পর্ব-১
তুমি মাত্রা?
ট্রেন ছাড়ার আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। আধঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করতে করতে প্লাটফরমের সব যাত্রী উঠে বসেছে। শূন্য প্লাটফরমে প্রায় একা দাঁড়িয়ে মাত্রা। কাঁধে ব্যাগ। ফাল্গুনের হালকা হাওয়ায় ঘামছে মাত্রা। লোকটা, নাট্যকার অনাবিল আনন্দ সেই আধঘণ্টা আগে ফোনে জানিয়েছে, আমি অটোতে উঠেছি। আসতে পনেরো মিনিট লাগবে।
সেই পনোরো মিনিট যখন আধঘণ্টায়ও শেষ হয় না, ট্রেন ছেড়ে দেবে, টেনশনে মাত্রা ফোন করে নাটকের ডিরেক্টর রহমান লুসাইকে। সারারাত সুটিং করে লোকটা হয়তো ঘুমুচ্ছে, ফোন দেওয়া এখন ঠিক না, কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারে না মাত্রা। ঠিকই ঘুম ঘুম গলায় ফোন রিসিভ করে লুসাই, হ্যালো মাত্রা? ঠিক টাইমে ট্রেন ছেড়েছে?
ঘোড়ার আণ্ডা! তীব্র ক্রোধ প্রকাশ পায় মাত্রার গলায়। আমি শুরুতেই বলেছিলাম আপনাকে ভাই, অচেনা লোকের সঙ্গে আমাকে দিয়েন না, প্রয়োজন হলে আমি একা আসবো, আপনি শুনলেন না। বললেন, অনাবিল ভাই খুব ভালো মানুষ। সেই পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি, ট্রেন ছাড়ার বাকি আছে সাত মিনিট। লোকটার দেখা নাই। এখন কী হবে?
মাত্রা, আমি দেখছি… হতাশ গলা রহমান লুসাইয়ের।
দেখেন, ভালো করে দেখেন; আমি না আসতে পারলে সমস্যা আপনার, আমার কী? যত্তসব! রাগে গির-গির করতে করতে ফোন কেটে দেয় মাত্রা মধুরিমা।
আন্তঃনগর ট্রেন সোনার বাংলার চালক হুইসেল দিচ্ছে, ছাড়বে চট্টগ্রামের উদ্দেশে। কী করবে মাত্রা, বুঝতে পারছে না। গতরাতে বাসায় ফিরেছে দেড়টায় শ্যুটিং শেষ করে। কোনো রকম শরীরের পোষাক চেঞ্জ করে মোবাইলফোনে ভোর পাঁচটার রিংটোন রেখে ঘুমিয়ে যায়। ভোর ঠিক পাঁচটায় রিংটোন বাজলে, শরীরের অহস্য ক্লান্তি উপেক্ষা করে বিছনায় উঠে বসে। বাথরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামে। রায়েরবাজার থেকে কমলাপুর আসার জন্য একটা অটো পেতেই দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়েছে। কমলাপুর স্টেশনে নেমে ভেতরে ঢুকে মোবাইলফোন বের করে কল দেয় অনাবিল আনন্দকে, হ্যালো আমি মাত্রা। আপনি কোথায়?
আমি বাসা থেকে বের হচ্ছি, বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগবে আসতে।
ওকে!
ট্রেনভ্রমণ এমনিতেই ভালো লাগে মাত্রার। ভেবেছিল, ট্রেনে উঠে একটা ঘুম দেবে। গতরাতের ঘুমটা পুষিয়ে নেবে। কিন্তু কোথাকার কোন অনাবিল আনন্দ, যিনি একজন নাট্যকার; তার লেখা নাটকেই শ্যুটিং করতে যাচ্ছি চট্টগ্রামে, সেই লোকটা বুঝি সব বরবাদ করে দিচ্ছে। কারণ, ট্রেনের টিকেট লোকটার কাছে। নিজের কাছে টিকেট থাকলে কোনো সমস্যাই ছিল না, তুই ব্যাটা না এলে আমার কী? আমি চলে যাবো আমার মতো; মেজাজটা রেল-ইঞ্জিনের চেয়েও গরম হয়ে আছে।
আবার বলছে তুমি! লোকটার আস্পার্ধা দেখো, চেনা নেই, জানা নেই, আসছে সময় শেষ করে, টেনশনের চূড়ান্ত রেখায় পৌঁছানোর পর, কিন্তু রহমান লুসাইয়ের কারণে, নিজেকে সহ্য করে নেয় মাত্রা মধুরিমা।
জি, আমি মাত্রা মধুরিমা, দাঁতে দাঁত ঘষে মাত্রা।
চুলো, ট্রেনে ওঠা যাক; এটা তোমার লাগেজ? আনন্দ লাগেজটা নিজের হাতে নিয়ে দ্রুত ট্রেনের দিকে ছোটে, পেছন-পেছন ছোটে মাত্রা। নিজে দ্রুত ট্রেনে ওঠে, ওর লাগেজটাও তোলে। ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে, শেষ হুইসেল বাজছে। লাফ দিয়ে ওঠে মাত্রা। ট্রেনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দেয়। মনে হয় ট্রেনের চালক, এতক্ষণ ওর ওঠার অপেক্ষায় ছিল।
নিজের কাঁধের ব্যাগটা মাত্রার ব্যাগের পাশে নামিয়ে রেখে তাকায়, তুমি এখানে থাকো মাত্রা। আমি দেখে আসি কোথায় আমাদের বাথ।
ওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায় চলমান ট্রেনের ভেতরের কম্পার্টমেন্টের মধ্যে। দ্রুত চলমান ট্রেনের খোলা প্যাসেসে দাঁড়িয়ে ভোরের হিমেল হাওয়ায় মনটা কেবল ভালোই হয়ে যায় না, কেমন উদাস হয়ে যায়। আর অনাবিল আনন্দের ওপর রাগটাও কমে আসে। লোকটা নিজেই চট্টগ্রাম যাত্রার সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।
দুই দিন আগে যখন লুইস দলবল নিয়ে চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম, তখন প্রশ্ন করেছিল মাত্রা, আমি কিভাবে যাবো?
তুমি ‘বিষাক্ত মধু’ নাটকের নাট্যকার আনন্দ ভাইয়ের সঙ্গে আসবে, ট্রেনে।
ওই লোকটাকে আমি চিনি না…
থামিয়ে দিয়ে লুইস বলেছিল, অনাবিল ভাই কিন্তু মজার মানুষ। কথা কম বলে কিন্তু সাহসী আর দায়িত্বশীল। লেখালেখি উনার প্যাশন। সংসারী মানুষ। কোনো ছোক ছোক অভ্যাস নেই; আমি নিশ্চিত, তোমার সমস্যা হবে না।
সিনিয়র ডিরেক্টর রহমান লুসাই। ওর ডিরেকশনে অনেক নাটকে অভিনয় করেছে মাত্রা। আস্থা বা বোঝাপাড়ার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সুতরাং আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু গতকাল বিকেলেও যখন আনন্দ মহাশয় ফোন দেয়নি, তখন ফোন দেয় লুসাইকে, ভাই আনন্দ সাহেব তো যোগাযোগ করেনি। সব ঠিক আছে তো?
দেয়নি ফোন?
না।
আমি দেখছি।
লুসাইয়ের সঙ্গে কথা বলার পাঁচ মিনিটর পর ফোন আসে অনাবিল আনন্দের, হ্যালো? আপনি মাত্রা বলছেন?
জি, আপনি কে?
আমি আনন্দ, অনাবিল আনন্দ!
ও আচ্ছা।
শুনুন, আমি ট্রেনের বার্থ রিজার্ভ করেছি। সকাল সাড়ে ছটায় ট্রেন; সোনার বাংলা। আপনি ঠিক সময়ে চলে আসবেন, আমিও যথাসময়ে আসবো। এটা আমার মোবাইলফোন নম্বর। সেভ করে রাখুন।
ওকে!
লোকটার মধ্যে কোনো জড়তা নেই, চটপট, সাবলীল। পুরুষের মধ্যে এই রূপটা খুব পছন্দ করে মাত্রা। কিন্তু কেন এত দেরি করলো, সে সর্ম্পকে কিছুই বললো না। কেন বললো না? নিজেকে মহাবৃক্ষ ভাবে নাকি? আমাকে তো চেনে না…
চলো, কম্পার্টমেন্টের ভেতর থেকে এসে দুই হাতে দুই ব্যাগ নিয়ে আবার ঢোকে কম্পার্টমেন্টের মধ্যে। দুই দিকে সারিবদ্ধ চেয়ারে যাত্রীরা বসা। কেউ মোবাইলফোন টিপছে, কেউ ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে কাদা, মুখ বিশ্রীভাবে হা করা। কেউ বই পড়ছে। দুই সারির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তিনটি কম্পার্টমেন্ট পার হয়ে নিজেদের ছোট বার্থটার সামনে দাঁড়ায়। পায়ে নিচে ব্যাগ দুটো রেখে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। লাইট জ্বালিয়ে ফিরে আসে দরজায় আনন্দ, এসো। ভেতরে এসো মাত্রা।
অদ্ভুত মদকতায় ভরা ভরাট একটা কণ্ঠস্বর, লোকটা কী আমাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে! ভেতরে ঢুকে একটা সোফায় বসতে বসতে ভাবে মাত্রা।
আনন্দও সামনের সোফায় মুখোমুখি বসে, তুমি যখন ভোরে ফোন দিলে, আমি তখন বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম। বের হয়েই গলির মধ্যে একটা অটো পেয়ে যাই, উঠে পড়ি। অটো চলছিল ভালোই কিন্তু শ্যমলীতে কবি শামসুর রাহমানের বাসার কাছে আসতেই অটো আর চলে না। বন্ধ। ড্রাইভার একজন বয়স্ক মানুষ। নেমে পেছনের সামনের যন্ত্রপাতি দেখছে, স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু স্টার্ট নিচ্ছে না। বেচারা বারবার ক্ষমা চাচ্ছে; দেখতে দেখতে দশ মিনিট চলে যায়। প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে ওঠে খুবই গুরত্বপূর্ণ। কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, অটো থেকে নেমে আরও অটো খুঁজছিলাম, কিন্তু মেইন রাস্তায় সকালবেলা খালি অটো নেই। সব অটোই যাত্রীবোঝাই হয়ে আসে।
কিন্তু আমার ফোন ধরছিলেন না কেন?
ধরে কী বলবো? এসব বললে তোমার টেনশন আরও বাড়তো।
তো এলেন কিভাবে? অটো ঠিক হলো?
না, অটো ঠিক হচ্ছে না। বেচারা ড্রাইভার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না, যে অটোই যাচ্ছে হাত উঁচু করে থামানোর চেষ্টা করি, কিন্তু থামে না। হঠাৎ একটা অটো থামলো কিন্তু যাত্রীবোঝাই। একজন নারী, একজন বাচ্চা আর পুরুষ। মানুষটা গলা বাড়িয়ে জানতে চায় আমার পরিস্থিতি। আমি বললাম, ট্রেন ছাড়ার আর ত্রিশ মিনিট আছে।
লোকটা বললো, উঠুন। ড্রাইভারের পাশে আমাকে বসালো।
আমি আমার অটো ড্রাইভারকে ভাড়া দিয়ে ভদ্রলোকের অটোতে উঠলাম। অটোর ড্রাইভারের পাশে বসার কারণে মোবাইলফোনও রিসিভ করতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম, তোমার ফোন। মোবাইলফোন ছিল প্যান্টের এই ডান পকেটে।
কিন্তু ওনারা কই যাচ্ছিল?
ওনারাও যাচ্ছিল সদরঘাট, ওদের বাড়ি চাঁদপুর। ওরা যাবার পথে ঘুরে আমাকে নটরডেমের মোড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়, আমি ভদ্রলোককে ভাড়াটা দিতে চাইলাম, কোনোভাবেই নিলো না।
অবাক কাণ্ড তো!
মানে?
এমনও মানুষ বাংলাদেশে আছে?
আমিই তো প্রমাণ দিলাম তোমাকে, আজকে, এই সকালে, একটু আগে। আমি নিশ্চিত, ভদ্রলোক ঝুঁকি নিয়ে আমাকে এখানে নামিয়ে না দিলে নির্ঘাত ট্রেনটা ফেল করতাম।
লোকটার নাম জিজ্ঞেস করেছেন?
অনাবিল আনন্দ হতবহ্বিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মাত্রা মধুরিমার দিকে, মেয়েটিতো টিভির পর্দার চেয়েও সুন্দর। অনেক সময়ে বাস্তব চেহারার চেয়ে টিভির বা সিনেমার পর্দায় নায়ক নায়িকাদের অপরূপ লাগে। মাত্রা প্রিয় অভিনয় শিল্পী আনন্দের। কিন্তু টিভির পর্দায় দেখার চেয়ে সম্মুখে বসা মেয়েটি অনেক সুন্দর, লাস্যময়ী, গোলাকার মুখ, তীব্র কামনায় ঠাসা একজোড়া ঠোট; চওড়া কপাল, সাদা ঝকঝকে সারিবদ্ধ দাঁত।
আমার কথা শুনছেন আপনি? মুখটা এগিয়ে প্রশ্ন করে মাত্রা।
নিজের মধ্যে ফিরে আসে আনন্দ, আমি খুবই লজ্জিত। ভদ্রলোকের নামটা জিজ্ঞেস করিনি; মাথাটা নুয়ে আসে। এতবড় একটা উপকার করলেন তিনি কিন্তু নামটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।
হাসে মাত্রা, এত নিজেকে অপরাধী ভাবার কারণ নেই। তাড়াহুড়ো, টেনশনের সময়ে মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়। আপনার জায়গায় আমি হলেও ভুলে যেতাম।
কিন্তু অটো থেকে নেমে আসার সময়ে অন্তত ভদ্রলোকের নামটা জেনে আসা উচিত ছিল, জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি রেখে আপন মনে বলে অনাবিল আনন্দ। মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ জীব।
এককাপ চা পেলে ভালো হতো, প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলে মাত্রা।
চা? বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দাঁড়ায় অনাবিল, আসছি। রুম থেকে বের হয়ে যায়।
মাত্রা মধুরিমা তাকায় জানালা দিয়ে বাইরে। দ্রুত পলায়নপর জানালার ওপাশে গাছপালা বাড়িঘর দরজা জানালা দোকান পাট দেখতে দেখতে ভাবে, মানুষ বাস করে ভুলের ওপর। অনেক সময়েই নিজের সিদ্ধান্ত কত ভুল হয়ে যায়। অনাবিল আনন্দ ভীষণ দায়িত্বশীল মানুষ অথচ ট্রেনের প্লাটফরমের ওপর দাঁড়িয়ে মানুষটাকে কতভাবে…। দেখা আর দেখার মধ্যে অনেক দূরত্ব।
ট্রেনের একজন হকারকে নিয়ে ঢোকে রুমের মধ্যে অনাবিল, মাত্রা সকালের নাস্তা কী খেতে চাও, ওকে বলো।
এত সকালে আমি কিছু খাই না ভাই।
চা খেতে চাইলে যে!
হ্যাঁ এককাপ চা।
মাত্রার কথা শেষ হতে পারে না, অনাবিল বলে, কফিও আছে। তুমি কফি পছন্দ করো?
মাথা ঝাঁকায়, কুব পছন্দ করি।
তাহলে দুই কাপ কফি আর দুটো বিফ বার্গার দিয়ে যাও, অনাবিল আনন্দ তাকায় হকারের দিকে।
হকারের পেছনে আর একজিন ছিল। দুজনে মিলে দুই কাপ কফি আর দুটো বার্গার রেখে চলে যায়। দুজনার বসার মাঝখানের ছোট সুদৃশ্য টেবিলের ওপর রাখা কফির দিকে তাকায় আনন্দ, নাও কফি।
এখনই?
চাইলে তো।
কিন্তু…
কী?
মাথা নিচু করে বসে থাকে মাত্রা মধুরিম। বিপরীত সোফায় মুখোমুখি বসে আনন্দ, কী সমস্যা? বাথরুমে যাবে?
মাথা নাড়ে মাত্রা, হ্যাঁ।
হাসে অনাবিল, চলো।
অনাবিল আনন্দের পিছু পিছু রুমের বাইরে আসে মাত্রা। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা বন্ধ করে সামনের দিকে হাঁটে অনাবিল। পেছন-পেছন মাত্রা। বাথরুমের সামনে একজন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। বাধ্য হয়ে দুজনে অপেক্ষা করছে। ত্রিশ সেকেন্ড পরে দরজা খুলে বের হয়ে আসে এক মধ্য বয়সী নারী। সঙ্গে সঙ্গে ঢোকে অপেক্ষারত লোকটি।
চলুন, ফিরে যাই,আস্তে বলে মাত্রা।
কেন? বাথরুমে যাবে না?
না।
কেন?
আমার অস্বস্তি লাগে।
কিসে অস্বস্তি লাগে?
একজনের পর একজনের ব্যবহার করা বাথরুম আমি ব্যবহার করতে পারি না। বিশ্রী গন্ধ লাগে, বমি আসে আমার।
বুঝলাম কিন্তু বাথরুম না সেরে থাকতে পারবে?
মাত্রা মধুরিমা একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সামনে ধাবমান গাছপালা আর ধু-ধু প্রান্তর দেখে।
শোনো, বাথরুম করাটা খুবই দরকার, যখন চাপ আসে। নইলে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। বিকেলেই শ্যুটিং তোমার। সারা ট্রেনে নিজেকে সামলে থাকবে কী করে? ট্রেনের যাত্রাটাই মাটি হয়ে যাবে। তুমি অপেক্ষা করো এক মিনিট, আমি আসছি…হন হন করে অনাবিল আনন্দ রুমের দিকে যায়। পরিস্থিতির কাছে কিছু করার থাকে না মাত্রার; সকালে তাড়াহুড়োর কারণে বাথরুমটা করা হযনি। চাপও আসেনি। অথচ যত সকালই হোক, বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ে বাথরুমের চাপ আসবেই, প্রকৃতির টানে। বাইরের বিধ্বস্ত, ময়লায় আকীর্ণ, গন্ধে মাখা বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না। আর দেখো, ভেতরের লোকটা এখনো বের হচ্ছে না। বাথরুমের মধ্যে গল্প লিখছে নাকি!
লোকটা বের হয়েছে? রুম থেকে ফিরে এসেছে আনন্দ।
নাহ।
ওদের কথার মধ্যে বাথরুমের লোকটা বের হয়ে আসে। এগিয়ে যাচ্ছিল মাত্রা, পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখে আনন্দ, একটু অপেক্ষা করো।
আনন্দ বাথরুমে ঢোকে। আশ্চর্য লোক তো, অবাক মাত্রা, আমি যাবো বাথরুমে, আর কি না লোকটা…কিন্তু দরজা বন্ধ করছে না। এগিয়ে যায় বাথরুমের সামনে। অনাবিল পানির কল ছোট বদনায় ধরে বাথরুমের কমোডের ওপর পানি ফেলছে। তিন বার পানি ফেলে পরিষ্কার করে, প্যান্টের পকেট থেকে সেন্টের বোতল বের করে বাথরুমে ছড়িয়ে দেয়। মাত্রা মধুরিমা হতবম্ব। সাত সকালে সোনার বাংলা আন্তঃনগর ট্রেনে কী হচ্ছে এসব? জগতের কেউ শুনেছে, ট্রেনের টয়লেটের গন্ধ তাড়ানোর জন্য সেন্ট ব্যবহার করতে। টয়লেট থেকে বের হয়ে ইশারা করে, যাও।
মাত্রা টয়লেটে ঢোকে, দরজা বন্ধ করে বসে কমোডে। জীবনে নাটকের শ্যুটিংয়ের কারণে বিদেশে অনেকবার গেছে। পাচঁতারা হোটেলে থেকেছে। কত অত্যাধুনিক বাথরুম ব্যবহার করেছে। সুন্দর, সাজানো অত্যাধুনিক বাথরুমের প্রতি দুর্বল মাত্রা। নিজের বাসার বাথরুমটা সাজিয়েছে মনের মতো। গান শোনে বাথরুমে থাকার সময়ে। পারতপক্ষে নিজের বাথরুমে কাউকে ঢুকতে দেয় না। কিন্তু আজকে এই মুহূর্তের সোনার বাংলা আন্তঃনগর ট্রেনের এই বাথরুমটা সবচেয়ে অত্যাধুনিক, আরামের। লোকটা কে আসলে? এমন করছে কেন? বাথরুমের বেগ আসার পর থেকেই ভাবনার মধ্যে ছিল, কোথায় জুটবে এমন বাথরুম? কিন্তু এমন বাথরুমে জুটলো, যা ছিল অভাবনীয়।
টয়লেট সেরে বের হয়ে আসে বিশিষ্ট অভিনয় শিল্পী মাত্রা মধুরিমা। দরজায় অপেক্ষায় দুজন যাত্রী। সামনের জন মাঝ বয়সী যাত্রী কিন্তু বাথরুম থেকে মাত্রাকে বের হতে দেখে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে, ভুলে গেছে বাথরুমে যাওয়ার পরিস্থিতি। পেছনের ছেলেটা ঠেলছে সামনের বয়স্ক লোকটাকে, আরে ভাই বাথরুমে ঢোকেন, নইলে আমি যাই।
আপনে চেনছেন ওনারে? ঘাড় ফিরিয়ে প্রশ্ন করে বয়স্ক লোকটা।
চলবে…