দ্বিতীয় পর্বের পর
হুমায়ুন আজাদ কথিত ‘কৌতুককর খিচুড়ি’র যথেষ্ট উপাদান পাওয়া যাবে ‘আধুনিক বাঙলা কবিতা’র প্রথম দুই সংকলনে। এক্ষেত্রে রসজ্ঞ সমালোচক আবু সয়ীদ আউয়ুব, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা কবি-সমালোচক-সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু- কেউই কারও থেকে কম যান না। বুদ্ধদেব বসুর সংকলনটির প্রবল জনপ্রিয়তা প্রকাশকদের স্বস্তি দিয়েছে। তারা বারবার সম্পাদককে নতুন সংস্করণের জন্য তাগাদা দিয়েছেন। নিয়মিত বিরতি দিয়ে বের হয়েছে নতুন নতুন সংস্করণ। আর সময়ের তালে তালে তিনিও হয়ে উঠেছেন সমঝোতাকামী, পক্ষপাতদুষ্ট, সময়ের নিবিড়পাঠে ব্যর্থ-বৃদ্ধ। হয়ে উঠেছেন ‘কৌতুককর খিচুড়ি’উৎপাদকের সার্থক পাচক।
বুদ্ধদেব বসু কথিত ‘প্রতিভাবান বালক’কাজী নজরুল ইসলাম-এর কয়েকটি কবিতা স্থান পেয়েছে সংকলনে। একজন ‘প্রতিভাবান বালক’ তো বড়জোর সামান্য কিছু বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেমি করতে পারে। তার বেশি কিছু নয়। তাহলে আধুনিক কবিতার মানদণ্ডে তার ছেলেমি স্থান পায় কী করে। তবুও কাজী নজরুল ইসলামের চারটি কবিতা স্থান পেতে দেখা যায় চতুর্থ সংস্করণ থেকে। প্রথম থেকে যে পাঁচটি কবিতা সংকলনভুক্ত হয়েছিল চতুর্থ সংস্করণের বেলায় তার চারটি কবিতায়ই বাদ দিতে হয়েছে কপিরাইট সংক্রান্ত জটিলতায়। তিনি সমাধানেরও উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু স্বত্বাধিকারী কিংবা তাদের প্রতিনিধিদের নীরবতার জন্য মাত্র কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করেই তিনি অন্য কবিতা নিয়ে সংকলন বের করে ফেললেন। মাত্র কয়েক সপ্তাহের অপেক্ষায়ই তিনি ধৈর্যহারা হয়ে গেলেন! এবং অন্য কবিতা নিয়ে সংকলন বের করাটাকেই অধিকতর যুক্তিযুক্ত হিসেবে মনে করলেন। বিষয়টিকে বুদ্ধদেব বসুর কর্মপ্রয়াসটির অপূর্ণতা হিসেবে দেখলেও খুব খারাপভাবে দেখা হয় না। এখানে দায়বোধের অভাবও ছিল প্রকট। নতুন একটি যুগ-লক্ষণের স্মারকে নিছক স্বত্ব-জটিলতার কারণে চার চারটি কবিতা বাদ দিয়ে অন্য কবিতা নেওয়াকে মেনে নেওয়া যায়? নিশ্চয়ই নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক বিবেচনা প্রয়োগ করার পরই তিনি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাগুলো নিয়েছিলেন। প্রথম তিন সংস্করণে তা বহালও রেখেছিলেন। তার মানে চিন্তার বিবর্তনে তিনি তখনো ওই কবিতাগুলোকেই আধুনিক কবিতা মনে করতেন। শ্রেষ্ঠও মনে করতেন। পরবর্তী সময়ে অন্য কবিতা নেওয়ায় নিশ্চয়ই নজরুলের দুর্বল প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা নেওয়া হয়েছে। এ রকম একটি বড় কাজে এ ধরনের দুর্বলতা সংকলনের অসম্পূর্ণতাকেই প্রকট করে তোলে।
বুদ্ধদেব বসুর সংকলনের প্রথম সংস্করণে ৪৯ জন কবির একশত ছিয়াত্তরটি কবিতা ছিল। দ্বিতীয় সংস্করণে ছয়জন কবি সংযোজিত হলেন। কবিতার সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ালো একশত ছিয়ানব্বইয়ে। তৃতীয় সংস্করণ বের হয় ১৯৫৯ সালে। এবার আরও দুজন নতুন কবি অন্তর্ভুক্ত হন। চতুর্থ সংস্করণ বের হয় ১৯৬৩ সালে। এবার কবির সংখ্যার পরিবর্তে কবিতার সংখ্যা বাড়ানো হয়। যাদের কবিতার সংখ্যা বাড়ানো হলো, তাঁরা হলেন, মোহিতলাল মজুমদার, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। পঞ্চম ও শেষ সংস্করণ বের হয় একটু দেরিতে। ১৯৭৩ সালে। এ সংস্করণে দশজন নতুন কবি যুক্ত হন। তাঁরা হলেন, সন্তোষকুমার ঘোষ, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, আলোক সরকার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, তারাপদ রায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। আগে অন্তুর্ভুক্ত কবিদের মধ্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কবিতার সংখ্যা বাড়ানো হয়। দেখা যাচ্ছে পঞ্চম এবং শেষ সংস্করণে সংস্করণে উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক কবিদের অন্তর্ভুক্তি যেমন হয়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে ইতোপূর্বে অন্তর্ভুক্ত কবিদের কবিতার সংখ্যাও।
সর্বশেষ সংস্করণ পর্যন্ত কবিদের অর্ন্তভুক্তি এবং কবিতার সংখ্যা বৃদ্ধি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে বৈকি। নতুন নতুন কবির অন্তর্ভুক্তি যেমন বুদ্ধদেব বসুর নিরন্তর নবায়নের ইঙ্গিত দেয়, তেমনি আধুনিক কবিতার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখা কবিরাও স্বীকৃতি পেয়ে যান। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর নির্বাচন বড়ই একপেশে। কারণ সর্বশেষ সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত কবিদের সমসাময়িক কবি, যারা পূর্ববঙ্গে অবস্থান করে কবিতা চর্চা করছিলেন তাঁদের কাউকেই এখানে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখি না। প্রশ্ন উঠতে পারে তিনি তাঁদের কাব্যচর্চা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন কি-না। এর একটা মোক্ষম ও চূড়ান্ত উত্তর হতে পারে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’পত্রিকার এক একটি সংখ্যা। যেখানে চল্লিশের আবুল হোসেন-এর কবিতা যেমন ছাপা হয়েছে, তেমনি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ প্রমুখের কবিতাও নিয়মিত ছাপা হয়েছে ।
এ ধরনের দুর্বলতা সংকলনের অসম্পূর্ণতাকেই প্রকট করে তোলে
সর্বশেষ সংস্করণে দশজনের মতো নতুন কবি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। অথচ একই সময়ে দীপ্যমান আলোকসঞ্চারী এক ঝাঁক কবি যারা আধুনিকতার সব দাবি পূরণ করে বাংলা কবিতায় আলো ছড়াচ্ছেন, বুদ্ধদেব বসু তাঁদের আমলেই নিলেন না। যেমন, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল গণি হাজারী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী প্রমুখ।
বাংলা কেবল পশ্চিমবঙ্গের চর্চার ক্ষেত্র নয়। বুদ্ধদেব বসু খুব ভালো করেই জানতেন পূর্ববঙ্গের কবিতা চর্চার বিষয়টি। তবু, তিনি এড়িয়ে গিয়ে মহাকালের পৃষ্ঠায় নিজেকে সংকীর্ণ প্রমাণ করলেন। ফলে আধুনিক কবিতার প্রথম জনপ্রিয় এবং বোদ্ধা মহলে গৃহীত সংকলনটি অসম্পূর্ণতার দোষে দুষ্ট হলো। আজ তো বড়ই পরিহাসের বিষয় বাংলা কবিতার চর্চার প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠছে সাবেক পূর্ববাংলা। বুদ্ধদেব বসুর একপেশে বৃদ্ধ চোখ এরকম অদূরদর্শী ছিল। আজ মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে, উত্তরকালে, দেখা যায় বুদ্ধদেব বসুর স্বীকৃতি এবং অনুমান কতটাই অদূরদর্শী।
বাংলা ভাগ নিয়ে এত যে মায়াকান্না, ইতিহাসের ভুল বিচার, সময়ের ব্যর্থ কান্না, ভগ্ন বাংলার জন্য এত দরদ, ভূ-গোলের তারকাঁটাকে এত অভিষাপ দেই আর কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও চর্চার একাত্মতার জন্য পুলক অনুভব করি, তার ফল এরকম খণ্ডিত কেন? ইতিহাস বাংলাকে ভাগ করেছে, ঠিক আছে, ভূ-গোল তারকাঁটা বিঁধে দিয়েছে, সেটাও ঠিক আছে, আমরা যে বুক চাপড়ে বলি বাংলার আত্মাকে ভাগ করা যায়নি। সেই অখণ্ড আত্মার নমুনা এরকম একপেশে কেন? ইতিহাসের নির্মমতা এবং মোড়ল-পণ্ডিতদের নিম্ন চোখে তাকানো থেকে বর্তমান বাংলাদেশ, সাবেক পূর্ববাংলা এখনো মুক্ত হয়নি। তবে সুখের কথা হলো বাংলার মূল কেন্দ্র ঢাকা হওয়াতে কলকাতাকেন্দ্রিক কোনো সামগ্রিক কাজ বাংলাদেশকে উপেক্ষা করে করা তাদের জন্য এখন দুষ্কর। বরং আমরাই এখন যেকোনো সংকলনের প্রতিনিধিত্ব করি। এবং ওপার বাংলাকে সংযুক্ত করে সাহিত্যের সত্যিকার দায় শোধ করি, ন্যায় বিচারও করি, খণ্ডিত হওয়ার অভিযোগ থেকে মুক্ত করি বর্তমানকে এবং ভবিষ্যৎকেও।
বুদ্ধদেব বসুর সংকলনের চতুর্থ সংস্করণে ছয়জন কবির কবিতা সংখ্যা বাড়ানো হয় যার মধ্যে দু’জন ছিলেন তার একান্ত সহকারী। বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতা সংকলনের কাজে যারা একান্ত সহযোগিতা করেছেন। প্রথম সংস্করণে যিনি অবিরল সহযোগিতা করেছেন তিনি হলেন অরুণকুমার সরকার আর দ্বিতীয় সংস্করণে নরেশ গুহ। চতুর্থ সংস্করণে এসে তাঁদের কবিতার সংখ্যা বাড়ানো হয়।
তাদের কাজটা একটু বেশিমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ ছিল
আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সংকলনে নেওয়া হয়েছিল পঁয়ত্রিশ জন কবির একশত নয়টি কবিতা। তাদের জীবিতাবস্থায় কয়েকটি সংস্করণ বেরিয়েছে। তাঁরা কবি ও কবিতার সংখ্যার ক্ষেত্রে কোনো সংযোজন বিয়োজনে যাননি। বুদ্ধদেব বসুকৃত সংকলনের সর্বশেষ সংস্করণে সাতষট্টিজন কবির দুইশত সাতচল্লিশটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রথম সংস্করণ থেকেই তিনি সংযোজনে ব্রতী হয়েছেন। সংযোজন ঘটেছে কবিতার সংখ্যায় এবং কবিতে। সর্বশেষ সংস্করণে তিনি দশজন নতুন কবির অনেকগুলো নতুন কবিতা সংযোজন করেছেন। হুমায়ুন আজাদের কবির সংখ্যা চুয়াল্লিশ। কবিতার সংখ্যা দুইশত আটাশটি। প্রথম প্রকাশের পর তিনি এক দশকেরও বেশি সময় বেঁচে ছিলেন। এর ভেতরে একাধিকবার মুদ্রিত হয়েছে সংকলনটি। তিনি কোনো সংযোজন বিয়োজনে যাননি।
আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সামনে কোনো মডেল ছিল না আধুনিক বাংলা কবিতার। সে-কারণে তাদের কাজটা একটু বেশিমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ, কারণ-লক্ষণ শনাক্ত করা থেকে শুরু করে তাদের চিন্তার অকাট্যতাসহ কবিতা নির্বাচনে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম ছিল। কারণ তার সামনে একটি নমুনা ছিল। ফলে সেই সংকলনভুক্ত কবি ও কবিতাকে গ্রহণে তার যেমন আপত্তি ছিল না, তেমনি তার নিজস্ব বক্তব্যকে জোরালো করার জন্য আগের দুজন রসজ্ঞ সমালোচকের বক্তব্যকে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন। বরং বাদ পড়াদের অন্তর্ভুক্তকরণ এবং চিন্তার পরিণত রূপ প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছেন । ফলে দেখা যায় প্রথম সংকলনের প্রায় সবাই (দুই জন কবি বাদে, তাঁরা হলেন নীরেন্দ্রনাথ রায় এবং সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী) তাঁর সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রের উভয় সংকলনে বড়ই সাদৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়।।
এবার দেখা যেতে পারে, মাত্র চৌদ্দ বছরের ব্যবধানে আধুনিক কবিতার প্রথম সংকলন থেকে বাদ পড়ে যাওয়া দু’জন কবির কবিতা কেমন ছিল।
আজ বিকালে হঠাৎ দুপেয়ালা চা খাওয়া ঘটে গেল
যদিও নিয়মিত চা খাওয়া আমার অভ্যাস নয়।
ফলে যা হোল এই যে রাত্রে কিছুতেই ঘুম এল না।
ঘন্টার পর ঘণ্টা একে একে বেড়ে যাচ্ছে,
ক্লান্ত হয়ে আসছে পরিচিত পৃথিবীর কলরব,
বরফওলার ডাক পাহারওলার হাঁক বাস-এর মেরামত;
গাড়ি মোটরের বিপরীতে, পথ এলিয়ে আছে নিশ্চিন্ত আরামে।
শুধু ঝিল্লীর ডাকের বিরাম নেই,
সে-ডাকও এত মৃদু ও এমন অবিচ্ছিন্ন যেন নৈঃশব্দ্যের প্রতিধ্বনি।
মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা যেদিন পাহাড়ি দেশে বেড়াতে গিয়ে
দলছাড়া হয়ে তোমাতে-আমাতে বনের মধ্যে গিয়ে পড়ি,
গভীর ঘন বন যেন সূক্ষ্ম একটি পায়ে-চলা রেখা ছাড়া পথ নেই,
যার গাছে গাছে লাগালাগি, পাতায় পাতায় ঠাসবুনানি হয়ে
আকাশ পড়েছে ঢাকা, দিন হয়েছে স্নানাভ রাত্রি,
আর অসংখ্য ঝিল্লীর অশ্রান্ত ক্রন্দনে যেখানে আদিম
পৃথিবীর প্রথমতম সঙ্গীত আজও ধ্বনিত হচ্ছে
মানুষের সমস্ত মুখর ভাষণকে স্তম্ভিত করে।
(ঝিল্লীস্বর, অংশবিশেষ, নীরেন্দ্রনাথ রায়)মৃত্তিকার নীড় ত্যজি সমুদ্র ও আকাশের দুরন্ত মায়ায়
সুদূরের আকর্ষণে সুরু হলো প্রতীচীর যন্ত্র অভিযান
অবাধ বাণিজ্যছলে বিশ্বব্যাপ্ত কল্যাণী লক্ষীরে
আসুরিক মন্ত্রবলে দ্বীপগৃহে বন্ধন-আশায়;
সেই যুগে,
মহাদেশদেশান্তরে পণ্যবীথিকার
সুবিস্তৃত দীর্ঘছায়াতলে,
লুণ্ঠিত কাঞ্চনস্তূপ অন্তরাল অন্ধকারে
সন্তর্পণে রূপ নিল সর্ব্ব-অগোচরে,
মানবের মস্তিষ্কের তন্তুজালমাঝে অর্থক্রিয়া বৃদ্ধির বিজ্ঞান;
সেই হতে সরস্বতী অলক্ষীর দাসীবৃত্তি করে চিরদিন।
জাগ্রত চেতনাস্তরে অনুক্ষণ কর্ম্ম ও চিন্তায়
সর্বংসহা বসু অচল অটল,
তারে এরা দিতে চায় উড়াইয়া
আত্মতত্ত্ব, মায়াবাদ,
বিশ্বপ্রেম, মানবতা, পরামুক্তি ধূপের ধোঁয়ায়।
উদ্দেশ্য কেবল,
বৈশ্যদ্বারে উঞ্ছবৃত্তি করি’
শূদ্রশক্তি জাগরণে ভয়ত্রস্ত বণিকের তরে,
ধম্মের বচন বচি’ নির্ম্মম কালের যাত্রা যদি কিছু রুধিবারে পারে।
(বজ্রলিপি, অংশবিশেষ, সুরেন্দ্রনাথ গেস্বামী)
নীরেন্দ্রনাথ রায়ের কবিতার দিকে মনোনিবেশ করলে দেখা যায়, আটপৌরে ভাষায় রোজকার দিনলিপি বলে যাচ্ছেন তিনি। একটি সাধারণ দিনে ঘটে যাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা কীভাবে তাঁকে প্রভাবিত করছে, তার প্রতিদিনের জীবনে কী ধরনের পরিবর্তন করে দিচ্ছে, তারই অনুপুঙ্খ বিবরণ। ধীরে ধীরে গভীরে গেলে দেখা যায় তিনি নিছক সাধারণ ঘটনার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য আরেক জগতে। যে-জগৎ তারই জীবন-সঞ্চারিত। কবিতার মধ্যে এক ধরনের গোপন ফাঁদ তিনি পেতে রাখেন এভাবে। এরকম একটি কবিতা বুদ্ধদেব বসুর বিবেচনায় বাদ পড়ে গেল। আমরা যে-আধুনিকের কথা শুনে এসেছি বুদ্ধদেব বসু এবং তাঁর পূর্বাপর রসজ্ঞ সমালোচকদের মুখে তার উপাদানগুলোর উপস্থিতি বোধ হয় ভালোভাবেই সন্ধান পাওয়া যাবে এই কবিতায়। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর কাঁচিতে তিনি খারিজ হয়ে গেলেন। তবে সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর কবিতার দিকে মনোনিবেশ করলে দেখা যাবে, বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘কবিতা’পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে আধুনিকতার লক্ষণ হিসেবে উপস্থাপনের যে দিকগুলোর কথা বলা হয়েছিল, সে-গুলোর প্রবল অনুপস্থিতি। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বাদ পড়ে যাবেন বুদ্ধদেব বসুর ছাকনিতে। কিন্তু আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়-এর বিবেচনার নিরিখ কিভাবে এই কবিতাটি পত্রস্থ করল আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম সংকলনে?
আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের এই ঝুঁকি ছিল না
যা হোক। ভাব ও উপস্থাপনার দিক থেকে বিবেচনা করলে হয়তোবা কবিতাটি খারিজ হয়ে যায়, হয়তোবা সময়ের দিক বিবেচনা করে কবিতাটি রাখা হয়েছিল। কিন্তু সময় এমন এক আপেক্ষিক প্রপঞ্চ যা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হবার দাবি রাখে। অর্থাৎ সময়ের দিক বিবেচনা করলে তিনি আধুনিক কালখণ্ডের। কিন্তু ভাব ও উপস্থাপনের দিক থেকে সেটা যদি আধুনিকের বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধারণ না করে, তাহলে তা সংকলনভুক্ত হওয়ার অধিকার রাখে না। কবিতাটি পত্রস্থ হওয়ায় বলা যায় সংকলনটি আধুনিকের সবকিছু ধারণ করতে পারেনি নির্মোহভাবে।
হয়তোবা অতটা নির্মোহ হওয়াও যায় না। হতে পারলে বুদ্ধদেব বসু কিংবা হুমায়ুন আজাদ তাঁদের সংকলনে নিজেদের কবিতাও রাখতেন না। মহাকালের পৃষ্ঠায় ছেড়ে দিতেন তাঁদের কবিতা অন্তর্ভুক্তির কাজ, নতুন প্রজন্মেও কোনো এক কবির হাতে। আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের এই ঝুঁকি ছিল না। কারণ তারা তো কবি ছিলেন না।
চলবে…
কবিতার সংকল: শিল্প থেকে দশকিয়া রাজনীতি-২ ॥ এমরান কবির
কবিতার সংকলন: শিল্প থেকে দশকীয়া রাজনীতি-১ ॥ এমরান কবির