ফারুক সুমন—কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৮৫ সালে, চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তিতে। অধ্যয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পেয়েছেন ‘নিপ্পন ফাউন্ডেশন অব জাপান’ (২০০৬) শিক্ষাবৃত্তি। শিক্ষকতা করছেন ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ’-এ।
প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলো হলো: ‘শামসুর রাহমানের কবিতা: নগর-চেতনা ও নাগরিক অনুষঙ্গ’ (২০১৫), ‘শিল্পের করতালি’ (২০১৯) ও ‘শামসুর রাহমানের কাব্যস্বর’ (২০২১)। কাব্যগ্রন্থ: ‘অচঞ্চল জলের ভিতর নিরাকার বসে’ (২০১৭), ‘আঙুলের ডগায় সূর্যোদয়’ (২০১৮), ‘বিচঞ্চল বৃষ্টিবিহার’ (২০২০)। ভ্রমণগদ্য ‘ভ্রমণে অবাক অবগাহন’ (২০২১)।
লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘রউফিয়ান রিদম সাহিত্য সম্মাননা-২০১৬’, ‘উচ্ছ্বাস প্রহর সাহিত্য সম্মাননা-২০১৯’ ও ‘সমতটের কাগজ লেখক সম্মাননা-২০২০’। এবার পেয়েছেন প্রবন্ধের জন্য ‘দোনাগাজী পদক-২০২১’। নিজের লেখালেখি ও পদকপ্রাপ্তি নিয়ে মুখোমখি হলেন চিন্তাসূত্রের।
চিন্তাসূত্র: এবার প্রবন্ধে ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি দোনাগাজী পদক’ পেলেন। কেমন লাগছে পুরস্কার প্রাপ্তিতে?
ফারুক সুমন: কাজের স্বীকৃতি পেলে কার না ভালো লাগে? আমি আনন্দিত, প্রাণিত বোধ করছি। যদিও পুরস্কার কিংবা পদকপ্রাপ্তির কাছে নতজানু হতে শিল্পপথে আসিনি। সুদূর শৈশব-কৈশোরের কথা মনে পড়ে। যখন শিল্পের অলৌকিক আনন্দের ভারবাহী হয়ে কবিতা লেখা শুরু করেছি। ব্যক্তিগত দুঃখবোধ, অপ্রাপ্তি ও হতাশার অন্তরতম হাহাকার শব্দবন্ধে, বাণীবিন্যাসে উৎকীর্ণ করতে চেয়েছি। তারপর ধীরেধীরে দীর্ঘ ২২/২৩ বছরের নিবিড় শিল্পযাপন ও সাহিত্যযাত্রা। যারা মহৎশিল্পী তারা জানেন, পার্থিব প্রাপ্তি কিংবা অর্থবিত্তের মোহ থেকে নির্মোহ হয়ে কিভাবে শিল্পে সচল থাকতে হয়। ফলে পুরস্কার পাওয়া কিংবা না পাওয়ার ব্যাপারটি মৌলিক শিল্পীর জন্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমন গুরুত্বহীনও।
চিন্তাসূত্র: আপনি তো প্রবন্ধ ছাড়াও কবিতা, কথাসাহিত্যও চর্চা করছেন। কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
ফারুক সুমন: মূলত কবিতা-ই আমার শিল্পধ্যানের শীর্ষাসনে সমাসীন। কবিতার নিবিড় নৈকট্যে বাহিত হয় আমার শিল্পমগ্ন সময়। তবে কিছু অনুভব-উপলব্ধি হয়ত কবিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধরা দেয় না। ফলে সাহিত্যের অন্য আঙ্গিকে প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি। এভাবে প্রবন্ধ, কথাসাহিত্য, কলাম কিংবা ভ্রমণগদ্যসহ নানা শিল্পাঙ্গিকে সচল রয়েছি।
চিন্তাসূত্র: প্রবন্ধ লেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন?
ফারুক সুমন: প্রবন্ধ লেখার প্রতি আগ্রহী হওয়ার বেশকিছু কারণ আছে। কেউ কেউ মনে করেন, যিনি কবি তিনি কেবল কবিতা-ই লিখবেন। যিনি কথাশিল্পী তিনি কেবল গল্প-উপন্যাসে সীমাবদ্ধ থাকবেন। প্রবন্ধ লিখতে গেলে তার মূল আগ্রহের বিষয়ে মনোযোগ থাকবে না বলে প্রবন্ধ লেখাকে নিরুৎসাহিত করেন। আমি এমনটি মনে করি না। শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কেবল প্রবন্ধে সম্ভব। এটা প্রবন্ধ লেখায় উৎসাহী হওয়ার কারণ হতে পারে।
এছাড়া, প্রবন্ধ লেখার প্রতি আগ্রহী হওয়ার নেপথ্যে দেশি-বিদেশি খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের শিল্পযাপন আমাকে প্রাণিত করেছে। আমরা মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা জীবনানন্দের শিল্পবৈভব যদি খেয়াল করি, শিল্পের বহুমাত্রিক উত্তাপ তাদের শিল্পসত্তাকে ছুঁয়ে গেছে। তারা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লিখে সমৃদ্ধ করেছেন।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন প্রাবন্ধিকদের মধ্যে্ কার প্রবন্ধ আপনাকে অনুপ্রাণিত করে?
ফারুক সুমন: সমকালীন যেকোনো বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন। সময় উত্তীর্ণ হওয়ার আগে মূল্যায়নে অযথার্থতার ইঙ্গিত থাকে। বর্তমানে কেউ কেউ প্রবন্ধ কিংবা সমালোচনাসাহিত্য নিয়ে নিরাশার বাণী শোনালেও আমি হতাশ নই। কারণ এই সময়ে সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও চিন্তাশীল প্রবন্ধচর্চায় যুক্ত আছেন কেউ কেউ। যাদের প্রবন্ধ পড়ে বুদ্ধির দীপ্তি উদ্ভাসিত হয় বৈকি। কমবেশি যাদের লেখা পড়েছি তাদের মধ্যে হামীম কামরুল হক, মোহাম্মদ নূরুল হক, মোহাম্মদ আজম, সুমন সাজ্জাদ, শিবলী মোকতাদির, বীরেন মুখার্জী, আল মাকসুদ, কাজী মহম্মদ আশরাফ, মামুন রশীদ, কুমার দীপ, সৌম্য সালেক, মোজাফফর হোসেন, রাকিবুল রকি, জোবায়ের মিলন, বঙ্গ রাখাল, শাহমুব জুয়েল, রঞ্জনা বিশ্বাস উল্লেখযোগ্য। এই তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে। মনের অজান্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ পড়ার আশঙ্কা আছে। আবার এই ক্ষেত্রে আমার পাঠের সীমাবদ্ধতাও থাকতে পারে।
চিন্তাসূত্র: এই সময়ের কবিতার আলোচনা করতে গেলে কোন কোন কবিকে আপনি এগিয়ে রাখবেন?
ফারুক সুমন: বাংলা কবিতা ও কবিসংখ্যা সবসময় আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করে। কথায় বলে, ‘এদেশ কবিতার দেশ’। বাংলার জলহাওয়া কবিতার ভাবালুতা তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করে। ফলে অসংখ্য কবির কবিতা আমাদের পাঠপরিধির বাইরে থেকে যাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। অগণিত কবির জমায়েত থেকে মুষ্টিমেয় কিছু নাম এই মুহূর্তে উল্লেখ করে অহেতুক বিরাগভাজন হতে চাই না। সময়ের জানালায় মৌলিক কবিমুখ উদ্ভাসিত হবে এই প্রত্যাশায় থাকি।
চিন্তাসূত্র: পুরস্কার নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। আপনি পুরস্কারকে কোন চোখে দেখেন?
ফারুক সুমন: সভ্য-সমাজে পুরস্কার প্রদানের রেওয়াজ শোভনীয় একটা দৃষ্টান্ত। কিন্তু হায়, ইতোমধ্যে এখানে পুরস্কার প্রদান নিয়ে এমন সব নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে যে, পুরস্কার রীতিমতো তিরস্কারের পর্যায়ে পতনোন্মুখ হয়েছে। ফলে অস্বীকার করবো না, অন্য অনেকের মতো আমিও প্রথম পুরস্কারকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি।
চিন্তাসূত্র: এই সময়ের কথাসাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কোন কোন লেখককে আপনি গুরুত্ব দেবেন?
ফারুক সুমন: এই সময়ের কথাসাহিত্য বিষয়-বৈচিত্র্য ও নিরীক্ষার নিরিখে বেশ এগিয়ে। বিশেষ করে গল্প লেখায় গল্পকারদের নিরীক্ষামূলক মনোভাব আভাসিত হয়েছে। গল্পের আঙ্গিক পরিচর্যা ও অভিনবত্বের বিবেচনায় এই সময়ের গল্পকে ধ্রুপদী আখ্যানের দীপ্তি ছড়াতে দেখি। গল্প-উপন্যাস লিখে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন এমন কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, আনিফ রুবেদ, নাহিদা আশরাফী, সাঈদ আজাদ, ইশরাত তানিয়া, আশান উজ জামান, সাদাত হোসাইন, রফিকুজ্জামান রণি, ইলিয়াস বাবর, নাহিদা নাহিদ, শিল্পী নাজনীন, মোজাফফর হোসেন, রুমা মোদক, হামিম কামাল, জয়দীপ দে শাপলু, মেহেদী উল্লাহ, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, আশিক বিন রহিম, রিপন আহসান ঋতু, সাইফ বরকতুল্লাহসহ আরও অনেকে।
চিন্তাসূত্র: বাংলা একাডেমি পুরস্কার, করপোরেট পুরস্কারের পাশাপাশি দেশের সাহিত্যয়সংগঠনগুলো থেকে দেওয়ার পুরস্কারের মধ্যে আপনি স্পষ্ট কোনো পার্থক্যর দেখেন? কোন পুরস্কারকে আপনার নিরপেক্ষ ও বেশি গ্রহণযোগ্যু মনে হয়?
ফারুক সুমন: কোনো পুরস্কার-ই শেষপর্যন্ত শতভাগ নিরপেক্ষ থাকে কি না, এই ব্যাপারে আমি সন্দিহান। তবে নিরপেক্ষতার ব্যাপারটি যখন অতিমাত্রায় ক্ষুণ্ন হয় এবং তলানিতে গিয়ে ঠেকে, তখন সেই পুরস্কার নিয়ে সমালোচনা হয়। রাষ্ট্রের আনুকূল্যে যে সব পুরস্কার থাকে, সেগুলো বিতর্কিত হয় মূলত রাজনীতির কারণে। দলীয় বিবেচনায় কখনো-বা এই পুরস্কার আপাত অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ওঠে। ফলে পুরস্কারের প্রকৃত মান বজায় থাকে না। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের দেওয়া পুরস্কারগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। পুরস্কারের অর্থমূল্য তুলনামূলক বেশি থাকে। সেকারণে এখানেও দেখা যায় সাহিত্যের রাজনীতি। এসব কিছুর বিবেচনায় সাহিত্যসংগঠনগুলো এখনো মন্দের ভালো হিসেবে সচল রয়েছে। যারা দীর্ঘদিন শিল্পে সমর্পিত থেকে সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত আছেন। সাহিত্যসংগঠনগুলো এমন কবি-সাহিত্যিকদের খুঁজে বের করে পুরস্কার দেয়। পুরস্কারের অর্থমূল্য যা-ই থাকুক, একনিষ্ঠতার বিবেচনায় এটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
আরও পড়ুন
কবি পরিচয়েই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি ॥ মামুন রশীদ
পুরস্কার এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে ॥ আজিজ কাজল