কাজী জহিরুল ইসলাম। জন্ম ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। প্রকাশিত গ্রন্থ পঞ্চাশ। কাব্যগ্রন্থ ১৭টি। কবিতায় পেয়েছেন কবি জসীম উদ্দীন পুরস্কার। কাজ করছেন জাতিসংঘের সদর দফতর, নিউ ইয়র্কে। সম্প্রতি প্রবাসের সাহিত্যচর্চা নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন এই কবি।
চিন্তাসূত্র: দেশ থেকে অনেক দূরে আছেন। কত বছর ধরে আছেন প্রবাসে? কেমন লাগছে প্রবাসজীবন?
কাজী জহিরুল ইসলাম: আমি কিন্তু সেই অর্থে প্রবাসী না। আসলে প্রবাসী বলতে পারেন, তবে অভিবাসী না। আমি দেশ ছেড়ে চলে আসিনি। কর্মসূত্রে দেশের বাইরে থাকি। ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে যাই কসোভোতে, ফিরে আসি ২০০৩ সালের এপ্রিলে। আবার যাই ২০০৪-এর নভেম্বরে, আইভরিকোস্টে। কেউ কেউ চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম, রাজশাহী যায় না? আমার কাছে এটাও সেই রকম। আমি জাতিসংঘের চাকরি নিয়ে কর্মস্থলে যাই। দেশ-বিদেশ কনসেপ্টটা আপেক্ষিক। পতাকা, সার্বভৌমত্ব, সরকার ভিন্ন বলেই আমরা বিদেশ বলছি। ভারত বিদেশ, পাকিস্তান বিদেশ। অথচ এই দু’টি দেশ তো ৭০ বছর আগেও স্বদেশ ছিল। আবার আজকের চট্টগ্রাম যে ৭০ বছর পরে বিদেশ হয়ে যাবে না কে জানে। আবার উল্টোটাও হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ স্বদেশ হয়ে যেতে পারে। দুই জার্মানি এক হয়েছে না? আমার কাছে পুরো পৃথিবীটাই মানুষের বিচরণক্ষেত্র। কোনো ভূ-খণ্ডই বিদেশ নয়।
বিদেশ বিবেচনা বাদ দিয়ে যদি দেখি—এখন যে ভূ-খণ্ডে বাস করছি তা আমার জন্মস্থান বা বেড়ে ওঠার কালের স্থানের সংস্কৃতি থেকে কতখানি বিচ্যুত, কী কী আমি পাই, কী কী পাই না। আমি যখন কসোভোতে বা আফ্রিকায় ছিলাম, তখন অনেক কিছু পেতাম না। ছোটো মাছ, কচুর লতি, কাঁঠালের বিচি—এইসব খাবার, আবার বাংলা ভাষায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো অথবা কোনো কাগজের সাহিত্য সম্পাদকের রুমে বসে শিল্প-সাহিত্যের আড্ডা দেওয়া, এসব এখন পাই। যখন লন্ডনে বা নিউ ইয়র্কে আছি তখন কিন্তু এর সবই পাচ্ছি। তাই আমার মধ্যে আহাজারিটা তেমন নেই। একসময় বাংলা বইয়ের অভাব বোধ করতাম, এখন তাও করি না। দেশ থেকে বই আনাতে পারছি। এখানেও বইয়ের দোকান হয়েছে। তবে একটি জিনিস আমি লক্ষ করেছি, যারা দেশে আছেন তারা আমাদের, মানে আমরা যারা দেশে নেই, সেইসব লেখক/কবিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখক/কবি বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার মধ্যে বাংলা একাডেমিও আছে। তারা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার প্রবর্তন করেছেন প্রবাসী লেখকদের জন্য। যার মূল্যমান মূল বাংলা একাডেমি পুরস্কারের এক-দশমাংশ। খবরের কাগজগুলো প্রবাসীদের খবর ছাপে গুরুত্বহীন পাতায়। টিভিগুলো প্রবাসীদের জন্য চাঙ্ক রাখে মধ্যরাতের পরে। এই কাজগুলো আমার কাছে অন্যায় মনে হয়।
চিন্তাসূত্র: কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখির সুযোগ পান কেমন?
কাজী জহিরুল ইসলাম: আমি তো প্রচুর লিখি। ৪৩টি বই বেরিয়েছে। ২০১৮-এর মেলায় আরও ৮টি আসবে। আমার লেখার গতি ভালো। যখনই সময় পাই, তখনই লিখি। বিদেশে থাকি বলে আমার তো বাড়তি ব্যস্ততা নেই। হ্যাঁ, এখানে অনেক কাজ নিজেকেই করতে হয়, যেমন কাপড় ধোয়া, হাড়ি-পাতিল ধোয়া, বাজার করা, গাড়ি চালানো, বাড়ি সাফ করা; এমনকি বাড়ি বা গাড়ির কিছু নষ্ট হয়ে গেলেও প্রথমে নিজেরাই ঠিক করার চেষ্টা করি। যেহেতু শ্রমের দাম খুব বেশি, অন্য লোক ভাড়া করে কাজ করানো কঠিন। এত কিছুর পরেও আমার মনে হয় না যে, সময়ের অভাব। সময় নেই, এই অভিযোগ অনেকেই করেন। আমি করি না। আমি কি ম্যাজিক জানি? হবে হয়ত।
চিন্তাসূত্র: দূরপ্রবাসে বসে দেশকে কেমন অনুভব করেন? হঠাৎ করেই দেশে ফেরার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে কখনো? দেশের কথা মনে পড়লে কী করেন?
কাজী জহিরুল ইসলাম: শুনুন, দেশে ফেরার জন্য আকুলি-বিকুলি করি না আমি। তবে দেশের কল্যাণের জন্য ভাবি। সারাক্ষণ ভাবি। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। যারা দেশকে ভালোবাসেন তাদের উচিত, দেশের বাইরে যারা বাইরে যেতে পারছেন না, তারা যেন একটু হাত-পা মেলে বসতে পারেন, শুতে পারেন। জন্মস্থানের ধুলো-মাটি কাদার সঙ্গে অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে। এখন কথা হচ্ছে—আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে একটি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে, নইলে নিজের ও দেশের দুইয়ের জন্যই ক্ষতিকর। আবেগ হচ্ছে কলমের কালির মতো। কালি ছাড়া লেখা হয় না। আবার বেশি কালি ছড়ালে লেখা নষ্ট হয়ে যায়। দেশ একটি প্রচণ্ড আবেগ, আমি এই আবেগকে কলমের কালির মতো নিয়ন্ত্রণ করি।
চিন্তাসূত্র: প্রবাসে সাহিত্য চর্চায় কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি পড়েছেন?
কাজী জহিরুল ইসলাম:যেখানে কম মানুষ বাস করে, সেখানে মফস্বলীয় একটা ব্যাপার গড়ে ওঠে। দেশের বাইরে প্রতিটি দেশে বা শহরে অল্প সংখ্যক বাঙালি বাস করেন। ফলে তাদের আচরণে একটা মফস্বলীয় ব্যাপার চলে আসে। নিউ ইয়র্কের বাঙালিদের মধ্যেও এটা আছে। মফস্বলীয় আচরণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—পাশের বাড়ির হাড়ির খোঁজ নেওয়া। সাধারণত ভরা হাড়ির খোঁজটা প্রচার করে না কেউ, তারা প্রচার করেন শূন্য হাড়ির খবর। এতে করে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিক্ততা তৈরি হয়। নিউ ইয়র্কে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা যারা করে, তাদের অনেকের মধ্যেই এই বিষয়টি আছে। লন্ডনে আমি চার বছর ছিলাম, ওখানকার অবস্থাও একইরকম দেখেছি। মফস্বলীয় খোঁচাখুঁচি আমাকে করেন অনেকেই। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত, এখন বিষয়টা বরং আমি এনজয়ই করি। একসময় বাংলা বই পাওয়া যেত না। এই আক্ষেপ শহীদ কাদরীর সারাজীবন ছিল। দেখা হলেই বলতেন বইটই তো পাই না। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। হরদম লোক যাচ্ছে, পছন্দের বই আনাতে পারছি। আত্মীয়/বন্ধুরা কিনে মেইল করে দিচ্ছে। আর দুই বাংলার সেরা লেখক, কবি, সাংবাদিক, শিল্পী নিয়মিতই আসছেন নিউ ইয়র্কে। তাদেরস সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে। না, আমি আসলে কোনো প্রতিকূলতা অনুভব করি না।
চিন্তাসূত্র: সামনে বিজয় দিবস। এ সময় আপনি দেশের বাইরে। বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর সময় বিদেশের মাটিতে বসে দেশকে কিভাবে উপলব্ধি-ধারণ করেন? দিবসগুলো পালন করেন কিভাবে?
কাজী জহিরুল ইসলাম:আমি একটি সংগঠন করি, এর নাম ঊনবাঙাল। এবার বিজয় দিবসে ঊনবাঙাল একটি দারুণ আয়োজন করছে। সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠান। তিন/চারজন বড় মাপের অঙ্কন শিল্পী আছেন নিউ ইয়র্কে। যেমন: তাজুল ইমাম, রাগীব আহসান, মাতলুব আলী প্রমূখ। তারা ‘বিজয় দিবস’ থিমের ওপর ছবি আঁকবেন। কবিরা কবিতা পড়বেন, শিল্পীরা গান করবেন। আমরা বিজয়ের আনন্দে, বিজয়ের রঙে, বিজয়ের সিম্ফনিতে অবগাহন করবো। এখানে সকল জাতীয় দিবসই যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে তিনদিনব্যাপী বইমেলা সবই হয়। আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, অন্তরে বাংলাদেশ সবসময়ই ধারণ করি।
চিন্তাসূত্র: আগামী বইমেলায় আপনার কোনো বই আসবে?
কাজী জহিরুল ইসলাম:একুশের মেলায় আমার ৮টি বই আসছে। এরমধ্যে দুটি বর্ধিত কলেবরে পুনঃমুদ্রণ, বিহঙ্গপ্রবণ (আত্মজীবনী), সৃষ্টিপুরাণ ও অন্যান্য লোককথা (মিথ ও লোকজ গল্প)। অন্য ছয়টি হচ্ছে: বালিকাদের চাবিওয়ালা (কবিতা), যে বৃক্ষটি কাল হয়েছে গুম (কবিতা), থাবড়া হামিদ (উপন্যাস), উড়ালগল্প (ভ্রমণ), বড় নারীদের কথা ও অন্যান্য গদ্য (প্রবন্ধ/ইতিহাস/মুক্তগদ্য) ও মিতুর ঘড়ি (শিশুসাহিত্য)।
চিন্তাসূত্র: দেশের সাহিত্যচর্চার নিয়মিত খোঁজ পান? কিভাবে দেখছেন এ সময়ের সাহিত্য চর্চা?
কাজী জহিরুল ইসলাম: অনলাইন পোর্টাল, ওয়েবজিন ও ফেইসবুক এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর এখন তো সব কাগজেরই অনলাইন সংস্করণ আছে। কারও হাতে যদি স্মার্ট ফোন না থাকে আর কম্পিউটারেও বসতে না চান, তার জন্য অবশ্য দেশের বাইরে বসে যোগাযোগ রক্ষা করা বেশ কঠিন। তবে সেই রকম বাঙালি লেখক তেমন নেই বললেই চলে।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
কাজী জহিরুল ইসলাম: বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচিত গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ করে নিজেরা অথবা লবিং করে আন্তর্জাতিক প্রকাশকদের দিয়ে প্রকাশ করাতে হবে। ভালো কিছু ওয়েব সাইট থাকতে পারে, সেখানে নির্বাচিত বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ প্রকাশ করা যেতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে সব লেখকের উইকিপিডিয়া পাতা খুলে দিতে হবে। সত্যিকারের প্রতিভাবান সাহিত্যিককে পুরস্কার/সম্মাননা দিতে হবে। তাহলে লেখকেরা তৈল মর্দনে মনোনিবেশ না করে ভালো সাহিত্য তৈরিতে মনোনিবেশ করবেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় জাতীয় পুরস্কারগুলো দেওয়া হয় বলে লেখকেরা রাজনৈতিক রাস্তাঘাট খুঁজতে খুঁজতে গলদঘর্ম হন। ভালো লেখা তৈরিরে মন দিতে পারেন না।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতার মধ্যে কোন শাখাকে আপনার ঋদ্ধ মনে হয়?
কাজী জহিরুল ইসলাম: মৌলিক প্রবন্ধ চোখে পড়ার মতো হচ্ছে কই। গ্রন্থ আলোচনা হয় কিছু কিন্তু প্রকৃত আলোচনা হয় না। প্রশংসাই হয় বেশি। উপন্যাসে হই হই করেও তেমন কিছু হয়ে উঠছে না। স্টোরি লাইন খুব ন্যারো। বড় ক্যানভাসে উপন্যাস লেখার যোগ্যতা আমাদের লেখকদের হয়তো আছে কিন্তু তারা কেন জানি লিখছেন না। বেশি বই লিখতে চান, দ্রুত লিখতে চান, এটা একটা কারণ হতে পারে। কবিতায় কিছু কাজ কিন্তু হচ্ছে। তবে গার্বেজের সংখ্যা বেশি বলে চোখে পড়ছে না। এই সময়ের তরুণ কবিরা বেশ নতুন ধরনের চিত্রকল্প তৈরির চেষ্টা করছেন। ফরিদ কবির, মাসুদ খান প্রমুখের কবিতা আমার কাছে বেশ সমৃদ্ধ মনে হয়। মাহবুব হাসান, রহিমা আখতার কল্পনা ভালো লিখছেন, কিন্তু প্রচলিত বাঁক-ভঙ্গির মধ্যেই আছেন। সুইডেনে থাকেন কবি শাকিল রিয়াজ, তাকে আমার একজন জাতকবি মনে হয়। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল প্রকৃতিকে উপজীব্য করে লিখছেন আধুনিক কবিতা, উপস্থাপনায় বেশ নতুনত্ব আছে। আরও অনেকের নামই বলা যায়, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না বলে বলতে পারছি না। তবে বাংলা ভাষায় একজন অসামান্য প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল পঞ্চাশের দশকে, যিনি এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর নাম আল মাহমুদ। এত বড় কাব্যপ্রতিভা একটি জাতির মধ্যে খুব সহসাই আসে না।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার অভিমত-মূল্যায়ন জানতে চাই।
কাজী জহিরুল ইসলাম: বাংলা ভাষায় প্রতিভাবান লেখকের জন্ম হয় কিন্তু প্রতিভার মূল্যায়ন হয় না বলে অচিরেই ঝরে যায়। যে দুয়েকজন টিকে থাকেন, তারাও জীবনের একপর্যায়ে এসে স্বীকৃতির লোভে নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। স্বীকৃতির দরকার কী, একথা আমরা যতই বলি, এই যুগে স্বীকৃতিকে অস্বীকার করে এগুনো যাবে না। স্বীকৃতিকে স্বচ্ছ করতে পারলে বাংলা সাহিত্যে প্রতিভার জেল্লা দশগুণ বেড়ে যাবে ২/৩ বছরের মধ্যেই। অসাধারণ সব উপন্যাস, কবিতা বেরিয়ে আসবে। ভালো বই লেখা হলে, পাঠকও গড়ে উঠবে। আরেকটি কাজ করতে হবে, প্রকাশনা শিল্পকে পেশাদারিত্ব অর্জন করতে হবে। ৩০০/৫০০ কপি বইয়ের প্রকাশনার ইতি টেনে ১ লাখ কপির প্রকাশনায় নামতে হবে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদক থাকতে হবে সকল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। বাংলা ভাষাভাষী সব পাঠকের দোরগোড়ায় বই পৌঁছে দিতে হবে। এটাই প্রকাশনায় পেশাদারিত্ব অর্জনের প্রধান উপায়।