চিন্তাসূত্রের নভেম্বর সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ছোটগল্প। অর্থাৎ ছোটগল্প বিষয়ক প্রবন্ধ–নিবন্ধ, ছোটগল্প ও তরুণ গল্পকারদের ভাবনা। তরুণগল্পকারদের ভাবনাপর্বে ছোটগল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন কথাশিল্পী রুমা মোদক।
চিন্তাসূত্র: আপনি কেন ছোটগল্প লিখছেন?
আমি ছোটগল্প কেন লিখছি— এটা বলা মুশকিল। তবে কবিতার অলংকার, ভাষা ও আঙ্গিক প্রকাশে অক্ষম হয়ে গদ্যের ভুবনে আসি।
চিন্তাসূত্র: আপনার গল্পের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত?
সৃষ্টিশীলতার কোন ব্যাকরণে বিশ্বাস করি না। তবে ছোটগল্পের নানা ফর্ম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। সমকালীন দেশি-বিদেশি সাহিত্য পড়ি। এডগার এলান পো যেমন বলেন, আধঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে পড়ে শেষ করতে হবে। কিংবা রবীন্দ্রনাথের ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা। কিংবা মার্কেজের মতে, ছোটগল্প তাই- যেখানে একটি উপন্যাসের ভূমিকা শুরু হয়। কাহিনী, চরিত্র, কাঠামো সবদিক থেকে। উপন্যাস কিংবা মহাকাব্যের বিস্তৃতি নয়, স্বল্প কথায় অধিক ভাব প্রকাশ এর অন্যতম প্রধান শর্ত বলে মনে হয়। গল্পকার হবেন নির্মোহ ভাষ্যকার। যা বলবেন, তা যেন পাঠকের কাছে পক্ষপাতিত্বহীন মনে হয়। কিন্তু গল্পকার যা বলতে চান, নন্দনতাত্ত্বিকভাবে তা ঠিক বলে দেবেন।
আসলে নিজে যখন লিখি, তখন কোনো পূর্বশর্ত মাথায় রাখি না। শুধু যে বিষয় নিয়ে লিখতে চাই, বিষয়টি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নিজস্ব ভাবনা ও সর্বোচ্চ উপায়ে প্রকাশের প্রচেষ্টা করি। চেষ্টা করি নিজস্ব গ্রাফট তৈরির, নিজস্ব গল্পভাষা ও কিছু একটা আবিষ্কার অথবা ভিন্ন পয়েন্ট অব ভিউ তুলে ধরতে। এ প্রচেষ্টা সচেতনভাবে করি। কখনো সার্থক হই, কখনো বা হই না। বুঝতে পারি।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে পারে বা চায়?
ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে পারে বা চায়, সেটা লেখক অনুসারে ভিন্নতা থাকে। ধরুন হুমায়ূন আহমেদের গল্পে পাঠক যা প্রত্যাশা করে, শহীদুল জহিরের গল্পে তা করে না। লেখক অনুসারে পাঠকেরও শ্রেণি ভিন্নতা থাকে। হুমায়ূন আহমেদের পাঠক আর শহীদুল জহিরের পাঠক এক নয়। আবার এমন পাঠকও আছেন, যারা উভয়কেই পড়েন। সেক্ষেত্রে পাঠের একটা আনন্দ, নতুন কোন আবিষ্কার, চমকে যাওয়া বা স্তব্ধ হওয়ার মতো কোন সত্য- অনেক কিছুই তারা প্রত্যাশা করেন।
আসলে লেখক তো সমাজেরই মানুষ, তিনি তো স্বসমাজের অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু লেখেন না। একজন সাধারণ মানুষ আর লেখকের পার্থক্যই এখানে যে, একটি ঘটনা একজন সাধারণ মানুষ যেভাবে দেখেন, একজন লেখক সেটা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন। আর সেই ভিন্নতাই তিনি প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করেন। এক্ষেত্রে লেখকের ক্ষমতা অসীম। তিনি ইতিবাচক বা নেতিবাচক দু’ভাবেই পাঠককে প্রভাবিত করতে পারেন।
চিন্তাসূত্র: একজন কবি যখন একজন গল্পকারও; তখন তার গল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে?
কবিতা ও গল্প সাহিত্যের সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি মাধ্যম। দুটির ভাষা-আঙ্গিক সবই ভিন্ন। একটির চাই আড়াল; অন্যটির বর্ণনা। একজন কবি যখন গল্প লেখেন; তখন তাঁর গল্প যদি কাব্যভাষা প্রভাবিত হয়, তা একটা পর্যায় পর্যন্ত মেনে নেওয়া যায়। অতিরিক্ত কাব্যময়তাকে আমি গল্প হিসাবে মেনে নিতে পারি না।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে যৌনতাকে কিভাবে নান্দনিক করা যেতে পারে?
যৌনতা জীবনে আবশ্যক। নারী-পুরুষের সম্পর্কের মৌল রসায়ন যৌনতা। তা আমরা যতই নানা অভিধায় অভিষিক্ত করি না কেন। তবে মানবিক সম্পর্ক আধুনিক সভ্যতার অবদান। ফ্রয়েডীয় যৌন সম্পর্কের তত্ত্ব এখন আর স্বীকার্য নয়।
সাহিত্যে যৌনতা আসবে কিন্তু এর নান্দনিক উপস্থাপনায় বিবেচিত হবে তা পর্নো হয়ে উঠলো- না শিল্প। ‘লেডি চাটার্লিজ লাভার’, ‘রাত ভর বৃষ্টি’, ‘বিবর’ উপন্যাসগুলো যৌনতার দায়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলো। কিন্তু কালের বিচারে এগুলো কিন্তু আজকের পাঠকের কাছে ভিন্নমাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।
চিন্তাসূত্র: কোন শ্রেণীর ছোটগল্প সবচেয়ে বেশি পাঠকসমাদৃত হয় বলে মনে করেন?
এটা বলা কঠিন। তবে সমকালে অধিক সংখ্যক পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য লেখা আর কালোত্তীর্ণ লেখা এক নয়। পাঠক সমাদৃত হওয়াটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এতো সরলীকৃত করা যায় না। গল্প যদি মস্তিষ্কে অভিঘাত করতে না পারলো, পাঠকের সাময়িক আনন্দে বিলীন হয়ে গেলো, তবে তাতেই এর সার্থকতা নয়। কারণ আমরা সে সমাজে বাস করছি, যে সমাজের স্টাব্লিশমেন্ট নানা দিক থেকে মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে। সেখানে লেখকের দায়িত্ব আছে, দায়বদ্ধতাও আছে। কারণ লেখক সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল মানুষ। সমাজের অসঙ্গতি তাকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করে এবং তার মেধা ও সৃষ্টিশীলতার দায়বোধ থেকে সে তার বিপরীতে অবস্থান নেবে- এটাই স্বাভাবিক। এটা যে সবসময় সচেতনভাবে করবে তা নয়। তার সংবেদনশীলতাই তাকে এ অবস্থানে যেতে উদ্বুদ্ধ করবে।
চিন্তাসূত্র: একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কোন কোন শর্ত পূরণ করতে হয়?
এটা আমি আগে বলেছি, ব্যাকরণে বিশ্বাস করি না। আবশ্যক বলে কিছু নেই। লেখক তার নিজের মতো করে তৈরি করে নেবেন। তবে নান্দনিক না হয়ে উঠলে শিল্পশর্ত পূরণ না করলে গল্প আর সংবাদে কোন পার্থক্য থাকবে না।
চিন্তাসূত্র: ছোটগল্প নিয়ে আপনার নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ কেমন ফলাফল দিতে পেরেছে?
প্রতিনিয়ত নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাই। পাঠক তো ভালো ভাবেই নেয়। কেউ কেউ দুর্বোধ্য বলে অভিযোগ করেন বটে। সেক্ষেত্রে আমি একটু পাঠকের মনোযোগ দাবি করি। কারণ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানবিক অবস্থান ও বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রেক্ষিতে সাহিত্য কেবল পাঠের আনন্দে সীমাবদ্ধ থাকবে এটা বিশ্বাস করি না।
চিন্তাসূত্র: আপনার ছোটগল্প নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
পরিকল্পনা দুটো। শুধু লেখার তাগিদে লিখবো। প্রকাশের তাগাদায় লিখবো না। দ্বিতীয়ত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিয়ে কিছু গবেষণাধর্মী ফিকশন লেখার ইচ্ছে আছে।
চিন্তাসূত্র: মানুষের কল্যাণে আপনার ছোটগল্প কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
মানুষ এবং মানুষই শেষ লক্ষ্য। কতোটুকু পারবে জানি না। তবে প্রত্যাশা তো- যা লিখি যতটুকু লিখি, যেন মানুষের কল্যাণেই নিযুক্ত থাকে।