ফকির আলতামাস ও ভিক্ষু সাহর নাথের কথা
বৈরামআলী থেকে ফকির আলতামাস এসে পৌঁছালেন গায়ুরকালা নামক স্থানে। নিশাপুরের পথ থেকে তিনি কিছুটা উল্টোদিকে চলে গেলেন। বৈরামআলী ও গায়ুরকালা উভয়ই প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপ ও সাধনস্থলের জন্য বিখ্যাত। ইসলামি শাসনব্যবস্থা ও সুফি প্রভাবে আগের সেই অবস্থা আর নেই তখন। কিন্তু তবু কিছু ভিক্ষু তখনো সেখানে বহাল ছিলেন শেষতম প্রদীপশিখারূপে। তারই একজন সাধু সাহরনাথ।
ফকির আলতামাসের পথসঙ্গী হিসেবে পাগল আশিক জুটলেন। বৈরামআলীর সেই নাটকীয় ও পরমালোকিত ঘটনার পর থেকেই আশিক তার সঙ্গ ছাড়লেন না। তারা দুজনই এসে উপনীত হলেন গায়ুরকালার বহু প্রাচীন একটি বৌদ্ধস্তূপের কাছে। কাছেই একটি শহর গড়ে উঠেছে নতুন করে। কাছাকাছি লোকালয় তেমন নেই বললেই চলে। ছোট ছোট টিলাময় ভূদৃশ্যের ভেতর হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটি দরগায়। কাছে গিয়ে জানা গেলো ওটি মালিক দীদারের সমাধি।
বেশ কয়েকটি পাহাড়ি গাছের নিচে দরগাটি। ভেতর থেকে রাবাব ও তার বাজিয়ে সেমা গাইছেন শিল্পীরা। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে দারুণ মজমা বসেছে। বাদ্য ও গীতির তালে বেশকিছু ফকির রকস্ করছেন। তারা ভেতরে ঢুকেই রকস্-এর ভাবনৃত্যে প্রবেশ করলেন এবং বিভোর হয়ে নাচতে লাগলেন। অভ্যাগত দুই মুসাফিরকে দেখে কিছুক্ষণ পর সেমা বন্ধ হয়ে গেল। একজন প্রশ্ন করলেন—হে আগন্তুকগণ! আপনারা কোথা হতে এসেছেন?
ফকির আলতামাস বললেন—আমরা এসেছি সেই বৃক্ষতল থেকে, যেখানে বাক্বা ছায়া ফেলে ফানারূপে।
দরগার একপাশে বসেছিলেন সাধু সাহরনাথ। একছুটে দৌড়ে এলেন আলতামাসের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তার পাশে অন্য ফকিররাও জড়ো হলো। কে আপনি? আপনার পরিচয়?
আমি কেউ নই, কেবল মার্ভ হতে নিশাপুরের দিকে নির্মাণাধীন একটি পথ। আমার সঙ্গী এই বাজপাখি ও পাগল মাস্তান আশিক।
আপনার নাম? আলতামাস বলে লোকে জানে। সাহরনাথ ফকির আলতামাসকে প্রণাম করে বললেন, আপনার কথা শুনেছিলাম আলপ্তগীনের কাছে। বহুদিন সে আমার সাথে কাটিয়েছিল। আজ আপনার দর্শন হলো, দয়াময় বুদ্ধ আপনাকে আজ দেখার সুযোগ করে দিলেন!
আমি এই মার্ভ অঞ্চলে একমাত্র ভিক্ষু, বাকিরা কিছুদিন আগেই চলে গেছেন। এখানে মিশে আছি ফকিরদের সঙ্গে। রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে আমাদের এখানে থাকা দায়, তবু আপনাদের আশীর্বাদে আজও রয়েছে এখানে। আমার বহুদিনের বাসনা আপনাকে দেখার, আজ তা পূর্ণ হলো। বহু কথাও জমে আছে। আমি সত্যিই আনন্দিত!
ফের বেজে উঠলো রাবাব ও তার, গাইতে লাগলো গান দরবেশি তারানায়। সবাই নেচে উঠলো, সাহরনাথ এসে যুক্ত হলেন ফকির আলতামাসের সঙ্গে, একসময় হাতে হাত ধরে সকলেই ঘুরতে লাগলেন; মাঝখানে দাঁড়িয়ে ফকির আলতামাস, দু’হাত উঁচিয়ে দুইদিকে প্রসারিত করে রেখেছেন, যেন একটি বৃক্ষ। আর সবাই তাকে ঘিরে নেচে উঠলেন। এমন সময় গানে গানে বলে উঠলো গায়ক:
কায়াগাছে ছায়া ঝরে, ঘিরে ঘিরে থাকে রে
ফানারূপে ডানা মেলে, বাক্বাপাখি দেখো রে।
সীমোরগ নয় সে তো, নয় নূর আরশের
ঝিরি ঝিরি ছায়া ঝরে, আলো ধরে বুকে সে।
রূপে যারা মজে যায়, অরূপে না পায় সে
কায়া ছেড়ে ছায়া হয়, দেখো আলতামাসে।
ফকির আলতামাসের একটি বিখ্যাত সুফিগান ওরা গাইতে লাগলো। মার্ভে এই গানটি অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে গীত হয় সেমা অনুষ্ঠানে। সাধু সাহরনাথ বললেন, এই গানটি আমি যতবারই শুনি ততবারই নির্বাণের আনন্দলাভ করি। আপনি বুদ্ধময় সত্তা। আজ আমার বুদ্ধ দর্শন হলো। বহুদিন ধরে আপনারই অপেক্ষায় ছিলাম। এখন আমি এখান থেকে চলে গেলেও আমার কোন আক্ষেপ রইবে না।
দরগায় সবার জন্য সামান্য সেবার ব্যবস্থা হলো। সেবা নিতে নিতে ফকির আলতামাস একটি খোরাসানি খেজুর তুলে সাহরনাথের হাতে দিয়ে বললেন, এর বিচিটি তুমি যেখানে গিয়ে স্থির হবে এরপর সেখানে রোপণ করবে। জল ঢালবে তাতে রোজ। দেখবে একটি বড় গাছে পরিণত হবে শিগগিরই ওটি। এবং এর তলে ঘর বাঁধবে। তোমার থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন। এখানেই হবে তোমার সমাধি। তোমার পরিনির্বাণের সেটিই হবে যোগ্যতম স্থান।
এতক্ষণ কথা বলার পর সাধু এবার থামলেন। তারপর তার অত্যন্ত প্রিয় কিছু শিষ্যকে বলতে লাগলেন, এই সাধু সাহরনাথ পরবর্তী সময়ে চলে আসেন সিংহলে। সেখানে তার সমাধি এখন মুসলিমদের কাছে বাবা খেজুরনাথ নামে খ্যাত। সেখানে যে উরস হয়, তা অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ এবং নানান ধর্মের মিলনমেলা হিসেবে অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছে। ভিক্ষু সাহরনাথ ওরফে বাবা খেজুরনাথ কৃপালাভ করেছিলেন দরবেশ আলতামাসের নিকট থেকে। এই কৃপা বড় আশ্চর্য জিনিস। তোমাদের সাধনজগতে যদি এই কৃপা না থাকে তবে তোমরা যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত থেকে যাবে তোমাদের বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা।
বস্তুত, সাধনজগৎটাই এক কৃপাভাণ্ডার। এখানে গুরু বা মুরশিদের কৃপা ছাড়া কোনো শিক্ষাই ফলপ্রসু হয়ে ওঠে না। আমার জীবনে আমি পেয়েছি এমন অসংখ্য মহাপুরুষের কৃপাবল, তোমরা জান না আমি হয়তো নিজগুণে সাধনমার্গে এতটুকু উন্নতি করতে পারতাম না যদি এই কৃপাবল না থাকতো। আজ তোমরা আমায় গুরুরূপে ধারণ করছো। কিন্তু আমি জানি এ কেমন বন্ধন! আমি আশা রাখি এই বন্ধনকেও একদিন পার হয়ে যাবো মুক্তির পথে, যদি কৃপা আমাকে সে পথে অবিচল আস্থাবান রাখে।
ফকির আলতামাস হলেন সেই কৃপাময় সত্তা, যার কোনো কিছুতেই কোনো বন্ধন নেই, আবার ভয়ও নেই। তিনি এতটাই সহজ মানুষ, যাকে লালন ফকিরের কথায় ভজে দেখতে হয় এবং এই দেখা হতে মেলে দিব্যজ্ঞান। ফকির লালন বলছেন, সেই সহজ মানুষকে ভজনা করতে, সে ভজনায় মিলবে দিব্যজ্ঞান; এরপর তুমি কেবল ভজনাই করতে থাকবে, তোমার ভজনা থামবে না। তুমি সাধারণ ভজনাকারী হতে দিব্যজ্ঞানী ভজনকররূপে পরিণত হবে। এই দিব্যপথ দীর্ঘ, কৃপালাভের মাধ্যমে যার পরিণতি ঘটে।
সাধনজগৎও একটি আমিত্বপূর্ণ জগতে পরিণত হয়, যদি তুমি তা কেবল অর্জনের পথ বলে মনে করো; কিন্তু এই পথ বর্জনেরও, মূলত অধ্যাত্মজগত বর্জনেরই পথ, কারণ, আমরা এতকিছু অর্জন করে বসে আছি স্তরে স্তরে পাললিক শিলার মতো যে তা শত আঘাতেও ভাঙতে চায় না। তাই বর্জনের ধারায় কঠিন বজ্রাঘাতে চিত্তকে নাশ করতে না জানলে পথ কঠিন, আর এই কঠিনতম পথটিকেই গুরু বা মহাপুরুষের কৃপালাভে সহজ করে নিতে হয়। ভিক্ষু সাহরনাথ তেমনি নিয়েছিলেন, সাহরনাথের সমাধি বা দরগাতে এখন তবারক হিসেবে প্রদান করা হয় খেজুরদানা। দরগায় বহুদিনের ঐতিহ্যবাহী রীতি হলো, খেজুরের বিচি আলাদা করে সে খেজুর দিয়ে প্রতিদিনের প্রসাদ বা শিরনি রান্না হয় আর বিচিগুলি মানুষজন অত্যন্ত পবিত্রজ্ঞান করে নিয়ে যান ঘরে।
একজন সাধকের জীবনটি হলো আসলে খেজুরদানার মতো। সকল সুষমাকে সে যখন প্রসাদরূপে মানুষের জন্য ব্যায় করবে তখন সে কেবল বিচির মতোই পড়ে রইবে, একটি পূর্ণ এবং প্রকৃত সত্তা, চিত্তবৃত্তির প্রলেপহীন ও নিরাভরণ–মুক্ত। এই বীজের মর্মটি যে বুঝতে পারে তার কাছে প্রসাদ হিসেবে এটি অসাধারণ, সে তার স্বীয় অন্তঃকরণেই তা রোপণ করবে।
চলবে…