শামীম হোসেন ১৯৮৩ সালের ৭ আগস্ট রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আত্মমগ্ন রয়েছেন তিনি কবিতায়। তার প্রকাশিত গ্রন্থ— বরেন্দ্র প্রান্তরে বসন্ত নামে (কাব্য-২০০৭), পাখি পাখি ভয় (কাব্য-২০১১), উপমাংসের শোভা (কাব্য-২০১২), শীতল সন্ধ্যা গীতল রাত্রি (কাব্য-২০১৩), ধানের ধাত্রী (কাব্য-২০১৫) এবং এক তুড়ি ছয় বুড়ি (ছড়া-২০০৮)। কবিতা লেখার পাশাপাশি সম্পাদনাতেও রয়েছে তার বিশেষ দক্ষতা। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে প্রকাশ করছেন শিল্প-সাহিত্যের কাগজ ‘নদী’। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার (২০১৫), রূপান্তর সাহিত্য পুরস্কার (২০১৩), রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (২০১১), অধ্যয়ন শিশু ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৬)। বর্তমানে তিনি গণমাধ্যমে কর্মরত। চিন্তাসূত্রের পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছেন আরেক তরুণ কবি পলিয়ার ওয়াহিদ।
পলিয়ার ওয়াহিদ: প্রথমে শুনতে চাই আপনার প্রথম কবিতা লেখার গল্প এবং প্রথম কবিতা ছাপার আনন্দ। প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের স্মৃতি শোনান।
শামীম হোসেন: সময়টা ছিল কৃষ্ণচূড়ার।প্রকৃতির যে সময়টাই ফুল ফোটে তেমন একটা দিনে কবিতার মতো করে একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি পড়তে দিয়েছিলাম এক বড় ভাইকে। বেশ কিছুদিন পর লেখাটি ছাপা হয়েছিল রাজশাহী থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক কাগজে। তবে আমার নামে নয়, সেই বড় ভাইটির নামে। প্রথম বই বের হয় ২০০৭ সালে। দারুণ এক উত্তেজনায় ছিলাম। আমার যে কখনো বই বের হবে কল্পনাও করিনি। একপ্রকার বন্ধু কবি আদিত্য অন্তরের উৎসাহে বেরিয়েছিল আমার ‘বরেন্দ্র প্রান্তরে বসন্ত নামে’ গ্রন্থটি। অখ্যাত কোনো কবির বই করার সাহস দেখিয়েছিল ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। পরে বইটি নিয়ে সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় অনেক আলোচনা ও পরিচিতি ছাপা হয়েছিল।
পলিয়ার ওয়াহিদ: এবার আপনি কবিতায় ‘কালি ও কলম পুরস্কার’ পেলেন। ‘চিন্ত্রাসূত্র’-এর পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন। আপনি আসলে জীবনে কী হতে চেয়েছিলেন? কবিতা ছাড়া আর কোন কোন কাজে আনন্দ পান?
শামীম হোসেন: চিন্তাসূত্রকেও ধন্যবাদ জানাই। স্বল্পায়ু জীবনে মানুষ তো অনেক কিছুই হতে চায়। একটা স্বপ্ন সামনে রেখে এগিয়ে যায়।তবে জীবন যাদের সময় দেয় তারাই হয়তো কবি হয়। মনে ও মননে আমি একটি কাজ করেই অধিক আনন্দ পাই, তা হলো কবিতা।
পলিয়ার ওয়াহিদ: কবি শামসুর রাহমানের প্রয়াণে আপনি একটা কবিতা লিখেছিলেন ‘এমন বিরহকাতর সন্ধ্যা দেখেনি কেউ’। অভিযোগ আছে তরুণরা নাকি তাঁর কবিতা পড়ে না! আপনি কি মনে করেন? এখন শামসুর রাহমানের কবিতা আপনার কাছে কেমন লাগে?
শামীম হোসেন: তরুণরা যে শামসুর রাহমানের কবিতা পড়ে না—এটা কাদের অভিযোগ তা কিন্তু তুমি বলোনি। তবে এ কথা তো সত্য—কবিতা বিশেষ মুহূর্তের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হয়। আজকের মুহূর্তে যা ভালো লাগছে, কাল তা নাও লাগতে পারে। আমি কিন্তু বরাবরই অগ্রজদের কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়ি। কবি শামসুর রাহমানও কিন্তু একটি কালখণ্ডের অনিবার্য নাম।
পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনার কবিতায় গ্রাম বাংলা, লতা পাতা, মাঠঘাট, মাটি কাঁদা—এসব ঘুরে ফিরে দেখা যায়। কারণটা কী? কবিতার বিষয় নিয়ে আপনার কি কোনো নতুন ভাবনা-চিন্তা আছে?
শামীম হোসেন: আমি যে পরিবেশে থাকি কিংবা যা মনে ধারণ করি, তাই তো আমার কবিতায় উঠে আসবে। চিরায়ত বাংলাকে তো বাঙালি হিসেবে অস্বীকার করতে পারি না। আমাদের পূর্বজদের দিকে তাকাও তাদের কবিতায় কী দেখতে পাবে। এখন হয়তো সময়ের প্রয়োজনে কবিতায় ইট-কাঠ-লোহা-লক্কড়ও ঢুকে যাচ্ছে। নিজের কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য নিয়ে অবশ্যই আমার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। হয়তো সামনেই তা দেখতে পাবে। কোনো কবিই তো চিরজীবন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। প্রবাহিত স্রোতে ভাঙচুর তো হয়ই।
পলিয়ার ওয়াহিদ: কবিতা আপনি কিভাবে লেখেন? মানে কবিতা কিভাবে আপনার কাছে ধরা দেয়? অনেকে নাজিল হওয়ার কথা বলেন!সে রকম কি কিছু টের পান? আপনার প্রসেসটা শুনতে চাই।
শামীম হোসেন: কিভাবে কবিতা লিখি, এটা বলা মুশকিল। তবে আমার জীবনটাই কবিতার ভেতর দিয়ে যাপন করি। কবিতা লেখার জন্য গভীর রাত থেকে ভোরবেলাটা আমার কাছে বেশি প্রিয়।কবিতা লেখার জন্য আমি মাথায় কোনো ছক কাটি না। গভীর পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণকে কাজে লাগাই।শব্দের বাহুল্য না বাড়িয়ে কবিতাকে চিন্তার দিকে ঠেলে দেই।
পলিয়ার ওয়াহিদ:আপনার প্রিয় তিনজন করে কবির নাম শুনতে চাই।
শামীম হোসেন: অনেকের লেখা ভালো লাগে। কাকে ছেড়ে কার নাম বলব। আমি তো কোনো পরীক্ষা দিচ্ছি না তাই সেভাবে নাম বলতে চাই না।
পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনার সময়ে কবিতার প্রবণতা অস্থির ও বিমূর্ত। খাঁটি বাংলায় যাকে বলে দুর্বোধ্য! সেটা কি স্বীকার করেন? পদ্য ঢঙ ভেঙে গদ্যে রবীন্দ্রনাথও কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন কিন্তু আপনাদের সময়ে এসে সেটা মহামারী রূপে দেখা দিল! এই সময়ের একজন কবি হিসেবে ব্যাপারটা কিভাবে দেখেন আপনি?
শামীম হোসেন: কবিতার বিচার কি দশক ধরে করা সম্ভব? পূর্ববর্তী সময়ের জের তার পরে লিখতে আসা কবিদের ভেতরও থাকে। সবার কবিতাই কি অস্থির বা বিমূর্ত। যে কবিতাগুলোকে দুর্বোধ্য বলা হচ্ছে—সেগুলোকে কি তাহলে কবিতা বলব—যা বোঝাই যায় না। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে গদ্য-পদ্য নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।
পলিয়ার ওয়াহিদ: কবিতার পাঠক চিরকাল কম। কিন্তু দিনদিন অবসরগুলো অন্য মাধ্যমে গ্রাস করছে! কবিতার পাঠক কম বা বাড়া শেষ পর্যন্ত কাদের ওপর নির্ভর করে?
শামীম হোসেন: কবিতার পাঠক চিরকাল কম—কোন পরিমাপে বলছ? পুঁথিপাঠের সময় যেভাবে মানুষ তা শুনেছে, এখন তো শুনছে না। কারণ মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে—ধীরে ধীরে মরছে মনও। এতে হতাশ হওয়ার কারণ নেই—ভালো কবিতা পেলে মানুষ পড়েই।
পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনার কবিতায় কুয়াশা, দীর্ঘশ্বাস, দুঃখ, কান্না, অন্ধকার অন্যদিকে অরণ্য, কোলাহল শব্দের ব্যবহার অধিক লক্ষ্য করা যায়। এটা কি সচেতন না কি অবচেতনে প্রয়োগ?
শামীম হোসেন: নানা ক্ষেত্রে জীবন বহুরকম বাঁক নেয়। কখন যে কোন মুহূর্তে শব্দগুলো চলে আসে কবিতায় তা বলা মুশকিল। এর বাইরেও তো অনেক নতুন শব্দ ব্যবহার করেছি আমার কবিতায়। সচেতনভাবে পড়লে হয়তো নজরে আসবে তোমার। আমার আগামী বইয়ে হয়তো আরও মুগ্ধতার কিছু পাঠক পেতে পারে।
পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বরেন্দ্র প্রান্তুরে বসন্ত নামে’ গ্রন্থে ‘সূর্য’ শিরোনামে একটি কবিতায় বলেছেন—‘সূর্যমুখীর মতো লাল সূর্যটা একদিনের জন্য হলেও আমার—চাই-ই-চাই…’ এখানে জীবনের কোন সূর্যের কথা বলেছেন?
শামীম হোসেন: চাওয়া-পাওয়া নিয়েই তো জীবন প্রবাহিত হয়। সবার জীবনেই বোধহয় বঞ্চনা থাকেই। কেউ জীবনের কাছে নতজানু হয়ে সমর্পণ করে—কেউ সংগ্রামটা চালিয়ে যায় সমগ্রজীবন।তেমন কবিও জীবনেও হতাশা থাকতে পারে—কিন্তু আত্মবিশ্বাস থাকা চাই শতভাগ। সেটা অবশ্যই তার লেখার প্রতি।
পলিয়ার ওয়াহিদ: আল মাহমুদ অনেক আগেই ঘোষণা করেছেন বাংলা সাহিত্যের রাজধানী ঢাকা। প্রশ্ন হচ্ছে কলকাতার কবিতা থেকে আমাদের কবিতা এগিয়ে কোন বিচারে? না থাকলে কোন ভিত্তিতে পিছিয়ে তারা? আপনি একজন কবি হিসেবে বিষয়টা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
শামীম হোসেন: আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদ কোন মাপকাঠিতে ঢাকাকে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী বলেছেন—তা আমার জানা নাই। যখন কথাটি বলেছেন তখন হয়তো তাঁর কথা ঠিক ছিল। কিন্তু এখন তো সাহিত্য শুধু ঢাকায় রচিত হচ্ছে না। কলকাতার কবিতা কিংবা বাংলাদেশের কবিতা এগিয়ে না পিছিয়ে—এ তর্কে জড়িয়ে বাংলা কবিতার লাভ কী? যেহেতু ভাষা এক কিন্তু ভৌগলিক সীমা আলাদা আমাদের। ফলে লেখাও আলাদা হতে পারে। আমার মনে হচ্ছে বাংলা কবিতা বহুরৈখিক একটা বাঁক নিচ্ছে।
পলিয়ার ওয়াহিদ:বাংলা কবিতার ভবিষ্যত কী? যে যা ইচ্ছে লিখে তাকে কবিতা বলে চালিয়ে দেওয়ার যে টেন্ডেন্সি চালু হয়েছে তাতে কবিতায় একটা অরাজকতা চলছে বলে বোদ্ধা মহলের দাবি! আবার অনেকে আশাবাদী বাংলা কবিতা খুব এগিয়ে যাচ্ছে! আপনি কী মনে করেন?
শামীম হোসেন: কবিতা অতীতেও ছিল এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। যে যা ইচ্ছে লিখে তাকে কবিতা বলে চালিয়ে দিচ্ছে—দিক। এগুলো নিয়ে ভাবার কিছু নেই। এরকম ঝাঁকে ঝাঁকে তো অনেকেই আসে কবিতার ঢংকা বাজাতে। যার থাকার সে থেকে যায়। যে বোদ্ধা মহল বলে কবিতার দিন শেষ—আমি তাদেও সঙ্গে একমত নয়। ভালো কবিতা পেলে এখনোও পাঠক পড়ে। বিশ্বকবিতার অংশও কিন্তু বাংলা কবিতা—তা ভুলে গেলে চলবে না। অনেক তরুণই তো ভালো লিখছে—আমরা কজনের খোঁজ রাখছি। আমাদের মিডিয়াগুলো তো গোষ্ঠীচর্চায় আবদ্ধ। তাদেরও তো দায়িত্ব আছে মেধাবী লেখক-কবিকে যথাযথ স্পেস দেওয়ার। বাংলা কবিতা নিয়ে আমি মোটেও হতাশ নই—খুবই আশাবাদী।