কুমার দীপ—মূলত কবি। পাশাপাশি লিখেছেন কবিতাবিশদে প্রবন্ধও। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো: নান্দনিক শামসুর রাহমান, রটে যাচ্ছে আঁধার, ভালোবাসার উল্টোরথে ও ঘৃণার পিরিচে মুখ। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন এই তরুণ কবি।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
কুমার দীপ: ওয়েবম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে ঠিকই, সেগুলো নবীনদের সাহিত্যচর্চায় বিশেষ ভূমিকাও রাখছে, কিন্তু সেগুলো যে একেবারে লিটল ম্যাগাজিনের জায়গা দখল করছে, সেটা ঠিক বলা যায় না। অনেকের কাছে ছাপা কাগজের কদর এখনো অন্যরকমের। তবে ভবিষ্যতে এমনটা হতে পারে।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
কুমার দীপ: অর্থব্যয় অবশ্যই বড় একটি কারণ, তবে এখনো অনেকেই আছেন, যারা নিজেদের সম্পাদনায় কাগজে ছাপানো পত্রিকা করতেই অভ্যস্ত, এতেই তাদের তৃপ্তি। বিশেষত, আগে থেকে যারা কাগজ করতেন, তাদের অধিকাংশ এখনো বছরে অন্তত একটি সংখ্যা বের করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। ওয়েবম্যাগ যারা করছেন, তাদের অধিকাংশই কিন্তু নতুন।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবেই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুমার দীপ: অভিযোগটি আংশিকভাবে অবশ্যই সত্য। আংশিকভাবে এজন্যে যে, কোনো কোনো ওয়েবম্যাগ বেশ সুগঠিত, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুসম্পাদিত। কিন্তু একথা বলতেই হচ্ছে, অনেকেই কেবল তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে কিংবা অনভিজ্ঞতাবশত বিবিধ রকমের ভ্রান্তিসহ অপরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছেন।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
কুমার দীপ: আগে যারা লিটল ম্যাগ করতেন, তাদের কাছে শিল্প-সাহিত্য ছিল জীবনের একটি অনিবার্য অংশ। যেকোনো প্রকারে সামান্য টাকা হাতে নিয়ে, অন্যের কাছে হাত পেতে, কেউ কেউ মায়ের নিকট থেকে মিথ্যা বলে টাকা নিয়ে, কেউ আবার বাপের পকেট মেরেও লিটলম্যাগ বের করতেন। হয়তো এখনো কেউ কেউ করেন, কিন্তু আগের সেই বহুবিধ চ্যালেঞ্জটা এখন আর নেই। এখন কম্পিউটার, ছাপাখানা, বিজ্ঞাপন, সর্বোপরি মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। কারও কারও বেশ কষ্ট হয়, ত্যাগস্বীকার করতে হয়, তারপরও একথা সত্য যে, অনেকেই এখন নিজের উপার্জিত টাকাতেই কাগজ প্রকাশ করেন। সেই তুলনায় ওয়েবম্যাগ করা একেবারেই সহজ একটি ব্যাপার, শুধু লেখা সংগ্রহের ব্যাপার। একথা অনস্বীকার্য, লেখা সংগ্রহও যে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ, বেশিরভাগ ওয়েবম্যাগ সম্পাদকের কাছে সেটা মনেই হয় না। এটা এখন খুব সহজ একটা ব্যাপার। আর শিল্পের প্রতি প্রকৃত দায়বদ্ধতা না থাকলে তো কোনো ব্যাপারই না, বাংলায় যা-তা লেখার লোকের অভাব নেই। আর কর্তৃত্ব ব্যাপারটা মানুষের অস্তিমজ্জাগত ব্যাপার, সুযোগ পেলে প্রায় সবাই সেটা করতে চায়, যোগ্যতা থাক বা না থাক।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
কুমার দীপ: ওয়েবজিন-ওয়েবম্যাগ-ব্লগজিন এগুলো এখন এত সহজ্যপ্রাপ্য যে, লেখার মান যাই হোক, যেহেতু চোখের সামনে এসেই যাচ্ছে, পড়তে হচ্ছে; অন্তত, দেখতে তো হচ্ছে। সে তুলনায় কাগজের পত্রিকা বা বই সহজ প্রাপ্য তো নয়ই, সহজে বহন বা ধারণযোগ্যও নয়, ফলে, বইবিমুখতা তো আসছেই। তাছাড়া প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ এমন পর্যায়ে উপনীত যে, যে-কোনো ধরনের লেখা-পড়াই এখন বিরল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যাদের সাহিত্যের প্রধান পাঠক-পাঠিকা মনে করা হতো, সেই তরুণ প্রজন্ম এখন পাঠবিমুখতার চূড়ান্ত পর্যায়ে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
কুমার দীপ: দুটোতেই। আমি জানি, ওয়েবে প্রকাশিত একটি লেখা একই সঙ্গে অগণিত পাঠকের কাছে পৌঁছে যায়। সেদিক থেকে হিসাব করলে ওয়েবম্যাগ বা ব্লগজিনে লিখতে ভালো লাগে, তবে এখনো ছাপার অক্ষরে নিজের লেখাটা দেখতে পেলে অনিন্দ্য পুলক অনুভূত হয়, হাতে নিয়ে মনে হয়—এই তো আমার অস্তিত্বের একটি স্মারক।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
কুমার দীপ: ওয়েবে সাহিত্যের প্রকাশ নিঃসন্দেহে ব্যাপক পাঠ ও পরিচিতির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। সংখ্যার হিসেব করলে সাহিত্যের প্রসারে এর বিরাট ভূমিকার সম্ভাবনা খুবই যুক্তিপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এখানে লেখক ও লেখার নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার ব্যাপারও আছে। প্রকাশের সাথে-সাথেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা অসহিষ্ণুতার শিকার হতে পারেন লেখক। তাছাড়া একটি লেখার যে কপিরাইট, সেটাও এখন হুমকির মুখে। একজনের লেখাকে যেমন আরেকজনের বলে চালিয়ে দেওয়ার বিপুল সুযোগ তৈরি হয়েছে, তেমনি লেখাটি সত্যিই যে কার, অনেক সময় প্রমাণের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
কুমার দীপ: সাহিত্যপাতার কথাই বা বলি কেন, দৈনিকের পুরো প্রিন্ট সংস্করণই তো এখন হুমকির মুখে। অনলাইন নিউজ প্রতি মুহূর্তে যেভাবে পাঠকের সামনে এসে হাজির হচ্ছে, তাতে কাগজের দৈনিক বা এর সাহিত্যপাতা অনেকটা গৌণ হয়ে পড়তে পারে।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
কুমার দীপ: একটি ওয়েবম্যাগকে শিল্প-সাহিত্যের কাছে দায়বদ্ধ হতে হবে। শুধু প্রকাশের জন্যই প্রকাশ নয়, প্রকৃত প্রকাশযোগ্য রচনাকেই বুকে ধারণ করে সামনে দাঁড়াতে হবে। লেখক অপেক্ষা লেখাকেই গুরুত্ব দিতে হবে। কে লিখলেন এটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চাইতে অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কী লিখেছেন সেই বিষয়টা। শিল্প-সাহিত্যের মৌলিক সূত্রকে না জেনে যারা কেবল নিজের বক্তব্যকে প্রকাশ করতে চান, তাদের লেখা প্রকাশের যুগ এটা নয়; এযুগে সবকিছুতেই যদি তৈরি হতে হয়, শিল্প-সাহিত্যেও হতে হবে। এটা মাথায় রেখেই যেকোনো সাহিত্য সম্পাদককে এগিয়ে যাওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।