন্দ সম্পর্কে হাতের কাছে থাকা দুটি বই দ্রুত পড়ে নেই। ১। প্রমদারঞ্জন ঘোষের লেখা ‘বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের জীবনকথা ও জীবন দর্শন’ এবং ২। সম্পাদিত ‘শ্রী অরবিন্দ স্মৃতি’। বই দুটি পড়ার পরে নাটকের একটি প্রাসঙ্গিক অনিবার্য প্রশ্ন মনে জেগেছিল, সেটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি, পাই নাই। অরবিন্দ যখন বিচারে ছাড়া পান তখন সহবন্দিদের মধ্যে উল্লাসকর দত্ত চিৎকার করে তাকে বকাঝকা করেছিলেন। এ ঘটনা হয়তো ইতিহাসে নাই, কিন্তু যুক্তিতে না থেকে পারে না। যুক্তি থেকেই ব্রাত্য বসু হয়তো তুলে এনেছেন। ইতিহাসে এবং এ নাটকে অরবিন্দের মুক্তির ব্যাপারে আদালতে ওকালতি করেছেন চিত্তরঞ্জন দাশ; পরে যিনি ‘দেশবন্ধু’ বলে বিখ্যাত হয়েছেন। নাটকে চিত্তরঞ্জন দাশের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ব্রাত্য বসু নিজে। চরিত্রটি নাটকে গৌন বলে ব্রাত্য বসুর অভিনয় ভালোভাবে ফুটে ওঠে নাই।
সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক ছিলেন বলে এই ভ্রাতৃঘাতী রাজনীতি থেকে সরে গেছেন এবং কল্পনাকে সতর্ক করেছেন। তিনি ‘বদ্ধমূল’ শব্দটি বিশেষভাবে উচ্চারণ করে এর নানাবিধ সমস্যার কথা প্রকাশ করেছেন।
অরবিন্দ ঘোষ সম্পর্কে আরেকটি প্রশ্ন অনেকেরই মনে জাগে, তিনি বিবাহিত ছিলেন কিনা। তার দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে অনেকেরই কৌতূহল না থেকে পারে না। নাটকে তাদের পরিবারের তিনজনের উপস্থিতি আছে, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ এবং তাদের ছোটবোন সরোজিনী। তাহলে তাদের, বিশেষ করে অরবিন্দের বিবাহিত জীবন নিয়ে কোনো কথা নেই। এ নাটকে সে বিষয়ে নাট্যকার নীরব কেন? আলিপুর মামলা থেকে খালাস পাওয়ার পরে অরবিন্দ ঘোষ বাংলার বিপ্লবী রাজনীতি ছেড়ে, বাংলা দেশ ছেড়ে পণ্ডিচেরীতে চলে যান। সেখানকার আশ্রমে তিনি জীবনের বাকি অংশ কাটিয়েছেন। সেই জীবন ঋষি অরবিন্দের, বিপ্লবী অরবিন্দের নয়। নাট্যকার ব্রাত্য বসু সেই শ্রী অরবিন্দের ঋষি জীবনের একটা অংশ কল্পনারূপী পৌলমী বসুকে জানালা বানিয়ে উন্মোচন করেছেন। অনেক বছর পরে সেখানে কল্পনাকে পাঠিয়ে নাট্যকার অরবিন্দের বিশাল জীবনের একটা দিক উঁকি দিয়ে দেখিয়েছেন অরবিন্দ কেমন জীবন যাপন করছেন।
ধ্যানের চেয়ে তাকে লেখালেখিতে ব্যস্ত দেখিয়েছেন নাট্যকার। সেখানে গিয়ে কল্পনা একজন নারী হয়ে কেন অরবিন্দের স্ত্রী, সংসার, সন্তান ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলেন না? নাট্যকার কেন অরবিন্দের স্ত্রী মৃণালিনীর কথা নাটকে আনলেন না, এ প্রশ্নটি বারবার মনে জেগেছে। পরে বুঝলাম, নাটকটি তো অরবিন্দের জীবনীনাটক নয়। নাটকটির নাম যেহেতু ‘বোমা’, সেহেতু বোমার বিষয়টিই মঞ্চে মুখ্যস্থান লাভ করেছে। এ নাটকে অরবিন্দ একক নন, অন্যতম মাত্র।
নাটকটিতে অরবিন্দের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দেবশঙ্কর হালদার। নাটক দেখার সময় তার নাম জানতাম না। তিনি ভালো অভিনয় করেছেন। তবে চেহারার দিক থেকে শ্রী অরবিন্দের সাথে দেবশঙ্কর হালদারের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। অরবিন্দের যত ছবি দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, তাঁর মুখটা দেবশঙ্কর হালদারের মতো এত বড় ছিল না। চিত্রশিল্পীরা পোর্ট্রেট আঁকার সময় কতগুলো সহজ রেখায় একটা অবয়ব দিতে চেষ্টা করেন। এমন সহজরেখার কাজটি ব্রাত্য বসু অরবিন্দের তেলচুপচুপে মাথার চুলের সিঁথিকাটা দিয়ে করেছেন। চেহারার অমিলের চেয়ে চুলের মিলেই এখানে শ্রী অরবিন্দ ঘোষকে খুব সহজেই চিহ্নিত করেছেন নাট্য অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। এখানেই বোঝা যায়, নাটকে শুধু কাহিনি আর অভিনয়ই সবটা নয়, মেকআপও একটা বড় বিষয়। তাছাড়া শ্রী অরবিন্দের মতো বড় মাপের মানুষের বাণীও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। একারণেই হয়তো যথোপযুক্ত কণ্ঠের অধিকারী দেবশঙ্কর হালদারকে এ নাটকের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। দেবশঙ্করের ভরাট এবং ধীর কণ্ঠের মাধ্যমে দর্শকেরা সত্যিকার শ্রী অরবিন্দকে শ্রদ্ধা করবেন; সেভাবেই তিনি অভিনয় করে গেছেন।
আর এ নাটকের আরেকটি বড় এবং উল্লেখযোগ্য দিক হলো মঞ্চব্যবস্থাপনা। মঞ্চের ওপরে আরেকটি মঞ্চ বানিয়ে নিয়ে সেই মঞ্চের ভেতর দিয়ে আদালত, কারাগার, পণ্ডিচেরীর শ্রী অরবিন্দের আশ্রম, তার বাসভবন, লেখার ঘর ইত্যাদি দেখানো যেমন সুন্দর হয়েছে, তেমনি সেই মঞ্চের ওপরে পণ্ডিচেরীর সমুদ্রসৈকত প্রদর্শন করানোও যথাযোগ্য হয়েছে। নাটকে লাল আলোর সম্পাতও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারা নাটকেই লাল আলো বিপ্লবের আবহ সৃষ্টি করে রেখেছে। মঞ্চে বৃষ্টি এবং সেই বৃষ্টিতে ভেজানোর ব্যবস্থা একটা অসাধারণ বিষয়। মঞ্চে এসব অসাধ্যকেও সাধন করা হয়েছে।
এ নাটকে নেতিবাচক চরিত্রদের মধ্যে কলকাতার পুলিশ অফিসার চার্লস অগাস্টাস টেগার্ট সাহেবের ভূমিকায় সত্রাজিৎ খুব ভালো করেছেন। তার পোশাক এবং মেকআপও যথোপযুক্ত হয়েছে। তিনজন পুলিশ অফিসারের মধ্যে তার অভিনয় সবচেয়ে ভালো হয়েছে। তবে মুখে লাগানো মেকআপের প্রলেপ চোখে পড়ার মতো।
নাটকে আরও যেসব চরিত্র রয়েছে তাদের মধ্যে অরবিন্দের ছোট ভাই বারীন্দ্র ঘোষের চরিত্রের অভিনেতাও ভালো অভিনয় করেছেন। বারীন্দ্রের লঘুচিত্ততার মধ্য দিয়ে অরবিন্দের ‘তত্ত্বহীন উন্মার্গগামিতা’ কথাটি সার্থকতা লাভ করেছে। তবে বারীনের সঙ্গে অন্য চরিত্রদের দ্বন্দ্ব তাকে নাটকের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে সেজদা অরবিন্দ, উল্লাসকর, হেমচন্দ্র এমনকি তিনি বিধবা কল্পনার সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। নাটকটি আসলেই দ্বন্দ্বমুখর। নাটকটিতে অন্য অভিনেতারাও ভালো অভিনয় করেছেন। হেমচন্দ্র কানুনগো, উল্লাসকর দত্ত; এসব চরিত্র বেশ ফুটে উঠেছে স্ব-স্ব চরিত্রের অভিনেতাদের অভিনয়ে। তবে কল্পনাচরিত্রে পৌলমী বসুর অভিনয় বেশ আকর্ষণীয় হলেও কণ্ঠস্বরে আরও দৃঢ়তা থাকলে ভালো হতো বলে মনে করি।
নাটকটির নামকরণ নিয়ে কিছু না বললেই নয়। বোমা বলতে বারীন নিজেকেই বুঝিয়েছেন। যদিও তিনি রাজনীতির সাথে ধর্মকে মেশাতে চেয়েছেন বলে একাধিকবার বলা হয়েছে। তবে তাঁকে বিশ্বাস করতেন না কাছের মানুষ উল্লাসকর দত্ত। তিনি বারীনকে একজন মানুষ মনে করতেন না, মনে করতেন একটা প্রবণতা। বারীনকে কোনো বন্ধু এমনকি কোনো নারীও পছন্দ করতেন না, এতে বোঝা যায় উল্লাসকর দত্তের ধারণাটি মিথ্যা ছিল না। বারীন প্রেমের জন্য বিধবা কল্পনার হাতে ধরেন, শেষে পায়েও পড়ে থাকেন, কিন্তু এভাবে কি প্রেমিক হওয়া যায়? পারলেন না তিনি। অরবিন্দ ঘোষ বোমা বলতে তাঁর সময় থেকে উত্তরকালের এমনকি চিরকালের ভারতের অশান্তির বীজ মনে করেছেন। তিনি বোমার জাতীয় রূপ, সাম্প্রদায়িক রূপ, শ্রেণীগত রূপ, বর্ণগত, গোষ্ঠীগত নানারূপ অন্তর্দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছেন। সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক ছিলেন বলে এই ভ্রাতৃঘাতী রাজনীতি থেকে সরে গেছেন এবং কল্পনাকে সতর্ক করেছেন। তিনি ‘বদ্ধমূল’ শব্দটি বিশেষভাবে উচ্চারণ করে এর নানাবিধ সমস্যার কথা প্রকাশ করেছেন।
এটি নাটক, ইতিহাস নয়। শিল্প হিসাবেই এটিকে বিবেচনা করা সঙ্গত। ব্রাত্য বসু এ নাটকের বেতর দিয়ে আমাদের ঔপনিবেশিক যুগের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে বর্তমান কালের সমস্যা পর্যন্ত চিহ্নিত করেছেন। আগামী দিনের জন্যও সেটি বিশেষ ইশারা হয়ে থাকবে।
চলবে…
আরও পড়ুন: নির্বাচিত নবীনের কবিতা