শৈশব ও কৈশোর সম্পর্কে জানতে চাইলে আপনি কিভাবে বলবেন…
জন্ম ১৯৫৫, ১০ মার্চ টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া নামক গ্রামে। পাশঘেঁষে বয়ে পাহাড়ি নদী বংশাই। স্রোতস্বিনী। বর্ষায় জল শোঁ শোঁ করে নদীতে পড়ে। উত্তর থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে নদীর দু’কূল উপচে জল পড়ে। জলে আসে পলি। বনভূমির নিম্নাঞ্চলে বিস্তৃত বিল। বিলে আসে মাছ। তারপর জল চলে যায়। চারপাশে ধান গাছের ফলবান চারা সাম্বা নৃত্যের মতো দোল খায়। পূর্বে প্রাচীন গোবিন্দপুর শহর হয়ে রাস্তা চলে গেছে গুপ্ত বৃন্দাবনের দিকে। উত্তরে মধুপুর গড়ের মহা বেষ্টনী। আদিবাসী পল্লীর খোল-করতালের দ্রিমিকি দ্রিমিকি শব্দ। বংশাইর ওপর আদ্যিকালের এক লোহার সাঁকো আছে। ব্রিটিশদের তৈরি। সরু। ওই রাস্তা ডিস্ট্রিক বোর্ডের। পশ্চিমে রাস্তার বনভূমির চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ঘাটাইল থানার দিকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মূল রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। দক্ষিণে দেওপাড়ার বনভূমির নিবিড়তম স্নিগ্ধতা। তারপরও বংশাইর জলের প্রতি ছিলো যত মুগ্ধতা। জলকেলিরত দুরন্ত বালকের আবেগ। কল্লোলিত জল ভেঙে দাঁড় টেনে নৌকোর মাঝি গায়, ‘কে যাইরে ভাটি গাঙ বাইয়া’। না মাঝির সঙ্গে দেখা হয় না। নতুন এক মাঝি পালতোলা নৌকায় বৈঠার ছলাৎ শব্দ করে নদীর বাঁকে হারিয়ে যায়। পাশের মৌডাল গাছের ডালে ঝাঁক ঝাঁক টিয়ে এসে বসে। ওড়াওড়ি করে। একদিন অনুভব করি আমি এক কবিতা কুমারীর প্রেমে পড়ে গেছি। এ বড় কঠিন পিরিত।
দেখুন, সৌভাগ্য বলুন আর দুর্ভাগ্য বলুন, আমার জন্ম হয়েছিল শতাব্দীপ্রাচীন এক এনশিয়েন্ট পরিবারে। পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত আমাদের ঐতিহ্যময় লাইব্রেরি সুনাম ছিল। যাতে সংরক্ষিত ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন অনেক গ্রন্থের সংস্করণ। আরবি, ফার্সি, ইংরেজি মিলিয়ে এক বিপুল সমারোহ। দীর্ঘকালব্যাপী একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের সংগ্রহে যে গ্রন্থগারটির জন্ম তার বয়স নেয়াহেত কম ছিল না। এই লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন চাচা সনেট রচয়িতা কবি রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী এবং আমার পিতা কবি, গল্পকার সিরাজউদ্দিন চৌধুরী। যে, কেউ পারিবারিক গ্রন্থাগারটি ব্যবহার করতে পারতেন। চাচা ছিলেন কবি নজরুলের ভাবশিষ্য। নজরুল তাকে স্নেহ করতেন। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র। বাবা পড়তেন প্রেসিডেন্সিতে। বাবা ১৯৪২ সালে বিএ পাস করে শিক্ষা বঞ্চিত মানুষদের জ্ঞানের আলো বিতরণ করার জন্য গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকতা শুরু করেন। কলকাতা থাকাকালীন, সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, ভারতী, পরিচয়, রূপায়ণসহ স্বনামধন্য সাময়িকীগুলোতে তাঁর কবিতা, গল্প প্রকাশিত হয়েছে। কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম, শাহাদাৎ হোসেন, ইব্রাহীম খাঁ, আবুল মনসুর আহমেদ, সিরাজ উদ্দিন কাশিপুরী, ড. আশরাফ সিদ্দিকীর ভালোবাসা ধন্য কবি সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী খুব বেশি কবিতা লেখেননি। ১৯৫৭ সালে ঢাকার রশীদিয়া লাইব্রেরি থেকে তার কবিতার বই ‘সাঁঝের বলাকা’ গল্পগ্রন্থ ‘আদরজান’ প্রকাশ পায়্ যা সুধিসমাজে সমাদৃত হয়েছিল। তারপর কেন সে কবিতা লিখেননি কারণ জানা যায়নি। বরঞ্চ ভায়োলিনের সুদক্ষ সুশ্রুত সুর ধ্বনি তাকে টেনেছিল বেশি। আর শিক্ষকতাকে নিয়েছিলেন ব্রত হিসেবে। ১৯৭৮ সালে তিনি গত হয়েছেন।
তো, লাইব্রেরিটি ব্যবহারের সবরকম দখল-দায়িত্ব নবম শ্রেণীতে থাকার সময় আমার মধ্যে চলে আসে। গ্রন্থাগারটির সংগ্রহে খুব বেশি বই ছিল না। প্রায় হাজার খানেকের মতো। তবে বঙ্গ সাহিত্যের দুষ্প্রাপ্য অনেক গ্রন্থ, ওই সমসাময়িককালে প্রকাশিত মাসিক, সাপ্তাহিক ষান্মাসিক, সাহিত্যের কাগজগুলো বাঁধাই ভলিয়ুম অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষিত থাকত। এ গ্রন্থাগারটিতে ইংরেজি সাহিত্যের অনেক ক্লাসিক বইয়ের সঙ্গে (যা আমার বড় চাচার সংগ্রহ) শৈশব-কৈশোরে পরিচিতি লাভ করি। তারাশংকরের চাঁদের পাহাড়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের আদিভৌতিক এবং গোয়েন্দা সিরিজের বইগুলো আমার কৈশোরে পড়া হয়ে যায়। আজ নিজকে খুব ভাগ্যবান মনে করি।
‘৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক আমাদের বাড়িটি দখল হয়ে যায়। এর অবশ্য কারণ ছিল, বাড়িটি ছিল সুরম্য অট্টালিকা, বায়ান্ন কুঠুরী সমৃদ্ধ। চারদিকে ঘন বন। এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। বাড়ির বাসিন্দারা বাড়ি ছেড়ে আরও গহীন বনে আশ্রয় গ্রহণ করে। চারদিক নদী বেষ্টিত হওয়ার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ ছিল। তারপর একদিন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাড়ির দখল নিয়ে নেয় পাকহানাদার বাহিনী। মর্টার, গুলি, সেলের ক্ষত নিয়ে এখনও বাড়িটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাকবাহিনী কর্তৃক বাড়ির মালামাল লুণ্ঠিত হয়। এ যুদ্ধে স্বয়ং কাদের সিদ্দিকী আহত হয়েছিলেন। পাকবাহিনী প্রায় চার মাস এর দখল রেখেছিলো। তারপর আবার মুক্তি বাহিনীর দখলে চলে যায়। এ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মধ্য দিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় আমাদের গর্ব, পারিবারিক গ্রন্থাগার। আজ আর এর কোনো অস্তিত্বই নেই। আমার প্রথম পাঠ, আমার প্রিয় ভালোবাসার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যৌবনে পা রাখি।
আপনার পাঠপ্রস্তুতির কথা বলুন…
একাত্তর সালে এসএসসি পরীক্ষার আগেই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গেল। এক জীবনে এ এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সদ্য আগত সহপাঠী আবুল কালাম আজাদ মাথায় ঢুকিয়েছিল, দেশ-জাতি-অধিকার, দ্রোহ। সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধ। একজন কিশোরের অনুভব-সংগ্রামে স্বাধীনতার মতো মহার্ঘ যখন অর্জিত হলো, তখন মনে হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে আমিতো স্টেন হাতে বাংকারে লাফিয়ে পড়িনি! তারপরও সেই মহান যুদ্ধে খর্বকায় এই কিশোরের দেশপ্রেমের অনুভূতি বিস্ময়কর!আজ মনে পড়ে, নইলে কী আর নয়মাস পর নতুন পতাকা হাতে কিশোর ‘জয়বাংলা‘ বলতে বলতে গঞ্জের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে লিখেছি—
আক্রান্ত মাতৃভূমির জন্য অস্ত্র হাতে বাংকারে লাফিয়ে পড়িনি
সন্ত্রস্ত কিশোর এক বুক ব্যর্থতা নিয়ে
পতাকা হাতে সূর্যোদয় স্পর্শ করেছিল প্রার্থিত ভোরে।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাহাত্তর সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি। অখণ্ড অবসর। সেই অবসরে কিশোরী অর্চনা বসাকের বিরহে লিখে ফেলি গল্প ‘ডালিয়া কেঁদেছিল’। ডাকে পাঠিয়ে দিই ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত হাবীবুর রহমান শেখ সম্পাদিত সাপ্তাহিক বাংলার দর্পন পত্রিকায়। পরের সপ্তাহে ছাপা হয়।
ডাকযোগে পত্রিকাটি পাওয়ার পর বাবা বললেন, ‘আরেকজন যুক্ত হলো।’
অই টুকুই।
হে প্রিয় মানুষ
হে প্রিয় নদী বংশাই
হে প্রিয় তরুরাজি
তোমাকে অস্বীকার করে আমি নাগরিক মানুষ।
না আর কখনো ওইভাবে গ্রামে ফেরা হয়নি। ধাতব নগর আমাকে আটকে দিয়েছিল। আমি কষ্টকর শৈশব-প্রেমিক।
তারপর,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে কর্মজীবন। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। ইনটারমিডিয়েট পড়াকালিন দৈনিক জনপদ-এ প্রুফ রিডিং দিয়ে যে জীবন শুরু, গৃহ শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক,এনজিও কর্মী,প্রকাশনা কর্মকর্তা,গার্মেন্টসের কেনাকাটা কর্মকর্তা, সাহিত্য পল্লীর সমন্বয়কারী, টেক্সটাইলের কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার, সবিশেষ একটি দৈনিকের সহকারী সম্পাদক। তবে বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হয়েও বাইশ বছর টেক্সটাইলের চাকরি করে আমি এনজয় করেছি। দেশ-বিদেশ ঘুরেছি। বয়ন শিল্পের ওপর পাঁচটি ডিপ্লোমা করেছি। যা আমাকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এমনকি আদম হয়ে সিউলে মোট বহন করেছি। আসলে যেকোনো কাজকে প্রাধান্য দিয়েছি।
লেখালেখির শুরু কিভাবে, এখন কী লিখছেন?
যুদ্ধের সময় অন্ত্যমিল রেখে কিছু অপরিপক্ক পদ্য লিখেছিলাম। যা যুদ্ধের টানাপড়েনের মধ্যে মহাকালে হারিয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। নইলে আমি অর্চনা বসাককে কেন মনে রাখব। ‘সলীম উদ্দিনের জীবনবৃত্তান্ত’ লিখতে গিয়ে নিজের মধ্যে গড়ে তুলি অন্য এক ভুবন। তবে কি আমিই সলীম উদ্দিন? ইত্যাকার অনুভবগুলো আরও পরের। কবিতার অবকাঠামো গত পরিবর্তন সত্তর দশকের প্রথমদিকে বোধ করি। আমি মুক্তিযুদ্ধ-প্রজন্ম সন্তান। সবকিছুকে নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। সেই নিরন্তর খোঁড়াখুঁড়ির মধ্যদিয়ে এতগুলো বছর অতীত হয়ে গেল। তারপরও বিরাম নেই। একদিন কোন ঘোরলাগা সন্ধ্যায় বাঁশ বাগানের ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মির আড়ালে কুমারী কবিতাদেবী ঝিলিকমারা রঙের খেলায় প্রেমান্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো, তার ভাষা আবিষ্কার করতে করতে দুঃখী প্রেমিক সেজে অপেক্ষা করছি। কতকাল!
এই যে আমি নামক মানুষটি সমাজ-সংসারে ব্যতিক্রমী জীবন যাপন করে তার জন্য পারিবারিক গ্রন্থগারটি ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে। শিল্প-সাহিত্যের পারিবারিক রুচি তৈরি করে দেয়। কিশোর বয়সে ফজলে লোহানী অনুদিত আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি’র বাংলা রূপান্তর পড়ে নিজেকে কিশোর সাজাতে ইচ্ছে হয়েছিল। যে অসীম নিঃসঙ্গতায় সমুদ্র তীরে বুড়োর জন্য অপেক্ষা করছে। ‘ম্যান মে বি ডেস্ট্রয়েড, নট ডিফিটেড’।
সারারাত একটা মুনিয়ার কান্নায় ঘুমাতে পারি না। কান্নার ভাষা আমি জানি না। অস্থিরতায় রাত কাটে। মনে হয় অনাদিকালের পুঞ্জিভূত কান্না আমার বুক ভরে আছে। অজানা নতুন ভোর হয়। যে ভোরে রূপ-রং আমার পরিচিত ভোর থেকে আলাদা। কে যেন আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে। এই তো সময়, মুক্তির একমাত্র পথ। এইভাবে যে কবিতাটির জন্ম হয়, তা নিয়ে কি পরবর্তী সময়ে আমি সুখী হতে পেরেছি? পারিনি। মৃত্যু অবধি এই না পাওয়ার মৌনদহন আমাকে পীড়িত করবে। অথবা একদিন কৃষকের ঘর্মাক্ত শরীর দেখে নিজকে পরাজিত মনে হয়েছে। অক্ষমতা কষ্ট দিয়েছে। ঘৃণা রাগে অনেকদিনের ঝর্ণাকলম আঁচড়িয়ে ভেঙে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম এই লেখালেখি মানুষকে মুক্তি দিতে পারে না। তারপর পরিচিত পৃথিবীর স্খলন, বেদনা, প্রেম আমাকে প্রলুব্ধ করেছে। তাই মানুষের প্রতিবাদের সামিল করেছি লেখালেখির ঘরবসতি।
আমি যেদিন ছিলাম না, সেদিনও সাহিত্য ছিল, যেদিন থাকব না, সেদিনও সাহিত্য থাকবে এবং যেদিন আছি সেদিনও সাহিত্য আছে। শুধু একজন শিল্পবিদ্ধ শ্রমিক মানুষকে প্রতিনিয়ত নিজেকে বিনির্মাণ করতে হয়। একজন সৃষ্টিশীল লেখকের নিজেকে নবায়ন অনিবার্য। মহাকালের ভেলায় উঠেছি। অমরতা চাই না। দেবী বর দেবেন কি না জানি না। শুধু অনঙ্গ বউ, কবিতা কুমারীর দেখা পেলেই তুষ্ট। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, প্রবন্ধ-নিবন্ধ মিলিয়ে গ্রন্থ সংখ্যা সতেরো।
নতুন প্রজন্মের লেখা পড়েন? তাদের নিয়ে কিছু বলার আছে?
আমি আগেই বলেছি, লেখালেখি সাধারণ কাজ নয়। এজন্য নিজকে নির্মাণ করতে হয়। আপনি যে মাধ্যমে লিখুন না কেন, তার বারান্দায় হাটাহাটি করতে নিজকে পোড়াতে হয়, ধারণ করতে হয় জাগতিক জয়-পরাজয়, গ্লানি, প্রেম-বেদনার মৌনদহন। পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে নিজকে বিনির্মাণ করতে হয়। তাদের মনে রাখতে হবে, বহুরৈখিক মাত্রায় জীবনকে আবিষ্কারের নাম সাহিত্য।
সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ
আপনাকেও।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মিলন সব্যসাচী