রফিকুর রশীদ একাধারে কথাসাহিত্যিক, গবেষক, ছড়াকার ও গীতিকার। ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৭ সালে মেহেরপুরে জন্ম নেওয়া এই সাহিত্যিকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর, নিষিদ্ধ সুবাস, চার দেয়ালের ঘর, রৌদ্র ছায়ার নকশা, অশনিপাতের দিন, ইচ্ছে পুতুল, চার গোয়েন্দার কাণ্ড, হলুদ দোয়েল ও অন্যান্য গল্প। সম্প্রতি চিন্তাসূত্রে পক্ষ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনি কবে থেকে লেখালিখি শুরু করেছিলেন?
রফিকুর রশীদ: আমার লেখালেখিতে আসা একেবারে কৈশোর পার হয়ে তারুণ্য চলছে অথবা যৌবনের প্রথম দিকে বলতে গেলে। বলতে পারো, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। তখন আমি নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্র। এই সময়টাতে পড়তে ভালো লাগতো। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকতো, বই পড়ার একটা অফুরন্ত সময় ছিল। আমার মা বই পড়তে ভালোবাসতেন। খুব অল্পশিক্ষিত মা, কিন্তু তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন। আমি আমার গ্রামের লাইব্রেরি থেকে, স্কুলের লাইব্রেরি থেকে মায়ের জন্য বই এনে দিতাম। সেই বই আনা-নেওয়ার ফাঁকেফাঁকে আমিও পড়ে ফেলতাম। এভাবেই শরৎচন্দ্র, বিভূতি, মানিকের সঙ্গে আমার পরিচয়। সে অর্থে বলতে গেলে আমার স্কুলের কোনো শিক্ষক, আমার কলেজের কোনো শিক্ষকদের কাছ থেকে নয়, মায়ের জন্য বই আনতে আনতেই বই পড়ার প্রতি আমার ভালোবাসা। আর লেখার প্রতি? সেটা আরও একটু পরে ঘটেছে। আমি যখন এসএসসি পাস করেছি। আমি মেহেরপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়েছি ‘৭৫ সাল পর্যন্ত। তখন আমরা একটা পত্রিকা ছাপি ‘অরুণিমা’ নামে। ছাপা তো নয়, ওটা ছিল একটা দেয়াল পত্রিকা। সেই ‘অরুণিমা’ নামে পত্রিকাতে কবিতা ছাপতে দিয়ে সে কী আনন্দ! আমি সম্পাদক ছিলাম না, সম্পাদক ছিলেন অন্য আরেকজন।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনার প্রথম প্রকাশিত লেখা কি কবিতা?
রফিকুর রশীদ: হ্যাঁ, আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা কবিতা।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: কবিতাটির নাম কী ছিল?
রফিকুর রশীদ: তা আজ আর মনে নেই। আমি এখনো যে কবিতা লিখি না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেটা প্রকাশের জন্য নয়, আনন্দের জন্য, নিজের ভেতরেই রাখি। তারপর যেটা বলছিলাম, মেহেরপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে যখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, সেটা ‘৭৫-এর শেষের দিকে। সেই সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গল্পকার হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে পরিচয় হয়, কবি আবু বক্কর সিদ্দিকী; যিনি কথাসাহিত্যিকও বটে, তাকে আমি ক্লাসঘরের টিচার হিসেবে পাই। কবি জুলফিকার মতিনকে আমি সামনে দেখতে পাই আমার টিচার হিসাবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মনে হলো এ এক অদ্ভুত জগত, এখানে আলো আছে অনেক, প্রাণ আছে অনেক। এখানে বন্ধুরা একরকম। এ রকম বন্ধুত্ব আগে তো দেখিনি! এমন শিক্ষার পরিবেশ তো আমি আগে পাইনি কখনো। যদিও আমার মেঠো কলেজের স্যার আনসারুল্লাহ হক, আমার কবিতা পড়তেন আর উৎসাহিত করতেন সেসব দিনের কথাও মনে পড়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আমার একটু প্রবণতাটা বেকে যায় গল্পের দিকে, কথাসাহিত্যের দিকে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনার লেখা প্রথম গল্পের নাম কী ছিল?
রফিকুর রশীদ: আমি প্রথম গল্প লেখা শুরু করি একটি কিশোর গল্প দিয়ে। ‘দুঃস্বপ্ন’ নামের একটি গল্প।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: এটি কত সালে ছাপা হয় ও কোন পত্রিকাতে?
রফিকুর রশীদ: এটি ছাপা হয় ‘৭৭ সালের দিকে। এটি ছাপা হয় ‘দৈনিক বার্তা’ নামে রাজশাহী থেকে একটা কাগজ বের হতো, এর ছোটদের পাতায় এটি ছাপা হয়।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনার প্রথম বই কত সালে প্রকাশিত হয়েছিল, সেটি কি গল্পের বই ছিল নাকি কবিতার?
রফিকুর রশীদ: আমার প্রথম বই বের হয়েছিল… সেটা গল্পের বই, বইটির নাম ‘হলুদ দোয়েল’, সেটা ‘৮৯ সালে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: তাহলে আপনি প্রথম গল্প লিখেছিলেন ১৯৭৭ সালে আর প্রথম বই তথা গল্পের বই প্রকাশ করেছেন ১৯৮৯ সালে। এর মাঝে যে ১২ বছর বা একযুগ তুল্য সময়, এই সময়টাতে আপনি কী করেছেন?
রফিকুর রশীদ: লিখেছি আর পড়েছি। পড়েছি আর লিখেছি।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: ওই সময়টাতে কোথায় কোথায় লিখতেন? পত্রিকায়?
রফিকুর রশীদ: এই সময়টাতে মূলত নিজের মতো করে লিখেছি। তা প্রকাশের আকুলতা ছিল। এ পত্রিকায় ও পত্রিকায় পাঠাতাম না, তা নয়। ছাপা হয়নি দুঃখ পেয়েছি। আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। আবার পরের মাসে আরেকটা লেখা পাঠিয়েছি। আমি বলছি ‘৭৮, ‘৭৯, ‘৮০ সালের কথা, তখন যে সব দৈনিক পত্রিকা বাজারে ছিল, তার মধ্যে যেগুলোতে আমার লেখা বেশি ছাপা হতো, দৈনিক সংবাদের কথা আমি বলব সবার আগে, আজাদ নামে একটা পত্রিকা বের হতো সেখানে ছাপা হয়েছে, দৈনিক বাংলায় লেখা ছাপা হয়েছে। এভাবেই তখন থেকে একটা দুটো করে গল্প ছাপা হয়েছে। এগুলোতে তখন আমি গল্প লিখছি। দৈনিকের সাময়িকীর পাতায় লিখছি। লিটলম্যাগ, এখান-ওখান থেকে বেরোয় খবর পেলে তাদের কাছেও লেখা দেই। তা লেখা পাঠানো, লেখা ছাপানো এগুলোর থেকে আমার অধিক মনোযোগ ছিল, লিখতে প্রস্তুতি গ্রহণ করা। লেখার জন্য পড়া।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: এই লেখার জন্য পড়াটা কী ধরনের ছিল?
রফিকুর রশীদ: আমি অন্যের গল্প যখন পড়ছি, এর ভেতর নতুন কী আছে, সেটা খুঁজে বার করার চেষ্টা। এখনো করি কিন্তু সেটা। এমনকি কোনো তরুণ লেখকের লেখা যখন সামনে পাই পড়ে ফেলি মনোযোগসহ। ধরা যাক, একটি পত্রিকাতে আমার গল্পের পাশে আরেকটি তরুণ গল্পকারের গল্প ছাপা হয়েছে, আমি চিনি ছেলেটিকে বা চিনি না, তো সেই তরুণ গল্পকারের গল্পটি আমি পড়ি এবং খুঁজি সে নতুন কী দিতে চাইল। ওর বলার ভঙ্গিটা কী নতুন, উপস্থাপনার ভঙ্গিটা কী নতুন বা বিষয়বস্তুটা কী একটু ভিন্নভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরল? এভাবেই আমি নতুন কিছু খুঁজি। কিন্তু নিজের জন্য নতুন পথ রচনা করা, তার জন্যে যে শক্তি প্রয়োজন, যে সাহসের প্রয়োজন, যে প্রস্তুতির প্রয়োজন সে আমার এখনো হয়ে উঠেছে বলে তা মনে করি না। আমি এখনো আমার নিজের পথ নিজে রচনা করার জন্যেই চেষ্টা করে চলেছি। বই বেরিয়েছে, তারপরেও অনেক বই বেরিয়েছে। তবু এখনো আমি খুঁজে চলি।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: তাহলে আপনার প্রথম বই প্রকাশের জন্য প্রস্তুতি নিতেই আপনার এক যুগ সময় পেরিয়ে গেছে, তাই নয় কী?
রফিকুর রশীদ: তা তো বটেই। তখন আমি শিক্ষকতা করতাম। আমাদের তো দুর্ভাগ্য আমরা ঢাকা চিনি না। প্রকাশকেরা বাস করে সব ঢাকাতে। ফলে প্রকাশকদের সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করতে হয়, তাও ভালো জানি না। আমারই কতিপয় বন্ধু উদ্যোগী হলেন। তারা বললেন, না, আমরা কুষ্টিয়া থেকেই বের করব। কুষ্টিয়ার একটি লেটার প্রেসে আমার প্রথম বইটি ছাপা হয়। কিন্তু বইটির প্রচ্ছদ ছাপার জন্যে আমি এবং আমার আরেক বন্ধু ঢাকায় গিয়েছিলাম। ঢাকায় অশোক কর্মকার তখন খুব ভালো ছবি আঁকত।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: অশোক কর্মকার! নাম করা প্রচ্ছদকার সে সময়কার?
রফিকুর রশীদ: হ্যাঁ। অশোক কর্মকারকে গিয়ে আমরা ধরলাম, দাদা প্রচ্ছদটা করে দিতে হবে। তিনি তো এত অল্প সময়ে করে দিতে হবে শুনে অবাক হলেন। আমরা তখন বললাম, আমরা কি ঢাকায় বসে থাকব ওটার জন্য, আমরা তো চলে যাব, ঢাকায় বসে থাকলে তো খরচ হয়। উনি বললেন, ফোর কালারে করতে হবে। আমি বললাম, ফোর কালারে করতে হলে তো অনেক টাকা লাগবে, অত টাকাই যে আমাদের নেই। তো শেষে দুই রঙা একটা প্রচ্ছদ করে দিলেন উনার অসন্তুষ্টিসহ। তবে আমি বলি, উনি ভালোই করেছিলেন। প্রচ্ছদ ওখানে থেকে করে, প্রচ্ছদটা ঢাকাতেই একটা প্রেসে ছেপে আমরা কুষ্টিয়া ফিরি।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: বইটি কোন প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল?
রফিকুর রশীদ: এটার নাম বৃহী প্রকাশনী। আমার এক বন্ধুর প্রকাশনী। তিনি কুষ্টিয়ার মানুষ। তিনি বললেন, আমরা এই প্রকাশনী থেকে কয়েকটা বই বের করেছি। সেই প্রকাশনীর অস্তিত্ব এখন তো আর নেই-ই, তখনো ছিল কি না, তাও জানি না। কেবল আমার বন্ধু নাসের মাহমুদের মাথার মধ্যে ছিল কি না, তাও বুঝি না। প্রকাশনীর নামটা সে ব্যবহার করতে বলেছিল, আমরা করেছিলাম। আর বই প্রকাশের পর নিজের উদ্যোগে একে ওকে বলে বলে ৫ কপি, ১০ কপি করে বিক্রি করে বেরিয়েছি। আরেকটি কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, কোন সাহসে জানি না, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর কর্ণধার মফিজুল হকের কাছে আমরা গিয়েছিলাম, ওই যখন প্রচ্ছদ ছাপতে ঢাকায় যায় তখনই। গিয়ে বলেছিলাম, এই নামে গল্পের বই আমরা ছাপছি। আমার নাম তিনি জানতেন পত্রিকার লেখালিখি সূত্রে। আমরা বললাম, বইটি আমাদের উদ্যোগেই ছাপছি কিন্তু বইটির পরিবেশক হিসেবে আপনার প্রতিষ্ঠানের নাম ছাপতে চাই। উনি সম্মতি দিয়েছিলেন। তার কাছে আমরা শ’ খানেক বই রেখে এসেছিলাম। তিনি বিক্রি করে টাকাও আমাদের দিয়েছিলেন।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: তখন কি প্রকাশকদের ভিতর স্বচ্ছতার একটা ভাব লক্ষণীয় ছিল?
রফিকুর রশীদ: আমি তো মফিজ ভাইকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করি, তিনি এই দায়িত্বটুকু না নিলেও পারতেন। তিনি নিয়েছিলেন আমার মতো একজন তরুণ লেখকের জন্য, এটা আমার কাছে একটা বড় ব্যাপার। এখন তো লেখকের সম্মানী নিয়েও প্রকাশকদের গড়িমসির অন্ত নেই। আমার মতে, এদেশের একজন প্রকাশক বইটি করার সময় যে কাগজ কেনেন, সেটার জন্য অর্থ ব্যয় করেন, কালি কেনার জন্য অর্থ ব্যয় করেন, ছাপার জন্য অর্থ ব্যয় করেন, বাইন্ডিংয়ের জন্য অর্থ ব্যয় করেন কিন্তু যিনি বইটি লিখলেন তার জন্য তিনি স্বেচ্ছায় সামান্য অর্থও ব্যয় করতে চান না।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: সে সময় একটা বই প্রকাশ করতে প্রেসে কী রকম খরচ হতো? এখন তো একটা বই নিজ খরচে করতে গেলে ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। তখন কী রকম খরচ হয়েছিল?
রফিকুর রশীদ: বইটি করতে অল্পকিছু টাকা আমি খরচ করেছিলাম। প্রেসের দায়-দেনাটা আমি মিটিয়েছিলাম। আমার চৌষট্টি পৃষ্ঠার ছোট্ট বইটি ছাপতে আমার অত খরচ হয়নি। আমাদের ৩-৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। এতেই আমরা প্রচ্ছদ ছেপে ফেলেছি ঢাকা থেকে। সেই টাকা দিয়েই আমরা ৩০০০কপি প্রচ্ছদ ছাপিয়ে ফেলেছিলাম, ১০০০কপি বই করে ফেলেছিলাম। আর বইয়ের গায়ের দাম করেছিলাম ৩৫টাকা।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: প্রচ্ছদকার অশোক কর্মকার কি আপনাদের কাছ থেকে তাঁর চিত্রকর্মের জন্য কোনো টাকা নিয়েছিলেন?
রফিকুর রশীদ: উনি টাকা নিতে চাইছিলেন না। উনি একদমই নিতে চাইছিলেন না কিন্তু আমাদের খুব ইচ্ছা হয়েছিল অশোক কর্মকারকে আমরা ৫০০টাকা দেই। একরকম জোর করেই টাকাটা আমরা দিয়েছিলাম।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনার প্রথম বইটি কি শিশুতোষ গল্পের বই ছিল?
রফিকুর রশীদ: না, ওটি ছিল বড়দের গল্পের বই। ১৯৭৭ সালের আগে আমি কখনো শিশুতোষ লেখালিখি করিনি বললেই চলে। ‘৭৭-এ ওই গল্পটি লেখার আগে অল্প কয়েকটি ছড়া লিখেছি ছোটদের জন্য। সেই দৃষ্টান্ত আছে বা এখানে ওখানে ছাপতেও দিয়েছি।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনি ছোটদের জন্য লিখেছেন, গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, গবেষণাধর্মী লেখালিখিও করেছেন। তবে বলতে গেলে, ছোটদের জন্যই আপনি বেশি লেখালিখি করেছেন।
রফিকুর রশীদ: দিন যত বাড়ছে ছোটদের জন্য মমত্বও তত বাড়ছে এবং ছোটদের জন্য রচনাও তত বাড়ছে। কিন্তু তারপরেও আমি বলি, ছোটদের হোক আর বড়দের হোক, গল্প লেখাতেই আমার বেশি আনন্দ হয়। আমি অবশ্য বড়দের গল্পই বেশি লিখেছি। এ নাগাদ বড়দের জন্য লেখা গল্পের বইও তো পনেরোটার মতো হয়েছে। আমি গল্প পড়তেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, লিখতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আজ পর্যন্ত আপনার কি কোনো কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে?
রফিকুর রশীদ: না, কোনোদিনই হয়নি তা।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনার কি কখনো মনে হয়নি, আপনি কবিতার বই বের করবেন?
রফিকুর রশীদ: শুরুর দিকে ভাবতাম।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: এখন কি আপনার মনে হয় না? আপনার তো সাহিত্যের মোটামুটি সব শাখাতেই বই আছে। কবিতা নীরবে লিখেও যান। তবু এখন অন্ততপক্ষে একটি হলেও কবিতার বই প্রকাশের ইচ্ছে জাগে না?
রফিকুর রশীদ: আরেকটু বয়স হোক। একসময় খুব তারুণ্যের সময় মনে হতো, একটা কাব্যগ্রন্থ বেরুক। তা যখন হয়ইনি, তখন আছে থাক। আরও খানিক পরে যদি হয়, মন চায়।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনার সাহিত্যের বেশিরভাগ জায়গায় দেখা যায়, আমাদের জাতীয় চেতনার বিষয়াবলি। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের মতো বিষয়গুলো। এটা কেন?
রফিকুর রশীদ: মুক্তিযুদ্ধের আমার বয়সটা ঠিক যুদ্ধে যাওয়ার মতো ছিল না। আমাদের পরিবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই চেতনার দিক থেকে শানিত ছিল, এখনো আছে, তারপরও একটা এইটেপড়া বালক যুদ্ধে যাবে, এতটা তীব্রভাবে কেউ ভাবেনি। আবার পরে জেনেছি আমাদের বয়সী কেউ কেউও মুক্তিযুদ্ধে গেছে। আফসোস হয়েছে, আমি কেন যাইনি। এখনো মনে হয়, এ জীবনে আর তো কখনো একাত্তর আসবে না। আর তো আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার এই সম্মান, এই সুযোগ পাব না কোনোদিন। তা নাই পাই, আমি যে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি, এই অক্ষমতা, এই অপারগতাকে আমি মোছার জন্যই আমার গল্পের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, উপন্যাসে বলি, নাটকে বলি, আমার শিশু সাহিত্যে বলি, আমি যে গান রচনা করি সেখানে বলি। আমি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি। আমার টোটাল প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে কোনোদিন কোনো গবেষক যদি আবিষ্কার করেন, মোট এতটি বাক্য রচিত হয়েছে, আমার মনে হয় তার মধ্যে হিসাব করলে পাওয়া যাবে সিকি পরিমাণ বাক্য মুক্তিযুদ্ধের জন্য রচিত হয়েছে। এটা তো কম কথা নয়। আর আমার বাড়ি যেহেতু মুজিবনগর জেলায়। মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার বলে চিহ্নিত মুজিবনগর নিয়ে আমি অহঙ্কার করি। সে কারণে ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমি আমাকে একটি দায়িত্ব দেয়, মেহেরপুর জেলার একদম তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উপাদান সংগ্রহ করার জন্য। দায়িত্বটি আমি পালন করি। করতে গিয়েই আমি টের পেয়ে যাই, মেহেরপুর জেলার প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে লেগে আছে মুক্তিযুদ্ধের কোনো না কোনো স্মৃতি। বিশেষ করে মুজিবনগর এলাকার আমি যার সাথেই কথা বলি, নারী অথবা পুরুষ, বয়োবৃদ্ধ অথবা যুবক, মুজিবনগর নিয়ে সবারই একটা কিছু বলার আছে। এই কথা শুনতে শুনতেই আমার মনে হয় মুজিবনগর নিয়ে তো একটা আলাদা গ্রন্থ হতে পারে। তখনো কিন্তু আমার জানা বোঝার মধ্যে নেই, মুজিবনগর নিয়ে আর কে, কী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাই আমার কাছে মনে হলো, এটি আমার দায়িত্ব, আমি মুজিবনগরের মানুষ। এই মাটি দাবি করে আমার কাছে। ফলে মুজিবনগর সন্নিহিত এলাকার বহু তৃণমূল মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ১৭ এপ্রিল যখন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ওখানে শপথ গ্রহণ করতে আসছে, তার আগে দিন পর্যন্ত ওই আম বাগানের তলাটা যারা সাফ করেছে ঝাড়ু দিয়ে, বাঁশের বাতা দিয়ে বেষ্টনী ঘিরেছে যারা, যারা কলাগাছ আর দেবদারু পাতা দিয়ে গেইট সাজিয়ে লিখেছে ‘ওয়েলকাম’, আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। যারা হাতলভাঙা চেয়ার নিয়ে এসে মঞ্চের সামনে মন্ত্রীদের বসতে দিয়েছেন, আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ভবের পাড়া মিশন হাসপাতালের দু’জন সিস্টার, যারা ওই গেটের ওপর ‘স্বাগতম, জয় বাংলা’ কথাটা তুলো দিয়ে লিখেছিলেন, আমি তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। এই তৃণমূল মানুষদের সঙ্গে কথা বলে আমি ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর’ নামে একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করি। ২০১০ সালে গ্রন্থটি ইত্যাদি প্রকাশ থেকে বেরোয়।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: মুজিবনগর নিয়ে আপনি গবেষণা কবে থেকে শুরু করেন?
রফিকুর রশীদ: এ ধরনের ইতিহাসমুখী কাজ আমি শুরু করি মূলত ১৯৯৬ সাল থেকেই।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: তাহলে কি বলা যায় মুজিবনগর নিয়ে আপনি ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গবেষণা করে তারপর গ্রন্থটি রচনা করেছেন।
রফিকুর রশীদ: হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: সুদীর্ঘ চৌদ্দ বছর?
রফিকুর রশীদ: হ্যাঁ, সুদীর্ঘ চৌদ্দ বছর আমাকে কাজ করা লেগেছে। তবে ‘৯৬ সালে যে কাজ করেছিলাম, সেই কাজটিই আমাকে পথ দেখিয়েছে, আমাকে উৎসাহিত করেছে, আমাকে নেশাগ্রস্ত করেছে। যে কথাটি আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমার মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পারার এই গ্লানি মোচনের জন্যই আমার শিল্প সাহিত্যে, আমার রচনায় আমি মুক্তিযুদ্ধকে এত গুরুত্ব দিয়ে আলোকিত করার চেষ্টা করেছি এবং করবও জীবনের একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনি মফস্বল শহরে বসবাস করেন। আপনি অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর কাজ করেছেন। ছোটদের জন্য লিখেছেন। শত শত গল্প লিখেছেন। উপন্যাস লিখেছেন। আপনার গ্রন্থগুলো ব্যাপকভাবে পঠিত হয়েছে। কিন্তু আপনি এখনো জাতীয় কিংবা বড় ধরনের কোনো সাহিত্য সম্মাননা পাননি। এই বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেন? এটা কী কারণে হয়েছে?
রফিকুর রশীদ: বালাই ষাট। যারা বিচার করার দায়িত্বে আছেন তারা তো দেবতার তুল্য। তাদের ভুল ধরি আমি? আমার আর সেই সাধ্য নেই। আর হ্যাঁ, যোগ্যতার অভাব তো বটেই এক প্রকারের। তবে সেটা আমার রচনার অযোগ্যতা নয়। আমি একশো ভাগ নিশ্চিত অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, আমাদের দেশে বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, যারা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন; সাহিত্যের জন্য যেসব জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এবং যাদের দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকে গুণী মানুষ, সত্যিকারের যোগ্য মানুষই পুরস্কৃত হয়েছেন। আমি তাদের দূর থেকে হলেও সালাম জানাই, স্যালুট করি। আমার রচনার পরিমাণে নয়, গুণে নয়, আমার রচনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নয়, আমার দেশাত্মবোধের দায়ভার থেকে নয়, যদি আমার রচনা সমগ্রের শুধু শিল্পমান বিবেচনা করা হয়, তাহলেও বলব যে, হ্যাঁ, আমাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অবিচার করা হয়েছে নাই বা বললাম। কারণ বিচার প্রার্থী তো আমি হইনি কখনো। এগুলো কিভাবে হতে হয় তাও জানি না। যারা বিচার করেন, তারা কী বাজার থেকে বই কিনে এনে বিচার করেন, নাকি লোকটির বাজার মূল্য দেখে করেন, নাকি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা দেখে করেন, আমি প্রক্রিয়াগুলোই ভালো করে জানি না। মাঝে মাঝে শুনতে পাই বাংলা একাডেমিতে নাকি নাম ওঠে। গত পাঁচ বছর থেকে শুনি। আর সেই নাম কেটে যায় আর বাতিল হয়। হবে হয়তো কোনোদিন। কিন্তু এ কারণে আমার একটি লেখাও কমে যায়নি এবং যাবেও না। আমি আমার কাজটি করে যাব। জীবনানন্দ দাশ তার জীবৎকালে তার গদ্য নিয়ে মূল্যায়িতই হননি। এখন খুঁড়ে খুঁড়ে বার করা হচ্ছে। আমার লেখা জীবনানন্দ দাশের মতো অত উঁচু মানের না হয়, না-ই দাবি করলাম, কিছু তো লিখলাম। এ দুনিয়ায় কিছু তো আবর্জনা সৃষ্টি করে গেলাম। যারা আবর্জনা ঘেঁটে, ছাই ঘেঁটে মানিক খোঁজেন, তাদের মতো কেউ আমার চলে যাওয়ার পরেও কিছু পেয়ে যেতে পারেন এই ছাইয়ের মধ্যে, আবর্জনার মধ্যে। সেটা হোক না আরও পঞ্চাশ বছর পরে। হতে পারে কিন্তু।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনি আপনার রচনার শৈল্পিক মানের কথা বললেন। কিন্তু আপনার কথাসাহিত্যের বা গদ্যের বিশেষ দিক আপনি কোনটি মনে করেন? মানে, আপনি আপনার গদ্যটাকে কিভাবে ফুটিয়ে তোলেন?
রফিকুর রশীদ: দেখো, একটি চমৎকার প্রসঙ্গ তুলেছ। গদ্য শিল্প নিয়ে আমাদের দেশে অনেক গদ্য শিল্পী নানা রকমের ভাঙচুর করেছেন। পদবিন্যাসকে উল্টে-পাল্টে একটু নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছেন। এই যে ভাঙা গড়া, এই যে নিরীক্ষা প্রবণতা আমি ঠিক এ পথে হাঁটিনি। এ পথ আমার তা আমার মনেও হয় না। আমি বাস করি প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে আমি খুব সাধারণ দৃষ্টিতে দেখি। আর যা দেখি তাই আমি উপস্থাপন করি আমার গদ্যে। সেই গদ্য কমলকুমার মজুমদারের গদ্য হবে আমি এমনটি নিজে তৈরি করতে চাইনি, আবার হুমায়ূন আহমেদের মতো গদ্য হবে আমি তেমনও চাইনি। আমি আমার মতো করে একটি গদ্য তৈরি করার চেষ্টা করেছি। যেমন করে আমাদের গায়ের মানুষগুলো কথা বলে, সেটাকে মমতাভরে উপস্থাপনা করার চেষ্টা করেছি। আর এসময়ে গদ্য নিয়ে নিরীক্ষা করতে গিয়ে, অনেকে ক্রমশ গল্প পড়িয়ে নিরীক্ষা করছেন না কি গল্প নিয়ে নিরীক্ষা করছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কারণ, গল্পের গদ্যকে তারা এমন জায়গায় নিয়ে পৌঁছাচ্ছেন, পাঠকেরা তার ভেতর আর কোনো গল্প খুঁজে পাচ্ছে না। তারা গদ্যের ক্যারিকেচারটি দেখাচ্ছেন। আমি ওই ভবি দেখে ভোলাতে চাইনি, ক্যারিকেচারের জাদু দেখিয়ে হাত সাফাই করে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চাইনি, আমি জাদুর আড়ালে জাদু বাস্তবতা যেটা, সেই বাস্তবতাটা দেখাতে চেয়েছি। আর ওরা জাদু বাস্তবতার নামে জাদুটাকেই সামনে নিয়ে এসে চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চেয়েছেন। আমি চোখ ধাঁধানোর কাজ করতে চাইনি, চমকে দেওয়ার মতো কাজ করতে চাইনি, সামনাসামনি যা দেখি, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: ওইসব নিরীক্ষাধর্মী গদ্য কি সাধারণ পাঠকের জন্য বোঝা কঠিন?
রফিকুর রশীদ: অসম্ভব। কঠিন নয় অসম্ভব সাধারণ পাঠকের জন্য। গল্পে তো আর গল্প থাকছে না, গদ্যের আধিক্য গল্পকে গ্রাস করে ফেলছে। তবে বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া পাঠক যারা, যারা খটখটে গদ্য পড়ে অভ্যস্ত, তারা যদি প্রস্তুতি গ্রহণ করে সেই গদ্য থেকে গল্প উদ্ধারের চেষ্টা করে, তাহলে তারা পারলেও পারতে পারেন।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: শিশুসাহিত্যের ওপর আপনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। ছোটদের জন্য, কিশোরদের জন্য আপনি ছড়া লিখেছেন। গল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন। বলতে গেলে শিশু সাহিত্যের সব ধারাতেই আপনি আছেন। বিষয়টা হচ্ছে, দশ বছর আগের শিশুর যে মানসিকতা ছিল, এখনকার সময়ের শিশুদের তো সেই একই মানসিকতা নেই। তাহলে, বর্তমানে যারা বাংলাদেশে শিশুসাহিত্য রচনা করছেন, তারা কি সবাই বর্তমানের শিশুদের মানসিকতার ভিত্তিতে শিশুসাহিত্য রচনা করতে পারছেন বলে আপনি মনে করেন?
রফিকুর রশীদ: না, পারছেন না। গত এক দশকে বর্তমান শিশুদের মনোজগতে যে বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমরা যারা শিশুসাহিত্য রচনা করছি, আমরা অনেকেই কিন্তু এই এক দশকে আমাদেরকে ততটা আপগ্রেড করতে পারিনি। কেউ কেউ, অল্পকিছু হাতে গোনা সাহিত্যিক আছেন, বিজ্ঞান মনস্ক শিশুসাহিত্যিক আছেন যারা নিজেদের আপগ্রেড করার চেষ্টা করেছেন কিংবা আপগ্রেড হয়ে উঠছেন। তবু শিশু বড় বিচিত্র একটা ব্যাপার। শিশুর সব কথা বুঝে উঠা বড় মানুষের সাধ্যেই নেই। এ কোনো কালে ছিলও না। বড় মানুষের পক্ষে শিশু মনস্তত্ত্বের ষোলো আনা বোঝা সম্ভব নয়, বারো আনা পর্যন্ত বোঝা যেতে পারে। আগেও বুঝে ওঠাটা সম্ভব ছিল না, এখনকার দিনে তো আরও অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে এক কম্পিউটার নামক যন্ত্রটি শিশু মনোজগতে এত ডাইমেনশনের পরিবর্তন এনে দিয়েছে তা কল্পনা করা যায় না। আমি এর মন্দ দিক সম্পর্কে বলব না, ভালো দিকই। এত পরিবর্তন এসেছে আমরা যারা গত চল্লিশ বছর ধরে লিখছি তাদের অনেকেই কিন্তু এই পরিবর্তনগুলোর খবরই রাখে না। ওই শিশুটির নতুন মনোজগতের সঙ্গে অনেকেই নিজেকে অ্যাডজাস্টই করতে পারেনি। তাই আমরা এখনো ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে, ‘ওই দেখা যায় তাল গাছ’ শেখাতে চেষ্টা করি। অথবা রবীন্দ্রনাথের পর নজরুলের দুটো পুরনো দিনের কবিতাই শেখানোর চেষ্টা করি। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমি হব সকাল বেলার পাখি, এই সকাল ডেকে আনবার জন্য তাদের যে আকুতি, সেটা কোনোদিনই পূরণ হবে না। আমরা যারা এখন ছোটদের জন্য লেখালিখি করি, তাদের শিশু মনস্তত্ত্বের এই রূপান্তর, এই উল্লম্ফনটাও বুঝতে হবে। পরিবর্তনগুলো ধীরে ধীরে হলে এক কথা, আর লাফ মেরে পরিবর্তন হলে সেটাকে আমি উল্লম্ফন হয়ে যায়। গত দশ বছরে শিশু মনস্তত্ত্বে কিন্তু উল্লম্ফন ঘটেছে। সেজন্য যারা ছোটদের জন্য সাহিত্য রচনা করছেন, তাদের আধুনিক হতেই হবে, আপডেটেড হতেই হবে। শুধু প্রযুক্তির সঙ্গে আপডেট হওয়ার কথাই বলছি না আমি এখানে, শিশু মনস্তত্ত্বের সঙ্গে আপডেট হওয়ার কথাও বলছি।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আমাদের সাহিত্যের সবচেয়ে দুর্বল দিক কোনটি বলে আপনি মনে করেন?
রফিকুর রশীদ: আমাদের সাহিত্যের জন্য সবচেয়ে দুর্বল দিক আমি যেটা মনে করি, সেটা হলো অনুবাদ। আমি নিজেও পারি না, ভালো করে ইংরেজি শিখিনি বলে, নিজে পারি না অন্য ভাষার সাহিত্য পাঠ করে নিজে সমৃদ্ধ হতে। আবার ভালো অনুবাদকের বড়ই অভাব। ভালো অনুবাদক তারা, যারা সাহিত্যকে অন্য ভাষা থেকে ইংরেজি হয়ে বাংলায় নিয়ে আসবেন এবং নিয়ে আসার ভঙ্গিটি হবে খুব মমতা মাখানো। যেন বাঙালি পাঠকের কাছে দূরের সাহিত্য পড়ছি এমনটি মনে না হয়। এই আন্তরিকতা নিয়ে আনুবাদ করার মতো অনুবাদক দেখছি না। আনুবাদও সাহিত্যের একটি শাখা কিন্তু। আজকাল তো অনুবাদ যন্ত্রেও হচ্ছে। যান্ত্রিক অনুবাদ তো আমরা চাইনি। একজন অনুবাদ সাহিত্যিকের কাছে তো আমরা সেটি প্রত্যাশা করি না। আমরা চাই, তিনি আরেকটি নতুন মাত্রার সাহিত্য নিয়ে আসবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুবাদ করেছেন, সেই অনুবাদ কিন্তু নতুন সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তার মৌলিক লেখা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: অনুবাদের বিষয়টা যখন তুললেন তখন কিছু কথা বলতে হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিকরা কিন্তু তাদের লেখালিখির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে অনেক ভালো উপন্যাস লিখছেন, কেউ ভালো গল্প লিখছেন। এই উঁচু মানের বা জনপ্রিয় উপন্যাস-গল্পগুলো ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে কিন্তু উপস্থাপিত হচ্ছে না। যেখানে অন্যান্য দেশের সাহিত্যে ইংরেজিতে অনূদিত হতে দেখা যাচ্ছে। এটার কারণ কী?
রফিকুর রশীদ: আমি তো মনে করি এটা খুবই জরুরি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি এখনো তুলনা করে দেখতেও শিখিনি, যেহেতু আমি পারি না। কিন্তু আমার মনে বলে, আমাদের দেশে যারই লেখা হোক অনেক উন্নত সাহিত্য আছে যা অনূদিত হয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। সেটা করতে পারলে আমার মনে হয়, বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডার পূর্ণ হতো। যেমনটা আমরা দাবি করছি, ল্যাটিন সাহিত্য, স্প্যানিশ সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য আমাদের ভাষায় সঠিকভাবে অনূদিত হলে আমরাও উপকৃত হতাম। এই অনুবাদের জায়গাটা তো সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আমরা কি এই অনুবাদের দিকটাতে পিছিয়ে গেছি? আমাদের বর্তমান সময়ের সাহিত্যিকদের বই ইংরেজিতে অনূদিত হতে দেখি না। আগে তো অনেকের বই অনুবাদ হতো, যেমন- জসীমউদ্দীনের ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
রফিকুর রশীদ: খুউব। দেখো, বাংলাদেশে কী দারিদ্র্য দেখো, অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের কথা বলছি না, রুচির দারিদ্র্যের কথা বলছি। এমন একটি পত্রিকাই তো হতে পারে, যে পত্রিকার কাজই হচ্ছে অনুবাদ করা। তারা দায়িত্ব নেবে পৃথিবীর সেরা সাহিত্যের বাংলা ভার্সন নিয়ে এসে তাদের পত্রিকায় ছাপানো, আবার বাংলা সাহিত্যের উন্নত সাহিত্যগুলোকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছাপানো। কই দেখি না তো। হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। অথচ এটি হওয়া খুবই দরকার। আমার কাছে কেন যেন মনে হয় আমাদের দেশে যারা ইংরেজি পড়ে, এই ইংরেজি পড়া ভদ্রলোকেরা ছোটবেলায় টনটনে গ্রামার শিখেছে, ইংরেজিতে ভালো নম্বর পেয়েছে। অতপর ইংরেজিতে ভর্তি হয়ে পড়েছেও, কিন্তু তাদের ভেতর লিটারেরি কোনো ইলিমেন্টস নেই বললেই চলে। তারা শুধু তথাকথিত ভালো স্টুডেন্টস ছিল, তারা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়েছে, কিন্তু ওরা সাহিত্য বোঝে না। ওরা শেক্সপিয়রের নাটক বোঝে না, কবিতাও বোঝে না, বরং সাহিত্য পড়তে গিয়ে ওরা খুব বিরক্ত হয়। এই যে সাহিত্য না বুঝেই ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করে ফেলছে যারা, তাদের কাছে যদি আমাদের দাবি করতে হয়, তারা পৃথিবীর সেরা সাহিত্য অনুবাদ করে নিয়ে এসে আমাদের দেবেন, সেটা অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। আর বাংলা ভাষায় রচিত উন্নত সাহিত্য থেকে ইংরেজি, সেটা তো তাদের দ্বারা অসম্ভব প্রায়। অথচ তুমি বই মেলা এলে দেখবে, একটা শ্রেণীর পাঠক আছে, হয়তো তাদের সংখ্যা বেশি নয়, কিন্তু তারা অনুবাদ সাহিত্য খোঁজে। আচ্ছা, আজকে অনেক কথা হলো, অন্য আরেকদিন আরও কথা হবে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।
রফিকুর রশীদ: তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।