চিন্তাসূত্র:এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোস্তফা হায়দার: এবারের বইমেলায় আমার একটি কাব্যগ্রন্থ আসছে। গ্রন্থটির নাম ‘চৈতালিপার্বণে কাঁচা মাংস’। প্রকাশক ইনভেলাপ, ঢাকা। প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। বইটিতে সময়ের যাপিত চিত্রকলার এক হাসিকান্না,বিরহ ও অধিকারের চিত্রালি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
চিন্তাসূত্র:সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মোস্তফা হায়দার: সারাবছর বই প্রকাশ করা আসলে কিছুটা দুঃসাধ্য। কারণ বই বাইন্ডিং করা শ্রমিকের পর্যাপ্ততা পেতে কষ্ট। অন্যদিকে বইমেলা কেন্দ্রিক বই প্রকাশের আনন্দ কিছুটা আলাদা। মেলাকেন্দ্রিক একটি উৎসবের আমেজ পাওয়া যায়। লেখক-পাঠক মাত্রই এ সময়টাকে ঈদ অথবা পূঁজার উৎসবে পরিণত করার মানসে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখে। আমার মতে মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশ করলেও বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রস্তুতি নিতে পারলে মেলাকেন্দ্রিক জটিলতা পরিহার করা সম্ভব। তবে মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশের আনন্দ অন্যসময়ে পাওয়া মোটেও সম্ভব নয়। তাই মেলাকেন্দ্রিক বই করার আনন্দভাগাভাগি পেতে উন্মুখ হয়ে থাকি।
চিন্তাসূত্র:একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
মোস্তফা হায়দার: চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে আজকের এই একুশে বইমেলার গোড়াপত্তন। একুশে বইমেলার জমকালো আমেজেই সারাদেশব্যাপী এক অনুরণনের জন্ম দেয়। একুশ মানে বাঙালির চেতনাও বলা যায়। ভাষাআন্দোলনের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে একুশের জন্ম। জন্মের স্রোত টান দিয়ে যায় বলে একুশের বইমেলা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বপ্নের শোকেস। যে স্বপ্নের সামিয়ানায় শিল্পের চাষাবাদ বেড়েই চলেছে। একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে নিশ্চিত প্রভাব রাখে বলে আমার বিশ্বাস। সবার কিছু না কিছু দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা থাকে। সেগুলো বাস্তবায়নের একটা মোক্ষম সময়েরও প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে একুশে বইমেলা। যদিও হাজার হাজার বই প্রকাশ হয়েই চলেছে। কালের বিবর্তনে তা দাঁড়াবে শিল্পের আয়না হয়ে। যে আয়নায় চুলচেরা বিশ্লেষণে শিল্পের ব্যবহার ফুটে উঠবে নিশ্চিত। তবে এও ঠিক, বাংলাদেশের সাহিত্য দু ধারায় বিভক্ত হওয়ায় প্রকৃত বিবেচনায় কিছুসাহিত্য অবমূল্যায়নে থেকে যায় আড়াল করা আয়নায়। নিরপেক্ষ এই ধারায় কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ কিছুটা কাজ করায় তখন কিছু মেধাবী সাহিত্যের উন্মোচন ঘটেছে। তারপর থেকে এ যাবৎ সে যাত্রায় নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারাতেও বাংলাসাহিত্যের কিছুটা ক্ষতি মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে। তাই নিরপেক্ষ বিবেচনায় একুশে বইমেলাকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের সাহিত্যে নিশ্চিত প্রভাব ফেলবে বলে আমার বিশ্বাস।
চিন্তাসূত্র:একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
মোস্তফা হায়দার: আমাদের দেশে সাধারণত প্রবীণ ও দাঁড়িয়ে যাওয়া সাহিত্যিকদের একটা অবস্থান হওয়ায় তাদের যেমন চিন্তা করতে হয় না তেমনি প্রকাশকরাও কিছুটা আশ্বস্থতায় তারা সারাবছর বই প্রকাশ করে সময় কাটাতে সাহস পায়। তবে একুশে বইমেলাকেন্দ্রিক তরুণ প্রকাশকরা সাহসের দানা বাঁধতে জোনা পাকায়। ধান কাটার সময় চাষার প্রাণে পানি যেমন আসে তেমনি একুশে বইমেলা কেন্দ্রিক তরুণরাও কিছু নব্য স্বপ্নের স্ফুরণ দেখার সাহস বুকে বাঁধে। জীবনের বিভিন্ন পেশার মতো প্রকাশনা শিল্পেও তরুণরা বেশ সাহসের সহিত এগিয়ে এসেছে। বেশ কয়েকজন চোখের সামনে সফলও হয়েছেন গত একদশকে। তাই একুশে বইমেলা কেন্দ্রিক প্রকাশনা শিল্পে তরুণরা সাহস পাচ্ছে। নতুন নতুন কর্মোদ্যমের সঞ্চার করছে।
চিন্তাসূত্র:প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
মোস্তফা হায়দার: প্রতিবছর বই প্রকাশের সংখ্যাধিক্যকে আমি অনেকক্ষেত্রে পজেটিভ দেখছি। মানুষের ভেতরের চাপাবারুদ গুলো ফোটার সুযোগ কিন্তু বই প্রকাশের মাধ্যমকে বলা যায়। তবে এও সত্য নিম্নমানের বই যে হচ্ছে না তা হলফ করে বলা যাবে না। এটা রোধের কিছুটা নিয়ম থাকা দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের দেশেতো কোনো নিয়মের বালাই চর্চা হচ্ছে না। চর্চা হচ্ছে লবিং,চর্চা হচ্ছ অনৈতিকতা। চর্চা হচ্ছে আদান প্রদানের। ফলে নিয়ম করলেও সঠিক প্রায়োগিকত ক্ষমতার অভাবে প্রকৃত মেধাও চাপা পড়ে হারিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের উভয় সংকট আমাদের তাড়া করছে। নিরপেক্ষ ও সচ্ছতা দাঁড় করানো গেলে নির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতো। তাহলে সাহিত্যের মানও বাড়তো নিশ্চিত।
ইচ্ছে হলে প্রকাশককে স্টলের অনুমতি দেয়। ইচ্ছে না হলে ঠুনকো দোষ ধরিয়ে স্টল দেওয়া থেকে বিরত রাখার মতো উদ্যত আচরণও করে। তা হলে মুক্তস্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। লেখক ও প্রকাশককে অবরুদ্ধ করার সামিলও বলা চলে। প্রকাশনা শিল্পেও গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে না বলে কণ্ঠরোধের আড়ালে অনেক তরুণ লেখক ও প্রকাশকের কবর রচিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মেধাচর্চার পরিবর্তে লেহন, দোহনও বাড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা। নিভে যাচ্ছে আলোর দ্যুতি। তাই নীতিমালা সৃষ্টি যেমন প্রয়োজন তেমনি নীতিমালার স্বচ্ছ ধারকবাহকের খুবই প্রয়োজন। তাহলে ভালো কিছু আশা করা যাবে, নিশ্চিত।