প্রথম পর্বের পর:
চারজন সম্পাদকের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু সবচেয়ে বিনয়ী। আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যুক্তিপ্রবণ। হুমায়ুন আজাদ একরোখা। সম্পাদকদের চরিত্রের এই স্বাতন্ত্র্য অথবা সমন্বয়কে যদি আমরা একত্রিত করি, তাহলে আধুনিক কবিতার একটি সামগ্রিক চারিত্র্য দাঁড়িয়ে যায়, হয়তোবা।
আবু সয়ীদ আইয়ুব সময়ের দক্ষ পাঠক। তাইতো তিনি বলতে পারেন, ‘পঞ্চাশ বছর পূর্বের মহৎ তুচ্ছ হয়ে যায়, তুচ্ছ মহৎ। একই যুগেও রুচিবৈষম্য বড় কম নয়’। চাক্ষুষ বৈচিত্র্যের চেয়ে মর্মগত ঐক্যের প্রতি অধিকতর মনোযোগী হলে সেগুলোকে তিনটি শ্রেণীতে সাজানো যেতে পারে। আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে এই তিনটি জিনিস হলো, পারমার্থিক, সামাজিক ও সাশ্রয়ী।
এই তিনটি জিনিসকে ব্যাখ্যা করলেই তো তাঁদের আধুনিক কবিতার দর্শন এবং নির্বাচন পক্রিয়ার পদ্ধতি সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা হয়ে যায়। তিনি মর্মগত ঐক্যের এই সুতোটি দিয়ে আধুনিক কবিতার নকশিকাঁথা গড়তে গিয়ে বেছে নিয়েছেন পশ্চিমা মতবাদ। ফলে আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, আমাদের আধুনিকতা পশ্চিমা। এ কথা বলার অপেক্ষাও রাখে না যে, আমাদের প্রথম আধুনিকরা (জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, অমীয় চক্রবর্তী) সবাই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তাঁদের কবিতায় ইংরেজি সাহিত্যের যথেষ্ট উপদানের উপস্থিতি রয়েছে। কেউ নিয়েছেন সরাসরি, কেউ আড়াল করে নিয়েছেন, কেউ গোপনে নেওয়ার মতো করে নিয়েছেন, কেউ আত্মস্থ করেছেন, কেউ আত্মস্থ করে নিজের দেশের আবহাওয়া জলবায়ুর সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় উপস্থাপন করেছেন। ফলে পশ্চিমা উপাদানের উপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া আমাদের আধুনিকতার উন্মেষকে ব্যাখ্যা করার জন্য যদি হেগেলকে আমদানি করতে হয়, যদি কার্ল মার্ক্সকে ধার করতে হয়, যদি স্পেনসার, যদি ওডেন, যদি এলিয়ট চলে আসেন তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। যদিও বাংলা কবিতা ইংরেজি কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া শুরু হয়েছে আরও অনেক আগেই। মাইকেল মধুসূদন দত্তই তো ছিলেন এর প্রথম পথ প্রদর্শক।
এতসব যুক্তি তর্কের ভেতরে গিয়েও আবু সয়ীদ আইয়ুব রোম্যান্টিকের সাথে আধুনিকের, আধুনিকের সঙ্গে প্রতীকীদের, প্রতীকীদের সঙ্গে রোম্যান্টিকদের সম্পর্ক ও বিভেদ, বিভেদ ও বিভাজন তুলে এনেছেন। রোম্যান্টিকদের সঙ্গে প্রতীকীদের বৈষম্য প্রকট বলেই আধুনিকদের সঙ্গে রোম্যান্টিকদের দূরত্ব বেড়ে যায়। এই দূরত্ব হুমায়ুন আজাদ যত গভীরভাবে অনুভব করেছেন অন্যরা তা করেননি। ফলে হুমায়ুন আজাদ যতটা কঠোর ও নির্দয় ও নির্মোহ হতে পেরেছেন অন্যরা তার ধারে কাছেও যেতে পারেননি। ফলে রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা গ্রহণ করেছেন বিপুল আগ্রহে। তাদের রুচির ভিন্নতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ প্রশ্নে তারা একমত ও নতজানু হয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ সেখানে বহুরৈখিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও সীমাবদ্ধতা। এবং শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথকে আধুনিক হিসেবে স্বীকারই করেননি। আবু সয়ীদ আইয়ুব যুক্তির কাছে নত হয়েছেন, ‘নতুন কবিরা যদি নতুন করে প্রেমের কবিতা না লেখেন তা হলে আমাদের একালের মনের কথা যে মনেই থেকে যায়, প্রকাশের আনন্দ পায় কেমন করে?’ এই কথার পরে বলা যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব আধুনিকতার সঙ্গে রোম্যান্টিকতার একটা আপস-রফা চেয়েছিলেন। সেটা তার জন্য একটু রক্ষাকবচ হয়েছিল বৈকি। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথকে অন্তুর্ভুক্ত করা কিংবা মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম কিংবা জসীম উদদীনসহ আরও অনেককে অন্তর্ভুক্ত করাটা জায়েজ করতে পেরেছিলেন।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, ‘বিশ্বের যে আদিম উর্বরতার কল্যাণে গাছ একদিন বাড়ার আনন্দেই আকাশের দিকে হাত বাড়াতো, সে উর্বরতা আজ আর নেই, সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে কাব্যের কল্পতরু আর জন্মায় না।’ অশ্রুকুমার শিকদার যে-বিষয়টিকে দেখেছিলেন বাংলা কবিতায় আন্তর্জাতিকতা ঢুকে পড়া হিসেবে। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আক্ষরিক অর্থেই সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই আপ্তবাক্যকে মেনে নিলেন। ফলে তার বিচক্ষণ চোখ ঠিকই খুঁজে পেল আধুনিক কবিতার দুরূহতার পশ্চিমী প্রতিরূপ। ‘…আর পশ্চিমেরই মতো তার আবহাওয়াতে আছে শূন্যতার অবসাদের ভাব—সবই যেন অনিশ্চিত, সবই নিরর্থক, আশা আর ছলনায় প্রভেদ নেই, উদ্যম অহমিকারই রূপান্তর। আধুনিক কবিতায় আছে একদিকে ছন্দের যন্ত্রকৌশল বর্জন, অন্যদিকে ছন্দের বৈচিত্র্য নিয়ে দুঃসাহসী পরীক্ষা।’
এ সব সমন্বয়ের ফলে বা সমাবেশের কারণে আধুনিক কবিতা হয়ে উঠল জটিল, বোধগম্যতা থেকে সরে যেতে থাকল ধীরে ধীরে। হুমায়ুন আজাদ এ বিষয়টিকে সাধুবাদ জানালেও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় দায়ী করছেন অন্য জিনিসকে। তিনি দোষ দিচ্ছেন ‘আধুনিক মনের অপ্রকৃতিস্থ জটিলতা’কে। হুমায়ুন আজাদ এই পরিবর্তনকে যুগান্তকারী বলছেন। বলেছেন, ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা এক আন্তর্জাতিক প্রপঞ্চের বঙ্গীয় রূপ।’ যদিও এই নতুনত্ব বাঙলা কবিতার পাঠককে মোটেও আকৃষ্ট করেনি। এই নতুনত্ব বাঙলা কবিতার পাঠককে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এই নতুনত্বকে গ্রহণের অনীহার জন্য তিনি দায়ী করছেন ‘বাঙালি সুলভ কুণ্ঠা’কে, সন্দেহ পোষণের প্রবণতাকে, আমাদের প্রথাগত চিন্তাকে, অতীতের তুচ্ছ বিষয়কে অতিশায়িত করে প্রদর্শনের হুজুগকে।
ফলে বাংলা কবিতার পাঠক যেমন বাড়েনি, তেমনি আধুনিক কবিরাও বাংলা কবিতার পাঠক বৃদ্ধির জন্য পেছনের দিকে ফেরেননি। এতে আধুনিক কবিতা আরও আধুনিক ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, সাধারণ পাঠকরা হয়ে উঠেছেন সন্ত্রস্ত। তাতে শিল্পর কোনো ক্ষতি হয়নি। কবিরা হয়ে উঠেছেন আরও প্রতিশ্রুতিশীল। এই প্রতিশ্রুতিশীলতাকে হুমায়ুন আজাদ অভিনন্দিত করেছেন বিপুল আগ্রহে। শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মহৎ কবিদের তালিকা (পনের জন) করতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন আধুনিক কবিদের সংখ্যাই পাঁচ। অর্থাৎ সমগ্র সাহিত্যের ইতিহাসে মোট পনেরজন মহৎ কবির মধ্যে কালের দিক থেকে শুরু হওয়া সদ্য আধুনিক কবিদের সংখ্যাই আনুপাতিক হিসেবে অনেক বেশি। হুমায়ুন আজাদ বিষয়টিকে গর্বের বিষয় হিসেবে দেখেছেন। আর বাংলা কবিতার পাঠক কমে যাওয়াকে তিনি গুরুত্বই দেননি। বাঙালিদের বাঙালিসুলভ সংস্কৃতিকে তিনি দায়ী করেছেন।
আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আধুনিকের উপাদান হিসেবে কতকগুলো লক্ষণকে স্থির করে নিয়েছিলেন, নিরিখ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। যেমন, সামাজিক বিষয়, বিতর্ক, ব্যঙ্গ, মননধর্মিতা, নতুনতর ভবিষ্যতের দিকে উন্মুখতা ইত্যাদি। কবিতা যাচাই ও বাছাইয়ের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব মানদণ্ডই ছিলো প্রধান মাধ্যম। বুদ্ধদেব বসুর আক্ষেপ ছিল এখানে। তিনি বিচলিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, বাংলা কবিতার গীতিধর্মিতা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, চিত্রকল্পপ্রধান কবিতা গৌন হয়ে যাচ্ছে, আবেগপ্রধান কবিতা উপযুক্ত মর্যাদা পাচ্ছে না। এই আক্ষেপগুলোকেও বুদ্ধদেব আক্ষেপে রাখলেন না। করে তুললেন আধুনিক কাব্যের আরেক মানদণ্ড। ফলে তার কাছে আধুনিকতা হয়ে উঠল এই উভয়বিধ লক্ষণকে ধারণ করার শিল্প । তাতে তাঁর ‘আনন্দ অবারিত।’
রাখঢাকহীন, অবিনয়ী, নির্মম
বুদ্ধদেব বসুকে শুধু বিনয়ী বা আবেগী না বলে উদারও বলা যেতে পারে। তিনি সাহিত্যকে যেকোনো নির্দিষ্ট ফর্মের ভেতরে আটকে রাখতে পক্ষপাতী নন। কোনো ফর্মুলার ভেতরে বাঁধতে গেলে ‘বোধের বিকৃতি’ অনীবার্য হয়ে যায়। ফলে তার পক্ষেই বলা সম্ভব, ‘গত পঁচিশ বা ত্রিশ বছরের বাংলা কবিতার মোটামুটি পরিচয় থাকলো এখানে।’ তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব হয়ে ওঠে, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা যেন সবিস্ময়ে এই কথাটা উপলব্ধি করি যে ঐক্যের মধ্যেও বিপরীতের স্থান আছে, বিরোধের মধ্যেও সংহতির সম্ভাবনা।’ এ রকম উদারতার কিছু খারাপ দিকও আছে। তা হলো তাতে যে কেউই ওই সম্ভাবনার ভেতরে শনাক্ত ও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারেন। আর সংকলনের অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে ‘গত পঁচিশ বা ত্রিশ বছরের বাংলা কবিতার মোটামুটি পরিচয়’ দেওয়াটাকে একটা বড় দূর্বল উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কারণ আধুনিক কবিতা এমন এক প্রপঞ্চ যেখানে হাজার বছরের পথ পরিক্রমান্তে কতকগুলো লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্যের অংশীদারী হয়ে তার বিগত মহাকাল থেকে পৃথক হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা। সেখানে কয়েক বছরের মোটামুটি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মানস কখনোই দূরদর্শী চিন্তার প্রকাশ হতে পারে না। হুমায়ুন আজাদ এক্ষেত্রে সোজাসাপ্টা, রাখঢাকহীন, অবিনয়ী, নির্মম। যেখানে তার বিবেচনার নিরিখ এতই ক্ষুরধার যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মহীরুহ কিংবা বুদ্ধদেব বসুর মতো প্রতিভাবানেররাও রেহায় পান না।
বুদ্ধদেব বসু ‘গত পঁচিশ ত্রিশ বছরের বাংলা কবিতার মোটামুটি পরিচয়’ এমনভাবে দিয়েছেন যে, কতকক্ষেত্রে প্রবল হাস্যরসে পর্যবসিত হয়েছে। যেমন তাঁর কৃত সংকলনে বিস্ময়করভাবে কয়েকটি ছড়া উপস্থিত। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সম্পাদকের সঙ্গেও তাঁর মতের মিল কিভাবে যে হয়ে গেল! দুটি সংকলনেই দেখা যাচ্ছে সুকুমার রায়ের পাঁচটি করে ছড়া স্থান পেয়েছে। ছড়াগুলো হলো ‘শব্দকল্পদ্রুম’, ‘রামগরুড়ের ছানা’, ‘হুলোর গান’, ‘শুনেছো কি বলে গেলো’ এবং ‘আবোল তাবোল’। আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলনে ছড়ার স্থান পাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। আধুনিকের লক্ষণ ও রুচিকে প্রাধান্য দিয়ে যেখানে নির্দিষ্ট হচ্ছে কবিতা, সেখানে উভয় সংকলেনই একই ছড়া স্থান পেয়ে গেল! এত যে রুচির স্বাতন্ত্রর কথা বলি, এত যে নির্ধারণের নিরিখ নিরিখ করি সে-গুলো যে কোথায় গেল! সুকুমার রায়ের ননসেন্স ভার্সের এই ছড়াগুলি ছড়ার নিরিখে মানোত্তীর্ণ এবং জনপ্রিয়। কিন্তু আধুনিক কবিতার মানদণ্ড তা কোনোভাবেই উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তবু, আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলনে তিনি স্থান পেয়ে গেলেন। এবং প্রথম তিন সম্পাদক এক সুমহান মতৈক্যে পৌঁছলেন।ৎ
শিল্পের জন্য শিল্প হলেই সব দায় শোধ হয় না
হুমায়ুন আজাদ এক্ষেত্রে সুকঠোর, নির্মম। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেওয়ার সাহস দেখান। তিনি নজরুলকে আধুনিক-অনাধুনিক কোনো হিসেবেই উল্লেখ না করার, উপেক্ষা করার স্পর্ধা (আসলে ধৃষ্টতা দেখান) রাখেন। আধুনিক কাব্যের বিচারে উত্তীর্ণ হলেও তিনি পাঁচ পাঁচজন কবিকে বাদ দিয়েছেন। কারণ আধুনিক কবিতার মানদণ্ড হিসেবে তিনি মানবতাবাদ এবং প্রগতিশীলতাকেও মান্য করেন। এর ব্যত্যয় যাদের ভেতর তিনি ঘটতে দেখেছেন তাঁদের তিনি স্বীকার করেও বাদ দিয়েছেন। বিষয়টিকে তিনি দেখছেন ‘আমাদের সময়ের শোচনীয় দুর্ভাগ্য’ হিসেবে। তিনি ঘোষণা দিয়ে বাদ দিয়েছেন যাদের তাঁরা হলেন, সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আবদুল মান্নান সৈয়দকে। ব্যাখ্যা দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ, ‘নিই নি, আমি নিতে পারি না, কেননা তাঁরা সামরিক একনায়কত্ব ও মৌলবাদে দীক্ষা গ্রহণ করে মানুষ ও কবিতা ও আধুনিকতার বিপক্ষে চলে গেছেন।’ দেখা যাচ্ছে শুধু শিল্পের জন্য শিল্প হলেই সব দায় শোধ হয় না মানবতার। তাকে মানবিক হতে হয়। শিল্পের দায় শোধ করে মৌলবাদে দীক্ষা গ্রহণ করলেও মানুষ সরে যায় মানবতা থেকে। সামরিক একনায়কতন্ত্র তো আরও জঘন্য। হুমায়ূন আজাদই প্রথম, যিনি আধুনিকতার চারিত্র্য লক্ষণ হিসেবে মৌলবাদ ও সামরিক একনায়কতন্ত্রের দীক্ষাকে আধুনিকতাবিরোধী হিসেবে উল্লেখ করলেন। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে প্রয়োগও করলেন।
আধুনিক বাংলা কবিতার সংকলন করতে গিয়ে স্বভাবতই হুমায়ুন আজাদ অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করবেন। পূর্বে এ রকম সংকলন হয়ে থাকলে সেটাকে খুবই গুরুত্বসহ বিবেচনা করবেন। হুমায়ুন আজাদের সংকলনের ভূমিকায় বিষয়টির উল্লেখও আছে। কিন্তু তিনি শুধু বুদ্ধদেব বসুকেই স্বীকার করলেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সংকলনটিকে স্বীকার করা দূরে থাক উল্লেখও করলেন না। ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন, ‘আধুনিক কবিতা সংকলনের সম্পাদকেরাও পরিচয় দিয়ে থাকেন দ্বিধা ও ভীরুতার; অনাধুনিক প্রথাগত কবিতাও তাঁরা নেন আধুনিক কবিতার সংগ্রহে, সৃষ্টি করেন বিভ্রান্তি; আধুনিক কবিতা যে একটি স্বতন্ত্র কবিতাধারা, তা বুঝতে দেন না পাঠকদের; যেমন বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৫৪) যেটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সংকলন আধুনিক বাংলা কবিতার। এটি আধুনিক কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছে পাঠকদের কাছে, আবার কাজ করেছে আধুনিক কবিতার বিরুদ্ধেও। এটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে, যা এক বড়ো বিভ্রান্তি, রবীন্দ্রনাথ মহৎ কবি সন্দেহ নেই, আর এতেও সন্দেহ নেই যে তিনি আধুনিক নন, রোম্যান্টিক। তাই স্থান পেতে পারেন না আধুনিক বাংলা কবিতার সংগ্রহে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এ সংকলনে আছে প্রমথ চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদদ্দীনের মতো , যাঁরা আধুনিক নন যদিও কবিতা লিখেছেন বিশশতকে;—সংকলনটিতে পাঠক নানারকম কবিতা পাঠের সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু আধুনিক কবিতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাননি। এ সংকলনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ও নানা অনাধুনিকের উপস্থিতি আধুনিক কবিতাকে স্বাধীন স্বতন্ত্র ধারার কবিতারূপে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি; পাঠকেরা বুঝে উঠতে পারেননি আধুনিক কবিতার মহিমা। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, জসীমউদ্দীন যদি আধুনিক হন একই সাথে, তাহলে আধুনিকতা হয়ে ওঠে হাস্যকর ব্যাপার, যদিও আধুনিক কবিতা এমন কোনো কৌতুককর খিচুড়ি নয়।’
চলবে…
কবিতার সংকলন: শিল্প থেকে দশকিয়া রাজনীতি: পর্ব-১ ॥ এমরান কবির