০১.
ফুলেশ্বরী গ্রামটা অনেক আধুনিক। অধিকাংশ ঘরবাড়ি পাকা। রাস্তাঘাট পাকা। প্রায় সব বাড়িতেই বিএ পাস, এমএ পাস ছেলেমেয়ে। শিক্ষিত উন্নত একটা গ্রাম। পরিবেশ অনেক সুন্দর। ইছামতি নদীর কিনার ঘেঁষে দাঁড়ানো গ্রামটি একদম একটা ছবির মতো সুন্দর। স্কুল কলেজ সবধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এ গ্রামে। মুক্তচিন্তার মানুষের সংখ্যা বেশি এখানে। অলি মাহমুদ এই গ্রামের সম্মানিত একজন মানুষ। পাবনা শহরের কোলঘেঁষা ফুলেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মাঠভরা জমিও আছে তার। অর্থবিত্তেও এলাকায় ভালো একটা প্রভাব রাখেন তিনি। রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত। ফুলেশ্বরী গ্রামই শুধু নয়, ফুলেশ্বরী ইউনিয়ন যে দুই-চার জন লোকের কথায় উঠবস করে, অলি মাহমুদ তাদের অন্যতম একজন।
চন্দনা ফুলেশ্বরী হাইস্কুলে চাকরি নিয়ে অলি মাহমুদের বাড়িতে ওঠে। অলি মাহমুদ তার আপন খালু। অলি মাহমুদ নিজেই চেষ্টা করে ক্ষমতা খাটিয়ে তার চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। এখানে ক্ষমতা না খাটালে চাকরি হওয়া সম্ভব নয়। রাজনীতির প্রভাব লাগে। অর্থ লাগে। এলঅকার প্রভাব লাগে। সবকিছু মিলিয়েই একটা ব্যবস্থা হয়। অলি মাহমুদ চন্দনার চাকরির ক্ষেত্রে এ সবের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এর কারণও আছে। মেয়েটার বাবা নেই। অনেক আগেই মারা গেছেন। দুই বছর আগে খুন হয়েছে তার স্বামী। পাশের ইউনিয়নেই তার নিজের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি। পাশাপাশি গ্রামে। ওর স্বামীর নাম ফারুক। ছেলে হিসেবে সে ভালো ছিল। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িত ছিল। ছেলেটা দেখতে সুন্দর ছিল। চন্দনাও দশগ্রামের মধ্যে দেখার মতো একটা মেয়ে। তার রূপের প্রশংসা মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়। লেখাপড়াতেও মেধাবী। রূপে-গুণে ষোল আনাতে ষোল আনা। ফারুকের সঙ্গে এক সময় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফারুকেরও ছেলে হিসেবে প্রশংসা ছিল। পারিবারিক সম্মতিতে তারা বিয়েও করে। সুখের সংসার হয়ে উঠেছিল দুজনের।
ফারুক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দাঁড়ায়। চন্দনা বারণ করেছিল। শোনেনি। তার বিপক্ষে প্রার্থী হয় সন্ত্রাসী জাহিদ। ইউনিয়নের প্রায় পুরো মানুষ ফারুকের পক্ষে। জাহিদ বুঝে ফেলে এ অবস্থায় তার চেয়ারম্যান হওয়া সম্ভব নয়। জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হবে। সে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যদিও তারা দূর-সম্পর্কেও আত্মীয়। মামাত-ফুপাতো ভাই। ক্ষমতার দাপট আর স্বার্থের কাছে এ সব মূল্যহীন হয়ে গেলো। নির্বাচনি প্রচার শেষে গভীর রাতে ফেরার পথে ফারুক তার দুজন সঙ্গীসহ খুন হয়। চন্দনার জীবনের হিসাব পাল্টে যায়। এলাকার লোকজন তাকে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ানোর জন্য অনেক রকমের অনুরোধ করলেও সে নির্বাচনে দাঁড়াতে সম্মত হয় না।
ফারুকেরই বন্ধু তালেব চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়ায়। ব্যাপক ভোটে জয়লাভ করে। চন্দনা নতুন নতুন সমস্যায় পড়তে থাকে। নতুন চেয়ারম্যান তাকে সম্মান জানানোর ভাব করে বেশি বেশি খাতির জমানোর চেষ্টা করতে থাকে। ফারুক বেঁচে থাকতে তালেবকে সে যেভাবে চিনতো, এখনকার তালেবের সঙ্গে সেই আগের তালেবের কোনো মিল খুঁজে পায় না। তারপর আবার এখন চেয়ারম্যান। সবকিছুতে এতবেশি খোঁজখবর নেয়, এতবেশি দরদ দেখায়, চন্দনার কাছে তা অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ মনে হয়। কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলাও সমস্যা। এসব উপেক্ষা করলেও ঝামেলা তৈরি হবে চন্দনা তা বোঝে।
পড়ালেখার প্রতি তার এই আত্মনিমগ্নতা ভালো লাগে চন্দনার। ছোটবেলা সে নিজেও পড়ালেখায় এম আত্মনিমগ্ন ছিল। নিজের সঙ্গে পিনুর অনেক মিল খুঁজে পায় সে। যে কারণে দিনে দিনে পিনু যেন তার আত্মার অপরিহার্য মানুষ হয়ে ওঠে।
পরিবারেও সমস্যা। ফারুকের ছোট ভাই তারেক সেও চন্দনার প্রতি নানা খবরদারি নানা নিয়মকানুন শুরু করেছে। ফারুকের অবর্তমানে সেই যেন ফারুক হয়ে উঠেছে। অবিবাহিত যুবক। টগবগে যুবক। চন্দনার প্রতি তারও যে একটা অন্যরকম মনোবাসনা তৈরি হয়েছে, তা তার চাল-চলনেই দিন দিন ফুটে উঠতেছে।
এসব সমস্যার কথা মায়ের পরামর্শে চন্দনা বড় খালা রাহেলা বেগমকে জানায়। রাহেলা বেগম এসব শুনে সিদ্ধান্ত নেয় নিজের কাছে মেয়েটাকে নিয়ে এনে রাখবে। স্বামী অলি মাহমুদকে বলে তার বিদ্যালয়ে চন্দনার চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে খালার বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। এখানে সুন্দর পরিবেশে সম্মানের সঙ্গে নতুন একটা জীবন হয়ে ওঠে তার। তার খালু অলি মাহমুদের সম্মান ও প্রভাব চন্দনার জীবনকে এখানে অনেক সহজ ও সাবলীল করে দেয়। দিনে দিনে এলাকাতে চন্দনাও সমীহ অর্জন করতে থাকে। সুন্দর ব্যবহার, ভালো শিক্ষক, মায়াবী চেহারা, তারপর আবার অলি মাহমুদের ভাগ্নি; সব মিলিয়েই নিরাপদ নিশ্চিন্ত একটা জীবন পায় সে। ফারুকের মৃত্যুর পর যে যন্ত্রণাদগ্ধ বাজে জীবনের মুখে সে পড়েছিল, সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন জীবনের দিকে হাঁটা শুরু করে। এখানেও অনেকে তার রূপ আর গুণের প্রেমে পড়লেও তা প্রকাশের সাহস দেখায় না। সেটুকু চন্দনা বুঝতে পারে।
চন্দনার স্কুলের সময়ের বাইরে বাড়িতে অধিকাংশ সময় কাটে পিনুর সঙ্গে। পিনু ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। তার খালাতো ভাই। পিনুর বড় ভাই রানু। কুষ্টিয়া শহরে থাকে। বিয়ে করে সংসার করছে। কলেজে শিক্ষকতা করে। মাসে এক দুবার বাড়িতে আসে। কুষ্টিয়া শহর আর ফুলেশ্বরী গ্রাম বেশি দূরের নয়। আট নয় মাইলের দূরত্ব। রানু চন্দনার চেয়ে দু বছরের বড়। রাহেলা বেগমের অনেক ইচ্ছে ছিল চন্দনাকে রানুর বউ করে আনবে। কিন্তু মেয়েটা ফারুকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। অলি মাহমুদও চন্দনাকে খুব স্নেহ করেন। সেই ছোটবেলা থেকেই। রাহেলা বেগমের মতো ইচ্ছেটা তারও ছিল। কিন্তু সেটা ওভাবে কখনো প্রকাশ করেননি। রানু নিজেও সেটা বুঝতো। তারও ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রানুকে নিয়ে ও রকম কখনো ভাবেনি চন্দনা, চিন্তাও করেনি। ফারুকের সঙ্গে প্রেম ও বিয়েতেই সে ডুবে ছিল। রানু এখনো তাকে অনেক স্নেহ করে। আদর করে কথা বলে। ওর জন্য বিভিন্ন উপহার আনে। এ নিয়ে রানুর সংসারে নীরব সমস্যা হয়। রানুর বউ মীম তা পছন্দ করে না। চন্দনার সঙ্গে বেশি কথা বলাও তার পছন্দ নয়। চন্দনার রূপের প্রতি তার তো ঈর্ষা আছেই। সেকারণে মীম যতটা পারে নিজের স্বামীকে চন্দনার থেকে দূরে রাখে। চন্দনা বাড়িতে আসার পর থেকে রানুর ঘন ঘন বাড়িতে যাওয়ায় সে বাধা তৈরি করেছে। মীম নিজেও চন্দনার সঙ্গে নিজের থেকে কথা বলে না। কখনো কথা হলেও তাতে হেয়ালিপনা বেশি থাকে।
চন্দনা এসব বোঝে। কিন্তু তা মাথায় তোলে না। নিয়তিকে সে মানতে চায়। বিধবা হওয়ায় পৃথিবীর যে নতুন একটা রূপ সে দেখেছে, দেখছে। বিধবা না হলে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। তারপর যদি সেই বিধবা রূপবতী হয়, তাহলে তা যে আরও কত বিপজ্জনক, তা শুধু অনুভব করা যায়, প্রকাশ করা যায় না। রানু এলে তার বউ যে তাকে সবসময় চোখে চোখে রাখে, চন্দনা বুঝেও না বোঝার মতো করে থাকে। সবার সঙ্গে হাসিমুখে চলে, কথা বলে, আদর আপ্যায়ন করে। নিজের ভেতর শুধু একটা অপমানের বিষতীর নীরবে বিদ্ধ হতে থাকে। যার যন্ত্রণা একাকী সহ্য করে। গহীন রাতে চোখের পানিতে সেই বেদনা কথা কয়।
পিনুর পড়ালেখার প্রতি তার বেশ নজর আছে। কয়েক মাস পরে পরীক্ষা। তার খাবার-দাবারেও অনেক সচেতন চন্দনা। প্রতিদিন তার জন্য দুধ কলা ডিম খাবারের তালিকায় থাকবেই। কী পড়ছে না পড়ছে এসব নিয়েও আলোচনা করে। চন্দনা নিজেও খুব মেধাবী ছিল। সেন্টার ফার্স্ট হয়েছিল। পিনু নিজেও অনেক পছন্দ করে চন্দনাকে। পিনু একেবারেই চুপচাপ স্বভারের। কথা বলে খুব কম। বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে ওরকম মেশে না। খেলাধুলাও করে না। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর বই নিয়ে পড়ে থাকে। খাবারটা পর্যন্ত চেয়ে খায় না। খাবার তার ঘরে নিয়ে যেতে হয়। চন্দনা আসাতে পিনুকে নিয়ে রাহেলা বেগমকে আর ভাবতে হয় না। সব চন্দনা করে। পিনু দেখতেও সেই রকম সুন্দর। যেমন গায়ের রঙ, তেমনি গড়ন-গঠন। মাথাভর্তি চুল যেন দিব্যি একটা কালোমেঘ।
চন্দনার খুব পছন্দ ওর চেহারাটা; ওকেও। কী সুন্দর একটা ছেলে। যেমন চেহারা তেমনি মেধাবী; সবকিছুতে একশ তে একশ; এমন ছেলে লাখে একটাও হয় না। সারাক্ষণ ওকে ঘিরেই থাকতে ইচ্ছে করে চন্দনার। থাকেও। যদিও পিনু তা নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। সে পড়ালেখা নিয়ে একা একা ডুবে থাকে। পড়ালেখার প্রতি তার এই আত্মনিমগ্নতা ভালো লাগে চন্দনার। ছোটবেলা সে নিজেও পড়ালেখায় এম আত্মনিমগ্ন ছিল। নিজের সঙ্গে পিনুর অনেক মিল খুঁজে পায় সে। যে কারণে দিনে দিনে পিনু যেন তার আত্মার অপরিহার্য মানুষ হয়ে ওঠে। চন্দনার স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা চিন্তা-ভাবনা সবকিছুতে পিনু জুড়ে থাকে। পিনুকে ঘিরেই বাঁচার ছোট্ট একটা জগৎ গড়ে তুলেছে সে। পিনু হয়তো নিজেও তা জানে না।
চলবে…