[পর্ব-৩: একান্নবর্তী সংসারে-সাতকাহন]
এক.
বিশ্ব সংসারের সকল সুখের সাকিন, এই সংসারাশ্রমেই নিহিত, তবু যে পারে, সে অনেক দূরেও যেতে পারে। একই সংসারে বাস করেও কেউ থাকে যোজন যোজন দূরে, কেউ বা খুবই আত্মার অদূরে। কাছে-দূরের এই মেঘ-রৌদ্র খেলা চলে চলমান এই সংসার সমুদ্রে। সমুদ্রমন্থন করে কেউ পান করে অমৃত, কারও হাতে উঠে আসে বিষভাণ্ডও।
ইতোপূর্বেই বলেছি, আমার আব্বা ও তিন চাচা মিলে চার ভাইয়ের একান্নবর্তী সংসার সেই যুগেও ছিল আদর্শ। আমাদের বড় কাকা বদর উদ্দিন আহমেদ ছিলেন সেই সংসারের প্রধান কর্তা। বাকি তিন ভাই কলকাতা শহরে থাকেন, প্রেস ব্যবসার উন্নয়নের চারপাশ ঘিরে। যখন যিনি সময় পান, বাই রোটেশন বাড়িতে আসেন-যান। শুধু ঈদে ও পরিবারের নিজস্ব কোনো পালা-পার্বণ থাকলে তবেই ম্যানেজারের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে তিন ভাই একসঙ্গে উপস্থিত থাকেন বাড়িতে।
আব্বাকে আসতে হতো প্রায়ই, কখনো জমিদারির কাজে, কখনো বড় ভাইকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতে এবং নিতেও। বাহুল্য বলা, মেজো, সেজো, ছোট—এই তিন ভাইয়ের কাছেই তাদের বড় ভাই ছিলেন পিতৃতুল্য ফিগার। বড় কাকার স্ত্রী আমাদের সবার কাছে বড় আম্মা হিসেবে পূজিত ছিলেন। ভাঁড়ারের সমূহ দায়িত্ব হাতে নিয়ে সংসারের অন্দর মহলের অন্যতম সম্রাজ্ঞী তিনি। কোন বেলা কী রান্না হবে, কে কী খাবে, সবই তার নির্দেশমতো পরিচালিত হতো।
তিন দেবরের খাবার শেষে তাদের বউদের ডাকতেন খেতে, মেজো, সেজো, ছোট বউয়ের মধ্যে মাছের কোন পিস কে পাবে, সেই সিদ্ধান্ত তিনিই নিতেন নিজের মতো করে। খাবার পছন্দ না হলেও কারও কোনো কথা বলার সুযোগ ছিল না। কেননা, বড় ভাবীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেবররা কোনো কথা শুনবে না, এটা তাদের প্রত্যেকের বউয়ের জানাই ছিল। এজন্যে স্বামীদের প্রতি মান-অভিমান যেমন ছিল, ভালোবাসার পাল্লাও কিছু কম ভারী ছিল না।
আব্বা চলে গেলেন ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি, তার জন্মও একই দিনে। তারপর থেকেই কলেজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের সংগ্রাম।
বর্ষাকালে জেলেরা সাপ্তাহিক হাটবারে যেতো আমাদের বাড়ির ঘাটের সামনে দিয়ে। নৌকার খোল ও খাড়ি বোঝাই করে ডাউটিয়াহাটে মাছ বিক্রি করতে যেতো জেলেরা। আব্বা বাংলো ঘরে বসে থাকলে জেলেনৌকা থামিয়ে প্রায়ই খাড়িসহ মাছ কিনতেন। সেদিনও একখাড়ি নতুন পানির তাজা নাচুনেনওলা মাছ কিনেছেন আব্বা। রাতে সবার খাবার পরে তিন দেবরের বউকে ডেকে খেতে দিয়েছেন বড় আম্মা। আমার মায়ের পাতে দিয়েছেন একটা লেজের টুকরো। মা আমার অভিমানে ভাত না খেয়ে উঠে চলে গেছেন তার শোবার ঘরে। আব্বা মায়ের গম্ভীর মুখ দেখে বুঝতে পেরেছেন, কারণ জানার পরে বলেছেন, অসুবিধা কী, খেয়ে নিতে লেজের মাছ দিয়েই।
মায়ের মুখে শোনা আরও একটা গল্প ছিল দুধের সঙ্গে জল মেশানোর ইতিবৃত্ত। অন্যান্য ভাইয়ের সন্তান, বাড়ির রাখাল, রাঁধুনি মিলে প্রতিবেলা ৩০/৩২ জনের রান্না হতো। এত মানুষের খাবার বণ্টনে সুষ্ঠুসমান নীতি মেনে চলা কঠিনই বটে। একহাতে সবার পাতে খাবার বেড়ে দিতেন বড় আম্মা। খাদ্য বণ্টনের এই কাজটি করতে গিয়ে বড় আম্মা দিশেহারা হয়ে প্রায়ই তা গড়বড় করে ফেলতেন।
রাতের বেলা সবাই সবরিকলা দিয়ে দুধভাত খেতো, শিশুরা তো বটেই। কাজেই সবার পাতে কবজি ডুবিয়ে না হলেও দুধ তো কিছুটা ঢেলে দিতে হবে যে করেই হোক। তিনি যে দেবী অন্নপূর্ণা। সবার প্রতি সমান দৃষ্টি দিতে হয়। কাজেই কোনোভাবে তা ম্যানেজ করে নিতেন। এই নিয়ে বড় জায়ের আড়ালেই বাকি তিন জায়ের মধ্যে ফিসফাস হতো ইশারা ইঙ্গিতে। ওসব কিছুই গায়ে মাখতেন না তিনি, বড়জা হিসেবে সবার মাথার ওপরেই ছিলেন আমৃত্যু। তবে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতেন তিনি। মিলেমিশে থাকায় তার জুড়ি ছিল না। হাঁড়ি পৃথক হওয়ার পরেও বড়আম্মা তার পাত থেকে লোকমা তুলে দিয়েছেন বেটা-ভাতিজির অনেকের মুখেই। সেই স্মৃতিও মোমের মৃদু আলোর মতো আমাদের হৃদয় গহ্বরে অম্লান হয়ে আছে।
দুই.
ভরা বর্ষাকাল ছিল আমাদের পরিবারের বেড়ানোর উত্তম সময়। বিশাল এক বজরা নৌকা ভাড়া করে আব্বা পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। যেতে যেতে নৌকা ভিড়িয়ে খড়াজাল থেকে তাজা লাফানো মাছ কিনতেন, নৌকাতেই রান্নাবাড়া হতো। খোলা আকাশের তলায়, পালতোলা জলের ওপর ভাসতে ভাসতে সেই অপূর্ব সুস্বাদু খাবার আব্বা খুব উপভোগ করে খেতেন।
পাটাতনে গোল হয়ে আমরা ছোটদের দল একসঙ্গে বসে খেতাম। মা-চাচিরা ছইয়ের ভেতরে বসে খেতেন। যাত্রায় সময়ে ঘর থেকেই খাজাঞ্চি ভরা আমর্তি-জিলাপি তুলে নিতেন নৌকায়। তীরবর্তী আখ ক্ষেত থেকে আখ কিনে নিতেন ডজন খানেক, কখনো কখনো আরও বেশি। বড়রা দাঁত দিয়ে ছিলে খেতো। আমাদের ছোটদের জন্যে দা দিয়ে আখের মধ্যখানের টুকরোকে প্রথমে চার ফালা করে কেটে নিতেন, তারপর ছিলে সেগুলো ছোট ছোট টুকরো করে আমাদের খেতে দিতেন মা।
তৎকালীন একান্নবর্তী পরিবারের সমষ্টিগত জীবনের ভালো-মন্দ দুই মিলেই তাদের যাপিত জীবন ছিল অনন্য এক অম্লমধুর রসে পরিপূর্ণ। বড় কাকার পাঁচ কন্যা এবং একমাত্র পুত্র সন্তানটি ছিল আমাদের সকলের প্রিয় সিরাজ ভাই। পুরো নাম সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। অসম্ভব শিক্ষানুরাগী ছিলেন আমার আব্বার মতোই। আব্বার নামে কলেজ প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কত ঝক্কি-ঝামেলা আমাদের পোহাতে হয়েছে আজ থেকে তেইশ বছর আগে। আব্বা চলে গেলেন ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি, তার জন্মও একই দিনে। তারপর থেকেই কলেজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের সংগ্রাম।
আমরাও পাঁচ বোন তিন ভাই। ভাই তিন জনই আমার ছোট। আমার পিঠাপিঠি হাসিব উদ্দিন আহমেদ, ডাক নাম সেলিম। দ্বিতীয় ভাই হাবিব উদ্দিন আহমেদ, ডাক নাম নান্টু। ত্রিশ বছর হলো সে স্যুইজারল্যান্ড প্রবাসী। সবচেয়ে ছোট যে জন রাকিব আহমেদ, ডাকনাম শীতল। শীতল ছাড়া বাকি দুই ভাই তখন বিদেশে। আব্বার নামে কলেজ করতে গিয়ে অনেক টাকার দরকার হলো। আমরা ভাই-বোনেরা মিলে উত্তরাধিকার সূত্রে আব্বার যে সম্পত্তি পেয়েছিলাম, প্রথমে সবাই তা কলেজের নামে সবটুকুলিখে দিলাম। উপরন্তু যে ক্যাশ টাকার প্রয়োজন ছিল, সুদূর প্রবাস থেকে সেলিম দফায় দফায় সেই টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে মায়ের কাছে।
এদিকে কলেজের স্বীকৃতি, স্থাপনা, শিক্ষক নিয়োগের যাবতীয় কাজের জন্যে রাত্রিদিন ছোটভাই শীতলের ছোটাছুটি চলছেই। ঢাকা-টু-মানিকগঞ্জ, মানিকগঞ্জ-টু-ঢাকা শতবার যাওয়া-আসা।
এই সময়ে আমাদের বাড়িতেই নবনিযুক্ত অধ্যক্ষ প্রফেসর জলিল সাহেবের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন মা, তার বাড়ি থেকে কলেজে আসা-যাওয়া সম্ভব নয়, অনেক দূরে, দৌলতপুরে তার বাড়ি। অথচ কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে অধ্যক্ষকে চব্বিশ ঘণ্টাই ব্যস্ত থাকতে হয় প্রথমদিকে।
কাজেই তাকে আমাদের বাড়িতে রাখা ছাড়া উপায়ও ছিল না। গ্রামে তো ভাড়া করে থাকার মতো বাড়ি-ঘর থাকে না। কাজেই বহুল পরিচিত শব্দ ‘জায়গীর’ নামক ব্যবস্থাটি একমাত্র ভরসা। আমাদের বিচক্ষণ মা, উদার হৃদয়ের সিরাজ ভাই, সেজো চাচা আফসার উদ্দিনের মেজো ছেলে ছেলে টুটু ভাই, ছোট চাচা ইনসারউদ্দিনের বড় ছেলে রেজা ভাই মিলে তখন কলেজ ও কলেজের শিক্ষকদের যেমন সামলান, তেমনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রও সংগ্রহ করেন।
যেখানে যখন যাকে দরকার, সিরাজ ভাই তার কাছেই ছুটে যেতেন তার প্রিয় সাইকেল চালিয়ে। অধ্যক্ষ সাহেবকে সময় দিতেন। সবার তখন একমাত্র লক্ষ্য যে করেই হোক কলেজটি যেন আব্বার নামেই প্রতিষ্ঠা করা যায়। শেষপর্যন্ত পরিবারের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি, সব বিরোধিতা ডিঙিয়ে। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে মায়ের নামে ‘ডাউটিয়া গড়পাড়া রহিমা হাফিজ হাই স্কুল’ নামে একটি অসাধারণ স্কুল গড়ে তুলেছে আমাদের ছোট ভাই শীতল তার একক প্রচেষ্টায়।
কলুবাড়ি মানেই সে বাড়িতে দুটো গরুর চোখ নারকেলের মালায় ঢাকা, সারাক্ষণ চক্রাকারে ঘুরছে তো ঘুরছেই। শর্ষে পিষে তিরতির করে তেল নামছে টিনের চুঙ্গা বেয়ে বেয়ে।
আব্বা তার জীবদ্দশায় এই কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর করে গেছেন নিজ হাতে। কাজেই এই কলেজ গড়ার কাজটি ছিল আমাদের পরিবারের জন্যে যেমন অঙ্গীকার, তেমনি নিজেদের গ্রামবাসীকে অশিক্ষার অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসার দায় ও দায়িত্ব ছিলো আমাদের। ‘হাফিজ উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জন্মমাটির ঋণ থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হয়েছি বলে মনে করি আমরা।
চব্বিশ বছরে গ্রামের এই কলেজটি টিনের ঘর থেকে চার তলা ভবনে পরিণত হয়েছে, এমপিওভুক্ত কলেজ হিসেবে সুনামের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। অথচ বিগত চল্লিশ বছর অবধি এই গ্রামের একমাত্র মেয়ে আমি এমএ পাসের দৃষ্টান্ত ছিলাম। এই জন্যই অজপাড়াগাঁয়ে কলেজটি তখন গড়ে তোলার ব্রত ছিল সময়ের দাবি।
আমাদের পারিবারিক অনুদান ও তিন চাচার পরিবারের সবারই সামগ্রিক সমষ্টিগত শিক্ষা অনুরাগের ফসল হিসেবেই আজ এই কলেজটি জ্ঞানের আলো বিতরণ করে চলছে ওই অন্ধকারে। সেই কলেজে আজ পাঠ গ্রহণ করছে কারা? আশার কথা যে, গড়পাড়া গ্রামের চাষি, বর্গাচাষি, ভূমিহীন প্রান্তিক মানুষের সন্তানেরা আজ এই কলেজের শিক্ষার্থী। এই কলেজের দুজন প্রাক্তন ছাত্র জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন।
তিন.
এবার ফিরে যাই আমার বড় কাকার পঞ্চকন্যার গীতবিতানে। সবচেয়ে বড় কন্যার নাম রাবেয়া বেগম। তাকে আমরা ডাকতাম রাবু বুজি বলে। সেই বংশের বড় কন্যা সন্তান। তার বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রাম শোলধারায়। দুলা ভাই ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার, পীর মানুষ। ঢাকার খিলগাঁওয়ে বাস করেছেন আজীবন।
মনে আছে, সেই স্মৃতির ভেলায় আমি ও রাবু বুজির মেজো মেয়ে শিরীন। দুজনেই তখন খুব ছোট্ট। কিন্তু স্মৃতিটুকু আলতো বাতাসে আজও অমলিন। গ্রামজুড়ে তখন কলেরা শুরু হয়েছে, শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ উপন্যাসে যাকে বলা হতো প্লেগ। উপন্যাসের নায়ক ডা. সুরেশবাবু এই প্লেগ রোগেই আত্মাহুতি দিয়েছিল। সে যাই হোক, আমাদের গ্রামে সে এসেছিল যখন, তখন নাম পাল্টে সে ওলাবিবি কিংবা কলেরা নাম ধারণ করেছিল।
রাবু বুজি তার বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল সেই কলেরাকালীন সময়ে। আগেই বলেছি, তার মেজো মেয়ে শিরীন। সে ছিল আমার সম বয়সী, বন্ধু, খেলার সঙ্গী। বুজির বড় মেয়ে ইরানী ছিল আমার মেজো বোন হাওয়া আপার সমবয়সী। এজন্যে আমি তাকে ইরানী খালা ডাকতাম।
সন্ধ্যাবেলা মাগরিবের নামাজের আগে আমাদের ৫/৬ জন শিশুর দলটিকে শীতলপাটি বিছিয়ে বসিয়ে দিতেন বুজি। তারপর ‘সালেমন কাওলাম মীর রাব্বির রাহিম’ এই দোয়াটি শিখিয়ে দিয়ে বলতেন, পড়তে থাকো, আমি নামাজ শেষ করে না আসাপর্যন্ত, কেমন? শোনো, এই দোয়া পড়লে কলেরা হবে না, সব সময় যদি মনে মনে পড়ো, তাহলে কখনো কোনো বিপদ আপদ হবে না তোমার। সেই যে শিখেছিলাম, কখনো তা ভুলিনি।
আমাদের গ্রামের অনেক মানুষ কলেরায় মারা গিয়েছিল। বর্তমান করোনার মতোই তা ছোঁয়াচে ও আত্মঘাতী ছিল। এজন্যে ভেতর বাড়ির উঠান ছেড়ে আমাদের বয়সী শিশুদের কিছুতেই বাইরে যেতে দিতো না। যা বলা হতো, তাই মানতাম, হঠাৎ যেন আমাদের প্রাণচাঞ্চল্য থেমে গিয়েছিল।
আমাদের ‘মিয়াবাড়ি’থেকে ৭/৮ বাড়ির পেছনে ছিল এক কলুবাড়ি। কলুবাড়ি মানেই সে বাড়িতে দুটো গরুর চোখ নারকেলের মালায় ঢাকা, সারাক্ষণ চক্রাকারে ঘুরছে তো ঘুরছেই। শর্ষে পিষে তিরতির করে তেল নামছে টিনের চুঙ্গা বেয়ে বেয়ে।
রান্নার তেল শেষ হলেই মা আড়াই কেজির এক ‘গাইন’শর্ষে মেপে সঙ্গে দুটো কাঁচের বতল দিয়ে পাঠিয়ে দিতেন সেই কলু বাড়িতে। ঘণ্টা ৩/৪ পরে দুই বতল তেল এবং বস্তায় খৈল ভরে নিয়ে ফিরে আসতো রাখাল। সেই খৈল আমাদের বাড়ির হালের গরুকে খাওয়ানো হতো চারের পানিতে ভিজিয়ে রেখে। কখনো আবার সার হিসেবে চাষের জমিতে ছিটিয়ে দিতো।
গ্রামের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত অধিকাংশ বউ-ঝিয়েরা সাবানের বিকল্পেও ব্যবহার করতো এই খৈল। আগের রাতে পরিমাণমতো খৈল পানিতে ফেলে ভিজিয়ে রাখতো, পরের দিন নদীর ঘাটে গিয়ে সেই ভেজানো গোলা খৈল চুলের গোড়ায় ঘষে ঘষে চুল ধুয়ে ফেলতো। আমাদের কালিগঙ্গা নদীর ঘাটে গেলে এই দৃশ্য চোখে পড়তো হর-হামেসাই।
কাজেই আমার আব্বার দুই ভাগনেই মামাদের হেফাজতে থেকে লেখাপড়া শেষ করে, চাকরিতে থিতু হয়েছিলেন। বড় ভাগনে আমেজ উদ্দিন ছিলেন খুবই মেধাবী, ধীরস্থির প্রকৃতির। ছোট জন তার উল্টো।
কলু বাড়ির গৃহস্থ বউ মারা গেলো কলেরায়, মৃত্যুর আগে একটু ডাবের পানি খেতে চেয়ে পায়নি। কারণ আমাদের পুরো গ্রামের কারও বাড়িতে তখন ডাব-নারিকেল গাছ বলে কিছু ছিল না। মাইল চারেক হেঁটে মানিকগঞ্জের মহকুমা শহরে গেলে হয়তো ডাবপাওয়া যেতো, কিন্তু কে যাবে, কলেরার ডামাডোলে কেউ বাড়ি থেকে বেরুতেও সাহস পায়নি।
আব্বার কানে যখন এই খবর পৌঁছালো, তিনিও খুব দুঃখ পেলেন। ইনসার চাচাকে ডেকে বললেন, আমরা এমন এক গ্রামে বাস করি, যেখানে একটিও ডাব গাছ নেই। ভাবো তো ইনসার, তুমি আমার ছোট ভাই, তুমি বা আফসার কেউ খেয়াল করলে না, গ্রামে যে ডাব গাছ নেই। মৃত্যুর আগে একটু ডাবের পানি পান করতে পারলো না কলুর বউ। এই দুঃখ রাখি কোথায়?
আমরা যখন গ্রামের মাথা, আমাদেরই খেয়াল করা দরকার ছিল, গ্রামে যে একটাও ডাব-নারিকেলে গাছ নেই। এরচেয়ে লজ্জা আর কী হতে পারে? পরের বছর বর্ষায় এক লঞ্চ ভাড়া করে আব্বা বরিশাল গিয়ে একশো নারিকেল চারা আর দুটো আমড়া গাছ এনে আমাদের বাগানে লাগিয়েছিলেন, আজও সে গাছ কিছু বেঁচে বর্তে আছে।
বাড়িতে গেলে এখনো আমরা আব্বার হাতে লাগানো সেই নারিকেল গাছের ডাব-নারিকেল দুটোই খাই। তবে আমড়া গাছ দুটো বহুবছর ফল দিয়ে কোনো এক ডুবুডুবু বর্ষার পানিতে মরে যায়। এই আমড়া গাছের আমড়া খেয়েছে গ্রামবাসী সবাই, কেননা, অধিকাংশ গ্রামবাসী আমড়া নামক ফলটি চিনতোই না, এমনকী নামও জানতো না। আমড়া তারা প্রথম দেখেছে এবং খেয়েছে আমাদের বাড়িতেই।
বর্তমান সময়ের মতো যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন অনুকূলে ছিল না যে, সারা দেশের ফলমূল সর্বত্র পাওয়া যাবে। এলাকা ভিত্তিক উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ থাকতো আমাদের সেই আটপৌরে গ্রামীণ জীবনগাথা।
চার.
ফিরে আসি সেই মূল প্রসঙ্গে।
বড়কাকার মেজো মেয়ে খুকি আপা ও সেজো হেনা আপার বিয়ে হয়েছিল আমাদের ফুপু জমিলা খাতুনের দুই পুত্র আমেজউদ্দিন এবং তামেজ উদ্দিনের সঙ্গে। আমাদের এই দুই ফুপাতো ভাইয়ের বাবা মিনহাজ উদ্দিন মুন্সী সন্তানদের ছোট রেখেই অকালে মারা যান। স্বামী শোকে আমার এই ফুপু প্রায় পাগলই ছিলেন দীর্ঘকাল। কাজেই আমার আব্বার দুই ভাগনেই মামাদের হেফাজতে থেকে লেখাপড়া শেষ করে, চাকরিতে থিতু হয়েছিলেন। বড় ভাগনে আমেজ উদ্দিন ছিলেন খুবই মেধাবী, ধীরস্থির প্রকৃতির। ছোট জন তার উল্টো।
আমার আব্বা আমেজ ভাইকে খুব পছন্দ করতেন তার সুবুদ্ধি, সুআক্কেলের জন্যে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আব্বার প্রতি তার ভক্তি, ভালোবাসা যেমন অক্ষুণ্ন ছিল, আব্বার আশীর্বাদেও তিনি আপ্লুত থেকেছেন সদা-সর্বদা। আব্বা তাকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রির জন্যে। তখনকার দিনে বিলেতফেরৎ মানেই জ্ঞানে-গুণে বিশেষায়িত ব্যক্তি।
গ্রামবাসী এ রকম বিলেতফেরৎদের ঘটা করে দেখতে আসতো বাড়ি বয়ে। যথাসময়ে দেশে ফিরে আসার পরে বড় কাকার মেজো মেয়ে খুকি আপার বিয়ে হয়ে যায় আমেজ ভাইয়ের সঙ্গে। সেই বিয়েতে খুকি আপাকে যত গহনা দেওয়া হয়েছিল, সেই ছিল আমার আগের মায়ের গহনা। যা রাখা ছিল তার দুই কন্যা মায়া আপা ও হাওয়ার আপার জন্যে। কিন্তু আব্বা আমেজ ভাই ও খুকি আপাকে এত ভলোবাসতেন যে, নিজের মেয়েদের জন্যে না রেখে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেই সময়ে খুকি আপাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন সব গহনা। নিজের মেয়ে আর ভাইয়ের মেয়েদের কখনো আলাদা করে দেখেননি।
অধিকাংশ মুসলিম পরিবারে এ রকম চাচাতো, ফুপাতো, মামাতো ভাই-বোনের মধ্যে বিবাহের প্রচলন অতীতে খুবই স্বাভাবিক ছিল। আত্মীয়তার সূত্রে মেলা-মেশার এই সুযোগে কখনো কখনো তাদের মধ্যে প্রেম-পিরিতির নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠতো, সবসময় যে তা পরিণতির দিকে যেতো তা নয়, তবে পরিবারের মধ্যে অবরুদ্ধ কন্যা সন্তানদের প্রেমের সম্পর্কগুলো দরোজা-জানালা বেয়ে এভাবেই অগ্রসর হতে পারতো বৈকি। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা, এই বিবাহকে অন্যায় বলে মানে।
কিন্তু জাগতিক পদ-পদবি, সংসারের কর্তৃত্ব কিছুরই প্রত্যাশী ছিলেন না তিনি। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাটির আসন তলের মানুষ।
তাছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, একই রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিবাহ বন্ধনের ফলে অটিস্টিক সন্তান জন্মানোর ঝুঁকি অনেক বেশি থাকায় এই ধরনের বৈবাহিক সম্পর্কের ব্যাপারে শিক্ষিত সচেতন ছেলে-মেয়েরা কেউ আর আগ্রহী নয় তেমন। তবে, একেবারে যে বন্ধ হয়ে গেছে, তাও নয়।
বাঙালি মুসলিম পরিবারে পুত্রহীন ধনাঢ্য অভিভাবকেরা সম্পত্তি রক্ষার প্রয়োজনেও অনেক ক্ষেত্রে স্বজনদের মধ্যে এই ধরনের বিবাহ প্রচলনে সায় দিয়ে থাকে। বড় ভাই আমেজ উদ্দিনের দেখাদেখি ছোট ভাই তামেজ উদ্দিনও খুকি আপার ছোট বোন হেনা আপাকে পটিয়ে বিয়েতে রাজি করিয়ে ফেলে। যথাসময়ে তাদের বিয়ে হয়ে যায় পরিবারের সম্মতিতে।
বিয়ের কয়েক বছর পরেই উন্নত চিকিৎসার নাম করে শাশুড়ি তথা মামিকে নিজের হেফাজতে, তার ঢাকার বাসায় নিয়ে রাখতে শুরু করে। সুযোগ বুঝে তামেজ উদ্দিন আমার আব্বা ও চাচাদের ভোগ-দখলে থাকা বড় কাকার নামের পুরো সম্পত্তির অংশ থেকে শাশুড়ির দু’আনা সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নেয়।
তখন আমাদের বড় আম্মা বেশ অসুস্থ। সিরাজ ভাইও কিছু জানেন না। বড় কাকার জীবদ্দশায় মীমাংসিত বাটোয়ারা দলিল অস্বীকার করে পরিবারের মধ্যে কেউ যে এমন কাজ করতে পারে, আব্বা তা আন্দাজও করতে পারেননি। সিরাজ ভাই নিজেও ভাবতে পারেননি যে, তার অসুস্থ মাকে দিয়ে তামেজ উদ্দিন এমন অন্যায় কাজ করিয়ে নেবে।
এই ঘটনা জানাজানি হলো তখনই, যখন তামেজ উদ্দিন একের পরে এক এক করে জমি বিক্রি করে আবার ঢাকায় চলে যাচ্ছে। জমিতে চাষ দিতে গিয়ে রাখালেরা সংবাদ নিয়ে এসে প্রথম জানালো আব্বা এবং আমার দুই চাচাকে।
-ঐ জমি তো আপনেগোর নামে নাই মিয়াসাব। জমি বেচা দিয়া গেছে তামেজ মিয়াসাব। নতুন মালিকে আমাগো হাল নামাতেই দেয় নাই ক্ষ্যাতে।
শুনে তো সবাই হতবাক। কী সর্বনাশ! কে বিক্রি করলো, কিভাবে বিক্রি হলো? মিয়ারা সম্পত্তি কেনে, তারা তো কখনো সম্পত্তি বিক্রি করে খাওয়ার লোক নয়, তবে? এই সব তথ্য উদ্ধার করতে গিয়ে জানা গেলো সব। বজ্রাহত প্রাণহীন বৃক্ষ যেমন কেবল দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু কোনো প্রাণশক্তি থাকে না, আমার আব্বার তখন সেই অবস্থা।
কী সব হৃদয় বিদারক সময় গেছে আব্বার-জীবনে তখন। সারারাত ঘুমাতে পারতেন না, কেবলই ছটফট করতেন, কখনো বারান্দার কাঠের ভারী খামে মাথা ঠুকতেন। আব্বার এত অস্থিরতা ও বিষণ্নতা আগে কখনো দেখিনি আমরা ছেলে মেয়েরা। আব্বার কষ্ট দেখে সইতে না পেরে একদিন আব্বাকে বললাম, আব্বা, আপনার নামের যেসব জমি বড় কাকার ছেলে সিরাজ ভাই খাচ্ছেন, আপনি না হয় সেগুলো বেচে দেন।
জবাবে তিনি বললেন, মা, তাতে তো সমাধান নেই। এতে আমার ছোট দুই ভাই আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর শোন মা, সম্পত্তি যে করে, সে তা বেচতে পারে না, তা রক্ষা করাই তার কাজ।
এই ঘটনার পরেও সিরাজ ভাইয়ের বাড়িতে এই বোন জামাই তামেজ উদ্দিন ও বোন হেনা যখন পুনরায় আসা-যাওয়া শুরু করলো, তাদের সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করতে দেখিনি সিরাজ ভাইকে। বরং আদর আপ্যায়ন করে তাদের বিদায় করেছেন। অসাধারণ, উদার চিত্তের মানুষ ছিলেন সিরাজ ভাই। যেকোনো মানুষকে ভালোবাসতে জানতেন, শ্রদ্ধাও করতেন বড়দের।
আমাদের বাবা-চাচাদের পরের আসনটিই ছিল সিরাজ ভাইয়ের জন্যে যেন নির্দিষ্ট। কিন্তু জাগতিক পদ-পদবি, সংসারের কর্তৃত্ব কিছুরই প্রত্যাশী ছিলেন না তিনি। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাটির আসন তলের মানুষ। না আসন, না মানুষ, সবকিছু অতিক্রম করে পঞ্চরিপুকে জলে পরিণত করেছিলেন এই ভাইটি আমাদের। অন্য এক জগতে বাস করতেন সতত। যেখানে ক্ষমাই পরম ধর্ম।
আসন তলের মাটির ‘পরে লুটিয়ে রব।
তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।
কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখো,
চির জনম এমন করে ভুলিয়ো নাকো,
তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব॥
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)চলবে…