যারা নিজেদের প্রচার বিমুখ বলে দাবি করেন তাদের পেছনেও সদ্য সাহিত্যে পা রাখা তরুণতর লিখিয়েরা কী ভেবে জানি খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে। কখনো এমন হয় নিজেকে গুরু বানানোর খায়েসে কেউ-কেউ শিষ্য হিসেবে টার্গেট করে আর টার্গেট অনুসারে তাকে এন্টিস্টাবলিস্টমেন্ট বুঝিয়ে দল ভারী করার চেষ্টা করেন।ওই গুরুই যখন সুযোগ পেয়ে জাতীয় দৈনিক অথবা বাজারি সাহিত্য পত্রিকায় লেখার ডাক পান তখন তার সমস্ত দর্শন চুলায় ফেলে তাড়াতাড়ি হাত তুলে বলেন, আছি তো। শিষ্য তখন চোখে দেখে গুরুর অধপতন। গুরুকে বাদ দিয়ে তখন শিষ্যই গুরু হয়ে ওঠেন তালিম দেওয়ার জন্য। আর নিজেও শিষ্য খোঁজা শুরু করেন।ছোটকাগজকে একেকজন একেকভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কিন্তু কোনো ছোটকাগজই শেষপর্যন্ত কোনো সংজ্ঞার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না।কেউ ব্যবসার পূঁজি হিসেবে ছোটকাগজকে ব্যবহার করেন, কেউ লেখক হিসেবে ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন।এর বাইরে কিছু কাগজ সব সংজ্ঞার বাইরে নিজের চরিত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।প্রকৃত পক্ষে তাদের কাজগুলো সাহিত্যকে উপকৃত করে।আজ যিনি একটি নতুন কাগজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে প্রশ্ন করুন, তিনি তার কাগজের কনসেপ্ট বলতে পারবে না।
উদ্দেশ্যহীন কোনো কিছু ঠিক ঠিকানায় পৌঁছতে পারে না—এটা সর্বজন স্বীকৃত কথা।
দুই.
বর্তমানে আমরা এক ধরনের ফেইসবুকীয় সাহিত্য চর্চা দেখি।অনেকেই ফেইসবুকে লেখা শুরু করেছেন। ফেইসবুকে লিখে চলছেন। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ প্রতিদিন একাধিক কবিতাও লেখার চেষ্টা করছেন। বিভিন্ন গ্রুপের কল্যাণে তারা লিটলম্যাগের আদলে ম্যাগাজিন প্রকাশ করারও চেষ্টা করছেন। কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে এমন একটি গ্রুপের আয়োজিত প্রোগামে কৌতূহলবশত গিয়েছিলাম। সেখানে একদল কবিতাকর্মীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। যাদের কাউকেই আগে থেকে চিনতাম না। আড্ডা দিতে-দিতে বুঝতে পারলাম, বাংলা কবিতার এই দুর্দিনে তাদের ছাড়া বাংলা কবিতার উপায় নেই! কবিতা নিয়ে তাদের চিন্তাভাবনার কথা শুনে মনে হলো, বাংলা কবিতার ভবিষৎ নিয়ে তাদের ছাড়া চিন্তা করার আর কেউ নেই। আড্ডা দিতে দিতে তারা লিটলম্যাগ প্রকাশের আলোচনা শুরু করল, এক শ কবির কবিতা আর কয়েকটি গল্প, প্রবন্ধ গোছানো হয়ে গেছে। ব্যস, হয়ে গেল, লিটলম্যাগের কাজ!
আরেক দিন তো ফেইসবুকীয় কবি সম্প্রদায়ের এক সদস্য বাংলাদেশের লিটলম্যাগের গোষ্ঠী উদ্ধার করছিলেন। রীতিমতো আমাদের চার জনকে লিটলম্যাগের ওপর টিচিং দিচ্ছিলেন। জানালেন, তাদের একটা গ্রুপ আছে। সেখান থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লিটলম্যাগ প্রকাশ করবেন। বর্তমান সাহিত্য সমাজে সেটা সাড়া ফেলে দেবে।ওই আড্ডায় আমি নতুন আর তিনি আমার অপরিচিত। তাই চুপ করে শুনছিলাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর তিনি যখন থামলেন, তখন বাংলাদেশের কোন কোন লিটলম্যাগ পড়েন জানতে চাইলে তিনি কোনো লিটলম্যাগের নাম বলতে পারলেন না। সময়ের কয়েকটি ভালো লিটলম্যাগের নাম বলে তাদের কোনো লিটলম্যাগের চেহারা দেখেছেন কি না—জানতে চাইলে তিনি সামনে একটি কাগজ দেখিয়ে বললেন, এটা আমার দেখা প্রথম লিটলম্যাগ। দেখলাম ওই কাগজটি নতুন, যেটা লিটলম্যাগের আদলেই প্রকাশিত। যার সম্পাদনায় যুক্তরাও ফেইসবুকের পরিচিত নাম।
যাদের সঙ্গে কিছু দিন আগে আমার পরিচয় হয়েছে, তবে তারা ভালো কাজ করার চেষ্টা করছেন। এবার ভাবুন, এই লিটলম্যাগ বিশেষজ্ঞ যখন কোনো লিটলম্যাগ প্রকাশ করবেন, তখন ওই কাগজটির চেহারা কেমন হবে! আমি ফেইসবুকে কবিতা চর্চাকারীদের মোটেই অনুৎসাহিত করছি না। কিন্তু যেখানে কোনো রকম মান না দেখেই, এডিট ছাড়াই লেখা প্রকাশের সুযোগ থাকে, সেখানে লেখার মানোন্নয়ন করা আমার কাছে কষ্টকর বলেই মনে হয়। আর ফেইসবুকীয়ে এইসব গ্রুপ ভিত্তিক কবিতাচর্চায় ভালো লিটলম্যাগের পাঠ যেমন অবদান রাখতে পারে, তেমনি প্রত্যাশা করি ফেইসবুকে সাহিত্যচর্চা আর লিটলম্যাগের আদলে করা কাগজগুলোর উদ্যোক্তারাও ফেইসবুক গ্রুপের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আরও গোছানো কাজ করতে পারলে, তাদের সাহিত্য আন্দোলন আরও বেগবান হবে।
তিন.
ফেইসবুক-ব্লগে লেখা প্রকাশে বিরুদ্ধে আমি কখনোই ছিলাম না। এখনো না। তবে, লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমগুলো যারা বেছে নিয়েছেন, তারা তাদের লেখার প্রতি কম যত্নশীল বলেই মনে হয়। মনে হয়, লেখার প্রতি কোনো দরদ নেই তাদের। বরং দ্রুত প্রকাশ করে বন্ধুদের বাহবা পাওয়ার প্রতিই তাদের যত আগ্রহ। তাই তাড়াহুড়োর কারণে অনেক সময়ই তারা দুর্বল লেখাটিই দ্রুত প্রকাশ করে দেন। এতে তাদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিটাই তো বেশি হচ্ছে। লেখা পাঠে আগ্রহী পাঠকরা তার দুর্বল লেখার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে লেখক হিসেবে তার স্তর নির্ণয় করে ফেলছে। ই-জগতের জনপ্রিয় কবি বা লেখকরা তাদের লেখায় শত-শত লাইক কমেন্ট পান। কেউ-কেউ হাজারেরও বেশি। তারা প্রায়েই বলেন, একটি লিটলম্যাগের কত কপি প্রিন্ট হয়? ৩০০/৪০০কপি? বেশি হলে ১০০০কপি, আর সাহিত্য পত্রিকার প্রচার সংখ্যাও তো ২০০০/৩০০০ কপির বেশি নয়। তাদের দাবি, এর চেয়ে বেশি পাঠক প্রতিদিন ই-জগতে তাদের লেখা পড়ছে।
এক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন—যারা ফেইসবুক, ব্লক, ওয়েবজিনে লিখে-লিখে ই-জগতে ব্যাপক জনপ্রিয়, তারা প্রিন্ট জগতে আসতে চান কেন? বই প্রিন্ট করার জন্য প্রকাশক খুঁজেন কেন? লিটলম্যাগ সাহিত্য পত্রিকায় লেখা প্রকাশের সুযোগ খোজেন কেনো?
চার.
কবিতা যদি হয়ে ওঠে, তবে যে কাউকেই কবি হিসেবে গ্রহণ করতে পাঠক বাধ্য। কিন্তু পাঠককে না টানতে পারলে, সে লেখা পাঠক পড়বে কেন। আগের তুলনায় এই ডিজিটাল যুগে পাঠকের হাতে সময় খুবই কম। তারপরও শত ব্যস্ততার ফাঁকেও পাঠক প্রকৃত কবিতার কাছে আসে। কবিতা নিজের যোগ্যতায় নিজেকে পড়িয়ে নেয়। ই-জগতের মধ্যে ব্লগের থেকে এখন ফেইসবুকে অনেক বেশি কবিতা লেখার চেষ্টা করা হয়। আর এই লিখিয়েদের দৌড়ে নারীরা এগিয়ে। তারা লেখার চেষ্টায় যেমন এগিয়ে, লাইক কমেন্টের সংখ্যায়ও এগিয়ে, আর লেখা প্রসবের সংখ্যা হিসাব করলে তাতেও তারা এগিয়ে। আর তাদের প্রক্রিয়াগুলো খুবই সুন্দর, নিজের একখানা ছবি ঘষেমেজে ফটোশপে কাজ করে সেই ছবির সঙ্গে লেখা পোস্ট করে দেন। পাঠক আর ছবির দর্শক পাগলের মতো লাইকের প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এই ফটোসপ-সুন্দরীরা সকাল-সন্ধ্যা লেখা পোস্ট করতেই থাকেন।
একজন কবি যেকোনো সময় কবিতা লিখতে পারেন।কিন্তু যদি এমন হয় যে, প্রতিদিন এক বা একাধিক কবিতা লিখতেই হবে, তাহলে সে লেখার চেহারা দেখলে পাঠকের বিরক্তি জন্মানোর কথা। কিন্তু আমাদের একস্তরের পাঠকের যেমন ফটোশপ-সুন্দরীর অপাঠ্য রচনা পাঠে বিরক্তি জন্মে না, তেমনি বেশির ভাগ ওয়েব সম্পাদকেরও না। সম্পাদকরা মহাপ্রতিভাবান কাউকে আবিষ্কার করেছে ফেলেছেন, এমন ভেবে একের পর এক এইসব মানহীন লেখা ছাপাতে থাকেন। আর এই প্রতিভা অন্বেষণে ও ফটোসফ সুন্দরীদের অপাঠ্য রচনা পাঠকদের জোর করে গেলানোর কাজে লিটলম্যাগ, ওয়েবম্যাগ ও সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের চেয়ে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকরা অনেক এগিয়ে।
গত ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত একটি দৈনিকের ঈদ সংখ্যায় চোখ রাখলে পাঠক অবাক হবেন। চিন্তা করতে থাকবেন এটা কি নারীদের লেখা প্রকাশিত বিশেষ কোনোও সংখ্যা না অন্যকিছু। নারীদের লেখা ছাপার মোটেই বিরোধিতা করছি না। নারীদের লেখা আরও বেশি করে ছাপানো উচিত। যেন তাদের অগ্রগতি হয়। কিন্তু সেটা যেন অন্তত একটু মানসম্পন্ন হয়। সম্পাদকরা যদি ফটোশপ-সুন্দরীদের মুখ আর লিপিস্টিকমাখা ঠোঁটে মুগ্ধ না হয়ে, লেখায় মুগ্ধ হয়ে লেখা ছাপান, তাহলে পাঠক আর সাহিত্য দুটোই উপকৃত হবে।