অদ্বৈত মারুত—কবি-ছড়াকার ও ছোটকাগজ সম্পাদক। লেখালেখির বিষয় প্রধানত ছড়া হলেও কবিতা ও ছোটগল্পেও তিনি সমান আগ্রহী। বিশেষত শিশুতোষ গল্পের প্রতি রয়েছে বিশেষ ঝোঁক। এই পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা পাঁচ। গ্রন্থগুলো হলো, ‘নিস্তরঙ্গের বীতস্বরে'(কবিতা), ‘ভাল্লাগে না’ (ছড়া) ‘হাজার তারার আলো’ (ছড়া কবিতা), ‘স্বর ভাঙার গান’ (কবিতা) ও ‘ভূত খেলে কুতকুত’ (শিশুতোষ গল্প) এছাড়া তিনি পাঁপড় একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করেন। পেশাগত জীবনে সংবাদকর্মী। একটি জাতীয় দৈনিকের একাধিক বিভাগীয় পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েব নিয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন এই তরুণ সাহিত্যিক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
অদ্বৈত মারুত: লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে—আমার কাছে তা মনে হয় না। বের হচ্ছে তো। সারা দেশ থেকেই বের হচ্ছে। বরং আগের চেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে। মেকআপ, গেটআপও বদলে গেছে। আকার-আকৃতিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এখন আর সম্পাদকরা ১ ফর্মার কাগজ করতে চায় না। ২ ফর্মা, ৩ ফর্মার কাগজ করতে চায় না। নিজের পকেটের টাকাও তেমনভাবে আর ঢোকাতে হয় না (অবশ্য এর ব্যতিক্রম এখনো আছে। কিছু কাগজ এখনো বের হয় নিজেদের পকেটের টাকায়)। গ্রাফিকস ও অত্যাধুনিক ছাপাখানার কল্যাণে পত্রিকাগুলো বেরোচ্ছে চমৎকার কাগজে ঝকঝকে হয়ে।
তবে লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রটা ইদানীং অনেক সহজ হয়েছে। অতিসহজেই অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগও বানানো যাচ্ছে। সার্বিকভাবে সাহিত্যের জন্য এটা খুবই ইতিবাচক দিক।
চিন্তাসূত্র: লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচ নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
অদ্বৈত মারুত: শুধু অর্থব্যয় নয়, প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রটাও ওয়েবের ক্ষেত্রে ব্যাপক। তবে যেটা হচ্ছে তা হলো, স্থায়িত্ব পাচ্ছে কম। মানে মানুষের মনে দাগ কাটছে কম। ছাপা কাগজের জায়গাটা এখনো দখল করতে পারেনি ওয়েবজিন বা ম্যাগগুলো। ভবিষ্যতেও পারবে না। কারণ দুটো ভিন্ন মাধ্যম। উভয়েরই চাহিদা রয়েছে পাঠকের কাছে।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবেই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অদ্বৈত মারুত: কথা সত্য। হয়তো যিনি সম্পাদক, তিনি প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞানার্জন করলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছেন। ফলে যা হওয়ার, তাই হচ্ছে। এটা তো লিটলম্যাগের ক্ষেত্রেও রয়েছে। কাজ করতে করতে নিশ্চয় একসময় দক্ষ কর্মীতে পরিণত হবেন।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারোশ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শত টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনে পয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
অদ্বৈত মারুত: প্রেম না থাকলে পুরো জীবনটাই তো অসারে পরিণত হবে। সাহিত্যপ্রেম আছে বলেই নিজে কিছু করার চেষ্টা করছে। মূলকথা হলো—নিজের পরিচিতি বাড়ানোর জন্য যতগুলো পথ রয়েছে, সবগুলো পথেই সে হাঁটার চেষ্টা করবে। এটা স্বাভাবিক।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
অদ্বৈত মারুত: মোটেও নয়। সত্যকথা বলতে কী, মোবাইল বলেন আর ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ মনিটর বলেন, এগুলো থেকে যে ধরনের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে, দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকায় তাতে কিন্তু চোখের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা যখন আপনি বুঝতে পারবেন, তখন কিন্তু বইপাঠেই ফিরে আসতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক ব্যাপার হচ্ছে, ‘নতুন কিছু’ আমরা এমন সাদরে গ্রহণ করি যে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করি না। সামনে আরও নতুন কিছু আসার অপেক্ষায় তাকিয়ে থেকে চলমান ব্যাপারটায় নিজেকে চালিয়ে নেই এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। আমি বিশ্বাস করি, ছাপাখানা কোনো দিন হারিয়ে যাবে না। হয়তো প্রযুক্তির উৎকর্ষে তা আরও আধুনিকতর হবে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, না লিটলম্যাগ, না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে/পড়তে পছন্দ করেন?
অদ্বৈত মারুত: একেকটির আবেদন একেক রকম। দৈনিক পত্রিকায় চাইলেই সবার লেখা প্রকাশ হবে—এটা এখনো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ছাপা হলে ভালো লাগে। দৈনিকের সাহিত্য পাতায় লেখা প্রকাশ পেলে অনেকেই একসঙ্গে পাঠ করতে পারেন। প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায় ভালো। কিন্তু লিটলম্যাগ তো ভিন্ন কিছু ধারণ করে, যা দৈনিকের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না বিভিন্ন কারণেই। কাজেই লিটলম্যাগই ভালো লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে। পাঠক কম হলেও যারা পড়েন বা লিটলম্যাগচর্চা করেন, তারা প্রকৃত পাঠক। তাদের কাছ থেকে যে সমালোচনা পাওয়া যায়, তাতে নিজেকে প্রকৃত লেখক হিসেবে তৈরি করতে সহজ হয়।
আর ওয়েব বা জিন—যেটাই বলুন না কেন, ওয়াও, বাহ, দারুণ, চমৎকার, অসাম শব্দগুলোর বাইরে খুব বেশি কিছু পাওয়া যায় না। আবেদনও থাকে একবেলা। নতুন লেখা প্রকাশ করলে পাঠক ওই একবেলা ওটা নিয়ে মুগ্ধ থাকেন। পরে ভুলে যান। তাই লিটলম্যাগই লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো জায়গা আমার কাছে।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিনশ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
অদ্বৈত মারুত: সমস্যা হচ্ছে, আপনার একটা প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই বাকিগুলোর উত্তর দেওয়া হয়ে যায়। ফলে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে হচ্ছে। আমি ইতিবাচক মানুষ। ভালোটাই বলব। তবে, একটি লেখার আবেদন যেন একবেলা স্থায়ী না থাকে। এটা কিভাবে উৎরানো সম্ভব, আমার জানা নেই।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
অদ্বৈত মারুত: যদি কোনো দিন ছাপাখানা বন্ধ হয়, তবেই এটা হতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবী যতদিন আছে, ততদিন ছাপাখানাও থাকবে, কাগজে প্রকাশিত হবে নানা কিছু। যেহেতু ছাপাখানা ধ্বংস হচ্ছে না, হয়তো প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটতে পারে, সে ক্ষেত্রে এমন আশঙ্কা নিতান্তই অবান্তর।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
অদ্বৈত মারুত: চিন্তাসূত্র ভালো কিছু করছে। বছর কয়েক আগে খুব সরব ছিল ‘ক্ষেপচুরিয়ানস’। এটির কাজকর্ম তখন খুব ভালো লেগেছিল। লেখা আপলোড হলেই চারপাশ থেকে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ত রচনাটি নিয়ে। কঠোর সমালোচনা। ভালো হলে কেন ভালো, কোন শব্দ বা লাইন ভালো লেগেছে—সব উঠে আসত। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি, উল্টাপাল্টা কথা না বলে, তোয়াজ, তোষামোদি ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে সমালোচনার ব্যাপারটা সামনে আনা সম্ভব হলে রচনাটির একটা গতি হয়। লেখার কঠোর সমালোচনা দরকার। তাতে প্রকৃত লেখক টিকে থাকবে। যাদের ঝরে যাওয়ার, তারা ঝরে যাবে।