‘৬২ ও ‘৮৩-এর শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলো নিজেদের উজ্জ্বল অতীতকে ধারণ করতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ এ আন্দোলনকে সমর্থন করবে না—এটা জানা কথা। শাসকশ্রেণীর উপদল হিসেবে ছাত্রদল কিংবা ছাত্রশিবিরও শিক্ষার অধিকার প্রশ্নে ছাত্রলীগের সঙ্গেই থাকবে। কিন্তু ছাত্রদের অধিকার, শিক্ষার দাবিতে সব সময় আন্দোলন করা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে শুধু খাপ খাওয়াতে পারেনি তা নয়, নিজেদের অপাঙক্তেয় হিসেবেও প্রমাণ করেছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও প্রকৌশল কলেজগুলোয় সাড়ে সাত শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তিনমাসের আন্দোলন গত ৯ সেপ্টেম্বর বুধবার থেকে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ছড়িয়ে পড়েছে জেলায়-জেলায়ও। ওইদিন ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের গুলির পর আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রবিবার পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে চলেছে। ‘ভ্যাট দেব না, গুলি করো’-এরমতো স্লোগানে শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়েছে, ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়া তারা রাজপথ ছাড়বে না। রবিবার ঢাকার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে রাস্তা অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। অচল হয়ে পড়ে ঢাকা। তবে দীর্ঘক্ষণ যানজটে বসে থাকলেও ব্যাপকহারে সাধারণ মানুষও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন করছেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে শিক্ষা পণ্য নয়, অধিকার—বিষয়টি সামনে এসেছে। টাকা দিয়ে কেন শিক্ষা কিনতে হবে—বিষয়টি ভাবাচ্ছে মানুষকে। অথচ যারা শিক্ষার অধিকারের দাবিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আন্দোলন করে আসছে, তারাই আছে পিছিয়ে রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যান্টিনে খাবারের দাম, পরিবহন ফি, উন্নয়ন ফি কিংবা বর্ধিত বেতন-ফির বিরোধিতা করে আন্দোলন করে আসছে তারা শুধু প্রেস বিজ্ঞপ্তি, বিবৃতি কিংবা নিজেদের কর্মী নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করেই। যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে ঢাকা অচল করছে, যখন প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো ঢাবিতে মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করে সংহতি জানাচ্ছে!
বামঘরানার ছাত্র সংগঠনগুলো প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য নামে বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছে। পহেলা বৈশাখে যৌন হয়রানির প্রতিবাদে দুই জোট এক হয়ে কর্মসূচি পালন করেছে। ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে রবিবার প্রগতিশীলজোট সংবাদ সম্মেলন করলেও ছাত্র ঐক্যের কোনও বক্তব্য বিবৃতিও চোখে পড়েনি এখন পর্যন্ত। জোটভুক্ত সংগঠনগুলো নিজেদের নামে বক্তব্য, বিবৃতি দিয়ে, মিছিল করে সংহতি জানাচ্ছে। আলাদা-আলাদা বিভিন্ন স্থানে অংশগ্রহণ করছে। সব শ্রেণীর মানুষকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সমর্থনের আহ্বান জানাচ্ছে। ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের ব্যাপকতা ও প্রয়োজনীয়তার বিচারে এ সব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ স্রেফ দায়সারা মনে হয়।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের বর্তমান রাজনৈতিক লাইন নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত থাকলেও সবাই স্বীকার করেন বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এ সংগঠনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ১৯৮৩ সালে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র ইউনিয়ন একদিনেই দেড় লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল। ছাত্র ই্উনিয়নের সেই সময়কার সাংগঠনিক শক্তি এখন আর নেই। তবু এখনও তারা দেশের বৃহত্তম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন। সর্বশেষ পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে যৌন হয়রানির প্রতিবাদে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সংগঠনটি। অথচ গত তিনমাস ধরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে আন্দোলন করে আসলেও ছাত্র ইউনিয়ন এই আন্দোলনকে সংগঠিত করতে উদ্যোগ নেয়নি। ছাত্র ইউনিয়ন ব্যস্ত ছিল নিজেদের সম্মেলন নিয়ে। রবিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সংগঠনটির সম্মেলন হওয়ার কথা।
বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেয় বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন (গণসংহতি)। তবে ধর্মঘটের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করা ছাড়া কোনও কর্মসূচি পালন করার খবর পাওয়া যায়নি। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি কর্মসূচি থাকায় ছাত্র ধর্মঘট একভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। মনে হয়, ফেডারেশনের নেতারা জেনেশুনেই এধরনের স্ট্যান্টবাজি করেছেন।
যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রবিবার থেকে টানা তিনদিন ধর্মঘটের ডাক দেয়।
ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল সমাবেশ করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলদেশ ছাত্রমৈত্রী। বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন (মুক্তি কাউন্সিল) বক্তব্য, বিবৃতি, পোস্টারিং ও লিফলেট বিলি করছে। সংগঠনটির সভাপতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমালোচনাও করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভ্যাট প্রত্যাহারের আন্দোলনের এই পর্যায়ে সমর্থক বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে সংযুক্ত করা দরকার। অথচ আশ্চর্য হয়ে দেখছি, বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে বলা হচ্ছে ও আইডি কার্ড না থাকলে চলে যেতে বলা হচ্ছে। কারণ হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে, বহিরাগতরা আন্দোলনের ক্ষতি করতে পারে! আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান করা হয়েছে, ‘আন্দোলন নিজের বিশ্ববিদ্যালয় বা শুধু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ রাখার মত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুন।’
ছাত্রগণমঞ্চ শুক্রবার তাদের সম্মেলেনের আগের দিন ও দুদিন পর পৃথক বিবৃতি দিয়ে আন্দোলনে সবার অংশগ্রহণ কামনা করেছে। বুঝাই যায় ছাত্র ইউনিয়নের মতো তারাও নিজেদের সাংগঠনিক সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে। অথচ এসব সংগঠন সাধারণ ছাত্রদের ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশ ও মানুষের স্বার্থে কাজ করতে আহ্বান জানায়। কিন্তু তারা নিজেরাই সংগঠনকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখেই কাজ করেন।
বাম ঘরানার ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম দেখে বলা যায় তারা এখন বিবৃতি ও মধুর ক্যান্টিন সর্বস্ব সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এককভাবে কোনও কিছু করার সামর্থ্য না থাকলেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য নিজেদের সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করতে পারেন না তারা। অথচ সব সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমর্থনে অথবা শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে যদি রাস্তায় নামত, তাহলে আরও গতি পেত আন্দোলন। যারা কোনো দিন আন্দোলন করেনি, তারা যদি পুলিশের গুলি খেয়েও ৪ দিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনগুলো কেন শাহবাগ অবরোধ করতে পারে না?
একসময় এসব সংগঠনের নেতাকর্মীর মুখে শোনা যেত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোনও আন্দোলন সংগ্রামে আসে না, তাদের আন্দোলনে সমর্থন দেয় না। এখন তারাও একই কাজ করছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—শিক্ষায় ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আন্দোলন নয়, এটা শিক্ষার মৌলিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ টাইপ অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকে সমর্থন জানালেই ছাত্র সংগঠনের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। যখন বাধ্য হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করছে, তখন তাদের পাশে দাঁড়াতে সংগঠনগুলোরও মাঠে নামা প্রয়োজন। না হলে ধীরে-ধীরে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনও। কার্যকারিতা হারাবে ছাত্র রাজনীতি। যদি ছাত্র রাজনীতি না করেই ছাত্ররা দাবি আদায় করতে পারে, তাহলে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন কোথায়? দেরি হয়েছে, তবে এখনও সময় আছে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত হওয়া প্রতিহত করা, ছাত্রদের অধিকার রক্ষা ও ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর রাস্তায় নামার।
* প্রকাশিত অভিমত লেখকের নিজস্ব। এর জন্য চিন্তাসূত্র দায়ী নয়।