দ্বিতীয় কিস্তি
চার.
বিশ্বের বৃহত্তম শিল্পকলা জাদুঘর প্যারিসের এই ল্যুভর মিউজিয়াম। প্যারিসের সেন নদীর ডান তীরে অবস্থিত এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনাও বটে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সৃষ্ট প্রায় ৩৮ হাজার শিল্পবস্তু প্রদর্শন করা হয় এই মিউজিয়ামে। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, ল্যুভে মিউজিয়াম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিদর্শিত শিল্পকলা জাদুঘর। এই বছর ৯ কোটি ৬ লাখ দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন। কাজেই এরকম একটি শিল্পভাণ্ডার দেখার স্বপ্ন সবার হৃদয়ে বসত করবে না তো কী?
মোনালিসার রেপ্লিকা দেখতে দেখতে চোখ অন্ধ। তবু তো বাসনা মরে না। চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি! জগদ্বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, মোহনীয় তার পেইন্টিং ‘মোনালিসা’। এই মোনালিসার অরিজিনাল বা মৌলিক ছোট এক টুকরো ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন যে হৃদয়-কম্পন অনুভব করেছিলাম—সেই অচেনা কম্পন অনুভূত হতো শুধু পরীক্ষা হলে বসে। নয়তো হঠাৎ প্রেমিকের দেখা পেলে।
পৃথিবীর সাড়া জাগানো মোনালিসার এই মূল ছবিটি দেখতে সেখানেও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রফিক আজাদ ও আমি দুজনেই গলদঘর্মে নাকাল হয়েছিলাম। যদিও সামনে পেছনে অভিন্ন ও অব্যয় আমাদের স্কট করে নিয়ে যাচ্ছিল। আধাঘণ্টায় বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে মোনালিসার হাসির সমুখে এসে যেই না তাকালাম, মনে হলো ঘন আঁধারের পটে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া একটি চাঁদমুখ দেখছি। কিন্তু দর্শনের সময় সর্বসাকুল্যে মাত্র পাঁচ মিনিট। খুঁটিয়ে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া, খুব কাছে গিয়ে দেখাও নিষেধ—লক্ষ কেটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে ছবিটি যেন অচিরেই নষ্ট হয়ে না যায়—সেজন্যে ছবি থেকে অন্তত ১০/১২ হাত দূরে দর্শকসারিতে দাঁড়িয়ে যেটুকু দেখা যায়, এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল সেদিন। তবে বিষণ্ন প্রকৃতির কবি রফিক আজাদও সেদিন সত্যিকার অর্থেই উচ্ছ্বসিত আনন্দে উদ্বেলিত ছিলেন। পরম-আরাধ্য কিছু প্রাপ্তি ও সন্দর্শনের আহ্লাদে যেন শিশিরভেজা এক মাঠ। সোনালি শিশির পানে যেমন খুশি থাকেন, আনন্দে টলমল, নির্মিলিত আঁখি—সে রকম অদ্ভুত মুখ মায়াচোখে তাকিয়েছিলেন তিনি আমার মুখপানেও।
কফির সঙ্গে ক্রোসোঁ খেতে খুব উপভোগ করতেন রফিক আজাদ। এ কারণে ২০১৫ সালে যখন আমরা টরন্টোতে যাই, অভিন্ন মন্ট্রিয়েলের নামকরা ‘আমা খুইয়াম’ নামের একটি বেকারিতে নিয়ে নানা পদের, নানা স্বাদের ক্রোসোঁ আর কফি খাইয়েছিল তার বাবাকে।
কেন?
তা কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি সেদিন।
তবে সেদিন এভেন্যু দ্যু শজেলিজেঁ ধরে দীর্ঘক্ষণ দু’জন হেঁটেছি হাতে হাত রেখে। হৃদয়-তন্ত্রীতে বারবার বেজে উঠেছেন কবি শার্ল বোদলেয়ার। এই পথেই তো হেঁটেছেন তিনি। তাই না? যেমন আমরা বাংলাদেশের দু’জন কবি তাকে স্মরণ করে এতদূর এসেছি, আজও খুঁজে চলেছি তার মুদ্রিত পদচ্ছাপ। রফিক আজাদ ও আমি দু’জনেই একসঙ্গে আবৃত্তি করেছিলাম তার বিখ্যাত সেই কালজয়ী পঙ্ক্তিমালা।
প্রিয়তমা, সুন্দরীতমারে,
যে আমার উজ্জ্বল উদ্ধার
অমৃতের দিব্য প্রতিমারে,
অমৃতেরে করি নমস্কার।বাতাসে সত্তার লবণে
বাঁচায় সে জীবন আমার,
তৃপ্তিহীন আত্মার গহনে
গন্ধ ঢালে চিরন্তন।
জগদ্বিখ্যাত শজেলিজেঁ নামের এই সড়কটির ওপর বহু চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ, ক্যাফে, বিশেষ সৌখিন দ্রব্যের দোকান যেমন আছে, তেমনি নামি-দামি ব্র্যান্ডের শপিংমল দাঁড়িয়ে আছে অপলক ভঙ্গিতে। এই রাস্তায় হেঁটেছেন শার্ল বোদলেয়ার বহু দিবস-রজনী। নিশ্চয় প্রেমিকা জান দ্যুভালকে নিয়ে শার্ল বোদলেয়ার এখানকার কোনো ক্যাফেতে বসেই কফি খেতেন। এই ভাবনা মাথায় নিয়ে আমরা দু’জনে একটা ক্যাফেতে বসে রেগুলার সাইজের দুটো কফি নিলাম। সঙ্গে দুটো ক্রোসোঁ। কবিকে স্মরণ করেই কফিমগে চুমুক দিলাম দু’জনে।
কফির সঙ্গে ক্রোসোঁ খেতে খুব উপভোগ করতেন রফিক আজাদ। এ কারণে ২০১৫ সালে যখন আমরা টরন্টোতে যাই, অভিন্ন মন্ট্রিয়েলের নামকরা ‘আমা খুইয়াম’ নামের একটি বেকারিতে নিয়ে নানা পদের, নানা স্বাদের ক্রোসোঁ আর কফি খাইয়েছিল তার বাবাকে। ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া শজেলিজেঁ সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক পুরাণ অনুসরণে—যার অর্থ ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দররাস্তা’। এই নামের সড়কটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই রয়েছে প্যারিসের অন্যতম দর্শনীয় সৌধ (প্যারিস গেট) আর্ক অফট্রায়াম্ফ।
ভাই হাবীবের অনুরোধে কিছু মার্কেটিং করেছিলাম। রেণু চমৎকার একটি ব্যাগ কিনে দিয়েছিল সেদিন।
পাঁচ
উনিশ শতকের পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনাটির নাম ছিল আইফেল টাওয়ার। যদিও বর্তমানে পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থাপনা বুর্জ খলিফা। একথা মানতেই হবে যে, আইফেল টাওয়ার একটি বিশ্ববিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক, যেটি প্যারিসের প্রায় সমগ্র জায়গা থেকে দেখা যেতে পারে। ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ স্মরণীয় করে রাখতেই ১৮৮৯ সালে প্যারিসে নির্মিত হয়েছিল আইফেল টাওয়ার। ১০৫০ ফিট উচ্চতার এই টাওয়ারটি কেবল প্যারিস শহরের আকর্ষণ নয়, গোটা বিশ্বে পরিচিত এক নাম। প্যারিসের সেন নদীর তীরবর্তী এলাকায় গোস্তাব আইফেল ১৮৮৯ সালে এটি নির্মাণ করেছিলেন।
মানুষ বেঁচে আছে শারীরিকভাবে, মন, মানবিকতা সবই যেন প্রকৃতির ধুলায় গড়ায় আজ। মানবিকতার নতুন সংজ্ঞায় আগামী পৃথিবী নিশ্চয় পথ করে নেবে নিজের মতো করে, আমরা তখন থাকবো কি থাকবো না কে জানে!
ফ্রান্স মানেই নতুন দর্শনার্থীর কাছে প্রথমে ল্যুভর জাদুঘর, আইফেল টাওয়ারের পর ভার্সাই রাজপ্রাসাদ সর্বাধিক পরিদর্শন করা স্মৃতিস্তম্ভ। আইফেল টাওয়ারের স্থানীয় নাম ‘লা দামে দি ফার’ অর্থাৎ লোহার নারী। এই লোহার নারীকে দেখতে প্রতিবছর কোটির ওপরে দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। আমাদের ছোট পুত্র অব্যয় রাজধানী প্যারিস শহরের আইফেল টাওয়ার দেখার আনন্দে যেন কাঁপছিল সেদিন।
বাংলাদেশ থেকে ৭৯০৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই আইফেল টাওয়ারে উঠে আমার সন্তানদের আনন্দ ঝুড়ি উপছে পড়ছিল যেন। খুশিতে তাদের নয়নদ্বয় যেন চিকচিক করছিল। অব্যয় তার অভিনব ভাবনা থেকে নিজের নামটি স্বাক্ষর করে এসেছিল—টাওয়ারের লোহার শরীরে। তারপর নিশ্চয় অব্যয় ভবিষ্যতে কোনো একদিন তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে যখন আইফেলটাওয়ারে যাবে, ওই উচ্চতায় উঠবে, নিশ্চয় সেদিন তার স্বাক্ষরটি খুঁজে বের করে দেখাবে তার সন্তানদের। নিশ্চয় তখন কবিপিতা-মাতা এবং ভাইকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম আইফেল টাওয়ার দর্শনের স্বপ্ন-শিহরণের গল্পটিও মনে পড়ে যাবে সেন নদীর জলপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে।
২০১২ সালের সেই স্বাক্ষরচিহ্ন—দেখে নিশ্চয় পিতা হিসেবে অব্যয়েরও মনে পড়বে সম্রাট শা-জাহানকে নিয়ে রচিত রবীন্দ্রনাথের অবিস্মরণীয় কবিতার অমর কিছু পঙ্ক্তি। সফল মানুষের চিত্তেও চিরকালের যে শূন্যতা ও হাহাকারের আর্তি—অপরিমেয় এক আকাঙ্ক্ষা ডেকে আনে,
তাই
চিহ্ন তব পড়ে আছে,তুমি হেথা নাই।
. যে প্রেম সম্মুখপানে
. চলিতে চালাতে নাহি জানে,যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজ সিংহাসন,
. তার বিলাসের সম্ভাষণপথের ধুলার মতো জড়ায়ে ধরেছে তব পায়ে
. দিয়েছে তা ধুলিরে ফিরায়ে।
চিত্রশিল্পের রেনেসাঁস যুগের অন্যতম আর এক প্রধান শিল্পী রাফায়েলের সৃষ্ট তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘ব্রিজওয়াটার’ দেখে একইভাবে বিস্মিত ও বিমোহিত হয়েছিলাম এই ভ্যাটিক্যানে। নয়নে স্মৃতির অঞ্জন মেখে দেখি সেসব সুখের দিনের ছবি। কিন্তু পৃথিবীর আজ গভীরতর অসুখ। আত্মঘাতী করোনার তাণ্ডবে গৃহবন্দি হয়ে আছে মানুষ। অতি প্রিয়জনদের সঙ্গেও দেখা হয় না কতকাল। মানুষ বেঁচে আছে শারীরিকভাবে, মন, মানবিকতা সবই যেন প্রকৃতির ধুলায় গড়ায় আজ। মানবিকতার নতুন সংজ্ঞায় আগামী পৃথিবী নিশ্চয় পথ করে নেবে নিজের মতো করে, আমরা তখন থাকবো কি থাকবো না কে জানে!
শেষ
আগের পর্ব: সে বড় সুখের সময় ছিল ॥ দিলারা হাফিজ