কথাসাহিত্যে কল্পনার স্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ততটুকু, যতটুকু কাউকে যৌক্তিকভাবে স্বপ্নবান করে। সঙ্গে অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, প্রজ্ঞার সংযোগও থাকতে হয়। এই অনুষঙ্গগুলোর যথাযথ ব্যবহারেই সফল হয়ে ওঠে শিল্পকর্ম। আর এসবের বহুমুখী প্রয়োগের বড় মাধ্যম হলো উপন্যাস। কারণ এতে একইসঙ্গে থাকে কাহিনি, কবিতা ও গান। থাকে চিত্রকলার বর্ণনা, নাটকের আবহ—ধর্ম-দর্শনও। বাদ যায় না রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি। অভিজ্ঞতা-কল্পনার সঙ্গে চিন্তার সুসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োগ ঘটিয়ে যারা উপন্যাস রচনা করেছেন, তাদের একজন আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯)। ব্যক্তির চিন্তাসূত্রকে গভীরতর ব্যাঞ্জনায় প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর উপন্যাস তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০) বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
শিল্পকর্ম—সবসময় সরাসরি সমাজের প্রতিচ্ছবি হয় না। যদিও এর স্রষ্টার বাস কোনো না কোনো সমাজেই। শিল্পের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক থাকা বা না-থাকার নেপথ্যে কাজ করে তার রুচি ও অভিজ্ঞতা। শিল্পীর মানসগড়ন ও সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্কের ধরনও শিল্পকর্মের ওপর গভীর রেখাপাত করে। কথাশিল্পীর স্ব-স্ব সমাজ থেকে পাওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তার কাজের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া সহপাঠী ও বন্ধুসাহচর্যের একটা বিশেষ প্রভাব পড়ে শিল্পকর্মে। একইসঙ্গে বঞ্চনা-নিপীড়ন, মানসগড়ন ও চিন্তা-কল্পনাকে প্রভাবিত করে। তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসের শুরুতে বিষয়টি তুলে ধরেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ।
আমার তিন বন্ধু, তিনজনেই গুণী ছেলে, আর্ট স্কুলের কৃতী ছাত্র ছিল, বিদেশ ঘুরে এসেছে। চিত্রকলার তীর্থভ‚মি ফ্রান্স, ইতালী, ইংল্যান্ডের গ্যালারী রেস্তোরাঁ গলিঘুজি ওদের নখদর্পণে, কোনো প্রসঙ্গে কথা উঠলেই চিৎকার করে ওঠে একশবার।১
এই বন্ধুসাহচর্য শিল্পীর জীবন ও সৃষ্টিকর্মে গভীর রেখাপাত করে দুই উপায়ে। প্রথমত, বন্ধুরা যেভাবে চিন্তা করে, কল্পনা করে, সেভাবে শিল্পীও করে। দ্বিতীয়ত, বন্ধুরা যা ভাবে, শিল্পী তার বিপরীত কিংবা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের কল্পনায় আচ্ছন্ন হয়। এ কারণে একশ্রেণির শিল্পীর কাজে তার বন্ধুদের প্রভাব প্রচ্ছন্নভাবে হলেও থাকে, অন্যশ্রেণির কাজে বন্ধুদের কোনো প্রভাব পড়ে না। তারা সত্যিকার অর্থেই ‘সকল লোকের মাঝে বসে’ থেকেও ‘নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা’২ হয়ে যায়। বিষয়টি অনেকটা এমন যে, তারা দশের মধ্যে এক হয় না, ‘দশের মধ্যে এগারো’৩ হয়।
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসের নায়ক-কথক জাহেদও তেমন। কথক তার তিনবন্ধুর সঙ্গে চলাফেরা করেও তাদের চেয়ে ভিন্ন, স্বতন্ত্র। তাই প্রদর্শনীতে অন্যরা কল্পনার প্রাচুর্যপূর্ণ ছবি আনলেও, জাহেদ এনেছে জীবনঘনিষ্ঠ ছবি। একেবারেই স্ত্রী ছবি ও সন্তান টুলটুলকে নিয়ে আঁকা চিত্রকর্ম। নাম দিয়েছে ‘মাদার আর্থ, বসুন্ধরা’। ক্যাটালগভুক্ত হলো ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ হিসেবে। এই ছবিটিই প্রদর্শনীতে প্রথম হয়েছে। প্রশংসিত হয়েছে। দামও মিলেছে প্রচুর। বন্ধুরা তাই যখন পুরস্কারজয়ের জন্য ট্রিট চাইলো, শিল্পী তাদের না করতে পারলো না। গেলো সঙ্গে। সেখানে শিল্প-সমঝদারদের সঙ্গে তার দেখা ও পরিচয়। নতুন জগতে প্রবেশ করলো শিল্পী। সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মনে পড়ে গেলো ছবিটি আঁকার পটভূমিও। ছবি আঁকার নেপথ্যের রহস্যের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেলো চিত্রকর্মটির বিষয় স্ত্রী ছবি, ছবির ভাই জামিলের সঙ্গে পরিচয়পর্বের ঘটনাও।
ছবির ভাই জামিলও একজন শিল্পী। তার সঙ্গে জাহেদের পরিচয় রঙের দোকানে। সেখান থেকে কাজের অফার দিয়ে জাহেদকে নিজের স্টুডিওতে নিয়ে যায় জামিল। সেখানে পরিচয় ঘটে ছবির সঙ্গে। সেই পরিচয় তাদের নিয়ে যায় পরিণয়ের দিকে। একসময় ছবির পোট্রেট আঁকতে যায় জাহিদ। এরই মধ্য দিয়ে দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। কিন্তু বিষয়টি মেনে নিতে পারে না জামিল। সে রুষ্ট হয়ে হাত তোলে জাহেদের ওপর। এরপর নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই সময় অভিমানে দূরে চলে যাওয়া জামিলের স্ত্রী মীরাও ছুটে আসে। শেষ হয় তাদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি পর্ব। শুরু হয় নতুন জীবন।
বরং সেখানে ক্ষমাই শ্রেয়। এর ওপর প্রেমই পারে উভয়পক্ষের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সেতু তৈরি করতে। সেই সেতুতে জীবনের সমস্ত ভারবাহী বাহন টেনে নেওয়াও প্রেমিকহৃদয়ের জন্য কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।
শরতের একদিনে মীরার মধ্যস্থতায় জাহেদ-ছবির বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবনের প্রথম রাতেই ঘটে বড় ধরনের ঘটনা। জাহেদ বুঝতে পারে ছবির দেহে স্পষ্ট মাতৃত্বের চিহ্ন। বিষয়টিকে শুরুতে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। এভাবে কেটে যায় বেশকিছু দিন। একসময় বিষয়টি নিয়ে ছবির মুখোমুখি হয়। বলে, ‘কেন ধোঁকা দিলে?’ ছবিও কোনো রকম ভনিতা না করেই অতীতের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার বর্ণনা দেয়। ছবি জানায়, জামিলের কাছে এসেছিল এক ব্যবসায়ী। সে সুযোগ বুঝে ছবিকে ধর্ষণ করে পালায়। এতে ছবি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তবে, পরে গর্ভপাতের মাধ্যমে ওই ভ্রূণ নষ্ট করে ফেলা হয়। কিন্তু ছবির গর্ভে যেহেতু বাচ্চা এসেছিল, সেহেতু শিশুর কান্না শুনলেই তার বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। এসময় ছবি এ-ও বলে, জাহিদই তার জীবনের প্রথম প্রেম। একমাত্র প্রেম। জাহেদও বুঝতে পারে, নিছক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ছবির দেহে মাতৃত্বের দাগ পড়েছে। সেখানে ছবি ছিল নিতান্তই অসহায়। সার্বিক দিক বিবেচনা করে ছবির ওই দুর্ঘটনার কথা উপেক্ষা করে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করে জাহেদ।
বছর ঘুরতেই জাহেদ-ছবির কোলজুড়ে আসে ছেলে সন্তান। তারা সন্তানের নাম রাখে টুলটুল। কিছু দিন পর ছবি-টুলটুলকে নিয়ে একটি ছবি আঁকে জাহেদ। এই প্রসঙ্গে জাহেদের বর্ণনা উল্লেখযোগ্য।
‘হ্যাঁ ছবি ঘুমুচ্ছে তার কোলের কাছে টুলটুল। হাওয়া আর চাঁদ যেন মিতালি পাতিয়েছে। একজন জানালার পর্দা উঠিয়ে ধরে অন্যজন বুলিয়ে যায় মায়াবী হাতের ছোঁয়া আশ্চর্য সুন্দর। মা ও শিশু এই তো বসুন্ধরা, দুঃখে দুর্ভিক্ষে দারিদ্র্যে ছিন্নভিন্ন কিন্তু তবু মরে না; তার স্নিগ্ধ শান্ত চোখের চাওয়ায় যুদ্ধে শিবির ভেঙে পড়ে। তার খুশির হাতছানিতে দোলে ধান গম ভুট্টার ক্ষেত সোনালি খামার নদীর তরঙ্গধারা।
আমি তন্ময় হয়ে দেখছি, এমন পবিত্র দৃশ্য ওর কপালে একটু চুমু খেতেও সাহস হলো না।
(…) অনাগতকালে আমিও থাকব না, ছবিও থাকবে না থাকবে না টুলটুলও। হয়তো থাকবে শুধু এই ছবি যার নাম মাদার আর্থ, বসুন্ধরা, ক্যাটালগে তালিকাবদ্ধ তেইশ নম্বর তৈলচৈত্র।৪
আর ওই ছবি পাকিস্তানের ‘জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী’তে প্রথম পুরস্কার অর্জন করে। জাহেদ তার পুরস্কারজয়ী ছবি, বসুন্ধরার জন্মবৃত্তান্ত বলতেই গিয়ে শিল্পী জামিল, তার বোন ছবি, ছবির সঙ্গে নিজের বিয়ে, বন্ধু মুজতবার সঙ্গে পতিতালয়ে যাওয়া, পাহাড়ি এলাকায় মগকন্যা তিনার সঙ্গে মুজতবার ব্যর্থ প্রেমের প্রসঙ্গও তুলে ধরেছেন। এরপর পাকিস্তান থেকে পুরস্কার নিয়ে বিমানে পুনরায় ঢাকায় ফিরে ছবি ও টুলটুলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি শেষ করেছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ।
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসে শিল্পীর মনস্তত্ত¡, শিল্পের দরজা-জানালার বিশেষ দিক ফুটে উঠেছে। সঙ্গে একটি বিশেষ সময়ের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, বিশেষত শিল্পীর জীবনের দারিদ্র্য, প্রেম-বিরহ, মিলন-বিচ্ছেদ, সুখ-দুঃখ, দাম্পত্য সংকটেরও বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। উপন্যাসটিতে যে বিষয়গুলোর প্রাধান্য রয়েছে সেগুলো হলো:
ক. শিল্পীর জীবন-যাপন, চিন্তা ও কল্পনাবিশ্ব
খ. প্রেম-বিয়ে, মিলন-বিরহ
গ. শিল্পরুচি বনাম গোয়ার্তুমি
ঘ. যৌন বিকৃতি, প্রতারণা ও উদারতা
ঙ. অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক স্তরবিন্যাস
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসের প্রধান অনুষঙ্গ শিল্পীর জীবন-যাপন, চিন্তা ও কল্পনাবিশ্ব। মানুষ নিজেকে শিল্পের স্রষ্টা হিসেবে প্রমাণ করার পাশাপাশি হয়ে উঠেছে সমঝদারও। স্রষ্টা মানুষ দেখেছে, মানুষই মানুষকে শাসন করে, শোষণ করে, অত্যাচার করে। যুগের পর যুগ মানুষই মানুষকে দাস-ক্রীতদাস বানিয়ে রাখে। বাইরে থেকে কোনো শক্তি এসে মানবজাতিকে শাসন করে না, শোষণও না। এমনকী কোনো প্রাণী কিংবা শক্তি এসে মানবজাতিকে কোনো রকম সহযোগিতাও কখনো করে না। মানুষই মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা। এমনকী মৃত্যুদণ্ডদাতাও।
উপন্যাসের শুরুতেই আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, শোষণ-চিন্তা-কল্পনার প্রসঙ্গ টেনেছেন লেখক। জাহেদের জোবেদা খালা তার প্রথম স্বামীকে ছেড়ে এসে ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেছেন। সেই জোবেদা খালার প্রথম স্বামী আহাদ পরে পাগল হয়ে গেছেন, একসময় মারাও গেছেন। সেই স্বামীর প্রসঙ্গ তুলতেই জোবেদা খালা এতকাল পর মূর্ছা গেলেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন লেখক, ‘প্রথম যৌবনের সেই একজন সত্যই কি ছিল তার প্রেমপাত্র? যদি ছিল তবে কেন বেছে নিলেন অন্যপথ?’৫ এরপর জাহেদ বলছে, ‘নিজের ঊর্ধ্বে উঠতে পারাটাই শিল্পী ব্যক্তিত্বেও সর্বপ্রথম অঙ্গীকার। এবং সে আমারও লক্ষ্য।’৬ নিকট আত্মীয়ের প্রেম, বিয়ে, সংসার, প্রতারণা, সংসার ভাঙার প্রসঙ্গ টেনে নিজের শিল্পসত্তা ও ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গ টেনে জাহেদ একজন শিল্পীর জীবন-যাপনের যে পরিচয় দিয়েছে, তাকে রুচিশীল-স্নিগ্ধ রূপ না বলার মতো কোনো কারণ নেই। একইসঙ্গে এ-ও বলতে হয়, এমন উপলব্ধির মাধ্যমে শিল্পের প্রতি লেখকের দায়বোধ ও শিল্পীর জীবনশৈলীর রুচিস্নিগ্ধতা, চিন্তার আভিজাত্য ও কল্পনার প্রাচুর্য প্রকাশে জাহেদকে পরিশীলিত করে তোলে।
জামিলের সঙ্গে পরিচয় থেকে শুরু করে তার বোন ছবির প্রতি অনুরক্ত হওয়া, বন্ধু মুজতবা, পতিতালয়, নিজের বিয়ে—এসব বিষয়ে জাহেদকে সুচিন্তিত, গভীর প্রজ্ঞার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। কখনো কখনো মনে হয়, জাহেদ চরিত্রে পুতপবিত্রতা ও ঔদার্যকে চাপিয়ে দিয়েছেন লেখক। আরোপ করেছেন দেবত্বও। এ কারণে বন্ধু মুজতবার সঙ্গে পতিতালয়ে গিয়েও সে থাকে নিরাসক্ত, শরীরের প্রতি তার মোহ থাকে না। আবার স্ত্রী ছবির বিবাহপূর্ব মাতৃত্বচিহ্নের কারণ জানার পরও স্ত্রীর প্রতি ঘৃণা দেখা যায় না। উল্টো ক্ষমার মহত্ত দেখায়। ভালোবাসার বিশালতার প্রমাণ দেয়। এতে জাহেদকে স্বাভাবিক দশজনের মতো মনে হয় না। মনে হয় জাহেদ ‘দশের মধ্যে এগারো’। তাই সে দশজনের মতো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, উল্টো উদারতা দেখায়।
যদিও ভেতরে অনেক ক্ষোভ সঞ্চিত হয়েছে তবু অনেকক্ষণ একা একা বারান্দায় পায়চারী করতে করতে এটুকু বুঝলাম, ছবির ঘটনাটাকে বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে বিচার না করলে আমি ভুল করতে পারি। আর সে ভুলের ফল হবে মারাত্মক। আমার অতিরিক্ত ভাবালুতার মানেই হবে ওর দুঃখ এবং দুঃখের ভার বেশি হলে একটু কাণ্ডও করে বসতে পারে।
এটাই সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমি সামান্য আঘাত করলেই এখন সে মুষড়ে পড়বে এবং তাতে আমার মনের ঝাল মিটবে কিন্তু ঐটুকুই আর কোনো লাভ নেই। অপর পক্ষে ইচ্ছে করলে আমি এখন ওকে আরো মঞ্জরিত করে তুলতে পারি, করতে পারি আরও সার্থক ও সুন্দর। তার জন্য প্রয়োজন প্রেম এবং ক্ষমা।৭
জীবনজিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে এখানে বড় দর্শন প্রকাশ করেছেন লেখক। জাহেদকে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে ঘটনায় ব্যক্তির দোষ নেই, সে ঘটনার জন্য দায়ী তো করা যায়-ই না, দেওয়া যায় না শাস্তিও। বরং সেখানে ক্ষমাই শ্রেয়। এর ওপর প্রেমই পারে উভয়পক্ষের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সেতু তৈরি করতে। সেই সেতুতে জীবনের সমস্ত ভারবাহী বাহন টেনে নেওয়াও প্রেমিকহৃদয়ের জন্য কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।
কারণ এখানে একজনের প্রেম ও জীবন সংগ্রামের উপাখ্যান বর্ণিত হলেও রচনার গুণে সেই একজনই হয়ে উঠেছে সংবেদনশীল-পরিশ্রমী-প্রেমিক হৃদয়ের হাজার জনের প্রতিমূর্তি।
আরেকদিক থেকে দেখলে ছবির উদারতাও উল্লেখযোগ্য। ছবির মাতৃত্বচিহ্ন গোপনেই দেখে জাহেদ। মধ্যরাতে ছবির বস্ত্র সরিয়ে তার শরীর দেখে জাহেদ। কিন্তু টের পেলেও ছবি ক্ষেপে যায় না। এই দৃশ্যটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মহামায়া’ গল্পের মিল রয়েছে। ‘মহামায়া’য় শর্তভঙ্গ করায় মহামায়া তার নায়ক-প্রেমিক-স্বামী রাজীব লোচনকে ছেড়ে চলে যায়। সেখানে প্রেমের চেয়ে নিজের প্রতিজ্ঞা-শর্তকে বড় করে দেখানো হয়েছে, কিন্তু তেইশ নম্বর তৈলচিত্রে শর্তের চেয়ে প্রেমকেই শিরোধার্য মানা হয়েছে। ‘মহামায়া’য় মহামায়া আত্মসম্মানবোধের জোরে জেদি, অভিমানী; ছবি প্রেমিক-স্বামীর প্রতি সমর্পিত, স্বামীর অস্তিত্বের সঙ্গে লীন। তাই সে পালায় না, এমনকী রাগও করে না। এখানেই ছবির সঙ্গে মহামায়ার পার্থক্য। মহামায়া যেখানে নিজের জিদের কাছে সমর্পিত, ছবি সেখানে জাহেদের প্রেমে মগ্ন-আচ্ছন্ন।
এ তো গেলো জাহেদ-ছবির চিন্তা-কল্পনা-জীবনদর্শন প্রসঙ্গ। জামিলের রুচি-ব্যক্তিত্ব জাহেদের চেয়ে ভিন্ন। জামিলও জাহেদের মতোই ভালোবেসে বিয়ে করেছিল মীরাকে। দুটি সন্তান জন্মের পর তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়। একসময় দুজন আলাদা বসবাস করতে থাকে। ওই পরিস্থিতিতে জামিলের শিল্পদর্শন-জীবনদর্শন প্রেমবিমুখ হয়ে ওঠে। তাই বোন ছবির প্রতি জাহেদকে অনুরক্ত দেখে সে ক্ষেপে ওঠে। জাহেদের উদ্দেশে বলে,
তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করো না। জীবনকে গড়ে তোলা সত্যি কঠিন কাজ। বিশেষ করে, শিল্পীর জীবন। শিল্পীর জীবনে প্রেম দরকার, কিন্তু তাতে জড়িয়ে পড়লে চলবে না। অথচ আমরা জড়িয়ে যাই। ফলে নৈরাশ্য এবং ব্যর্থতা। দৃষ্টান্ত আমার জীবন। কিছুই করতে পারতাম না এই আমি মনে করিনে, কিন্তু একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম বলেই সখাদ সলিলে ডুবে গেছি। শিল্পী জামিলের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই, এখন আছে শুধু তার প্রেতাত্মা।৮
জামিলের এই বক্তব্যের ভেতর দিয়ে প্রেমের যে রূপ ফুঠে ওঠে, তা পরিপূর্ণ নয়। তাতে ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার প্রকাশ পায়, প্রেমিকার প্রতি দায় ও ভালোবাসার স্বীকৃতি মেলে না। কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থেই, নিজের ক্যারিয়ার গঠনের স্বার্থেই প্রেম চলবে, স্বার্থ ফুরালে প্রেয়সীকে ছুড়ে ফেলতে হবে, এমন দর্শন আর যাই হোক শিল্পীর হতে পারে না। জামিলের ক্যারিয়ারভিত্তিক স্বপ্ন তাকে মানববিচ্ছিন্ন শিল্পীর দিকে ঠেলে দেয়। যদি পরবর্তী সময়ে শিল্পীর ছন্নছাড়া জীবনকে অস্বীকার করে নারী-সংসারকেন্দ্রিক জীবনকেই জামিল স্বাগত জানিয়েছে, গ্রহণ করেছে।
এই দুই শিল্পীর বাইরে তাদের বন্ধু মুজতবার জীবনদর্শন, চিন্তা, কল্পনার পুরোটাজুড়ে রয়েছে ভোগবাদ। সে ভোগী। তাই পতিতালয়ে যায়। নারীর শরীর ভোগ করে, কিন্তু সেই শরীরের প্রতি তার মায়া জন্মায় না। চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় মগকন্যা তিনাকেও ভোগ করে ফেলে রেখে পালানোর মধ্য দিয়ে মুজতবা চরিত্রের ভোগবাদিতা-নিষ্ঠুরতা প্রকাশিত হয়েছে।
এই তিন চরিত্রের মনস্তত্ত¡ বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়, শিল্পী কেবল মানবতাবাদীই হয় না, কেউ কেউ স্বার্থপর-আত্মপরও হয়। আবার কেউ কেউ অতি উদারও হতে পারে।
এই উপন্যাসের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো প্রেম-বিয়ে, মিলন-বিরহ। উপন্যাসটিতে চার জোড়া নর-নারীর প্রেম প্রসঙ্গ এসেছে। এক. জামিল-মীরা, দুই. জাহেদ-ছবি, তিন. জোবেদা খালা-আহাদ, চার. মুজতবা-তিনা। এরমধ্যে জামিল ও মীরার প্রেম-বিয়ের পর কিছু দিন বিরহ। এরপর আবার জাহেদ-ছবির কল্যাণে মিলনে রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত প্রেম-মিলনেরই জয় হয়। জোবেদা খালা ভালোবেসে প্রথমে বিয়ে করেছিলেন আহাদকে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বড় ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে আহাদকে ছেড়ে চলে যান। আহাদ সেই শোক সামলাতে না পেরে প্রথমে পাগল হয়ে যায়, পরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মুজতবা পাহাড়ি অঞ্চলের মগকন্যা তিনার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে। ভোগ শেষে প্রতারণা। পালিয়ে যায় মুজতবা। এরপর সে নিয়মিত পতিতালয়ে যায়, সেখানে রাধারাণীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। তবে শরীর পর্যন্তই। মন সেখানে গৌণ; এমনকী কেউ কারও মনের হদিসই পায় না। উপরন্তু জাহেদকেও রাধারাণীর কাছে নিয়ে যায় মুজতবা। কিন্তু জাহেদ চরিত্র এতটাই কাঠিন্যে ভরা যে, লেখক তাকে ভোগের দিকে কিংবা সাময়িক পুলকের দিকে প্ররোচিত হতে দেননি।
বাকি থাকলো জাহেদ-ছবি যুগলের প্রেমপ্রসঙ্গ। এই জুটির পরিচয়, পরিণয় ধীরগতিতে। সংযমের। পরস্পরকে বোঝাপড়ার, সম্মানের। মূলত পুরো উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে এই জুটিকে কেন্দ্র করেই। প্রধান চরিত্রও এই দুটি।
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও মর্মান্তিক একইসঙ্গে মহত্বের দিক হলো একাধারে যৌনবিকৃতি, প্রতারণা ও উদারতা। জামিলের কাছে আসা ব্যবসায়ী ছবিকে ধর্ষণের মাধ্যমে যে যৌনবিকৃতির পরিচয় দেয়, সেটি কেবল ঘৃণার নয়, মানবতার জন্যও ভয়াবহ। এদিকে, প্রেমের অভিনয় করে মগকন্যা তিনার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েও তাকে রেখে পালিয়ে গিয়ে আরেক কলঙ্কের অধ্যায় রচনা করে মুজতবা। শুধু তিনাই নয়, রাধারাণীর সঙ্গেও যৌনসম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে মুজতবা। অবশ্যই রাধারাণী পতিতা হওয়ায় এই সম্পর্কেও কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। তাই এখানে যৌনবিকৃতির প্রসঙ্গ তুললেও প্রতারণার অভিযোগ তোলা যায় না। অর্থাৎ তিনার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করেও তাকে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়ে প্রতারণা করে মুজতবা, কিন্তু রাধার কাছ থেকে পালানোর কোনো ঘটনা নেই। কিন্তু বিকৃতি আছে, বহুগামিতা আছে। কারণ সে নিজেই রাধার কাছে যেমন যায়, তেমনি নিতে চায় জাহেদকেও। সে নিজে বহুগামী, অন্যকেও সেই পথে নামাতে চায়। কিন্তু জাহেদ চরিত্রে একধরনের দার্ঢ্য ও ছবির প্রেমে একনিষ্ঠতার প্রশ্নে অনেকটাই ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার মতো’ দৃঢ় মনোভাব থাকায় তাকে বহুগামিতার পথে নিতে পারে না মুজতবা।
এদিকে, ব্যবসায়ীর ধর্ষণের ঘটনা জানার পরও আক্রান্ত ছবির প্রতি ভালোবাসার কমতি রাখে না জাহেদ। পরন্তু তাকে ভালোবাসা ও ক্ষমার আভরণে ঢেকে দেয়। আবার ছবিও তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কোনো লুকোচুরি কিংবা মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয় না। ফলে দুজনের মধ্যে হৃদয়ের লেনদেনে কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি হয় না। বিশ্বাস-আস্থা-ভরসার জায়গাও চিড় ধরে না। এখানে আস্থা-ভরসা-উদারতার ভেতর দিয়ে প্রেমের জয়গাথা রচিত হয়।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক স্তরবিন্যাস এই উপন্যাসকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তবে, এই অনুষঙ্গ পুরো ক্যানভাসের তুলনায় কম পরিমাণে দেখা যায়। কারণ উপন্যাসে মূলত প্রথমত প্রেমকে মহৎ করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তারও বেশি বড় করে দেখানো হয়েছে কথক চরিত্রের মহত্ত, উদারতা ও ক্ষমার ঔদার্যকে। এখানে দেখানো হয়েছে, মানবসমাজের মধ্যে শিল্পীরা যেহেতু সবচেয়ে সংবেদনশীল সম্প্রদায়, সেহেতু তারা যেকোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সবার আগে প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু এই প্রতিবাদ জানানোর পথ খুব মসৃণ নয়। আবার সবসময় সরবও নয়। তাই শিল্পীরা মানবসমাজের প্রধান শত্রু হিসেবে আবিষ্কার করে শাসকশ্রেণিকে। এরপর অসৎ ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের। যে শাসক শ্রেণি ও পুঁজিপতিরা সমাজে দৃশ্য-অদৃশ্য বিভিন্ন দেয়াল তৈরি করে, মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে রাখে। বিষয়টি অবশ্যই সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে শাসকশ্রেণির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষেও পাশাপাশি শিল্পীরাও উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু রূঢ়সত্য উপলব্ধি করা যত সহজ, সে দেয়াল ভেঙে ফেলা তত সহজ নয়। তবে, যতই কঠিন হোক, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যেমন রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যায়, তেমনি শিল্পীরাও নিজ নিজ অঞ্চলে সমকালীন মানবশত্রুর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। কখনো সরবে, কখনো নীরবে। এই প্রক্রিয়া সবকালেই প্রায় সমানভাবে সত্য।
এই উপন্যাসের প্রায় শুরুতেই দেখা যায়, শিল্পী জামিল তার স্টুডিওতে নিয়ে যায় জাহেদকে। নতুন অতিথিকে চা খাওয়াতে চাইলেও পারে না। কারণ ঘরে চা পাতা নেই। এমনকী খাবারের মতোও কিছু নেই। শিল্পী জীবন দারিদ্র্যের জীবন, সংগ্রামের জীবন। বিষয়টি নিয়ে জামিল বিব্রত হয় না। বরং সরল স্বীকারোক্তি করে, ‘আমাদের সম্বন্ধে কি ভাববে তুমি, তাই ভেবে আমার হাসি পেল। এই প্রথম দেখা, অথচ কি অদ্ভ‚ত অভিজ্ঞতা!’৯ এরপর জাহেদ চাল-ডাল-তেল-নুন কিনতে বাজারে উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। এখানে দারিদ্র্য, দয়া, সামাজিক স্তরবিন্যাস নিয়ে জাহেদকে স্বগতোক্তি করতে দেখা যায়।
দারিদ্র্যকে ঘৃণা করি কিন্তু অন্যের দারিদ্র্য মোচনের ক্ষমতাও নেই। এক পয়সা দু’পয়সা সাহায্য দিয়ে সে অসম্ভবও বটে। সমাজের কাঠামোটাকেই পাল্টে দিয়ে দারিদ্র্যের অবসান ঘটানোই আমার সংকল্প। সে জন্য ভিক্ষে কখনো দিইনি। ভিক্ষুককে কিছু দেয়ার মানে ভিক্ষাবৃত্তিরই পোষণ এবং ভিক্ষুকের জাতি দুনিয়ার বুকে টিকে থাকতে পারবে না। কিন্তু এখানে সে ব্যাপার নয়। অবস্থাটা এত স্পষ্ট ছলনার প্রয়াসটুকু পর্যন্ত অনুপস্থিত। (. ..) ছবির মুখটা গভীর করুণ এখানে কোথায় ছলনার চিহ্ন? ১০
জাহেদের স্বগতোক্তির ভেতর দিয়ে লেখক এখানে দেখিয়েছেন, অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিকচক্রের মধ্যে সাম্য-অসাম্য—এই দুটি বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হয়। এক্ষেত্রে সাম্য বজায় থাকলে বিষয়টি নিয়ে তেমন চর্চা করা হয় না। তবে অসাম্য থাকলে তার বিরুদ্ধে শিল্পীকে সোচ্চার হয়ে উঠতে দেখা যায়। এই বিবেচনায় কেউ কেউ হয়তো শিল্পীকে শাসক-পুঁজিবিরোধী ভ‚মিকায়ই দেখতে পান কিন্তু এমন অভিযোগ সবসময় সত্য নয়। কারণ, অতীতে বহু শিল্পীকে দেখা গেছে রাজা বা শাসকের প্রশংসা করে কাব্যরচনা করতে। বহু চিত্রশিল্পীও ছবি এঁকেছেন রাজা-বাদশাহদের অনুরোধে-নির্দেশে। কখনো কখনো স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও। আর এসব ক্ষেত্রে শাসকের কাছ থেকে তারা পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন রাজ-দরবারে চাকরি কিংবা মোটা অঙ্কের মাসোহারা।
তেইশ নম্বর তৈলচিত্র-এর কাহিনি একরৈখিক, মোচড়হীন ও একহারা। তবে, একঘেয়ে নয়। বহুমানুষ অধ্যুষিত জনপদের কোনো জটিল জীবনাল্লেখ্য এখানে নেই। এখানে মূলত কথক শিল্পী জাহেদ ও ছবি দম্পতির পরিচয়, প্রণয় নিয়ে একটি নিটোল গল্প বোনা হয়েছে। প্রসঙ্গ ক্রমে এসেছে ছবির ভাই জামিল, জাহেদের বন্ধু মুজতবা, মুজতবার প্রেমিকা রাধারাণী ও তার আরেক প্রেমিকা মগকন্যা তিনার কথাও। এসবই শাখা অনুষঙ্গ। আর এসবের ব্যাপ্তি উপন্যাসে সামান্যই। ফলে কেউ কেউ এই উপন্যাসকে বড় আকারের ছোটগল্প বলেও চালিয়ে দিতে চাইবেন। তবে, সেই ধারণা শতভাগ ভুল হতে বাধ্য। কারণ এটি মোটেও বড় আকারের ছোটগল্প নয়। কারণ এখানে একজনের প্রেম ও জীবন সংগ্রামের উপাখ্যান বর্ণিত হলেও রচনার গুণে সেই একজনই হয়ে উঠেছে সংবেদনশীল-পরিশ্রমী-প্রেমিক হৃদয়ের হাজার জনের প্রতিমূর্তি।
এখানেই শিল্পীর চিন্তাসূত্র দ্রোহে রূপ নিয়েছে, মোড় নিয়েছে বিপ্লবে। এভাবে শিল্পের জানালাকেও একরৈখিক দৃষ্টি দিয়ে বহুরৈখিক করে তোলার একটি সফল পদক্ষেপও দিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। আর ঔপন্যাসিক হিসেবে এখানেই তার সাফল্য, এখানেই তার বিশেষত্ব-স্বাতন্ত্র্য; ঔজ্জ্বল্যও।
একজন চিত্রশিল্পীর প্রেমকাহিনীকে ঘিরে উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে। উপন্যাসের নায়ক শিল্পী জাহেদ আমাদের জীবনের বৃহত্তর সামাজিক পটভ‚মিকায় চিত্রিত হয়নি; চিত্রিত হয়েছে তার ব্যক্তিজীবনের রহস্যময় দ্বীপের বিচিত্র অভিজ্ঞতার পটে। উপন্যাসে মানবজীবনকে যে এশটি বৃহৎ-বিশাল-মহিমান্বিত পটে স্থাপন করে বিস্ময় উৎপাদন করা হয়, এখানে তা করা হয়নি; ছোটগল্পের জীবনবৃত্তে কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। তবে, ব্যক্তিজীবনের উচ্চতা, তীব্রতা, তীক্ষ্ণতা, গভীরতা এই রচনার প্রাণকেন্দ্র। এসব না থাকলে এই উপন্যাস ব্যর্থ হতো, যেমন ব্যর্থ হতো হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’। শিল্পী জাহেদের জীবন যদি একটি দ্বীপের সম্পূর্ণতা ও ব্যাপ্তি নিয়ে অকৃত্রিমতার সঙ্গে এ রচনায় রূপায়িত হয়ে থাকে, তবে ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অসার্থক হয়নি, বলা চলে। ১১
কাহিনি, চরিত্র, সংলাপ, পটভ‚মির সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ এই বলে—তেইশ নম্বর তৈলচিত্র মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক উপন্যাস। তবে এই উপন্যাসে উচ্চবিত্তের জীবন চিত্রিত হয়নি, এমনকী একেবারে নিম্নবিত্তও ধরা পড়েনি। উপন্যাসে কথা বলেছে নিম্নমধ্যবিত্ত, যারা অর্থে সাবলম্বী না হলেও চিত্তে অভিজাত। পোশাক-বাড়ি-গাড়ির ঝলক না থাকলেও রুচির স্নিগ্ধতায় চারপাশকে তারা মোহিত করে রাখে। তারা কেবল নিজেরাই যে রুচিবান তা নয়, সমাজে সুরুচির জোগান দেওয়ার দায়িত্বও পালন করেছে।
প্রধান দুই চরিত্র—জাহেদ ও ছবি প্রেমের ক্ষেত্রে নিজেদের সর্বোচ্চ উদারতা, সততা ও ক্ষমতার নিদর্শন রেখেছে। একই পথেই চলেছে জামিল ও মীরাও। ব্যতিক্রম মুজতবা ও রাধারাণী। দুজনেই বহুগামী, দুজনেই শরীরসর্বস্ব, দুজনেই বিকৃতির উপাসক। তবে, মুজতবা স্বভাবদোষে, রাধারাণী পেটের দায়ে। অন্যদিকে মুজতবার লালসার শিকার মগকন্যা তিনা ভাগ্যবিড়ম্বিত। তার দায় একা মুজতবার বললেও অত্যুক্তি হয় না।
উপন্যাসের ভাষা সাবলীল, ঝরঝরে। চরিত্রের উপযোগী সংলাপ রচনার পাশাপাশি লেখক অলঙ্কার প্রয়োগেও সিদ্ধহস্ততার প্রমাণ রেখেছেন। মাঝেমাঝে দর্শনতুল্য বাক্যও উচ্চারণ করেছেন। যেমন, ‘শিল্পী মাত্রই অহঙ্কারী এবং আত্মপ্রচারে উৎসাহী’, ‘বড় প্রেম শুধু স্বার্থপর নয় উদারও বটে’, ‘শাঁখের করাত আসতেও কাটে, যেতেও কাটে’। বাক্যগঠনে লেখকের নিজস্বতা স্পষ্ট। কখনো ছোট ছোট বাক্যে, কখনো দীর্ঘ বাক্যে লেখক গল্প বলে যান। তবে, বেশিরভাগই ছোটবাক্যে বলেছেন। এতে বাক্যের টান টান উত্তেজনা বহাল থেকেছে।
মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের পাশাপাশি পরিবেশ বর্ণনা লেখককে প্রায় প্রকৃতিপ্রেমী বলেই মনে হয়। প্রকৃতির দৃশ্য বর্ণনা ও মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে গদ্যশিল্পীর চেয়ে কবিত্বই বেশি তার ওপর ভর করে বলা চলে।
চাঁদ হয় অস্ত গিয়েছিল, নয় অনেক আড়ালে জানালাটা, তাই অন্ধকার। গাছপালায় ভোর হওয়ার আগেকার ঘোর লাগা ছায়া। শেষ রাতের হাওয়া বইছে। একদল পাখি কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেলো।১২
শব্দের ব্যবহার, কাহিনির বর্ণনায় একটি বিষয়ই পরিস্ফ‚ট হয়েছে, সেটি হলো শিল্পীর চিন্তাসূত্র। কথাশিল্পী কী চিন্তা করেন, তার প্রকাশ কিভাবে তিনি করেন, সেই কৌশলের সুলুক-সন্ধান করতে হলে চিত্রশিল্পীর মনোজগতের খবর আগে বের করে আনতে হবে। সেই কাজটি জাহেদের পর্যবেক্ষণ দিয়ে লেখক প্রকাশ করেছেন।
আরেকটি কথা—একরৈখিকতার কারণে, বহু মানুষের পদধ্বনির পরিবর্তে এক ব্যক্তির হৃদয়বীণার সুরে বেজে ওঠায় এই উপন্যাসকে অনেকেই ছোটগল্প বলতে চাইতে পারেন। কিন্তু উপন্যাস একরৈখিক হতে দোষ কী? একরৈখিক হওয়ার কারণে এই উপন্যাসে গুরুতর কোনো শিল্পহানি ঘটেনি। এছাড়া, ব্যক্তিবিশেষের জীবনচিত্র ও তার পারিপার্শ্বকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ খোদ লেখকই প্রধান চরিত্র জাহেদের জবানিতে জানিয়েছেন।
সব মানবের শিরোমণি যাঁরা তাঁরা আমার নমস্য কিন্তু একজনের ছোট্ট হৃদয়ের সবটুকু অধিকার করে বেঁচে থাকাই আমার লক্ষ্য। কালের অতল গর্ভে তলিয়ে যাব, হারিয়ে যাব। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। কিন্তু তবু যাওয়ার বেলায় আমার ঠোঁটে থাকবে বিজয়ীর হাসি। এবং এটাই আমার বিদ্রোহ, এটাই আমার বিপ্লব। হাওয়ার ওপর ভেসে বেড়ানো নয়, বসুন্ধরার দৃঢ় ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে কাজ করা। পুরাতন দুর্গকে ভেঙে নতুন প্রাসাদ গড়ে তোলার এই একমাত্র পথ। অন্যথায় আত্মধ্বংসই হবে সার। ১৩
জাহেদ সর্বজনের ‘শিরোমণি’ না হয়ে একজনের ‘ছোট্ট হৃদয়ের সবটুকু অধিকার করা’কে নিজের দ্রোহ হিসেবে দেখেছে। এটাকে বিপ্লব হিসেবে ঘোষণা করেছে। ব্যক্তি জাহেদের জন্য এটা জীবনের দ্রোহ, সমাজের বিপ্লব। কিন্তু বহুরৈখিক কাহিনির বিপরীতে একরৈখিক গল্পের মাধ্যমে উপন্যাস রচনা করে আলাউদ্দিন আল আজাদও সাহিত্যিক দ্রোহ দেখিয়েছেন। ঘটিয়েছেন সফল বিপ্লব। নিজেই সেই বিপ্লবের ঘোষণা না দিলেও এবং দ্রোহের চিন্তাসূত্র আলাদা করে প্রকাশ না করলেও কিন্তু উত্তম পুরুষে রচিত তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসের নায়ক জাহেদের একজনের ভালোবাসার পরিপূর্ণ প্রেমিক হয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে নিজের অব্যক্ত বাসনার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন লেখক।
আলাউদ্দিন আল আজাদ দেখিয়েছেন, মৌলিক কাজ যিনি করেন, তিনি অগ্রজের দেখানো পথে হাঁটেন বটে, তবে ততটুকু, যতটুকু পথ চিনতে সময় লাগে। একবার কানাগলি থেকে মূল সড়কে উঠতে পারলে কিংবা মূল সড়ক পার হয়ে নতুন চোরাগলির মুখ চিনতে পারলে পথিককে যেমন আর কারও শরণাপন্ন হতে হয় না, কথাশিল্পীও তেমনি। পথের এই সূত্র জানার পর আর কোনো পথপ্রদর্শকের দরকার হয় না; নিজেই নতুন নতুন পথের আবিষ্কার করতে পারেন। সেই নতুন পথ সৃষ্টিতে তার যেমন আনন্দ, তেমনি স্বস্তিরও। তাই ‘একজনের ছোট্ট হৃদয়ের সবটুকু অধিকার করে বেঁচে থাকাই’ লক্ষ্য বলে ঘোষণা দেওয়ার মধ্য দিয়েই প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে তিনি দ্রোহ করেছেন। এখানেই শিল্পীর চিন্তাসূত্র দ্রোহে রূপ নিয়েছে, মোড় নিয়েছে বিপ্লবে। এভাবে শিল্পের জানালাকেও একরৈখিক দৃষ্টি দিয়ে বহুরৈখিক করে তোলার একটি সফল পদক্ষেপও দিলেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। আর ঔপন্যাসিক হিসেবে এখানেই তার সাফল্য, এখানেই তার বিশেষত্ব-স্বাতন্ত্র্য; ঔজ্জ্বল্যও।
তথ্যসূত্র
১. আলাউদ্দিন আল আজাদ, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, গতিধারা, ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৩। পৃ: ১৫
২. জীবনানন্দ দাশ, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র (আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত) ধূসর পাণ্ডুলিপি, ‘বোধ’, অবসর, ঢাকা, সপ্তদশ মুদ্রণ, নভেম্বর/ ২০২০। পৃ: ৭৮
৩. মোতাহার হোসেন চৌধুরী প্রবন্ধ-সমগ্র, ‘সংস্কৃতি কথা’, (সৈয়দ আবুল মকসুদ সম্পাদিত), নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার ঢাকা, ১১০০। দ্বিতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৯, পৃ:৩২
৪. আলাউদ্দিন আল আজাদ, তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, গতিধারা, ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৩। পৃ: ২১
৫. তদেব, পৃ: ২১
৬. তদেব, পৃ: ২১
৭. তদেব, পৃ: ৫৭
৮. তদেব, পৃ: ৩৭
৯. তদেব, পৃ: ২৩
১০. তদেব, পৃ: ২৩
১১. মনসুর মুসা, পূর্ব বাঙলার উপন্যাস, পূর্বলেখ প্রকাশনী ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, জুন ১৯৯৭, পৃ: ৯৪
১২.আলাউদ্দিন আল আজাদ তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, গতিধারা, ঢাকা, তৃতীয় সংস্করণ, এপ্রিল ২০১৩। পৃ: ৪৯
১৩. তদেব, পৃ: ৭১