চিন্তাসূত্র: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
হেনরী স্বপন : প্রশ্নটির উত্তর একরকম বাণিজ্যীকরণের ব্যাখ্যায় দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, এবারের বইমেলায় ‘বেহুলাবাংলা নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সিরিজে আমারও একটি বই বেরুচ্ছে। এটি বেহুলাবাংলা প্রকাশনীর স্বত্বাাধিকারী কবি লেখক প্রকাশক চন্দন চৌধুরী প্রকাশ করছেন। যদিও আমার কোনো লেখাই শ্রেষ্ঠ উপাধিতে চিহ্নিত হওয়ার মতো নয়; তবু প্রিয় অনুজ প্রকাশকের একান্ত প্রশ্রয় ও উৎসাহে করপোরেট এই টিপ আমার ললাটেও পরতে হলো। বইটির প্রচ্ছদশিল্পী চন্দন চৌধুরী নিজেই। এছাড়া ভাষাপ্রকাশ থেকে ‘কবিতা, অবলোকন ও উন্মোচন’ শিরোনামে বেরুচ্ছে আমার দ্বিতীয় গদ্যগ্রন্থ। বইটির প্রকাশক ভাষাপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী ড. মিজান রহমান। সে নিজেও একজন লেখক ও গবেষক। এখানে বলে রাখা ভলো, কবিতা লেখাই আমার একমাত্র প্র্রণয় ও বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। সেই প্রণয়ের পাশাপাশি কবিতা পাঠের আভিজ্ঞতা ও ভালোমন্দ উন্মোচনের মতোন আমার পাঠ্যঅনুভব, কাব্যযাত্রার অভিজ্ঞতা, বন্ধুদের কবিতার প্রতি পক্ষপাত; এমন নানা বিষয়কে উপজীব্য করেই গদ্যগুলো লেখা হয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই লেখাগুলো গ্রথিত করেই আমার এই গদ্যগ্রন্থের আত্মপ্রকাশ। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন তরুণ প্রচ্ছদশিল্পী আল নোমান। এছাড়া এবার কলকাতা বইমেলায় অলোপৃথিবী প্রকাশন থেকে ‘গাছেদের হিজাব পরালে’ শিরোনামে একটি কবিতার বইও বেরুচ্ছে। এটিরও প্রচ্ছদশিল্পী আল নোমান। সর্বোপরি বলা যায়, আমার রচনাপত্রের প্রতি ব্যাপক উচ্ছ্বাস কখনো কোনোকালেই ছিল না তেমন। তবুও এ-বছর একে একে তিনটি বই প্রকাশিত হচ্ছে, এই ভেবেই বেশ উচ্ছ্বসিত আমি।
চিন্তাসূত্র: সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
হেনরী স্বপন : আমার তো মনে হয়, সারাবছরই প্রতিষ্ঠিত বড় প্রকাশকরা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু ও গুণমানসম্পন্ন বই প্রকাশ করে থাকেন। আর মননশীল এসব বইয়ের প্রতি পাঠকেরও আগ্রহ ঢের আছে। তবে, একশ্রেণির মেলাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও ভাড়াটে প্রকাশকের মাধ্যমে কতিপয় শৌখিন লেখক এবং প্রতিষ্ঠান বইমেলাকে ঘিরে এক রকম গ্রন্থ প্রকাশের প্রতিযোগিতা সৃষ্ট করে। আর এভাবেই মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশ মানেই পাঠক-লেখক ঠকানোর মচ্ছব চলে পুরো একটি মাস। তাই, বইকে ভালোবেসে বইমেলার ইমেজ খুঁজতে আসেন যে মানুষগুলো, তারা কখনোই সেই বইমেলার দেখা পাচ্ছেন না। সেই মেলা হচ্ছেও না। তবে যা হচ্ছে,তা হলো শুধু সেল! বিক্রয় ও বিক্রয় হচ্ছে। এতে লাভ হচ্ছে একটাই, একশ্রেণীর প্রকাশকের। যদিও পাঠক-প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটছে। তা-ও কিছুমাত্র কাল খোলা আকাশের নিচে। যারপরনাই প্রকাশকগণ একচেটিয়া পুষিয়ে নিচ্ছেন। ছেঁড়াভাঙা, লুজ সেলাই, যেনতেনপ্রকারেণ ছাপা, কাঁচা বাঁধাই; এমন সব বই পাঠককে কী করে গছাবেন, সেটাই মুখ্য চিন্তা প্রকাশকদের। এতে করে ক্রমশই ব্যবসায়িক বেনিয়া মনোবৃত্তিদের জমায়েতে কাতরাচ্ছে আমাদের বইমেলা।
বইমেলা তার ঐতিহ্যও হারাচ্ছে। কেননা এখনকার বইমেলায় জ্ঞানের পরিচর্যা, পাঠকের কল্যাণ, বিক্রেতাদের হৃদ্যতার লেশমাত্র নেই। অথচ ইউরোপ আমেরিকার সমস্ত পেশার অন্যতম বলে মূল্যায়িত হয় একজন প্রকাশকের কাজকে। কারণ এঁরা একটি দেশের শিল্পের পরিচর্যা করে, গ্রন্থরুচি ও দেশের মান বৃদ্ধি করে, উন্নত ও রুচিশীল লেখা প্রকাশ করে বলেই এঁদের এতটা সম্মান দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আমাদের প্রকাশকরা করেন উল্টোটি। কেউ করেন-‘পাইরেট এডিশন’ কেউ কেই তো বই প্রকাশের রীতিনীতির তোয়াক্কাই করেন না। উপরন্তু পাঠককে ছাড় দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার পরিবর্তে এঁরা নিজেরাই কে কতটা সুবিধে সুযোগ আদায় করে নেওয়া সম্ভব; এমন চিন্তার আবর্তেই ব্যস্ত প্রকাশকেরা।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
হেনরী স্বপন : বইমেলার শুরুটা বই বিক্রীকে কেন্দ্র করে আরম্ভ হলেও, দিনে দিনে এটি এখন আর স্রেফ বই ব্যবসার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কারণ, এই মেলা জাতীয় জীবনে, বিশেষ করে সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রগতিতে যে প্রভাব বা বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কেননা, এদেশে একমাত্র মেলা উপলক্ষে যে বিপুলসংখ্যক নতুন বই প্রকাশিত হয়, পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে এত সংখ্যক বই বের হয় কি না, আমার জানা নেই। আবার, এই সময়ে অনেক প্রতিভাবান লেখকের প্রথম বই কিংবা অনেক তরুণ প্রথম গ্রন্থকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সর্বপরি বইমেলা এখন লেখক, প্রকাশক ও পাঠকের গণ্ডি পেরিয়ে একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। যদিও এই বইমেলা ঘিরেই গর্দা-ভূষি মালের মতো সস্তা হয়ে উঠছে, কবি ও লেখক উপাধি। এবং আর্থিক লেনদেনের তোড়ে তৈরি হচ্ছে যথেচ্ছ কিছু ফিডার লেখক/ সৌখিন কবির দল। এতে মেলা নির্ভর বছর বছর বাড়ছে যে বইয়ের সংখ্যা, ও-গুলো তো, বই নয়? ললিপপ প্রকাশনীর বইনামক প্রোডাক্ট! ফলে এই প্রোডাক্টের ভিড়ে বাংলা সাহিত্যের গুণমানসম্পন্ন বই আর মননশীল লেখকের সাময়িক কিছুটা ক্ষতিও হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
হেনরী স্বপন : একুশের বইমেলার আয়োজক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলা একাডেমি নামক একটি প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা দিয়ে থাকে এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রকাশনা সংস্থাগুলো অংশগ্রহণ করে মাত্র। এক্ষেত্রে প্রকাশনা শিল্প ও তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় বা একাডেমি তেমন কোনও ভূমিকাই পালন করে না। যদিও একুশের বইমেলা মানেই এক মাসে তরুণদের প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যাই বেশি থাকে। হয়তো সেইসব বই মানসম্মত নয় বলে বিবেচিত হওয়ার সংখ্যাও অধিক। যদিও বলতেই হয়, যা মানসম্মত নয়, তা শ্রম দিয়ে টাকা খরচা করে বের করার প্রয়োজন কী? তবে নতুন লেখক হলেই বই মানহীন হবে, এমন ধারণাও ঠিক নয়। অনেক নতুন লেখক তার প্রথম গ্রন্থেই খ্যাতিমান হয়েছেন। দ্য গড অব স্মল থিংস প্রকাশের আগে অরুন্ধতী রায় কিন্তু লেখক হিসেবে পুরোপুরি অপরিচিত ছিলেন। আর মার্গারেট মিশেল প্রথমত একমাত্র উপন্যাস লিখে ১৯৩৭-পুলিৎজার লাভ করে। সম্প্রতি এক জরিপে জানা যায় আমেরিকায় বাইবেলের পর এটিই সর্বাধিক পাঠকনন্দিত বই। আর আজ আমরা যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক বলে দাবি করি, তারা একদিন অনেকেই লিটল ম্যাগাজিন দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলাম। তাই, বইমেলায় ছোটকাগজ বা লিটল ম্যাগাজিনের উদ্যোগকে আরও বেশি আনুকূল্য ও প্রণোদনা দিয়ে বহু তরুণ সম্ভাবনাময় লেখক খুঁজে পাওয়াও সম্ভব। এক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনের প্রথাবিরোধী লেখকদের প্রতিভা বিকাশের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া দরকার। পাশাপাশি নতুন প্রতিভাবান লেখকদের বই প্রকাশে কাগজে ভর্তুকিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
হেনরী স্বপন : এখনকার ডিজিটাল সভ্যতায় কেবল প্রকাশনা উপরণই নয়। বাজারি উপকরণের চেয়েও বাড়ছে লেবেন্সুস মার্কা বইয়ের সংখ্যা। যদিও মানহীন এইসব বইয়ের সংখ্যাধিক্যে প্রকৃত লেখকের এবং ভাল বইয়ের কিছু আসে যায় না! আর, নীতিমালা প্রোফাইল-এসব আমলাতান্ত্রিকতা! প্রকৃত শীল্পের জন্য প্রয়োজন নাই। ভাল শিল্পবোধ সম্পন্ন প্রকাশকরা সঠিক বইটি বেছে নিয়ে মানসম্পন্ন ভাবেই প্রকাশ করবেন।
তবে, সরকারের ডিজিটাল দায়বদ্ধতার জন্য হলেও, একটি বড় ডিজিটাল ডিসপ্লের মাধ্যমে বইয়ের প্রচ্ছদ প্রকাশক পরিচিতি স্টল নির্দেশনার ব্যবস্থা কম্পিউটারইজ করা তো মোটেই দুরূহ কাজ নয়। সর্বপরি বইমেলার বিক্রয় এবং নিয়মকানুন শৃঙ্খলা ও নীতিমালাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের একচেটিয়া ভূমিকার সঙ্গে যেনো একটি সামাজিক কমিটি থাকে, যেখানে প্রকাশক কবি লেখক শিল্পী বইপ্রেমীপাঠকেরাও যুক্ত থাকবেন। কারণ, বই সমগ্র জাতির চেতনা ধারণ করে। জাতির সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার পরিচয় বহন করতে অন্তত বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের প্রধানতম লেখক, প্রকাশক, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে বসে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে বইমেলার মান ও মর্যাদা বাড়াতে প্রকাশনাশিল্পকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা গুরুত্বের সাথে ভাবা প্রয়োজন জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বার্থে। আর তাতেই আশা করি আমাদের প্রাণের বইমেলা অন্ততঃ বাণিজ্যমেলা, ট্রেড ফেয়ার কিংবা বইয়ের বাজার হয়ে উঠবে না। এমোন একটি সার্বিক বইমেলা হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কী?