তপন বাগচী—কবি, প্রাবন্ধিক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক। জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৬৮ সালে। উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ: শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি, কেতকীর প্রতি পক্ষপাত, অন্তহীন ক্ষতের গভীরে, সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল। প্রবন্ধগ্রন্থ: সাহিত্যের এদিক-সেদিক, সাহিত্যের কাছে-দূরে, চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : চন্দ্রাহত অভিমান, নির্বাচন সাংবাদিকতা, নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার, তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন এই কবি-গবেষক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
তপন বাগচী: লিটলম্যাগ আর ওয়েবম্যাগের তফাৎ ব্যাপক। কখনোই পরিপূরক নয়। লিটলম্যাগ যেমন পকেটের বাঁচিয়ে, সন্তানের দুধ কেনার টাকা বাঁচিয়ে, ধারদেনা করে প্রকাশ করা হতো, তেমনি আর্থিক সচ্ছল সম্পাদকও ছিলেন। দৈনিকে জায়গা না পেয়ে লিটলম্যাগ করার কথা যেমন জানি, তেমনি দৈনিকে প্রকাশযোগ্য লেখকও দৈনিকের দিকে না তাকিয়ে লিটলম্যাগ প্রকাশ করেছেন। লিটলম্যাগ একটা আদর্শিক লড়াই। পুঁজির কাছে লড়াইটা মার খেলেও কিছু অর্জন আছে আমাদের। কিন্তু প্রযুক্তির সুবিধা পেয়ে ওয়েবম্যাগ অনেকক্ষেত্রেই অসম্পাদিত। এর মধ্য দিয়েও বেশ কিছু ওয়েবম্যাগ আছে, যা অনেক লিটলম্যাগের চেয়ে সাহিত্যাদর্শে উন্নত।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
তপন বাগচী: বেশির ভাগ ওয়েবম্যাগই সুসম্পাদিত নয়, কখনো কখনো অসম্পাদিত, ঢের পাচ্ছি। কিন্তু সেগুলো কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। সাহিত্যরুচি নির্মাণে যদি ভূমিকা না রাখে, তবে সেই সব ওয়েবম্যাগের হতাশ-মৃত্যু অনিবার্য।
চিন্তাসূত্র: লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
তপন বাগচী: এসব ওয়েবম্যাগ প্রকাশের উদ্দেশ্য থাকে নিজের দুর্বল রচনাকে গুরুত্ব দান, যা ধোপে টেকে না। লিটলম্যাগেও সেই প্রবণতা দুর্নিরীক্ষ্য নয়। নিজের গুচ্ছকবিতা প্রকাশ, নিজেকে প্রধান প্রমাণের জন্য বন্ধু ও অনুজদের দুর্বল কবিতা পাশে রাখা, নিজের বইয়ের প্রশংসামূলক আলোচনা প্রকাশ, ছদ্মনামে নিচের বইয়ের আলোচনা লেখা, এসব করে তো কেউ লেখক হতে পারেনি। এই চেষ্টা এখনও রয়েছে। ওই বিকৃত আনন্দ পেতে থাক তারা, সাহিত্য তার নিজের নিয়মে চলুক।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
তপন বাগচী: পাঠক কবেই আর বইপাঠমুখী ছিল। ৫০০ কপি ক্রেতা পেলেই প্রকাশক খুশি। সেক্ষেত্রে ওয়বেম্যাগে তো হিট বেশি। বই না পড়ুক, সাহিত্য পড়লেই তো আমরা ধন্য। আর ৫০০ পাঠক থাকলেই চলবে। আমি তাদেরই মুখাপেক্ষী।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
তপন বাগচী: আমি তো সর্বভুক। দৈনিকের সাহিত্যপৃষ্ঠা, লিটলম্যাগ, ওয়েবম্যাগ তো বটেই দেয়ালপত্রিকা, এমনকি দেয়াললিখনও মন দিয়ে পড়ি। জমির দলিল কিংবা আদালতের রায়ের কপিও পড়ি। আর সাইনবোর্ড পড়তে পড়তে হাঁটি। কুড়িয়ে পাওয়া কাগজের ভাঁজে পেয়ে গেছি কত মহার্ঘ্য বচন। পৃথিবীতে অপাঠ্য নয় কিছুই। প্রকৃতি পড়ি, মানুষ পড়ি। জেগে থাকতে পড়ি, স্বপ্নেও পড়ি। আর আমার কল্পনার পাঠ যে কত বিস্তৃত, তার মাপ আমার জানা নেই।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও সীমিতসংখ্যক পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
তপন বাগচী: সংখ্যাবিচারে ও সুবিধাবিচারে ওয়েবম্যাগের সম্ভাবনা প্রবল পরাক্রমী। কিন্তু একটা কাঠামোতে দাঁড়াতে আরও কিছু সময় লাগবে। আমরা তার জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করব।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
তপন বাগচী: যতই প্রসার ঘটুক ওয়েবম্যাগের, মুদ্রিত মাধ্যমের গুরুত্ব সহজে কমবে না। মুখের কথা ও চিন্তাকে অক্ষররূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল মুদ্রণযন্ত্র। এখন যদি বৈদ্যুতিন মাধ্যম তার স্থান দখল করে, তাকে সময়ের দাবি হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি করার মতো প্রতিক্রিয়াশীল আমি নই।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
তপন বাগচী: ব্লগজিন বিনে পয়সায় খোলা যায়। কিলোবাইট হিসেবে তো টাকা খসে। পকেটে লাখ টাকা থাকলে্ই কেউ লিটলম্যাগ করতে উঠেপড়ে লেগে যান, বিষয়টি এমনও নয়। এখানে টাকার চেয়ে রুচি, যোগ্যতা ও আদর্শটাই বড়। ব্লগজিনে পরিশ্রম কম। লেখকদের কাছ থেকেই কম্পোজ করা লেখাই আসে। তাই সম্পাদনা দূরে থাক, প্রুফ দেখার ঝক্কিটা না পোহালেও চলে। মজার ব্যাপার হলো, ৫টি বাক্য শুদ্ধ লিখতে পারে না, সেও এখন ব্লগজিন বের করে। এ্ কেবল নিজের প্রচার, সম্পাদক হিসেবে বাহবা পাওয়া, লেখক হিসেবে সমাজে কল্কে পাওয়ার গোপন অভীপ্সা থেকেই এই উদ্যোগ।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
তপন বাগচী: সাহিত্য পড়তে চাই। নির্ভুল বানান চাই। বিশুদ্ধ বাক্য চাই। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা চিন্তার প্রতিফলন চাই। জমা হওয়া লেখার সমাবেশ নয়, পরিকল্পনার বাস্তবায়ন চাই।