রিয়েল আবদুল্লাহ—কবি, লিটলম্যাগ সম্পাদক। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে এই কবি চিন্তাসূত্রকে জানালেন নিজের ভাবনার কথা।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
রিয়েল আবদুল্লাহ: শুধু একসময় নয়, এখনো অনেকে ভালো লিখেও দৈনিকের সাহিত্যপাতায় স্থান পান না, ফলে তারা নিজেকে প্রকাশের জন্য বা নিজেকে তুলে ধরার জন্য ভিন্নপথ অবলম্বন হিসেবে লিটলম্যাগ বের করেন। তার কারণ সাহিত্য পাতাগুলো এখনো একটি বলয়ে আবদ্ধ রয়েছে। পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকরা নিজেদের পরিচিত বন্ধু-বান্ধব বা কবিদের কাছেই কেবল লেখা আহ্বান করেন। এমনকী কিছু পত্রিকা রয়েছে যেগুলোর আছে সাপ্তাহিক গোপন বিষয়, যা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা কবি ছাড়া অন্যকেউ পায় না। যার জন্য ভালো লিখে পত্রিকায় পাঠালেও সেদিনের বা সে সপ্তাহের স্থিরকৃত বিষয়ের সঙ্গে খাপ খায় না বলে তা আর ছাপানো হয় না। অথচ তা হওয়া উচিত উন্মুক্ত—সবার লেখা জমা পড়বে আর সে লেখা থেকে বাছাই করে সবচেয়ে ভালো লেখাটি ছাপানো হবে। বেরিয়ে আসবে ভালো লেখক। তা যখন হয় না বা হয়ে ওঠে না, তখনই আসে দ্রোহের কথা। আর অস্বস্তি বোধ থেকে নয় সে দ্রোহ থেকেই জন্ম নেয় লিটলম্যাগ। কিন্তু তা কষ্ট সাধ্য ও প্রচণ্ড রকম ব্যয়বহুল। পর্যাপ্ত পৃষ্টপোষকতা না থাকলে বেশি দূর এগুতে পারে না তা। আধুনিক এই সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আসে ওয়েবম্যাগ। যা সহজলভ্য ও সহজসাধ্য—আর এ সহজলভ্যতার কারণেই বেড়েছে ওয়েবম্যাগ। আমিও মনে করি লিটলম্যাগের জায়গাটাই আস্তে আস্তে এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
রিয়েল আবদুল্লাহ: তা আমার কাছে মনে হয় একটু অন্যরকম। শুধু অর্থব্যয় কমের কারণে নয়, অতিসহজে ওয়েবম্যাগের ব্যবহারের বিষয়ই মুখ্য। তারপরও বলব, লিটলম্যাগে যে অসহনীয় খরচটা হয়, তার চাইতে ওয়েবম্যাগে খরচ অনেক কম। অর্থনৈতিক সংকুলানের কারণে লিটলম্যাগ টানা প্রকাশ করতে না পেরে একসময় মন ভেঙে যেতে থাকে—’না আর আর বের করব না’ বিষয়টি চলে আসে সামনে। ওয়েবম্যাগে তা কিন্তু হয় না। আর এই সহনীয় পর্যায়ের কারণেই ওয়েবম্যাগে শান্তি খুঁজে পান লেখকরা। এখানে ছোট-বড়-তরুণ সব শ্রেণীর লেখক হাত খুলে লেখেন।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবে সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
রিয়েল আবদুল্লাহ: তা ঠিক। আমিও অনেক ওয়েবম্যাগ দেখেছি, যেখানে বানান তো দূরের কথা লেখাটি পর্যন্ত দেখা হয় না। লেখক যেভাবে মেইল করেন, সেভাবেই হুবহু প্রকাশ করে দেওয়া হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রতিটি লেখার জন্য চাই আগে সম্পাদনা, পরে প্রকাশ। অন্তত বানান সজাগ হতে হবে সম্পাদককে। লেখক ভুল করে, যা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে কোনো লেখকের লেখা বাদ নয়, তার জন্য লেখককে উপদেশ দেওয়া যেতে পারে। তিনি তা মানুন অথবা না মানুন, ওয়েব ম্যাগের সম্পাদককে হতে হবে এ ব্যাপারে খুব দৃঢ়। কারণ লিটলম্যাগ যায় অল্পদূর আর ওয়েবম্যাগ পুরোটাই বৈশ্বিক।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
রিয়েল আবদুল্লাহ: আমি মনে করি, এ ব্যাপারটি কেবল সাহিত্যপ্রেমের জন্যই। প্রত্যেক লেখক যা লেখে, তা তার কাছে রত্নতূল্য, তা যদি অন্যের কাছে যথোপযুক্ত নাও হতে পারে। আবার তা হতে পারে নিজের লেখাগুলোর সহজ প্রকাশ অথবা নিজের লেখাগুলোর সংরক্ষণের বিষয়ও। কর্তৃত্ব করে বা করতে চায়, তাদের আমি লেখক বলে মনে করি না।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
রিয়েল আবদুল্লাহ: না তা নয়, বই যারা পড়েন, তাদের বই পড়া না হলে ঘুম আসে না। তবে ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন বই পড়ার মতোই মজাদার। নতুন নতুন লেখকদের কিংবা নামজাদা লেখকদের লেখাটি সহজেই পাচ্ছি। একঝলকে লেখককেও জানা যাচ্ছে। তার বইটি কেনার ব্যাপারে আগ্রহ জাগছে। কারণ ওখানে তার ছবিটিও থাকে। কেউ কেউ তা কিনেও নিচ্ছি। লেখক পাঠক উভয়েই উপকৃত হচ্ছে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, না লিটলম্যাগ, না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে পছন্দ করেন?
রিয়েল আবদুল্লাহ: পক্ষটান বা দলীয়করণ বা বলয়বৃত্তের টানে পড়ে আমিও হয়েছি চিড়াচেপ্টা। একটা সময় ওদিকে আর যাইনি। কয়েকজন মিলে আমাদের কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে বের করেছি লিটলম্যাগ। তারপর নিজেও একটা ম্যাগাজিন ‘রূপান্তর ময়মনসিংহ’ সম্পাদনা করছি। একটা ম্যাগাজিন করা এত কষ্টের যে, তা বলে শেষ করা যাবে না। তা একা একা করতে ইচ্ছে করে না আর। অনেকের কাজ যদিও হাতে নেই, তা নিজেকেই করতে হয়। খুব কষ্ট হয়। তাই নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছি ওয়েব ম্যাগাজিনের দিকে। ওয়েবজিন আস্তে আস্তে শিল্পী-কবি গড়ার কারিগর হয়ে উঠছে। তার বড় একটি উদাহরণ হলো—চিন্তাসূত্র।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
রিয়েল আবদুল্লাহ: এই আধুনিক সভ্যতায় ওয়েব ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। একটি লেখাকে চিরন্তন করে তুলতে ওয়েব ম্যাগাজিন ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এর মাধ্যমে একটা জায়গাতে আর সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে না। খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়া যাচ্ছে সারা বিশ্বে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষার সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাচ্ছে । যেকোনো ওয়েব ম্যাগাজিন করে বসে থাকলে হবে না, এর পেছনে এর উৎকর্ষ বাড়াতে নতুন নতুন পদক্ষেপের পাশাপাশি আরও বেশি শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করতে হবে।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
রিয়েল আবদুল্লাহ: যারা ওয়েবম্যাগ সম্বন্ধে জানে না বা ওয়েবম্যাগে লেখেনি, তাদের এর সুবিধা-অসুবিধা বোঝা কঠিন। ওয়েব ম্যাগাজিন যে সাহিত্যে ঝড় হয়ে আসছে, এটা কিন্তু সত্য। আমি প্রথম প্রথম দেখেছি, ওয়েবম্যাগে অনেক বড় বড় সাহিত্যিক লেখতে চাইতেন না। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেখছি, এতে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বও লেখা দিয়ে এগিয়ে আসছেন। যা খুব আনন্দের ব্যাপার। যেটা সাধারণত লিটলম্যাগে হয় না। চেয়েচিন্তেও একজন নামকরা লেখকের লেখা পাওয়া যায় না। ওয়েবম্যাগ কিন্ত সে সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসছে। যা সাহিত্যে নতুন-পুরাতনের মধ্যে একটি মেলবন্ধন সৃষ্টি করছে। যা খুবই ইতিবাচক দিক বটে। আমি মনে করি, এ অবস্থা চলতে থাকলে বা ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাতে পারে।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
রিয়েল আবদুল্লাহ: একটি ওয়েবম্যাগ হবে সুসাহিত্য ও তথ্যসমৃদ্ধ অবশ্যই। ওয়েবম্যাগে লেখা প্রকাশের আগে অবশ্যই বেছে বেছে লেখা নিতে হবে। এডিট না করে কোনো লেখা দেওয়া যাবে না। মানসমৃদ্ধ বা একজন লেখকের লেখা মানসম্মত বিবেচনা হওয়ার পরই কেবল সে লেখা প্রকাশ করতে হবে। কারণ লিটলম্যাগের মতো ওয়েবম্যাগের গণ্ডি সীমাবদ্ধ নয়—বিস্তৃত। এর পাঠক দু-তিনশত নয় লাখ লাখ। তাই সুচারু বিশ্লেষণের পরই একটি লেখা ওয়েবম্যাগে স্থান পাবে বলে আমি মনে করি। পত্রিকার সাহিত্যপাতাগুলোর মতো কারও কোনো বিশেষ পরিচিতি এখানে কাজ করবে না। আমি চাই শুধু দেশি সাহিত্য নয় বা বাংলা ভাষার নয় বিদেশি সাহিত্যও বাংলা ভাষার পাশাপাশি থাকবে। সরাসরি সে ভাষাতেই থাকবে এবং সঙ্গে থাকবে তার অনুবাদ। তাতে বাংলা ভাষার বৈচিত্রটা অনুধাবন করা সহজ হবে। এজন্য একটা বিভাগ খোলা যেতে পারে। ওয়েবম্যাগে সাহিত্যের সব বিষয়াবলি আসবে, যেন সুসাহিত্যিক মাত্রই ওয়েবম্যাগে আগ্রহ দেখান। সমৃদ্ধ হয় বাংলা ভাষার ও সাহিত্য। চিন্তাসূত্র সে কাজে সবার আগে হাত দেবে বলে আমার বিশ্বাস।