চিন্তাসূত্র: দেশ থেকে অনেক দূরে আছেন। কত বছর ধরে আছেন প্রবাসে? কেমন লাগছে প্রবাসজীবন?
ফকির ইলিয়াস: আমার পরবাসজীবন প্রায় ৩২ বছরের। এখন তো আর ভালো না লাগার কোনো কারণ নেই। শিকড় নিচে গেঁথে গেলে যা হয় আর কি!সুখে-দুঃখে ভালোই আছি বলতে পারি।
চিন্তাসূত্র: কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখির সুযোগ পান কেমন?
ফকির ইলিয়াস: আমি রুটিন মাফিক চলি। আমার একটা বরাদ্দ সময় থাকে পড়াশোনার। লেখালেখির। আমি পাঁচ দিনে ৪০ঘণ্টা জীবিকার জন্য খাটি। বাকি দুদিন ছুটি। ওই দুইদিন সময় বের করে লিখি। কাজে যাওয়া-আসার ফাঁকে প্রায় তিনঘণ্টা সময় বরাদ্দ থাকে বাহনে বসে পড়ার। আন্তর্জালিক আড্ডা দেওয়ার। সপ্তাহে লেখার একটি তালিকা থাকে আমার কম্পিউটারের টেবিলে।
চিন্তাসূত্র: দূরপ্রবাসে বসে দেশকে কেমন অনুভব করেন? হঠাৎ করেই দেশে ফেরার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে কখনো? দেশের কথা মনে পড়লে কী করেন?
ফকির ইলিয়াস: দেশকে অনুভব তো করিই। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমি মার্সিডিস নিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে দৌড়াব কোথায়? সেই সড়ক কি আছে? নেই। চাইলেই আমি বাংলাদেশকে, সমাজকে, মানুষের মানসিকতাকে বদলে দিতে পারছি না। এই দুঃখটি আমাকে বেশি কাঁদায়। ইচ্ছে ছিল ২০ বছরের বিদেশ জীবন শেষ করে বাংলাদেশে ফিরব। পারিনি। আমার মতো অনেকেই পারেননি। পারবেন না। মা’কে মনে পড়ে খুব বেশি। মা দেশে থাকেন। আর আমার মা’ই তো মাতৃভূমি। দেশের গান শুনি। ভালো কবিতা পড়ি, মন খারাপ হলে।
চিন্তাসূত্র: প্রবাসে সাহিত্যচর্চায় কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি পড়েছেন?
ফকির ইলিয়াস: আমাকে এমন কোনো প্রতিকূলতা পেরোতে হয়নি। বিদেশে ভাণ্ডার অনেক। পড়াশোনার সুযোগ আছে। আর্কাইভ আছে। আমি যে শহরে থাকি, নিউইয়র্কে অনেক বিস্তৃত পরিমণ্ডল সাহিত্য-শিল্পের। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মিডিয়ায় লিখতে পারছি, প্রবাসে আছি বলেই। আমার আনন্দ সেটাই।
চিন্তাসূত্র: সামনে বিজয় দিবস। এ সময় আপনি দেশের বাইরে। বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর সময় বিদেশের মাটিতে বসে দেশকে কিভাবে উপলব্ধি-ধারণ করেন? দিবসগুলো পালন করেন কিভাবে?
ফকির ইলিয়াস: দেখুন, আমি একসময় সাংগঠনিক মাঠকর্মী ছিলাম। নিউইয়র্কে আজ যে সাংস্কৃতিক ব্যাপৃতি গড়ে উঠেছে, এর প্রায় ৯০ শতাংশেই কোনো না কোনোভাবে আমার হাতের ছাপ রয়েছে। বিজয় দিবস আমার প্রাণের দিবস। ডিসেম্বর আমার নিজেরও জন্মমাস। এই মাসটিকে আমি সেলিব্রেট করি আনন্দযজ্ঞে। আমি সবসময় চাই, বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাক। মানুষ সৃষ্টিশীল হয়ে দাঁড়াক। আমি সাহিত্য-অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়েই বিশেষ দিবসগুলো কাটাই। কবিতা পড়ি। কবিতা শুনি। লেখালেখি করি।
চিন্তাসূত্র: আগামী বইমেলায় আপনার কোনো বই আসবে?
ফকির ইলিয়াস: হ্যাঁ, আসবে। দুটি বই কনফার্ম। ‘শহীদ কাদরীর দরবারের দ্যু্তি’ (প্রবন্ধ)। আর ‘প্যারিস সিরিজ ও অন্যান্য কবিতা’। আরেকটি প্রকাশনী থেকে ‘কবিতা সংগ্রহ’ বের হতে পারে, না ও হতে পারে।
চিন্তাসূত্র: দেশের সাহিত্যচর্চার নিয়মিত খোঁজ পান? কিভাবে দেখছেন এ সময়ের সাহিত্যচর্চা?
ফকির ইলিয়াস: আমি নিয়মিত ঢাকা’র দৈনিকের সাহিত্যপাতা, ওয়েব পোর্টালগুলো পড়ি। মিলিয়ে দেখি, বিদেশি সাহিত্যের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে। বাংলাদেশের নবীনদের মাঝে ‘শর্টকাট’ প্রতিষ্ঠার লড়াই আমাকে আহত করছে। কেউ কেউ খুবই ভালো লিখছেন। নিরীক্ষণ করছেন। এটা আশার দিক। কিন্তু ফেসবুকে ‘আমিও কবি’ মার্কা আবর্জনা সবার ক্ষতি করছে। সাধারণ পাঠক প্রতারিত হচ্ছেন। কেউ কেউ বছরে ৮/১০টা বই লিখে ঘরের কোণা ভরিয়ে দিচ্ছেন। এদের সাধন-ভজন নেই। আর সাধনা না করলে তো সাহিত্যিক হওয়া যায় না।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ফকির ইলিয়াস: অনুবাদ করতে হবে শক্ত হাতে। এর জন্য উদ্যোগী হতে হবে। একটি উদাহরণ দেই। একটি লিটল ম্যাগাজিনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমি একজন প্রখ্যাত মার্কিন কবির তিনটি কবিতা অনুবাদ/রূপান্তর করেছি সম্প্রতি। এই কবিতাগুলো ভাবান্তর করতে গিয়ে আমি আমার বড় মেয়ে, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে মাস্টার্স প্রস্তুতিপর্বের ছাত্রী নাহিয়ান ইলিয়াসের সাহায্য নিয়েছি। একটা বিষয় লক্ষ করলাম, তার আর আমার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বেশ ভিন্ন। অনুবাদ এভাবেই ভিন্ন হাতে, ভিন্ন মাত্রা পায়। ভিন্ন ভাবনা খুলে দেয়।
কিছুদিন আগে, কবি কামাল চৌধুরীকে নিয়ে আমরা নিউইয়র্কে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সেখানে আমি অনুবাদের বিষয়টি বলেছি। জানতে চেয়েছি, বাংলা একাডেমির অনুবাদ সেলে কোনো বাজেট থাকে কি না। সাজেস্ট করেছি, অনুবাদ এভাবে হতে পারে; যেমন ঢাকায় একদল পেইড অনুবাদক একটি ভালো উপন্যাস/কবিতার বই প্রাথমিকভাবে অনুবাদ করলেন। তারা সেটা আমেরিকায় পাঠালেন। আমেরিকায় একটি সমন্বয়ক টিম থাকবে। তারা আন্তর্জাতিক মানের কয়েকজন অনুবাদককে রেডি করে রাখবেন। সমন্বয়কারীরা প্রাথমিক অনুবাদ মার্কিনি অনুবাদকদের হাতে তুলে দেবেন। এরপর ঢাকার মূল অনুবাদক, সমন্বয়কারি টিম ও মার্কিনি অনুবাদকরা মিলে ফাইনাল করবেন। তারপর বইটি লন্ডন-নিউইয়র্ক-প্যারিস থেকে একযোগে বের হবে। কাজটা খুব কঠিন। কিন্তু আমি জানি আমরা চাইলেই তা পারবো। আমি পারবো, আমার দায়িত্ব পালন করতে। কিন্তু বাজেট কে দেবে? বাংলা একাডেমি দেবে? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দেবে? টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। অনুবাদকের প্রতিঘণ্টা সম্মানী নিউইয়র্কে ১৫০ থেকে ৩৫০ ডলার। এসব কথা আমি আমাদের সম্মানিত বন্ধু কবি কামাল চৌধুরীকে বলেছি। তিনি বলেছেন, ঢাকায় গিয়ে কথা বলবেন। আমি আশাবাদী মানুষ। আশা দিয়ে আমার দিন শুরু হয়। প্রতিদিন একটা দুটো ভালো কাজ করি। ভালো সংবাদ পাই। ভালো লেখা পড়ি। আমি এভাবেই বাংলার অনুবাদ-সাহিত্য নিয়ে আশায় আশায় আছি, থাকি।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতার মধ্যে কোন শাখাকে আপনার ঋদ্ধ মনে হয়?
ফকির ইলিয়াস: আমি কবিতার মানুষ। বিশ্বে ভালো প্রবন্ধের সংখ্যা খুব বেশি নয়। গল্প নতুন প্রাণ পাচ্ছে। নতুন গল্পকার নতুন চোখ দিয়ে ঘটনা দেখছেব- দেখবেন—এটাই নিয়ম। সময়ের সঙ্গেই সাহিত্য এগোয়। কবিতার পাশাপাশি, বাংলাদেশে এই সময়ে বেশ কিছু প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক দাঁড়িয়েছেন। তা আমি লক্ষ করছি।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার আশাবাদ সম্পর্কে জানতে চাই।
ফকির ইলিয়াস: বাংলা সাহিত্যের ভবিষৎ উজ্জ্বল। বিশ্ব প্রেক্ষাপট বদলেছে। ‘সাহিত্যের অর্থনীতি’ বলে একটি বিষয় এখন আলোচনায়। অর্থনীতি শাসন করছে অনেক কিছুই। আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হলে আমাদের অনুবাদ খাতে বড় বাজেট রাখতে হবে। নিজেদের মূল্যায়ন, নিজেদের করতে শিখতে হবে। কী করা যেতে পারে, তা আমি আগেই বলেছি।